ভারতীয় সুবীরদের বাংলাদেশ বিরোধী ষড়যন্ত্র এবং রাজনীতিতে ‘লিভ এন্ড লেট লিভ’র গুরুত্ব
এক:
৪ আগস্ট দৈনিক মানবজমিনে ‘সুবীর ভৌমিকের বাংলাদেশ বিরোধী কুৎসিত প্রচারণা’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক সেনাবাহিনীসহ রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কুরুচিপূর্ণ অপপ্রচার করে চলছেন ভারতীয় সাংবাদিক সুবীর ভৌমিক।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, সম্প্রতি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানের হাই কমিশনারের সাধারণ একটি সাক্ষাৎ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর করা একটি ফোনালাপকে কেন্দ্র করে নতুন গল্প ফেঁদেছেন এই বিতর্কিত সাংবাদিক। তার ইস্টার্নলিংক লিখেছে, ইমরান খানের সাথে ফোনে ১৫ মিনিট আলাপ করে শেখ হাসিনা কার্যত ভারতকে প্রত্যাখ্যান বা rebuff করলেন। আবার উস্কানি দিয়ে বলছেন, এই ‘হাসিনা চ্যালেঞ্জ’ ভারত এখন কীভাবে নেয় সেটাই প্রশ্ন।
শেখ হাসিনার সরকারের আমলে গণতন্ত্রহীনতা, গুম, খুন, নির্যাতনসহ সামগ্রিক কর্মকান্ড নিয়ে দেশের মানুষের রয়েছে বুক ভরা আহাজারি ও আর্তনাদ। কিন্তু এখানে ‘চ্যালেঞ্জ’ বলতে গোটা বাংলাদেশকেই বুঝানো হয়েছে বলে মনে করা হয়। তাই বাংলাদেশকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করা হলে এর জবাব সম্মিলিতিভাবেই দেয়া প্রয়োজন। তবে হ্যাঁ, সুবীর ভৌমিকের ভাষায় বাংলাদেশকে ‘ভারত কীভাবে নেয়’ তার প্রভাব আমরা প্রতিনিয়ত দেখছি। সীমান্তে নিরীহ মানুষকে পাখির মতো গুলি করে প্রায় প্রতিদিন হত্যা করছে বিএসএফ। দশ লাখের অধিক ভারতীয় যার বেশিরভাগই অবৈধ অভিবাসী তাদের ভাষায় ‘খয়রাতি খাওয়া’ বাংলাদেশ থেকে রেমিটেন্স পাঠাচ্ছে। ট্রানজিট, ট্রানশিপমেন্ট পেয়েছে ভারত। বন্দর দিয়ে মালামাল পরিবহনে দিবে কম শুল্ক আর দেশের ব্যবসায়ীদের থেকে পাবে অগ্রাধিকার। নিজের দেশকে নিরাপদে রেখে সুন্দরবনের ঘা ঘেঁষে করছে রামপাল। তিস্তাসহ ৫৪টি অভিন্ন নদীর পানির হিস্যা দিবে না, বিনিময়ে উল্টো পানি নিয়ে যাবে তাদের ত্রিপুরায়। সামরিক নীতিতে সংবেদনশীল হলেও বাংলাদেশের উপকূলে রাডার বসিয়ে আমাদেরকে চোখেচোখে রাখবে। কারণ প্রতিবেশী বড় দেশ হিসেবে কিছু বাড়তি দায়িত্ব আছে বটে !
হয় তুমি আমার পক্ষে, নয়তো শত্রূ পক্ষে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভারত কি এই ডক্ট্রিন অনুসরণ করছে? কিন্তু নেপালের কথা স্মরণে রাখা উচিত নয় কি? ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির পালস ধরে রাখতে তার নিজের অর্থনৈতিক সমৃদ্বি ও সমরনীতিতে, ভূ-রাজনীতির সমীকরণ জেনেও রাশিয়ার পাশাপাশি আমেরিকার সাথে সম্পর্ক বৃদ্বি করে যাচ্ছে । সৌদি, আরব আমিরাতের পাশাপাশি ইরানের সাথে রয়েছে ভাল সম্পর্ক। যদিও চীন এবার এখানে বাগড়া বসিয়েছে। চীনের সাথে সীমান্ত সংঘাতে জড়ালেও মায়ানমারের সাথে রয়েছে গভীর দহরম মহরম। বাবরি মসজিদ ভেঙে দিয়ে রাম মন্দিরের ভিত্তি স্থাপন করে নরেন্দ্র মোদী বলছেন তাঁর দেশ নাকি ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শে উদ্ভুদ্ব। সেই আদর্শ অটুল রাখছেন বলেও প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। ভূতের মুখে কি যেন শুনছি বলা হয়? এখন থেকে ধর্মীনিরপেক্ষতার নতুন সংজ্ঞাও লিখতে হবে । ভারত আগুন নিয়ে খেলছে, তা হয়তো ধর্মীয় অন্ধ গোড়ামির কারণে বুঝে নাও আসতে পারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মুসলিম দেশের ঘা ঘেঁষে রয়েছে ভারতের নৌ চলাচলের রাস্তা । ভারত সাগর, আরব সাগর, দক্ষিণ চীন সাগরসহ প্রশান্ত মহাসাগর এবং হরমুজ প্রণালী, বসফরাস প্রণালী ও সুয়েজ খালের পার্শবর্তী দেশগুলো কিন্তু মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে বিভিন্ন মুসলিম অধ্যুষিত দেশে লাখ লাখ ভারতীয় মুসলমানদের নাকের ডগায় কাজ করেও গরু খাওয়ার অপরাধে পিঠিয়ে মুসলমানদের হত্যা করা হয় ভারতে । কিন্তু গোমাংস রপ্তানিতে ভারত বিশ্বে তৃতীয়। সত্যিই সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ! নোবেল লরেট অমর্ত্য সেন বলেছেন, ‘ভারতকে বোঝার মতো জ্ঞান মোদির নাই। তিনি কেবল বুঝেন হিন্দুত্ববাদ।’ তাঁর সাথে সুর মিলিয়ে বলা যায় শুধু মোদী নয় ভারতীয় আমলা ও বেশিরভাগ রাজনীতিবিদ আধুনিক জগতের এখনো অনুপযোগী।
দুই:
সুবীর ভৌমিক অক্সফোর্ড পড়ুয়া ভারতীয় সাংবাদিক। এক সময় বিবিসি বাংলাতেও কাজ করেছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি বাহিনী তথা সামগ্রিক অবস্থা নিয়ে তিনি একটি বই লিখেছেন। তাতে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রত্যক্ষ মদদে শান্তি বাহিনী বাংলাদেশে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে বলেও উল্লেখ করেছেন। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তার কাজকর্ম থেকে এটা পরিষ্কার করে বলা যায় যে, দক্ষিণ এশিয়াতে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার উদ্দেশ্য হাসিলে তিনি মিডিয়া উইংয়ের দায়িত্ব পালন করছেন। তার পরিচালিত ইস্টার্নলিংক ও লুকইস্ট নামে দু’টি পোর্টালেই শুধু নয় ভারতীয় বিভিন্ন মিডিয়াতে নামে বেনামে ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশ বিরোধী উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রচার করে যাচ্ছেন। বিশেষ করে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে অস্থিরতার গালগল্প বানিয়ে দেশপ্রেমিক, দক্ষ ও মেধাবী অফিসারদের সেনাবাহিনী থেকে সরিয়ে দেয়ার ফন্দি আটছে। গত ৯ জুন ২০২০, টেলিগ্রাফ ইন্ডিয়াতে
‘A crack in the hornets’ nest: Strife within Bangladesh military order –
Sheikh Hasina Wajed needs to take firm control of the situation before the army rocks her boat’ শীর্ষক একটি নিবন্দ্বে গাঁজার নৌকা দিয়ে পাহাড় বাইতে চেয়েছেন। নিবন্দ্বটি বিশ্লেষণ করলে যে কারো পক্ষে নানা ধরণের অসঙ্গতি ও পরস্পর বিরোধী বক্তব্য বের করা সম্ভব। সুবীর ভৌমিকে বক্তব্য হচ্ছে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে নাকি এক ধরণের অস্থিরতা চলছে এবং বিরাট একটি অংশ সেনাপ্রধান এম এ আজিজকে পদচ্যুত করতে চাইছে। আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা CIA এবং চীনের গোয়েন্দা সংস্থা MSS মিলে সেনাপ্রধান এম এ আজিজকে সরিয়ে রাষ্ট্রদূত করে বাইরে পাঠানোর কাজটি করছে বলে উল্লেখ করেছে। আঞ্চলিক ও বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটে বিবেচনায় যা শুধু অসঙ্গতিপূর্ণ নয় উদ্ভট চিন্তাও বটে। তিনি এসব তথ্যের সূত্র হিসেবে নিরমালা সাহা ছদ্মনামে একজন সাংবাদিকের লেখা নিবন্দ্বকে উল্লেখ করেছেন। নিরমালা সাহা অন্য কেউ নয় ছদ্মনামে নিজেই সুবীর ভৌমিক।
সত্যিকার অর্থে সাম্প্রতিক ও নিকট অতীতের অবজ্ঞা ও দাদাগিরি কর্মকান্ডে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী ও কূটনীতিক পাড়াতে ভারতের প্রতি অনীহা ও অস্বস্তি কাজ করছে। এই অনীহার পেছনে কয়েক শত যৌক্তিক কারণও রয়েছে । এই খবর ভারতের গোয়েন্দারা জানেন। আর এতেই তাদের যত মাথা ব্যাথা। এজন্য গুজব ছড়িয়ে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীতে অস্থিরতা ও অবিশ্বাস সৃষ্টি করার হীন ষড়যন্ত্র চলছে। যাতে করে ছুঁতো বের করে সেনাবাহিনীর দেশপ্রেমিক ও দক্ষ অফিসার যারা ভারতের তাবেদারী মানবে না তাদেরকে সরিয়ে দেয়া যায়। দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী হয়তো সামরিক নীতিমালার মৌলিক তত্ত্ব অনুসরণ করার তাগিদে দিল্লির সাথে সামরিক মাখামাখি করতে রাজি নয় । রক্তে কেনা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং মুক্তিযুদ্বের অঙ্গীকার সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীই শেষ ভরসা। তাই তাদের নিয়েই যত মাথা ব্যাথা ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার বেতনভুক্ত গুপ্তচর হিসেবে খ্যাত সাংবাদিক সুবীর ভৌমিক ও তার প্রভুদের ।
তিন:
২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া চিকিৎসার প্রয়োজনে লন্ডন সফরের সময় যুক্তরাজ্যে ঈদুল আজহা উদযাপন করেন। লন্ডনে ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্যমতের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন। বিএনপি গণতন্ত্র, শান্তি, উন্নয়ন ও জনগণের কল্যাণের রাজনীতিতে বিশ্বাস করে উল্লেখ বলে তিনি বলেন ‘আমরা জাতিকে বিভক্ত করে নয় বরং ঐক্যবদ্ধ করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে চাই। বেগম জিয়া বলেন, আমরা সবাইকে নিয়ে ঐক্য, শান্তি ও উন্নয়নের রাজনীতি করতে চাই। আওয়ামী লীগের সঙ্গেও ঐক্যের রাজনীতি করতে চান উল্লেখ করে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ দেশের পুরাতন রাজনৈতিক দল। আওয়ামী লীগের মধ্যেও ভালো ও দেশপ্রেমিক লোক আছে জানিয়ে তিনি বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে তাদেরকে সঙ্গে নিয়েই তিনি দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। আর যদি জনগণের ভোটে বিরোধী দলে থাকতে হয় তবুও নির্বাচিত সরকারকে জনগণের প্রতি দায়বদ্ব থেকে দেশ পরিচালনা করাতে জোরালো ভূমিকা রাখবে ।
সরকারের বৈধতা নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রশ্ন থাকা স্বত্ত্বেও, সম্প্রতি বিশ্বব্যাপী করোনা দূর্যোগের সময়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশের মানুষের দুঃখ্য-দূর্দশা ও কষ্ট লাঘবে সরকারকে সব ধরণের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। সরকারের অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির দায়ে করোনা টেস্টে বিশ্বাসযোগ্যতা হারালে দেশে ও বিদেশে এর খেসারত দিতে হবে জানিয়ে আগাম সতর্কও করেছিলেন। প্রতিহিংসা ও বিদ্বেষের রাজনীতির বিপরীতে সহনশীল রাজনীতির পরিবেশ তৈরিতে সরকারে থাকা দলটির জন্য এটা ছিল এক বিরাট সুযোগ। কিন্তু সরকার এখনো সেই চিরচেনা পথে হাটঁছে বলেই মনে হচ্ছে। তারেক রহমানের কথা শুনলে সরকারেরই ফায়দা হতো। আজ বিশ্বময় বাংলাদেশের বিশ্বাসযোগ্যতা তলানিতে আর দেশের মানুষের পাশাপাশি লক্ষ লক্ষ প্রবাসীরাও এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হচ্ছেন। রাজনীতি একটি গতিশীল বিজ্ঞান। অভ্যন্তরীণ চাহিদার উপর ভিত্তি করে আঞ্চলিক ও বিশ্ব রাজনীতির গতি প্রকৃতিও এক জায়গায় বসে থাকে না। আঞ্চলিক শক্তি যখন পরিবর্তিত বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতির শক্তির সাথে প্রতিযোগিতায় ব্যর্থ হয় তখন তারা জনবিচ্ছিন্ন সরকারের দুর্বলতার সুযোগে অপেক্ষাকৃত ছোট দেশকে চোখ রাঙানির উপর রাখতে চায়। তাই তারা প্রথমেই দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে পানি ঘোলা করে ফায়দা নেয়ার চেষ্টা করে থাকে । মাঝে মধ্যে তারা যে সফলকাম হয় না, তা কিন্তু নয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে স্বৈরাচারী এরশাদ, ওয়ান ইলেভেনের সরকার এবং বিডিআর এর হত্যাযজ্ঞ তার উদাহরণ।
বিগত এক দশকের বেশি সময় ধরে জেল-জুলুম, নিপীড়ন-নির্যাতনের পরেও সরকারের প্রতিদ্বন্দ্বী বৃহত্তম দলটির শীর্ষ নেতৃত্বের কাছ থেকে সহনশীল ও সহযোগিতামূলক রাজনীতির বার্তা দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার দৃঢ় অঙ্গীকারের পাশাপাশি জনগণের প্রতি অগাধ ভালোবাসা ও প্রাজ্ঞ রাজনীতিকের পরিচায়ক।
চার:
চীন-ভারত সীমান্ত যুদ্বে ভারত তাদের ভূমি হারিয়ে এবং পরিবর্তিত আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতি ও অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে তারা আবার স্বরূপে আবির্ভূত হচ্ছে। বাংলাদেশ, নেপালসহ এ অঞ্চলে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার হয়ে গুজব ও বিভ্রান্তি সৃষ্টিতে পারঙ্গম ভারতীয় সাংবাদিক সুবীর ভৌমিকের সাম্প্রতিক বাংলাদেশ বিরোধী কুৎসিত প্রচারণা তারই ধারাবাহিকতা মাত্র। বিগত দিনগুলোতে ভারতের অবজ্ঞা, অভিন্ন নদীর ন্যায্য হিস্যা না দেয়া, সীমান্ত হত্যা এবং সাম্প্রতিক সময়ে নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ লোককে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়ার হুমকি প্রদান, মুসলমান হিন্দু বিভাজনকে উস্কানীসহ ইত্যাদি নানা ইস্যূতে বাংলাদেশের মানুষের কাছে ভারতের ইমেজ একেবারে তলানিতে। এর পরে গত দুই তিনটি জাতীয় নির্বাচনে ভারত যেভাবে নগ্ন হস্তক্ষেপ করেছে এতে তাদের আধিপত্যবাদী খায়েশের জিহবা অনেক দূর এগিয়েছে। হওয়ার যুক্তিও আছে। কারণ কূটনীতিতে দর কষাকষির প্রিতিটি সুযোগ ক্ষমতায় ঠিকে থাকার স্বার্থে বিকিয়ে দিতে হয়েছে। আজ বাংলাদেশের বন্দরে ভারতীয় মালামাল অগ্রাধিকার পাবে বলে চুক্তি করা হয়েছে। বাংলাদেশ পানি পায় না কিন্তু আমাদের থেকে ত্রিপুরাতে পানি যাবে। তাই এখনো সময় আছে পেছনে না থাকিয়ে মর্যাদাবান জাতি হিসেবে সামনের দিকে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ তৈরী হয়েছে। আর এই সুযোগ কাজে লাগাতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন রাজনৌতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্যমত এবং একে অন্যের প্রতি সহনশীল আচরণ। নেপাল পারলে বাংলাদেশ পারবে না কেন?
বিশ্বায়নের এই যুগে পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে শুধু পার্শ্ববর্তী দেশ নয় গোটা দুনিয়ার সাথে অর্থনীতির সংযোগের প্রয়োজন রয়েছে। তবে তা আত্মমর্যাদাকে ভুলন্ঠিত করে নয়। পৃথিবীতে যারা আত্মমর্যাদা সমুন্নত রেখে একে অন্যের সাথে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমরনীতিতে একে অন্যের পরিপূরক হয়ে কাজ করছে তাদের অতীত ইতিহাস যে খুব সুখকর ছিল তা কিন্তু নয় । পাকিস্তানের কথাই ধরা যাক। একাত্তরের মুক্তিযুদ্বে সাহসিকতার স্বাক্ষর রাখতে না পারলে আজও দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক করে রাখতো তারা। এমনিভাবে প্রতিটি জাতি তাদের আত্মিনিয়ন্ত্রনের অধিকার প্রতিষ্ঠার পরেই ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। ভারতীয় সুবীর ভৌমিকদের সম্মিলিতভাবে জানান দিতে হবে, বাংলাদেশ কারো করুনার পাত্র নয়। যারা ‘খয়রাতি’ বলে অবজ্ঞা করে তাদেরকে প্রয়োজনে রক্ত দিয়ে জবাব দিতে হবে। অন্যথায় সামনে আরো খারাপ সময় অপেক্ষা করছে। তবে আশার কথা যে, দক্ষিণ এশিয়াতে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি আর প্রিতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্বে উদার গণতন্ত্র ও মধ্যপন্থী রাজনীতি ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছে। গ্লোবাল বিশ্বে এখন একা চলার অবকাশ নেই। পার্শ্ববর্তী বৃহৎ দেশ হিসেবে ভারতের সাথে ভারসাম্যপূর্ণ সুসম্পর্ক সময়ের দাবি। হ্যাঁ বন্ধুত্ব, প্রভুত্ব নয়। একবিংশ শতকের আধুনিক দুনিয়ায় বন্ধুত্বকে জোরদার করতে হবে ন্যায্য হিস্যা দেয়া নেয়ার ভিত্তিতে। অন্য কোন রাস্তা খোলা নাই এখানে। তাই এ ধরণের সম্পর্ক এবং ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে প্রয়োজন অভ্যন্তরীন রাজনীতিতে সহনশীলতা ও সহিষ্ণুতা।
আমরা যদি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দিকে থাকাই তাহলে দু’একটি ব্যতিক্রম ছাড়া দেখতে পাই যে, প্রধানত দুটি বা তিনটি রাজনৈতিক দল পালাক্রমে দেশ শাসন করে আসছে । এক্ষেত্রে দেশের বিরুদ্বে ষড়যন্ত্র মোকাবেলা ও অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে ক্রমান্বয়ে জবাবদিহিতার কাঠামোতে নিয়ে আসতে রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে এক ধরনের ‘লিভ এন্ড লেট লিভ’র সমঝোতা থাকা চাই । যাতে আধিপত্যবাদীরা রাজনীতিকদের ক্ষমতাপ্রীতি ও দুর্বলতার সুযোগে দেশ নিয়ে যাচ্ছেতাই খেলা করতে না পারে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্বে ষড়যন্ত্র মোকাবেলার বড় নিয়ামক হতে পারে রাজনৈতিক দলগুলোর একে অন্যের প্রতি পারস্পরিক সহনশীলতা ও সহিষ্ণু রাজনীতির চর্চা। জাতীয় অঙ্গীকার বাস্তবায়নের জন্য রাজনৈতিক দলসমূহ ও জাতীয় নেতৃবৃন্দের মধ্যে সহনশীলতা ফিরিয়ে আনা জরুরি। আর এতে করেই রাষ্ট্র পেতে পারে একটি আত্মমর্যাদাবান ও অগ্রসর জাতি আর জনগণ পাবে কল্যাণমুখী একটি মানবিক রাষ্ট্র । কিন্তু দেশ শাসনে যারা রয়েছেন তারা আত্মমর্যাদাশীল ও কল্যাণমুখী রাষ্ট্র এবং রাজনীতিতে সহনশীল বাংলাদেশ দেখতে চান কি না তা এখন মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন?
লেখক: ডক্টর এম মুজিবুর রহমান।
সংবাদ বিশ্লেষক ও সাবেক সহকারী অধ্যাপক, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।
লন্ডন, ০৫ অগাস্ট ২০২০।