আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের বিচার শুরু
গণহত্যায় রক্তস্রোত বয়ে গেছে
বাংলা সংলাপ ডেস্কঃ মিয়ানমারের রাখাইনে রক্তস্রোত বয়ে গেছে। তারই মর্মস্পর্শী বর্ণনা দিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবীরা। এমন বর্ণনা তুলে ধরে রাখাইনে গণহত্যা বন্ধে জরুরি পদক্ষেপ নিতে আদালতের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন গাম্বিয়ার অ্যাটর্নি ও আইনমন্ত্রী আবুবাকার তামবাদু। আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে)-এর শুনানিতে দাঁড়িয়ে সর্বপ্রথম তিনি এ অনুরোধ জানান। মিয়ানমারকে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো ওই আইনজ্ঞ বলেন, আধুনিক যুগে গণহত্যা পুরোপুরি অগ্রহণযোগ্য। তিনি আদালতের কাছে এ সংক্রান্ত কড়া নির্দেশনাও চান। তিনি এ নিয়ে অন্তর্বর্তী আদেশ কামনা করেন। বলেন, আমাদের মনে রাখতে হবে রোহিঙ্গারাও মানুষ।
তাদের বেঁচে থাকার অধিকার আছে। খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের নিশ্চয়তা তাদের দিতে হবে। রোহিঙ্গা শিশুরও অধিকার রয়েছে শিক্ষা লাভের। চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্নও তাদের কারও কারও থাকতে পারে। মঙ্গলবার নেদারল্যান্ডসের হেগ শহরে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে (আইসিজে) রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় মদতে দেশটির সেনাবাহিনী এবং তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণহত্যার অভিযোগের শুনানিতে বাদীপক্ষের আইনজীবীরা তাদের যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য তুলে ধরেন। মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সুচিসহ বাদী-বিবাদী পক্ষ ছাড়াও দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে জড়ো হওয়া পর্যবেক্ষকরা এ সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন। গাম্বিয়ার অ্যাটর্নির পর বিশ্ববিখ্যাত আইনজ্ঞ প্রফেসর পায়াম আখাবান বক্তব্য রাখেন। মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় কীভাবে রোহিঙ্গাদের জাতিগতভাবে নির্মূলে এ সম্প্রদায়ের নারী ও শিশুদের টার্গেট করা হয়েছিল, কীভাবে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের গণহত্যা ও গণধর্ষণ করে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে, তার মর্মস্পর্শী বিবরণ তুলে ধরেন তিনি। আদালত এবং পর্যবেক্ষকরা অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে তার বক্তব্য শোনেন। আখাবান বলেন, বিশ্ব সম্প্রদায় বিশেষত জাতিসংঘের বিভিন্ন রিপোর্টে কেস টু কেস ঘটনা এবং সাক্ষী রয়েছে। আমি কয়েকটি উদাহরণ হিসেবে আদালতের বিবেচনায় উপস্থাপন করছি। ওই গণহত্যা সুপরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে। একটি জাতিকে নির্মূল করে দেয়ার জন্য। এতে পুরো মিয়ানমার রাষ্ট্রযন্ত্রের সায় ছিল, না হয় তারা এটি ঠেকাতে পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। গণহত্যার ভয়াবহতা তুলে ধরে তিনি আদালতকে বলেন, ৮ মাসের একজন অন্তঃসত্ত্বাকেও রেহাই দেয়া হয়নি। তারা এতটাই বর্বর যে, সবার সামনে তাকে উলঙ্গ করে। তারপর কয়েকজন মিলে ৯ বার ধর্ষণ করে। মায়ের অনাগত সন্তানকে গর্ভেই মেরে ফেলেছে অত্যাচারী সৈন্যরা। শুধু তাই নয়, ওই মাকেও তারা মৃতপ্রায় অবস্থায় আটকে রাখে। আখাবান আদালতের উদ্দেশ্যে বলেন, দেড় মাসের শিশুপুত্রও হত্যা থেকে রেহাই পায়নি। তারা প্রথমে মায়ের কোল থেকে সন্তানকে কেড়ে নেয়। মায়ের সামনেই তাকে হত্যা করে। পরে মাকে উলঙ্গ করে, দফায় দফায় গণধর্ষণ করে, এক পর্যায়ে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। সন্ধ্যায় ওই সন্তানের নানী তার মেয়ে ও নাতির লাশ দেখতে পান। আখাবান বলেন, কী বলবো আদালত? গণহত্যার আলামত স্পষ্ট। সেখানে এতটাই বীভৎসতা হয়েছে যে, ভিকটিম রোহিঙ্গাদের রক্ত আর সীমান্তে থাকা ক্যানেলের (নাফ নদ) পানি একাকার হয়ে গিয়েছিল! ওই ক্যানেলে গণহত্যার শিকার অনেক লাশ ভাসছিল। আখাবান তার দীর্ঘ বর্ণনায় এটা প্রমাণের চেষ্টা করেন যে, রাখাইনে এখনো অনেক রোহিঙ্গা রয়েছে, যারা জীবন-মৃত্যুর ঝুঁকিতে রয়েছে। তাদের কেউ কেউ বন্দিজীবন যাপন করছেন। এ অবস্থায় তাদের যাতে বর্মী সেনা ও রাষ্ট্রযন্ত্র আর কোনো ক্ষতি করতে না পারে এ জন্য এখনই দেশটিকে জবাবদিহির মধ্যে আনতে হবে। এমন একটি অন্তর্বর্তী আদেশ দিতে হবে, যাতে রাখাইনে রোহিঙ্গারা স্বাভাবিক পরিবেশে জীবনযাপন করতে পারে। তাদের জীবনমানটা যেন রক্ষা হয়। উল্লেখ্য, মামলার বাদী গাম্বিয়ার আইনজ্ঞ তামবাদু বলেন, আমি ২০১৮ সালে কক্সবাজারে ওআইসি’র পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করি। সেখানে রোহিঙ্গাদের চোখে ভয়, কষ্ট ও মানবিকতার চরম অবমাননা দেখতে পেয়েছি। জানতে পেরেছি সেখানে কীভাবে বেঁচে থাকাদের স্বজনরা গণহত্যার শিকার হয়েছে। তিনি বলেন, রাখাইনে ব্যাপক গণহত্যা না হলে লাখ লাখ লোক পালিয়ে আসতো না। তিনি বলেন, আমরা এত দূরে থেকেও কেন আইসিজেতে এসেছি? কারণ বিশ্বে যেকোনো স্থানে এমন গণহত্যা হলে দূরে থাকলেও এর বিচারের দায় আমরা এড়াতে পারি না। তিনি আরো বলেন, গাম্বিয়া তাদের আবেদনে আদালতকে এই ঘোষণা করতে বলেছে যে, গণহত্যার কনভেনশনের অধীনে মিয়ানমার তার দায়বদ্ধতা লঙ্ঘন করেছে এবং অব্যাহত রেখেছে; চলমান গণহত্যার কাজ বন্ধ করতে হবে এবং এর দায়বদ্ধতাগুলোকে মানতে সম্পূর্ণ সম্মান করতে হবে। তিনি বলেন, গণহত্যার অপরাধীদের একটি উপযুক্ত ট্রাইব্যুনালের সামনে আনার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে; এবং অবশ্যই গণহত্যার শিকার হওয়া রোহিঙ্গাদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে। জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তনসহ এবং তাদের পুরো নাগরিকত্ব এবং মানবাধিকারের প্রতি সম্মান এবং বৈষম্য, নিপীড়ন এবং অন্যান্য সম্পর্কিত কর্মের বিরুদ্ধে সুরক্ষাসহ গণহত্যা কনভেনশন লঙ্ঘনের পুনরাবৃত্তি না করার নিশ্চয়তা দেয়ার অনুরোধ জানান তিনি।
মিয়ানমারের মিন গাই গ্রামে চালানো নৃশংসতা তুলে ধরেন আইনজীবী অ্যানড্রু লোয়েনস্টেইন। জাতিসংঘের তদন্তে এসব তথ্য উঠে এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে ওই গ্রামে হত্যা করা হয়েছে ৭৫০ জনকে। এর মধ্যে ৬ বছর বয়সের নিচে এমন শিশু রয়েছে শতাধিক। এ প্রসঙ্গ তুলে ধরে লোয়েনস্টেইন একজন সাক্ষীর ভাষায় বলেন, আমি আমার চারজন প্রতিবেশীর সঙ্গে একটি বাড়িতে প্রবেশ করি। এর মধ্যে তিনজনের সঙ্গে বাচ্চা আছে। আমাদের চারদিকে মেঝেতে পড়েছিল মৃতদেহ। এগুলো আমাদের গ্রামের যুবক ছেলেদের। আমরা ওই বাড়িতে প্রবেশ করতেই সেনারা ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়। একজন সেনা আমাকে ধর্ষণ করে। আমার কাঁধে ও পেটে ছুরিকাঘাত করে সে। আমার শিশু সন্তানকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিলাম আমি, যার বয়স ছিল মাত্র ২৮ দিন। কিন্তু তারা আমার কাছ থেকে তাকে কেড়ে নিয়ে মাটিতে ছুড়ে ফেলে। এতে সে মারা যায়।
শুনানির সূচনা যেভাবে: দ্য হেগের স্থানীয় সময় সকাল ১০টায় বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক, রোহিঙ্গা এবং মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে শুনানি শুরু হয়। গাম্বিয়ার প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন সে দেশের আইন ও বিচারমন্ত্রী আবুবকর মারি তামবাদু। মিয়ানমারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন দেশটির স্টেট কাউন্সেলর অং সান সুচি। শুনানির শুরুতে আইসিজের প্রেসিডেন্ট আবদুলকোয়াই আহমেদ ইউসুফ শুনানির প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিচারকক্ষে উপস্থিত সুধীজনদের অবহিত করেন। বাংলাদেশ সময় বেলা তিনটার কিছু পরে আদালতে ১৫ জন বিচারপতির সঙ্গে এডহক দু’জন বিচারপতির নিয়োগের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। ওই দু’জন বিচারপতি গাম্বিয়া ও মিয়ানমারের মনোনীত। শুরুতেই দুই এডহক বিচারপতি গাম্বিয়ার নাভি পিল্লাই এবং মিয়ানমারের প্রফেসর ক্লাউস ক্রেস শপথ নেন। এরপর দ্য হেগের পিস প্যালেসে যুগান্তকারী মামলা (গাম্বিয়া ভার্সেস মিয়ানমার)-এর শুনানি আরম্ভ হয়। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর গণহত্যা চালিয়ে মিয়ানমার গণহত্যা সংক্রান্ত বৈশ্বিক সনদ লঙ্ঘন করেছে কি-না? তার বিচারেই আইসিজে’র ওই শুনানি। শুরুতে গাম্বিয়া যে অন্তর্বর্তী পদক্ষেপের নির্দেশনা চেয়েছে, তা পড়ে শোনান আদালতের রেজিস্ট্রার গোটিয়ার। পরে গাম্বিয়ার আইনমন্ত্রী তামবাদু মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলাটির কেন তিনি বাদী হয়েছেন তার প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন এবং বাদী প্যানেলের আইনজীবীদের আদালতে পরিচয় করিয়ে দেন।
ফেসবুকে ‘ফেক রেপ’ নামে পেইজ খুলে সুচির দপ্তর: শুনানিতে মার্কিন আইনজীবী তাফাদজ পাসিপান্দো আদালতকে বলেন, রোহিঙ্গা নারীদের ধর্ষণের কথা অস্বীকার করতে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সুচি বলেছেন, সেনাবাহিনী এবং বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর কেউ নোংরা বাঙালি মেয়েকে ছোঁবে না। ওরা আকর্ষণীয় নয়। এই আইনজীবী বলেন, ফেসবুকে ‘ফেক রেপ’ নামে যে পেজ খোলা হয়েছে, সেটির নিয়ন্ত্রণও হচ্ছে স্টেট কাউন্সিলরের দপ্তর থেকে। আইনজীবী তাফাদজ পাসিপান্দো আদালতের কাছে আরাকানে এখনো যে ছয় লাখ রোহিঙ্গা আছেন, তাদের দুর্ভোগ ও ঝুঁকির কথা তুলে ধরেন। বলেন, সেখানে রোহিঙ্গাদের কাঁটাতারের বেষ্টনীর মধ্যে শিবিরে আটক রাখা, চলাচলের স্বাধীনতা খর্ব করা ও অন্যান্য বিধিনিষেধের কথা, যা জাতিসংঘ তদন্তে উঠে এসেছে, সেগুলোর বিবরণ দেন। এই আইনজীবী বলেন, রোহিঙ্গাদের চাষাবাদের জমি কেড়ে নেয়া হয়েছে, খাদ্য সরবরাহ কমানো হয়েছে, তাদের পালিত পশু কেড়ে নেয়া হয়েছে বলে জাতিসংঘ তদন্তে যে তথ্য উঠে এসেছে, তার উদ্দেশ্য হচ্ছে তাদের অভুক্ত রাখা। এগুলো গণহত্যার উদ্দেশ্য হিসেবে সনদের লঙ্ঘন। আরো গণহত্যার অপরাধ যাতে না ঘটে, সে জন্য ব্যবস্থা নিতে পারেন এই আদালত। তিনি বিভিন্ন প্রমাণ তুলে ধরে বলেন, এগুলোয় গণহত্যার উদ্দেশ্যের প্রতিফলন ঘটেছে। এরপর তিনি তার বক্তব্য শেষ করেন। তার আগে বাদীপক্ষের আইনজীবী অধ্যাপক পায়াম আখাবান তার বক্তব্যে বলেন, মঙ্গলবার গণহত্যা সনদের ৭০তম বার্ষিকী। কিন্তু এই সনদের আলোকে গণহত্যা বন্ধ হয়নি। আখাবান গণহত্যা সনদের লঙ্ঘন কীভাবে ঘটেছে, তা তুলে ধরেন। জাতিসংঘ তদন্তকারীরা রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানোয় রাষ্ট্রীয় ভূমিকার কথা বলেন। তিনি তদন্তে পাইকারি হারে হত্যাযজ্ঞ পরিচালনার প্রমাণ মিলেছে বলে জানান, যা সনদের লঙ্ঘন। গণহত্যা সনদ ও আইসিসি’র রায়ে যে ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতাকে গণহত্যার মতো অপরাধ গণ্য করা হয়েছে, জাতিসংঘ তদন্তে সে ধরনের অপরাধের বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। মার্কিন বংশোদ্ভূত অপর আইনজীবী অ্যান্ড্রু লোয়েনস্টেইন যুক্তি তুলে ধরে বলেন, মিয়ানমারের জনমিতিক গঠন (ডেমোক্রাফিক) পরিবর্তনের চেষ্টা করছে। সেনাপ্রধান রোহিঙ্গাবিরোধী প্রচারে জড়িত থাকায় তার ফেসবুক ও টুইটার অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিতে হয়েছিল, যা রাষ্ট্রীয় নীতি ও ভূমিকার প্রমাণ। পরে বক্তব্য দেন মার্কিন অপর আইনজীবী আরসালান সুলেমান। তিনি আইসিজের এখতিয়ার বিষয়ে আদালতের বিধিমালার ৪১ (১) উদ্ধৃত করেন।
উল্লেখ্য, হেগের ওই বিচার আদালতের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে থাকা অপর আদালত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) মিয়ানমারের বিরুদ্ধে পূর্বে দায়েরকৃত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এখনো তদন্তাধীন। আইসিজের মামলায় প্রতিবেশী না হওয়া সত্ত্বেও বৈশ্বিক সনদে স্বাক্ষরকারী হিসেবে মিয়ানমার থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরের আরেকটি উপমহাদেশ আফ্রিকার রাষ্ট্র গাম্বিয়া মামলাটি দায়ের করেছে। দ্বিতীয়ত, এই প্রথম মানবাধিকারের লড়াইয়ের জন্য শান্তিতে নোবেলজয়ী একজন রাজনীতিক গণহত্যার সাফাই দিতে হাজির হলেন পিস প্যালেস বা শান্তি প্রাসাদে। সুচির বিরুদ্ধে সর্বজনীন এখতিয়ার নীতির আলোকে নেদারল্যান্ডসে মামলা হয়েছে বলে শোনা গেলেও তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এই নীতির আলোকে মামলায় ডাচ্ কর্তৃপক্ষ গত সেপ্টেম্বরে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে একজন সিরীয় বিদ্রোহীকে গ্রেপ্তার করেছে। তবে সরকারপ্রধান হিসেবে সুচি দায়মুক্তির অধিকারী হওয়ায় তার গ্রেপ্তারের আশঙ্কা নেই। তবে আর্জেন্টিনায় তার বিরুদ্ধে একই ধরনের মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি আছে। গাম্বিয়ার পক্ষে মামলাটি পরিচালনা করছেন দেশটির অ্যাটর্নি জেনারেল ও আইনমন্ত্রী আবুবকর মারি তামবাদু। রুয়ান্ডার গণহত্যা মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা পরিচালনার অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ তামবাদুর সঙ্গে আন্তর্জাতিক আইনে বিশেষজ্ঞ যুক্তরাজ্যের অধ্যাপক ফিলিপ স্যান্ডসসহ বিশ্বজুড়ে খ্যাতি থাকা বেশ কয়েকজন আইনজ্ঞ শুনানিতে অংশ নিচ্ছেন। আদালতে গাম্বিয়া গতকাল তার বক্তব্য উপস্থাপন করেছে। আজ বুধবার মিয়ানমার তার অবস্থান তুলে ধরবে। এরপর বৃহস্পতিবার সকালে গাম্বিয়া এবং বিকালে মিয়ানমার প্রতিপক্ষের যুক্তি খণ্ডন ও চূড়ান্ত বক্তব্য পেশ করবে। মামলার রায় পেতে স্বল্পতম আট সপ্তাহ থেকে কয়েক বছর পর্যন্ত লাগতে পারে।
মিয়ানমার বিশেষজ্ঞ ও বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের সাবেক বার্তা সম্পাদক ল্যারি জাগান গতকাল ব্যাংকক পোস্ট-এ এক নিবন্ধে লিখেন, আইসিজের শুনানিতে মিয়ানমারের আইনি দলের প্রধান হিসেবে যুক্ত হয়েছেন গণহত্যা ও আন্তর্জাতিক আইনে বিশেষজ্ঞ কানাডার মানবাধিকারবিষয়ক আইনজীবী অধ্যাপক উইলিয়াম সাবাস। মিয়ানমারের অ্যাটর্নি জেনারেল তুন তুন ও, দুই জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তা এবং আন্তর্জাতিক দুই আইনজীবী যুক্ত আছেন মিয়ানমারের প্রতিনিধিদলে। বাদী গাম্বিয়া আর বিবাদী মিয়ানমার ছাড়াও শুনানি পর্যবেক্ষণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার প্রতিনিধিরা এখন হেগে। এসব দেশের মধ্যে আছে বাংলাদেশ ও কানাডা। মামলায় গাম্বিয়াকে সমর্থন দিতে ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) কূটনীতিকেরাও উপস্থিত হয়েছেন। আরো জড়ো হয়েছেন বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা রোহিঙ্গা অধিকারকর্মী এবং মিয়ানমার সরকারের সমর্থকরা। গত ১১ই নভেম্বর পেশ করা আবেদনে গাম্বিয়া বলেছে, কথিত শুদ্ধি অভিযানের সময় গণহত্যামূলক কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে, যেগুলোর উদ্দেশ্য ছিল জাতিগতভাবে নির্মূল করা। এ জন্য রাখাইনে বাছবিচারহীন হত্যা, ধর্ষণ ও অন্যান্য যৌন সহিংসতা, কখনো কখনো বাড়িতে লোকজনকে আটকে রেখে জ্বালিয়ে দেয়ার মাধ্যমে গ্রামগুলোর পদ্ধতিগত ধ্বংস সাধন করা হয়েছে। গাম্বিয়া গণহত্যাবিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদের ৩ নম্বর ধারার আলোকে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে সনদ লঙ্ঘনের অভিযোগ করেছে। গাম্বিয়া ও মিয়ানমার উভয় দেশই ১৯৪৮ সালে গৃহীত এই সনদে স্বাক্ষরকারী এবং ওই ধারায় সনদ লঙ্ঘনবিষয়ক বিরোধ আইসিজেতে নিষ্পত্তির বিধান রয়েছে। গাম্বিয়া সনদ লঙ্ঘনের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিষয়টি নিরসনে গত ১১ই অক্টোবর মিয়ানমারকে কূটনৈতিক পত্র দেয়।
আইসিজের নবনিযুক্ত রেজিস্ট্রার ফিলিপ গোটিয়ার সমপ্রতি ইউএন রেডিওকে বলেন, আন্তর্জাতিক বিচার আদালত শান্তিপূর্ণ উপায়ে বিরোধ নিষ্পত্তি করে। এই আদালতে রাষ্ট্র ছাড়া কেউ অভিযোগ করতে পারে না। বিরোধে লিপ্ত উভয় পক্ষের সম্মতি ছাড়া আদালত কোনো বিরোধ নিষ্পত্তির চেষ্টা করেন না। মামলার শুনানিতে মিয়ানমারের অংশগ্রহণকে তাই আইন বিশেষজ্ঞরা আদালতের প্রতি দেশটির আস্থার বহিঃপ্রকাশ বিবেচনা করে ইতিবাচকভাবে দেখছেন। রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা ও তাদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন কিছু জরুরি পদক্ষেপ চায় গাম্বিয়া। এগুলোর মধ্যে রয়েছে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যাসহ সব ধরনের নিপীড়ন বন্ধ রাখা এবং গণহত্যার সব ধরনের আলামত নষ্ট না করা। রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে বিচারে গাম্বিয়াকে সব ধরনের সহযোগিতা আর সমর্থন দেবে কানাডা ও নেদারল্যান্ডস। আইসিজেতে বিচারের শুনানি শুরুর আগে দুই দেশ এক যৌথ বিবৃতিতে এ ঘোষণা দিয়েছে।
১৫ সদস্যের আদালত: এই আদালতের বর্তমান প্রেসিডেন্ট হলেন সোমালিয়ার বিচারপতি আবদুলকোয়াই আহমেদ ইউসুফ এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট চীনের বিচারপতি ঝু হানকিন। বিচারকদের নির্বাচন করেন জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ও সাধারণ পরিষদ। অন্য সদস্যরা হলেন স্লোভাকিয়ার বিচারপতি পিটার টমকা, ফ্রান্সের বিচারপতি রনি আব্রাহাম, মরক্কোর মোহাম্মদ বেনুনা, ব্রাজিলের অ্যান্টোনিও অগাস্টো কানকাডো ত্রিনাদে, যুক্তরাষ্ট্রের জোয়ান ই ডনোহু, ইতালির গর্জিও গাজা, উগান্ডার জুলিয়া সেবুটিন্দে, ভারতের দলভির ভাণ্ডারী, জ্যামাইকার প্যাট্রিক লিপটন রবিনসন, অস্ট্রেলিয়ার রিচার্ড ক্রফোর্ড, রাশিয়ার কিরিল গিভরগিয়ান, লেবাননের নওয়াফ সালাম এবং জাপানের ইউজি ইওয়াসাওয়া।