প্রধানমন্ত্রীর অসুস্থতায় সংকটে দেশ
বাংলা সংলাপ ডেস্কঃ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের করোনা আক্রান্তের খবর পুরোনো। নতুন খবর হচ্ছে শারীরিক অবস্থার অবনতির কারণে তাকে ভর্তি করা হয়েছে হাসপাতালে। বর্তমানে তিনি লন্ডনের সেন্ট থমাস হাসপাতালের ইন্টেনসিভ কেয়ারে। তার অসুস্থতাজনিত অনুপস্থিতিতে সরকার পরিচালনায় নেতৃত্ব দেবেন পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডমিনিক রব। বরিস জনসন সুস্থ হওয়ার আগ পর্যস্ত দেশের বর্তমান বৃহত্তম জনস্বাস্থ্য সংকটকালে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেন। ২৩ মার্চ বৃটেনকে তিন সপ্তাহের জন্য লকডাউনের ঘোষণা দেয়ার তিনদিনের মাথায় নিজে করোনা আক্রান্ত হওয়ার কথা প্রকাশ করেন বরিস জনসন। প্রথমে তিনি আইসোলেশনে ছিলেন। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সরকার পরিচালনায় প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিচ্ছিলেন তিনি।
রোববার শারীরিক পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হলে ডমিনিককে দায়িত্ব পালনের সিদ্ধান্ত দেন প্রধানমন্ত্রী। বরিস জনসনের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ডমিনিকেরসনামই অবশ্যই আলোচনা হচ্ছিল সকল মহলে। ইতিমধ্যে ডমিনিকের দুইদফা করোনা পরীক্ষায় নেগেটিভ ফলাফল আসে। ডাউনিং স্ট্রিটের একজন মুখপাত্র রোববার সন্ধ্যায় বলেছেন, বরিস জনসন আইসিইউতে ভর্তি হওয়ার সময় সচেতন ছিলেন। সাবধানতা হিসেবেই তাকে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়েছে। স্বাস্থ্য সচিব ম্যাট হ্যানকক বলেছেন, যুক্তরাজ্যের নেতা ‘আমাদের দুর্দান্ত এনএইচএসের কাছ থেকে সেরাতম যতœ’ পাবে। সোমবার সকালে বিবিসি রেডিও ফোর এর প্রোগ্রামে ডাচি অব লাংকাস্টারের চ্যাঞ্চেলর বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীকে কিছুটা অক্সিজেন সাপোর্ট দেয়া হয়েছিল। এখন অতিরিক্ত শ্বাসপ্রশ্বাসের প্রয়োজন হচ্ছে না।
বরিস জনসনের হাসপাতালে ভর্তি এবং ডমিনিক রাবকে আপতকালীন দায়িত্ব দেয়ার পর থেকে নানা আলোচনা শুরু হয়েছে গণমাধ্যমে। বরিসের অসুস্থতা দীর্ঘায়িত হলে কি হবে? ডমিনিক কতদিন ধরে নেতৃত্ব দেবেন? সেক্ষেত্রে কি রানী নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেবেন? কনজারভেটিভ দল কি নতুন নেতৃত্ব নির্ধারণ করবে? এইসব দূরবর্তী প্রশ্নের পাশাপাশি কিছু প্রশ্ন এখন মুখোমুখি। সরকার কখন ঘোষিত লকডাউনটি মুক্ত করবে? এটি স্বল্পমেয়াদে আরও কঠোর করা হবে? সরকার কি করোনা পরীক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি ও ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহ করতে পারবে। লকডাউনের কারণে নিন্ম আয়ের লোকজনের অর্থনৈতিক পরিণতিতে কি করা দরকার? বরিস জনসন তার সরকারকে সাধারণ নির্বাচনের বিজয়ী করতে যে দক্ষ নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রাব তার কতটুকু ভার বহন করতে পারবেন? দলের সাবেক কনজারভেটিভ নেতা ও প্রধানমন্ত্রীর বন্ধু ইয়ান ডানকান স্মিথ গণমাধ্যমকে বলেছেন, রাবের উপর পূর্ণ আস্থা রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর। তিনি প্রধানমন্ত্রীর অত্যন্ত ঘনিষ্ট এবং তার কর্মপরিকল্পনা, পদ্ধতি ও দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো ধারণা রাখেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত নয়। ডমিনিক এই ভূমিকা পালনে সক্ষমের চেয়েও বেশি দক্ষ এবং সরকারে রয়েছে তাঁর দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বরিস জনসন যদি দ্রুত সুস্থ না হন বা দায়িত্ব পালনে অক্ষম হন সেক্ষেত্রে রানীকে নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করতে হবে। এটার কোন বিকল্প নেই। কারণ ডমিনিক রাব স্বল্পমেয়াদে মন্ত্রীসভার নেতৃত্ব দিতে পারবেন। তবে তিনি পরবর্তী ডি জুরি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বিষয়ে কোন নিশ্চয়তা নেই। ফলে রানীকে নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করতে হবে। কনজানভেটিভ পার্টিতেও শক্তিশালী সংখ্যাগরিষ্ঠের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচনের প্রয়োজন হতে পারে। তবে করোনাভাইরাসজনিত সৃষ্ট পরিস্থিতির কারণে সেটা কখন হবে সেটা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। আবার একটি জাতীয় সরকার গঠিত হওয়ার সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে। অন্যসব দলের সদস্যরা সংকটকালীন সময়ে একটি সরকারকে সমর্থন করতে পারেন। এছাড়া বর্তমান সংকটকালে কনজারভেটিভ দলের নেতৃত্ব নির্বাচনে নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করতে পারেন প্রধানমন্ত্রী। যদিও সে সম্ভাবনা দূরবর্তী।
বৃটেনের অতীত নজির
বৃটেনের সরকার ব্যবস্থায় ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টারের সাংবিধানিক কোনো তাৎপর্য নেই। আবার তাত্ত্বীকভাবে বৃটিশ রাজতন্ত্রের রয়েছে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের একচ্ছত্র অধিকার। তবে বিগত দুই শতাব্দী ধরে এটার কোন প্রায়োগিক বাস্তবতা নেই। ফলে কিছু আইনজীবী ডেপুটি প্রধানমন্ত্রীর অবস্থানকে সেটা দিয়ে বিবেচনা করেন। তবে বৃটেনের ইতিহাসে বিভিন্ন সময়ে নানাজন উপ-প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা পালন করেছেন। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় স্যার উইনস্টন চার্চিলের সাথে যুদ্ধকালীন সরকারে এ পদের দায়িত্ব পালন করেছেন ক্লেমেট অ্যাটলি। ২০১০ সালে ডেভিড ক্যামেরনের সাথে এই দায়িত্ব পালন করেছেন নিক ক্লেলগ। একইভাবে জন প্রেসকোট ছিলেন টনি ব্লেয়ারের ডেপুটি। জন মেজরের কার্যকালের শেষদিকে এ পদে কাজ করেছেন মাইকেল হেলসটাইন। বৃটেনের ইতিহাসে লৌহ মানবী খ্যাত মার্গারেট থ্যাচারের আমলে একজন ডেপুটি ছিলেন স্বল্প সময়। তবে সাম্প্রতিককালে থেরেসা মে বা গর্ডন ব্রাউনের সময় কোন উপ-প্রধানমন্ত্রী ছিলেন না।
বৃটেনে উপপ্রধানমন্ত্রীর পদটি একটি অবৈতনিক চাকরি। ফলে যিনি এই পদে থাকেন তাকে অন্য একটি পদেও থাকতে হয়। চার্চিলের উপপ্রধানমন্ত্রী ক্লেইগকে রানীর প্রিভি কাউন্সিলের তত্ত্বাবধানে কাউন্সিলের লর্ড প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত করা হয়েছিল। আর প্রেসকোট ও হেলস্টাইন ছিলেন ফার্স্ট সেক্রেটারি অফ স্টেট। এখন প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে- ফার্স্ট সেক্রেটারি অফ স্টেট কি? বৃটেনের সরকার ব্যবস্থায় ফার্স্ট সেক্রেটারি অফ স্টেটের ভূমিকাকে কখনও কখনও ‘ডি ফ্যাক্টো উপ-প্রধানমন্ত্রী‘ হিসাবে উল্লেখ করা হয়। উপ-প্রধানমন্ত্রী পদে আনুষ্ঠানিকভাবে নিয়োগের রীতি না থাকলেও পদবিটি মন্ত্রিপরিষদের অন্যমন্ত্রীদের চেয়ে প্রাধান্য দিয়ে তৈরি করা হয়। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পদোন্নতি দেয়ার যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তিকেই ওইপদে নিয়োগ দেয়া হয়। বরিস জনসনের সাথে যেমন এই পদে ডমিনিক রাব দায়িত্ব পালন করছেন তেমনি তেরেসা মে‘র সাথে ড্যামিয়ান গ্রিন, ডেভিট ক্যামেরনের সাথে জর্জ ওসবার্ন ও উইলিয়াম হেগ, গর্ডন ব্রাউনের অধীনে মিটার ম্যান্ডেলসন ডেপুটির ট্যাগ ছাড়াই দায়িত্ব পালন করেন।
রাষ্ট্রপ্রধানদের শুভকামনা
বরিস জনসনের অসুস্থতার খবর পেয়ে দ্রুত আরোগ্যের জন্য শুভ কামনা জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি বরিসকে ভালো বন্ধু আখ্যায়িত করে তার সুস্থতার জন্য সমস্ত আমেরিকান প্রার্থনা করবে বলে মন্তব্য করেন। ট্রাম্প বলেছেন, তিনি (বরিস) একজন দুর্দান্ত ভদ্রলোক এবং একজন মহান তো। আমি আশাবাদী এবং নিশ্চিত যে তিনি ভাল হতে চলেছেন। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো দ্রুত আরোগ্যের প্রত্যাশা করে বলেছেন, শিগগিরই আপনাকে ১০ নম্বরে দেখব আশা করি। ফরাসী প্রেসিডেন্ট বলেছেন, এই ‘কঠিন মুহূর্তে’ প্রধানমন্ত্রী ও বৃটিশ জনগণের কাছে তাঁর পূর্ণ সমর্থন জানাচ্ছেন। আমি এই পরীক্ষার সময়ে তার দ্রুত পুনরুদ্ধার কামনা করছি। স্কটল্যান্ডের প্রথম মন্ত্রী নিকোলা স্টারজিন টুইটে বরিস জনসন ও তার পরিবারকে শুভকামনা জানিয়েছেন। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন, স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেড্রো সানচেজ শুভ কামনা জানিয়েছেন। এছাড়া নতুন লেবার নেতা স্যার কিরে প্রধানমন্ত্রীর অসুস্থতাকে ভয়াবহ দু:খজনক সংবাদ উল্লেখ করে টুইটে বলেছেন, এই অবিশ্বাস্যভাবে কঠিন সময়ে প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর পরিবারের সাথে রয়েছে পুরো দেশ। সাবেক লেবার নেতা জেরেমি করবিন, লন্ডনের মেয়র সাদিক খান, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন, থেরেসা মে বরিসের প্রতি শুভ কামনা জানিয়েছেন।