ফিরে দেখা বাংলাদেশ : যেভাবে হয়েছিল ৩০শে ডিসেম্বরের নির্বাচন
বাংলা সংলাপ ডেস্কঃ বাংলাদেশের বর্তমান জাতীয় সংসদ গঠনের জন্য আয়োজিত গত বছরের ৩০শে ডিসেম্বরের বিতর্কিত নির্বাচনের এক বছর পুরো হয়েছে।
গত ১১ বছরে প্রথমবারের মতো এই নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দল অংশ নিয়েছিল, ফলে সে বিবেচনায় ২০১৮ সালের এই জাতীয় নির্বাচনের একটা ভিন্ন দিক ছিল।
তবে দলীয় সরকারের অধীনে নিয়ন্ত্রিত এবং একচেটিয়াভাবে নির্বাচন করার অভিযোগ ওঠে। এই নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন এবং অভিযোগের পাল্লা অনেক ভারী হয়।
অনেক প্রশ্ন এবং অভিযোগের মুখেও টানা তৃতীয় বার সরকার গঠন করেছে আওয়ামী লীগ। তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি মাত্র সাতটি আসন পেয়ে শেষ পর্যন্ত সংসদে গেছে।
৩০শে ডিসেম্বেরের নির্বাচনই এখনও রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনায় অগ্রাধিকার পায়। কারণ এই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
কিন্তু কেন এত বিতর্ক? কী ঘটেছিল সেই ভোটের দিন? – এসব প্রশ্নও রয়েছে রাজনীতিতে।
ভোটের আগের রাতেই অনেক অভিযোগ
ভোটের দিন সারাদেশে সব ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল নির্বাচন কমিশন। কিন্তু অনেক নির্বাচনী এলাকা থেকে বিএনপি এবং তাদের জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের বেশ কিছু প্রার্থী ভোটের আগের রাতেই ভোটকেন্দ্র নিয়ে সংবাদমাধ্যমের কাছে নানা অভিযোগ তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন।
তাদের অভিযোগ ছিল, রাতেই বিভিন্ন কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং তাদের জোটের প্রার্থীর সমর্থকেরা ব্যালট পেপারে সিল মেরেছে।
প্রায় সারারাতই বিরোধী প্রার্থীরা বিভিন্ন মিডিয়ায় টেলিফোন করে এমন অভিযোগ করছিলেন।
তবে আগের রাতে সিল মারার অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে আওয়ামী লীগ।
নির্বাচন কমিশনও এমন অভিযোগ মানতে রাজি হয়নি।
সকালটা কেমন ছিল
ভোট শুরুর আগের মুহুর্তে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের একটি কেন্দ্রে বিবিসি বাংলার সাংবাদিকের ক্যামেরায় ধরা পড়ে ব্যালট ভর্তি বাক্স।
চট্টগ্রাম-১০ আসনের শহীদ নগর সিটি কর্পোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের একটি কেন্দ্রে এই ঘটনা ঘটে।
ভোট গ্রহণের প্রস্তুতির শেষ পর্যায়ে সকাল ৭টা ৫৪ মিনিটে ঐ কেন্দ্রে বিবিসি’র সাংবাদিক দেখতে পান, বিভিন্ন বুথে ব্যালট বাক্স নেয়া হচ্ছে। ভোট শুরুর নির্ধারিত সময় ছিল সকাল ৮টা। কিন্তু ওই কেন্দ্রে বিবিসির সাংবাদিক যেসব ব্যালট বাক্স দেখেছেন, সেগুলো ছিল ব্যালট পেপার দিয়ে ভরানো।
বিবিসি’র সাংবাদিক কেন্দ্রটির প্রিজাইডিং অফিসারের কক্ষে গিয়েও ব্যালট ভর্তি বাক্স দেখতে পান। তিনি তার মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় ব্যালট ভর্তি বাক্স কেন্দ্রের বুথে নেয়ার দৃশ্য ধারণ করেছিলেন।
চট্টগ্রামের সেই ভোটকেন্দ্রের বাইরে কিন্তু ততক্ষণে অনেক ভোটার জড়ো হয়েছিলেন। ভোটের আগেই বিবিসি’র ক্যামেরায় ধরা পড়া ব্যালট ভর্তি বাক্সের ভিডিও সকালেই প্রকাশ করা হয়েছিল।
পরে অবশ্য ঐ কেন্দ্রটির ভোট স্থগিত করা হয়েছিল বলে জানানো হয়।
সকালেই ঢাকা এবং আশেপাশের এলাকায় বিবিসি’র সাংবাদিকরা অনেক অনিয়ম, কারচুপির ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছিলেন।
ভোট কেন্দ্রগুলো নিয়ন্ত্রিত ছিল
ঢাকার কেন্দ্রগুলোতে বাইরে ভোটারদের উপস্থিতি ছিল সকাল থেকেই। অনেক কেন্দ্রের বাইরের পরিবেশ দেখে ভিতরের অবস্থা বোঝার উপায় ছিল না।
ভোট শুরুর ঘন্টাখানেক পর থেকেই অনেক কেন্দ্রের ভিতরে আওয়ামী লীগ বা তাদের জোটের প্রার্থীর সমর্থকদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে দেখা যায়।
ঢাকার বিভিন্ন আসনে অনেক কেন্দ্রে বিএনপিসহ বিরোধী জোটের প্রার্থীদের এজেন্ট ছিল না। কেন্দ্রগুলোর বাইরে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো।
অনেক কেন্দ্রে বিবিসি’র সাংবাদিকরা দেখেছিলেন, পুলিশ সদস্যরা কেন্দ্রের মুল দরজা বন্ধ করে কাউকে ভিতরে প্রবেশ করতে দিচ্ছেন না। আর কেন্দ্রের ভিতরে সরকার সমর্থক প্রার্থীর পক্ষে ব্যালট পেপারে সিল মারা হচ্ছে – এমন অভিযোগ ছিল দিনভর।
দিন যত গড়াচ্ছিল, রাজধানীর কেন্দ্রগুলোর বাইরে শুধু ক্ষমতাসীনদের প্রার্থীর সমর্থকদের উপস্থিতি ছিল লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। অনেক কেন্দ্রে সাধারণ ভোটারেরাও দীর্ঘ অপেক্ষা করে ভোট দিতে না পারায় অনেকে তাদের ক্ষোভ তুলে ধরেন কেন্দ্রে থাকা সাংবাদিকদের কাছে।
সংবাদমাধ্যমের খবর হয়, কয়েক ঘন্টা ভোট হওয়ার পরই কেন্দ্রগুলোর পরিবেশ নিয়ে যখন নানান খবর বা অভিযোগ প্রকাশ হচ্ছিল, তখনই ঢাকার কেন্দ্রগুলোতে ভোটার উপস্থিতি আরও কমে গিয়েছিল।
ভোটকেন্দ্রের পরিবেশ নিয়ে যে সব খবর পাওয়া গিয়েছিল, সেই খবরের ভিত্তিতে এটি একটি নিয়ন্ত্রিত এবং একচেটিয়া নির্বাচন ছিল বলা যায়।
দেশের অন্য এলাকাগুলো থেকেও ভোট নিয়ে একই রকম অভিযোগ আসে।
ভোটের পুরোটা সময় ঢাকাসহ সারাদেশের বিভিন্ন ভোট কেন্দ্র নিয়ে শুধুই অনিয়ম কারচুপির নানা অভিযোগ পাওয়া যায়।
ভোটের দিন সহিংসতাও ঘটে। চট্টগ্রামের পটিয়াসহ দেশের কয়েকটি জায়গায় নির্বাচনী সহিংসতা বা সংঘর্ষে কমপক্ষে ১৫ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়।
ভোটের শুরুতে নেতাদের বক্তব্য
শুরুতেই ঢাকা সিটি কলেজ কেন্দ্রে ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “এই নির্বাচনে যেই ক্ষমতায় আসুক, বাংলাদেশের উন্নয়ন অব্যাহত থাকবে।”
সকালে বিএনপি এবং গণফোরামসহ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ড. কামাল হোসেন সিদ্ধেশ্বরী এলাকায় কেন্দ্রে ভোট দিয়ে বলেন, বিভিন্ন জায়গা থেকে তিনি ভোট জালিয়াতির খবর পাচ্ছেন। তিনি আশা করেন, নির্বাচন কমিশন এগুলোর দিকে নজর রাখবে।
বিরোধী প্রার্থীদের নির্বাচন বয়কট
ভোট শুরুর পর ঘণ্টা দুয়েক যেতে না যেতেই অনেক এলাকা থেকে বিএনপিসহ ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীরা নানা অভিযোগ তুলে নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা দেয়া শুরু করেন।
দুপুর দু’টার মধ্যেই ১০০টির বেশি আসনে বিএনপি প্রার্থীরা একের পর এক নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন। সারাদেশ থেকে শুধু তাদের নির্বাচন বয়কটের খবরই পাওয়া যাচ্ছিল।
তবে বিএনপি দলগতভাবে এবং তাদের নতুন জোট ঐক্যফ্রন্ট জোটগতভাবে নির্বাচন বয়কট শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে ছিল। তবে বেশিরভাগ আসনে শেষ পর্যন্ত ভোটের মাঠে তাদের প্রার্থীরা ছিলেন না।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তখন বলেছিলেন যে বয়কটের বিষয়টি ছিল প্রার্থীদের নিজেদের সিদ্ধান্ত।
বিএনপির পুরোনো ২০ দলীয় জোটের শরিক জামায়াতে ইসলামী ২২টি আসনে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে প্রার্থী দিয়েছিল। তবে ভোটের দিন দুপুর দেড়টার দিকে জামায়াত সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে প্রার্থিতা প্রত্যাহার কররার ঘোষণা দেয়।
ভোটের ফলাফলও ছিল চমকে দেয়ার মতো
নির্বাচনের ফলাফলও ছিল সম্পূর্ণ এক পাক্ষিক।
আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জোটসঙ্গীরা ২৮৮টি আসন পায়। আর বিএনপি এবং ঐক্যফ্রন্ট পায় মাত্র সাতটি। বাকি তিনটি আসন পায় অন্যান্যরা।
অনেক ভোট কেন্দ্রে একশো’ ভাগ ভোট পড়ে বলে ফলাফলে দেখা যায়। ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর বাইরে অন্য কেউ ভোট পাননি অনেক কেন্দ্রে।
নির্বাচনের ছয় মাস পরে নির্বাচন কমিশন কেন্দ্র-ভিত্তিক যে ফলাফল প্রকাশ করে, তা পর্যালোচনা করে সুজন নামের একটি সংগঠন যে প্রতিবেদন প্রকাশ করে, তাতে দেখা যায় যে ৭৫টি আসনের ৫৮৬টি কেন্দ্রে যত বৈধ ভোট পড়েছে, তার সবগুলোই নৌকা মার্কার প্রার্থীরা পেয়েছেন।
জাতীয় সংসদের মোট আসনের একটি বাদে ২৯৯টি আসনে নির্বাচন হয়।
নির্বাচন এবং ফলাফল প্রত্যাখান
ভোট শেষে কিছু ফলাফল আসার পর দেখা যায় যে ক্ষমতাসীনরা বিপুল ভোটে এগিয়ে যাচ্ছেন। এই ধারার প্রেক্ষাপটে ৩০শে ডিসেম্বরই সন্ধ্যায় সংবাদ সম্মেলন করে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচন এবং ফলাফল প্রত্যাখান করে।
ঐক্যফ্রন্টের নেতা ড. কামাল হোসেন নজিরবিহীন অনিয়ম এবং কারচুপির অভিযোগ তোলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, “দেশের সব জায়গা থেকে ভোট ডাকাতির খবর এসেছে। প্রহসনের এই নির্বাচন বাতিল করা হোক।”
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও নির্বাচন বাতিল করে পুননির্বাচনের দাবি তুলে ধরেন।
মি. আলমগীর বলেন, “অনেকে বলে থাকেন, ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করে আমরা ভুল করেছিলাম। কিন্তু এবারের নির্বাচনের মাধ্যমে প্রমাণ হলো যে, ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্তই সঠিক ছিল। আমরা পুরো নির্বাচন প্রত্যাখান করেছি।”
তবে আওয়ামী লীগ পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করে, “একটি অভূতপুর্ব নির্বাচন হয়েছে। একটি অবাধ এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়েছে।”
প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম বলেন, “বিএনপি নিশ্চিত পরাজয় জেনেই ভোটের মাঝপথে নিজেদের প্রত্যাহার করেছে এবং বিভিন্ন অভিযোগ তুলছে। এগুলো তারা আগেই ঠিক করে রেখেছিলো।”
নির্বাচন কমিশনের বক্তব্য
ঐক্যফ্রন্টের বিভিন্ন অভিযোগ এবং পুনঃনির্বাচনের দাবি নাকচ করে দেয় নির্বাচন কমিশন।
ভোটের পরদিন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা সংবাদ সম্মেলন করে তাদের বক্তব্য তুলে ধরেছিলেন।
তিনি বলেছিলেন, মোট ভোটারের ৮০ শতাংশ তাদের ভোট দিয়েছেন।
প্রশ্নবিদ্ধ এই নির্বাচন কি উদাহরণ হয়ে থাকবে?
কয়েকটি জায়গায় সহিংসতায় কমপক্ষে ১৫ জনের নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে।
তবে নির্বাচন কমিশনের মতে, কয়েকটি জায়গায় সহিংসতা হলেও তারা সার্বিকভাবে সুষ্ঠু পরিবেশে নির্বাচন শেষ করতে পেরেছেন।
নির্বাচন হয়ে গেছে – এমন একটা স্বস্তি দেখা গেছে আওয়ামী লীগের মধ্যেও।
এই নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয়বার সরকার গঠন করে।
বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “৩০শে ডিসেম্বরের নির্বাচন নিয়ে যত অভিযোগ বা প্রশ্ন এসেছে, তাতে এটি গণতন্ত্রের নির্বাচনী ব্যবস্থাকেই ধ্বংস করে দেয়ার প্রতীক হয়েছে। এই নির্বাচন বিভিন্ন সময় একটি নেতিবাচক উদাহরণ হিসেবে আসবে।”
আওয়ামী লীগ নেতারা অবশ্য তা মানতে রাজি নন।
দলটির নেতারা বলেন, বিএনপি যখন যে নির্বাচনেই পরাজিত হয়েছে, সেই নির্বাচন নিয়েই প্রশ্ন তুলেছে। ফলে ৩০শে ডিসেম্বরের নির্বাচন নিয়ে বিএনপির অভিযোগের ব্যাপারে তারা চিন্তিত নন।