পথেঘাটে ‘মেয়ে-পটানো’র কায়দা কানুন: রোমান্টিক না অপরাধ?
বাংলা সংলাপ ডেস্কঃ লন্ডনের বিখ্যাত স্যাভয় হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে বিবিসির একজন রিপোর্টার একদল শিক্ষার্থীর সঙ্গে অপেক্ষা করছিলেন, যারা সবাই ৭০০ মার্কিন ডলার দিয়ে এক কোর্সে ভর্তি হয়েছে, যেখানে সবাই পথেঘাটে মেয়েদের আকর্ষণ করার কায়দা-কানুন শিখতে এসেছে।
এডি হিচেনস এই কোর্সের হেড কোচ, আস্তে আস্তে হেঁটে তিনি মঞ্চের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন, কোর্সের সবাই বুটক্যাম্পে পরস্পরের সঙ্গে পরিচিত হবেন এবার।
“আমি একজন হেটেরোসেক্সুয়াল, মানে মেয়েদের প্রতি আকর্ষণ বোধ করি। আমাকে একজন সেক্স-আসক্ত মানুষ বলতে পারেন। ২০০৫ সাল থেকে আমি এই ‘গেমে’ আছি।”
‘গেম’ হচ্ছে কয়েক কোটি পাউন্ড অর্থের ব্যবসা, যেখানে পুরুষেরা অন্য পুরুষদের শেখান কিভাবে নারীদের আকর্ষণ করতে হবে, যাকে অনেকেই অন্যভাবে বলেন ‘মেয়ে-পটানো’।
‘মেয়ে-পটানো’ নতুন কোন ব্যাপার নয়, কিন্তু এই ডিজিটাল যুগে ‘সিডাকশন কোচ’ অর্থাৎ যারা বিপরীত লিঙ্গের সঙ্গী আকর্ষণ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন, তাদের প্রধান কাজ হচ্ছে কত নারীকে আকর্ষণ করা যায় এবং কত দ্রুত তা করা যায় সেটা শেখানো।
বিশ্ব জুড়ে এই ব্যবসার বাজার বাড়ছে। অনেক অনলাইন কোর্স আছে। ইউটিউবে শত শত ভিডিও পাওয়া যায়, যেগুলোর রয়েছে হাজারো সাবস্ক্রাইবার।
এই বুটক্যাম্পে পুরুষেরা কেবল পুরুষদেরই সঙ্গী আকর্ষণের কায়দা-কানুন শেখাবেন।
মেয়েরা হয়ত জানেনও না যে তারা কীভাবে এ ধরণের ব্যবসার অংশ হয়ে উঠেছেন।
ছদ্মবেশে একটি কোর্সে ভর্তি হয়ে বিবিসির একজন সাংবাদিক গিয়েছিলেন সরেজমিনে দেখতে যে কী শেখানো হয় ঐ ক্লাসে।
এ কোর্সের শিক্ষা হাতেকলমে প্রয়োগ করতে গিয়ে যা করেন একজন পুরুষ, অনেক সময়ই সেটা নারীকে উত্ত্যক্ত করার সামিল।
প্রায়শই নারীর অনুমতি ছাড়াই তার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করা হয়। এই দুইটিই ফৌজদারি অপরাধ।
সেই ক্লাসে নানা দেশের নানা পেশার পুরুষেরা এসেছেন।
যেমন আমস্টারডাম থেকে এসেছেন একজন শেফ বা রাঁধুনী, মার্কিন নৌবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা, ব্রাজিলের একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, ডাবলিনের কম্পিউটার প্রোগামার এবং ম্যানচেস্টার থেকে একজন চিকিৎসক।
রাস্তাঘাটে আকর্ষণ
স্ট্রিট অ্যাট্রাকশন বা রাস্তাঘাটে কীভাবে মেয়েদের আকর্ষণ করা যাবে এমন একটি প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছিলেন আদনান আহমেদ।
তিনি এখন কারাগারে ।
রাস্তাঘাটে মেয়েদের প্রতি হুমকি এবং অশালীন ভাষা ব্যবহার করার দায়ে এখন বিচারের অপেক্ষায় রয়েছেন আহমেদ।
অথচ মাত্র এক বছর আগে আহমেদ মেয়ে-পটানোতে নিজের দক্ষতা নিয়ে বিজ্ঞাপন পর্যন্ত দিয়েছিলেন অনলাইনে।
আহমেদ রাস্তাঘাটে মেয়েদের সঙ্গে কথাবার্তার চেষ্টা করতে করতে গোপনে তাদের ভিডিও করতেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে তার একজন সহপাঠী বিবিসি রিপোর্টারকে জানিয়েছিলেন, আহমেদ এরকম ২৫০টির বেশি ভিডিও আপলোড করেছিলেন।
আহমেদের এসব ভিডিওর মধ্যে মেয়েদের পটানো এবং তাদের সঙ্গে রাত্রিযাপনের ঘটনা দেখানো হয়েছে।
কখনো কখনো অন্তরঙ্গতার অডিও ক্লিপও শেয়ার করতেন আহমেদ।
টার্গেট কারা?
আহমেদের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ছিল এমন দুইজন নারীর সঙ্গে বিবিসি কথা বলেছে।
৩৭ বছর বয়সী আহমেদ যখন বেথকে প্রেমের প্রস্তাব দেন তখন তার বয়স ১৭ বছর।
গ্লাসগোর শপিং স্ট্রিট বলে পরিচিত রাস্তা দিয়ে কাজ শেষে একা হেঁটে বাড়ি ফিরছিলেন বেথ।
নভেম্বরের এক রাতে অন্ধকার রাস্তায় হঠাৎ এসে আহমেদ তার পথ আটকে জিজ্ঞেস করেন “তুমি কি রাশিয়া থেকে এসেছো?”
“সে বলছিল সে যখন ইউক্রেন বা এরকম কোথাও ছিল, সে যৌনকর্মী ভাড়া করতো। সে খুব নোংরাভাবে বলছিল, তুমি তাদের থেকে ভালো।”
নিজের নাম সে বলেছিল এডি, আর বারবার বেথের ফোন নম্বর চাইছিল, আর বেথকে স্পর্শ করার চেষ্টা করছিল।
বেথ বলছিলেন: ”সে জানত বাসের জন্য আমাকে এক ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে, যে কারণে আমি খুবই ভয় পেয়েছিলাম।”
“ব্যাপরটি আমার মোটেও ভালো লাগেনি, পুরো রাত আমি ভয়ে কাটিয়েছি।”
এমিলি নামের আরেক নারীকে যখন আহমেদ অ্যাপ্রোচ করেন, তখন পুরো ঘটনাটি ভিডিও করে আহমেদের একজন বন্ধু।
বিবিসি বলার পরই কেবল এমিলি জানতে পারে যে আহমেদের সঙ্গে তার পুরো কথোপকথনটি অনলাইনে রয়েছে, যে কেউ চাইলেই সেটা দেখতে পারে।
কিন্তু ডিজিটাল জমানায় মেয়ে পটানোর যে ব্যবসা তৈরি হয়েছে, তার নেতিবাচক দিক সম্পর্কে অনেকেই সচেতন নন।
বিবিসির প্রতিবেদন পড়ে এক ডজনের বেশি নারী পুলিশের কাছে পথে ঘাটে অপরিচিত পুরুষের কাছ থেকে আচমকা ‘প্রস্তাব’ পাবার ব্যপারে অভিযোগ করেছেন, যার প্রায় সব কয়টিই অশালীন আচরণের অভিযোগ।
বুটক্যাম্প
কেবল ব্রিটেনেই এখন এমন ডজন ডজন প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যাদের প্রশিক্ষিত পুরুষদের অনেকে নিজেকে ‘পিক-আপ আর্টিস্ট’ বলে পরিচয় দেন, যাদের একজন আহমেদ।
‘পিক-আপ আর্টিস্ট’ দের সবার ইউটিউব চ্যানেল রয়েছে। সেখানে তারা এ সংক্রান্ত নানা রকম কৌশল বর্ণনা করে।
যাদের অ্যাপ্রোচ করা হয়, সেই নারীদের স্পর্শ করা, অনুসরণ করা এবং স্বল্পকালীন সম্পর্ক স্থাপনের জন্য ক্রমাগত অনুরোধ করা হতে থাকে।
কখনো তাদের অনুমতি ছাড়াই বিরক্তিকরভাবে চাপ প্রয়োগ করা হয়।
স্ট্রিট অ্যাট্রাকশন নামে একটি চ্যানেলের এক লাখ ১০ হাজার সাবস্ক্রাইবার রয়েছে।
এর প্রতিষ্ঠাতা এডি প্রত্যেকটি ভিউ থেকে অর্থ উপার্জন করেন।
বিশেষত নিঃসঙ্গ পুরুষেরা এতে আকৃষ্ট হন, সব বয়সের পুরুষেরাই রয়েছেন।
তবে এই কাজটি যে নীতিবিরুদ্ধ, সেটি সম্পর্কে সচেতন অল্প সংখ্যক পুরুষ।
এদিকে, গ্লাসগোতে আহমেদের বিচার প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। তার বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছে, এর একটি অপ্রাপ্তবয়স্ক নারীর সঙ্গে যৌনসম্পর্ক স্থাপনের।
ইতিমধ্যে আহমেদ নয় মাস জেল খেটেছে।
এই ঘটনা প্রথম আলোচনায় আসে যখন রিটা নামের একজন নারী বিবিসিকে জানান, যে তিনি সম্ভবত ‘অ্যাডি’কে চেনেন।
কলেজের একাধিক সহপাঠী, সিনিয়র ক্লাসের ছাত্রী কিংবা শপিং মলে কাজ করা সেলস গার্ল কেউ বাদ পড়েননি আহমেদের আগ্রহের তালিকা থেকে।
একদিন আহমেদ ধরা পড়ে যান, ক্লাস শেষে যে গাড়ি পার্কিং এলাকায় বসে তিনি কাজ করতেন, সেখানে গিয়ে একদিন এক ছাত্রী আবিষ্কার করেন আহমেদের গোপন জগত।
শত শত অর্ধ নগ্ন নারীর ছবি, অন্তরঙ্গতার ভিডিও এবং অডিও দেখে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন ওই ছাত্রী।
রিটা বলছিলেন, আমি মুখ খোলার পর অনেকেই এগিয়ে আসেন।
“আমি সবাইকে সচেতন করতে চাই যে আমাদের চারপাশেই এ রকম পুরুষ আছে। মেয়েদের আরো সাবধান হতে হবে।”
বিবিসির ডকুমেন্টারি প্রচার হবার পর স্ট্রিট অ্যাট্রাকশন এক বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে, প্রতিষ্ঠানটি কখনোই পুরুষদের অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপনে উৎসাহ দেয় না। – সৈজন্যে বিবিসি বাংলা