যিলহাজ্ব মাসের ফজিলত ও করণীয় আমল
বান্দাদের প্রতি আল্লাহ তা’আলার বিশেষ অনুগ্রহ যে,তিনি তাঁরই আনুগত্যের জন্য বিশেষ বিশেষ সময় নির্ধারণ করে দিয়েছেন। যাতে করে তারা বেশি বেশি আমাল করে লাভবান হতে পারে। তাঁরই নৈকট্য লাভের জন্য নিজেদের ভিতর আমালের প্রতিযোগিতা করতে পারে।
এমন বিশেষ সময়ের অন্যতম হচ্ছে, যিলহাজ্বের প্রথম দশ দিন। যে দিনগুলোর গুরুত্ব আর ফজিলত সম্পর্কে স্বয়ং রাসুলুল্লাহ (সা) সত্যায়ন করছেন। বেশি বেশি আমলের প্রতি উৎসাহ দিয়েছেন। এমনকি আল্লাহ তা’আলা নিজে এ ব্যাপারে শপথ গ্রহন করছেন।
জেনে নেই যিলহাজ্বের দশ দিনের ফজিলত সমূহ:
১. আল্লাহ তা’আলা এ ব্যাপারে শপথ গ্রহন করছেন। অন্য সব কিছু বদ দিয়ে আল্লাহ তা’আলার এমন শপথ এ দিনগুলোর গুরুত্বের জন্য যতেষ্ট ছিল। কেননা বিষয়ের গুরুত্ব আর মাহাত্ব্য অন্য কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দিয়ে বুঝা যায়। আল্লাহ তা’আলা বলেন- (وَالْفَجْرِ وَلَيَالٍ عَشْرٍ ) শপথ ফজরের, শপথ দশ রাত্রির ( আল কোরআন ৮৯/১,২) মুফাস্সিরিনে কেরাম বলেন দশ রাত্রি দিয়ে যিলহাজ্বের প্রথম দশ রাত্রির কথাই বুঝিয়েছেন।
২. আল্লাহ তা’আলা কোরআনে এই দশকের দিনকে “নির্দিষ্ট দিন” বলে উল্লেখ করে তাকে বেশি বেশি স্মরণ করতে বলছেন। তিনি বলেন- (ويذكروا اسم الله في أيام معلومات على ما رزقهم من بهيمة الأنعام) তারা যেন নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর নাম স্মরণ করে তাঁর দেয়া চতুস্পদ জন্তু যবেহ করার সময়। অতঃপর তোমরা তা থেকে আহার কর এবং দুঃস্থ-অভাবগ্রস্থকে আহার করাও”। ( আল কোরআন ২২/২৮) মুফাস্সিরিনে কেরাম বলেন নির্দিষ্ট দিন বলতে এখানে যিলহজ্বের প্রথম দশ দিনের কথা বুঝানো হয়েছে।
৩. রাসুলুল্লাহ (সা) এ দিনগুলোকে বছরের সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন বলে আখ্যায়িত করছেন। فعن جابر رضي الله عنه عن النبي صلى الله عليه وسلم قال :(فضل أيام الدنيا أيام العشر ـ يعني عشر ذي الحجة ـ قيل: ولا مثلهن في سبيل الله؟ قال : ولا مثلهن في سبيل الله إلا رجل عفر وجهه بالتراب
হযরত জাবির (রা) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা) বলেন- দুনিয়ার সর্বোত্তম দিনগুলো হল যিলহাজ্বের দশ দিন। জিজ্ঞাসা করা হল, আল্লাহর রাস্তায় যাওয়া কি তার সমতুল্য নয় ? তিনি বললেন, আল্লাহর রাস্তায় যাওয়া তার সমতুল্য নয়। তবে ঐ ব্যক্তি, যার চেহারা ধূলিযুক্ত হয়েছে, অর্থাৎ শাহদাতের মর্যাদা লাভ করেছে।-(মুসনাদে বাযযার)
৪. এ দিনগুলোর ভিতর আরাফার দিনও আছে। যে দিনকে হজ্বে আকবর ও গুনাহ মাফের দিন বলা হয়। এমনকি জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাওয়ার দিন বলেও আখ্যায়িত করা হয়। যদি জিলহাজ্বের দশ দিন না হয়ে শুধু আরাফার দিন হত তাও এই মাসের ফজিলতের জন্য যতেষ্ট ছিল।
৫. এ দিনগুলোতে আছে “ইয়াওমুন নাহর” তথা কোরবানির দিন। যে দিন বছরের সব চেয়ে উত্তম দিন হিসেবে গণ্য করা হয়। قال صلى الله عليه وسلم (أعظم الأيام عند الله يوم النحر، ثم يوم القر)
রাসুলুল্লাহ (সা) বলেন “আল্লাহর নিকট সর্বাধিক মহিমান্বিত দিন হল নহর তথা কোরবানির দিন। অতঃপর কোরবানির পরের তাশরিকের দিনগুলি। (আবু দাউদ)
৬. হাফেজ ইবনে হাজার (রা) ফাতহুল বারীতে বলেন এ দিন সমূহে বহু আমালের সমাগম ঘটে বলে বছরের অন্য দিনের তুলনায় মাহাত্ব্য বেশি। এ দিনগুলোতে হজ্ব-উমরাহ, সালাত, সিয়াম, দান-সদকা, কোরবানি ইত্যাদি বহু মৌলিক ইবাদতের সমাবেশ ঘটেছে। যেগুলো সাধারণত অন্য সময় একসাথে পাওয়া যায় না।”
এ দিনগুলোতে আমলের গুরুত্ব হচ্ছে:
عن ابن عباس رضي الله عنهما قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: (ما من أيام العمل الصالح فيها أحب إلى الله من هذه الأيام ـ يعني أيام العشر ـ قالوا: يا رسول الله، ولا الجهاد في سبيل الله؟ قال: ولا الجهاد في سبيل الله، إلا رجل خرج بنفسه وماله ثم لم يرجع من ذلك بشيء)
ইবনে আব্বাস (রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা) বলেন: “আল্লাহ্র নিকট যিলহাজ্বের প্রথম দশকের আমলের চেয়ে উত্তম পছন্দনীয় আমল নেই। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন: আল্লাহ্র পথে জিহাদও নয় কি? হে রাসূলুল্লাহ্! তিনি বললেন: “আল্লাহ্র পথে জিহাদও নয়। অবশ্য সেই মুজাহিদের কথা ভিন্ন, যে জান-মাল নিয়ে জিহাদে বেরিয়ে পড়ে, কিন্তু আর কোন কিছুই নিয়ে ফিরে আসে না (অর্থাৎ আল্লাহর পথে শহীদ হয়ে যায়)।” (বুখারী)
আবু ছাম্মান নাহদী বলেন-
يقول أبو ثمان النهدي: كانوا ـ أي السلف ـ يعظمون ثلاث عشرات: العشر الأخير من رمضان، والعشر الأول من ذي الحجة، والعشر الأول من محرم.
প্রতেক সালাফই তিনটি দশককে মর্যাদা দিতেন এবং আমলকে গুরুত্ব দিয়ে করতেন। এগুলো হচ্ছে রামাদ্বানের শেষ দশক, যিলহাজ্বের প্রথম দশক ও মহাররামের প্রথম দশক।
যিলহাজ্বের পছন্দনীয় আমালসমূহ:
১. হাজ্ব ও উমরা করা হচ্ছে এ মাসের অন্যতম বিশেষ আমাল। সুযোগ ও সামর্থ্য থাকলে হাজ্ব ও উমরাহ্ আদায় করা। আর হাজ্বের সব কাজ এ দশ দিনেই হয়ে থাকে।
২. সাওম আদায় করা এ দিনগুলোর আরেকটি আমাল। এ মাসের প্রথম দশকে প্রতি এক এক দিনের সাওমের বদলে এক এক বছর সাওমের ছাওয়া মিলে। শুধু আরাফার দিনের সিয়াম দ্বারা আগের ও পেছনের এক বৎসরের গুনাহ মাফ করা হয়। রাসুলুল্লাহ (সা) বলেন- فقال صلى الله عليه وسلم : (صيام يوم عرفة احتسب على الله أن يكفر السنة التي قبله والتي بعده)
আরাফার দিনের সিয়াম আদায় করার দ্বারা বিগত এক বছর ও আগামী এক বছরের গুনাহ মাফ হওয়ার ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলার নিকট আমি আশাবাদী। ( সহীহ মুসলিম)
৩. এ দিনগুলোতে বেশি বেশি নফল সালাত আদায় করার প্রতি মনোযোগী হওয়া। রাসুলুল্লাহ (সা) বলেন- (وما يزال عبدي يتقرب إلى بالنوافل حتى أحبه) [رواه البخاري]
নফল সালাত আল্লাহ্ তা’আলার নৈকট্য লাভের সবচেয়ে বড় মাধ্যম ও শ্রেষ্ঠ উপায়।(বুখারী)
৪. অধিক পরিমাণে তাকবীর, তাহলীল ও তাহমীদ পড়া। রাসুলুল্লাহ (সা) বলেন- فعن ابن عمر رضي الله عنهما عن النبي صلى الله عليه وسلم قال: (ما من أيام أعظم عند الله ولا أحب إليه العمل فيهن من هذه الأيام العشر، فأكثروا فيهن من التهليل والتكبير والتحميد)
এই দশ দিনের মর্যাদার সমতুল্য এবং এই দশ দিনের আমল অপেক্ষা অধিক প্রিয় আমল আল্লাহর কাছে নেই। সুতরাং তোমরা এই দিন সমূহে অধিক পরিমাণে তাসবীহ, তাহমীদ, তাহলীল এবং তাকবীর পড়। (আহমদ)
ইমাম বুখারী (র) বলেছেন- ইবনে ওমর (রা) এবং আবু হুরায়রা (রা) এ দশ দিন তাকবীর বলতে বলতে বাজারে বের হতেন, মানুষরাও তাদের দেখে তাকবীর বলতো। তিনি আরও বলেছেন- ইবনে উমর (রা) মিনায় তাঁর তাঁবুতে তাকবীর বলতেন, তা শুনে মসজিদের লোকেরা তাকবীর বলত এবং বাজারের লোকেরাও তাকবীর বলত।
কাজেই এই দশ দিন উচ্চস্বরে বেশি বেশি তাকবীরে তাশরীক পড়া সুন্নাত। পুরুষরা আওয়াজ করে পড়বে, আর নারীরা নিম্নস্বরে পড়বে।
৫. এ দিনগুলোতে দান সাদাকা করা। এটি এমন আমল যার মাধ্যমে একজন সহজে কমনীয় সাওয়াব পেতে পারে। সাদাকা দ্বারা মালে বরকত হয়।
৬. পশু কোরবানি করা হচ্ছে এ দিনের অন্যতম আমাল। যিলহাজ্বের দশ তারিখ “ইয়ামুন নাহরের” দিন পশু কুরবানি করা হচ্ছে এ দিনের আমাল। আয়শা (রা) থেকে বর্ণনা, রাসুলুল্লাহ (সা) বলেন- وعنْ عائِشةَ أنَّ النَّبيَّ – صلَّى اللهُ علَيْه وسلَّم – قال: ((مَا عَمِلَ ابْنُ آدَمَ يَوْمَ النَّحْرِ عمَلاً أحَبَّ إلى اللهِ – عزَّ وجلَّ – مِنْ هراقةِ دَمٍ،
কোরবানির দিনে পশু কোরবানির চেয়ে প্রিয় কোনো আমল আল্লাহ্ তা’আলার কাছে নেই। (তিরমিজি)
আল্লাহ তা’আলার নিকট ভালো আমাল দ্বারা এই দিনগুলো কাটানোর তাওফিক কামনা করছি। আমিন।
লেখক:কলামিস্ট।