করোনাভাইরাস বিশ্বে যেভাবে বাড়িয়ে দিচ্ছে উত্তেজনা
বাংলা সংলাপ ডেস্কঃকরোনাভাইরাস মহামারিতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর একটি স্পেন এবং তাদের জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা সামগ্রী প্রয়োজন।
কিন্তু তাদের নতুন সরবরাহ সংগ্রহের চেষ্টায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তুরস্কের সরকার।
কারণ দেশটির কোভিড-১৯ উপদ্রুত এলাকার জন্য কয়েকশো ভেন্টিলেটর কিনেছিল তিনটি স্প্যানিশ স্বাস্থ্য সংস্থা, যার শিপমেন্ট হওয়ার কথা ছিল।
কিন্তু সেগুলো নিজেদের জন্য আটকে রেখেছে তুরস্কের সরকার।
স্থানীয় কর্মকর্তাদের বরাতে একে ‘চুরি’ বলে বর্ণনা করেছে স্পেনের গণমাধ্যম।
প্রায় এক সপ্তাহ ধরে নানারকম চেষ্টা তদবির করে স্পেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবশেষে ওই সরবরাহটি দেশে আনতে সক্ষম হয়।
কোভিড-১৯ কীভাবে দেশগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক উত্তেজনা বাড়িয়ে দিচ্ছে, এটি তার একটি উদাহরণ মাত্র।
কোথায় কোথায় উত্তেজনার ঘটনা ঘটছে?
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার বিরোধ নতুন করে সবার মনোযোগ কেড়েছে।
বিশেষ করে সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিরুদ্ধে ‘চীন প্রীতির’ অভিযোগ তুলে সংস্থাটিতে মার্কিন অনুদান বন্ধের হুমকি দেয়ার পর।
লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্সের সামাজিক ও রাজনৈতিক গবেষক সোফিয়া গ্যাস্টন বিবিসিকে বলছেন, ”থিওরি মতে, বিশ্বের দেশগুলো সবাই মিলে একত্রে একরকম যুদ্ধ করার কথা। কিন্তু বাস্তবে যা ঘটছে তা হলো, এই সংকট জাতিগুলোকে অন্তর্মুখী করে তুলেছে। সহযোগিতার বদলে তারা নিজেদের দরকারের প্রতি বেশি গুরুত্ব দিয়ে প্রতিযোগিতায় নেমেছে।”
এর একটি উদাহরণ হতে পারে ইউরোপীয় জাতিগুলোর মধ্যকার দূরত্ব।
যখন কোভিড-১৯ ইতালিতে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে, প্রতিবেশী দেশগুলোর কাছে চিকিৎসা সরঞ্জাম ও অন্যান্য সামগ্রীর জন্য সহায়তা চেয়েছিল দেশটি। কিন্তু জার্মানি ও ফ্রান্স, উভয় দেশ বরং এ জাতীয় জিনিসপত্র রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
ব্রাসেলসে ইটালির রাষ্ট্রদূত মাউরিজিও মাসসারি বলছেন, ”অবশ্যই এটা ইউরোপীয় একাত্মতার কোন লক্ষণ নয়।”
জার্মানির আরেকটি আচরণেও সন্তুষ্ট নয় ইতালি। ইউরোপে মহামারীতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে সহায়তায় জন্য তহবিল তৈরির একটি প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে জার্মানির একটি প্রদেশে বার্লিন।
ওই প্রস্তাবের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রিয়া এবং ফিনল্যান্ড। অন্যদিকে স্পেন, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, গ্রিস, আয়ারল্যান্ড, পর্তুগাল, স্লোভেনিয়া এবং লুক্সেমবার্গ প্রস্তাবটিতে সমর্থন দিয়েছে।
এই বরং ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে বিভেদ আরও পরিষ্কার ভাবে ফুটিয়ে তুলেছে।
চীনের ‘মাস্ক’ কূটনীতি
ইতালি আরও একটি ক্ষেত্রে বিশেষ উদাহরণ তৈরি করেছে, যাকে বলা হচ্ছে ‘চীনের মাস্ক কূটনীতি’ হিসাবে।
নিজেদের দেশে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে আনার পর বিভিন্ন মহাদেশের অনেকগুলো দেশে রোগটি মোকাবেলা করার জন্য নানারকম উপকরণ ও সহায়তা পাঠিয়েছে চীন। এসব দেশের মধ্যে রাশিয়াও রয়েছে।
মেডিকেল সরঞ্জাম, টেস্টিং কিট, এমনকি চীনা চিকিৎসকদের একটি টাস্কফোর্স পেয়েছে রোম। ইতালির সামাজিক মাধ্যমে এখন হ্যাশট্যাগ গ্রাসিচায়না (ধন্যবাদ চীন) এখন ট্রেন্ডিং বিষয়।
কূটনৈতিক এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিষয়ক বিশেষজ্ঞ, লন্ডন ভিত্তিক প্যাক্স টেকাম নির্বাহী পরিচালক গেসু অ্যান্টনিও বায়েজ বলছেন, ”বিশ্বে নিজেদের যে অবস্থান, সেটারই অপব্যবহার করছে করছে যুক্তরাষ্ট্র- ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘আমেরিকাই প্রথম’ নীতি সেটাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।”
যেকোনো ক্ষেত্রেই ওয়াশিংটনের অবস্থান বন্ধুত্বপূর্ণ সংজ্ঞার অনেক বাইরে।
চীনের সঙ্গে বিরোধের বিষয়টি বাদ দিলেও ডোনাল্ড ট্রাম্প জার্মানির উদ্ভাবিত একটি কোভিড-১৯ টিকার একমাত্র অধিকার দখল করার জন্য জার্মান কর্মকর্তাদেরও চাপে ফেলেছিলেন।
সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ভারতের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি দিয়েছেন যদি তারা ম্যালেরিয়া বিরোধী ঔষধের রপ্তানি নিষিদ্ধ করার আদেশ তুলে না নেয়। কোভিড-১৯ রোগের চিকিৎসায় ওই ঔষধটি পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে।
”এই সংকটের সময় কোন কূটনৈতিক শক্তিবলে কাজ করছে না যুক্তরাষ্ট্র। আর সেই সুযোগটি ব্যবহার করছে চীন,” বলছেন মি. বায়েজ।
তবে ব্রাজিল দেখিয়ে দিয়েছে যে ‘মাস্ক কূটনীতি’ সহজ কোন বিষয় নয়।
তবে চীনের ‘মাস্ক কূটনীতি’ সব নয়।
বিশ্লেষক সোফিয়া গ্যাস্টন বলছেন, চীন শুরুতেই কোভিড-১৯ রোগের মহামারী ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে বলে আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচনা রয়েছে।
তিনি বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়েছে যে, সংক্রমণ ও মৃত্যুর তথ্য গোপন করেছে চীন।
”চীন যখন জনসংযোগের অনেক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে, একই সময়ে তারা অনেক বেশি সমালোচনারও শিকার হচ্ছে। তাদের সংক্রমণের প্রকৃত সংখ্যা আমরা যখন জানতে পারবো, তখন আরও বেশি সমালোচনা হবে,” বলছেন গ্যাস্টন।
চীনের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে ব্রাজিলও। মহামারির শুরু থেকেই ব্রাজিল এবং বেইজিং বেশ কয়েকবার বিতণ্ডায় জড়িয়েছে।
সামাজিক মাধ্যমে পরস্পর ঝগড়ায় জড়িয়েছেন চীনের কূটনীতিক আর প্রেসিডেন্ট জার বোলসনারোর ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তারা।
সম্প্রতি ব্রাজিলের শিক্ষামন্ত্রী আব্রাহাম ওয়েইট্রাব একটি টুইটে অভিযোগ করেছেন যে, চীনামন্ত্রী তাকে বর্ণবিদ্বেষী বলেছেন।
এর জবাবে ব্রাসিলিয়ার চীনা দূতাবাস বলেছেন, ” এ ধরণের বক্তব্য খুবই অযৌক্তিক, ঘৃণ্য এবং সেখানে বর্ণবাদী সুর রয়েছে।”
চীন হচ্ছে ব্রাজিলের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়িক অংশীদার।
তবে মি. ওয়েইট্রাবের এই মন্তব্যের পর চীন থেকে ভেন্টিলেটর ও স্বাস্থ্য সামগ্রী কেনার ক্ষেত্রে সমস্যায় ভুগছে হচ্ছে ব্রাজিলের স্বাস্থ্য বিভাগকে।
পূর্ব উত্তেজনায় নতুন রসদ
গেসু অ্যান্টনিও বায়েজ বলছেন, ”এই ঘটনা দেখেই বোঝা যায় যে, অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে কূটনীতি এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি।”
”দেশগুলোর উচিত পরিস্থিতির সঠিক বিশ্লেষণ করা এবং সঠিক ব্যবস্থাপনা দ্বারা ভয় কাটিয়ে ওঠা।”
কিন্তু আগে থেকে চলে আসা বিরোধে নতুন করে অগ্নিসংযোগ করছে এই ভাইরাস। এক্ষেত্রে বিশেষ করে কলম্বিয়া এবং ভেনেজুয়েলার নাম বলা যেতে পারে।
ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর সরকারকে বৈধ সরকার হিসাবে স্বীকার করেনা কলম্বিয়ার কর্তৃপক্ষ।
ভেনেজুয়েলার অভিবাসীরা সীমান্ত অতিক্রম করে কলম্বিয়ায় প্রবেশ শুরু করার পর থেকেই দুই দেশের মধ্যে বিরোধ শুরু হয়।
তবে সর্বশেষ পদক্ষেপ নেয়া হয় নিকোলাস মাদুরোর অফিস থেকে। তারা কলম্বিয়ার সরকারের জন্য দুইটি কোভিড-১৯ মেশিন দেয়ার প্রস্তাব দেন।
কারণ কলম্বিয়ার একমাত্র মেশিনটি নষ্ট বলে জানা যায়।
তবে এই প্রস্তাবের কোন জবাব দেয়নি কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট ইভান ডুকের অফিস।
এদিকে মধ্যপ্রাচ্যে, কাতারে মিশরীয় যে নাগরিকরা আটকে পড়ে আছেন, তাদের নিয়ে কাতার ও মিশরের মধ্য বিরোধ তৈরি হয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কোভিড-১৯ রোগী রয়েছে কাতারে। দেশটি আল জাজিরাকে জানিয়েছে যে, তাদের দেশে মিশরীয় যে অভিবাসী শ্রমিকরা আটকে রয়েছে, তাদের বিশেষ বিমানে করে ফেরত পাঠাতে চাওয়া হলেও গ্রহণ করতে রাজি হচ্ছে না মিশর।
চরমপন্থিদের সমর্থন দেয়ার অভিযোগ তুলে ২০১৭ সালে যেসব দেশ কাতারের সঙ্গে সকল প্রকার কূটনৈতিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করেছিল, মিশর তাদের অন্যতম।
মাস্ক ও লকডাউনের চেয়েও বিতর্কের অন্য কারণ
মাস্ক বা লকডাউনের বাইরেও অন্য আরো অনেক কারণ নিয়েও উত্তেজনা বাড়ছে।
১৮ই মার্চ ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ফাঁস হওয়া একটি প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয় যে, রাশিয়া প্রভাবিত গণমাধ্যম পশ্চিমা দেশগুলোয় কোভিড-১৯ নিয়ে ভুয়া খবর ছড়াচ্ছে।
এসব অভিযোগকে ‘অসত্য’ বলে দাবি করেছেন রাশিয়া সরকারের একজন মুখপাত্র।
যদিও বিভেদ বাড়ছে, কিন্তু অনেক বিশেষজ্ঞ এই মহামারির মধ্যে ইতিবাচক দিকও দেখতে পাচ্ছেন।
গবেষণা সংস্থা ওভারসিজ ডেভেলপমেন্ট ইন্সটিটিউটের গবেষক অ্যানালিসা প্রিজন বলছেন, ”এই সংকট দেখিয়ে দিয়েছে যে, উন্নত দেশগুলো সবসময়ে সব বিষয়ে দক্ষ হতে পারে না।”
”মহামারির প্রভাব নিয়ে যেভাবে চীন তার অভিজ্ঞতা ইতালির সঙ্গে বিনিময় করেছে, তা খুবই সময় উপযোগী একটা ব্যাপার।”
তবে সোফিয়া গ্যাস্টন মনে করেন, এই সময়ে আরো বেশি সহযোগিতা দরকার।
”যখন পশ্চিমা দেশগুলোয় জাতীয়তাবাদের প্রবণতা বাড়ছে, তখন সহযোগিতার প্রদর্শন আরও বেশি দরকার।”
”অথচ এখন তার বদলে, অনেক কৌশল বরং এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের সম্পর্ক আরও খারাপ করে তুলছে।,” তিনি বলছেন।