আহলে কিতাবীদের সাথে ঘর-সংসার
আপনারা কি একটি বিষয় লক্ষ্য করেছেন যে, আমাদের প্রিয় বাংলাদেশের মানুষ কেন জানি দেশ ছাড়তে চায়। কথা বলে জানা যায় বিশেষ করে শিক্ষিত, আর্থিক ভাবে সাবলম্বী, ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সচিব ও আমলা শ্রেণীর মানুষগুলো কেন যেন দেশে থাকতে চায় না বা তাদের ছেলেমেয়েদের কেন জানি দেশের বাহিরে সেটল হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। এর কারণ কি? অনুসন্ধান করে জানা গেলো রাজনৈতিক অস্থিরতা, জীবনযাত্রার মান, সামাজিক সমস্যা, সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি, জীবনের নিরাপত্তা হীনতা, নিম্ন মানের চিকিৎসা, ভেজাল খাবার, অনুন্নত পরিবেশ এবং এর সাথে হামলা আর মামলাকেই বেশি দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা। আপনি যদি এই দেশছুট/দেশত্যাগী শ্রেণীর সাথে কথা বলেন তারা আরেকটি অন্যতম বিষয়কে তাদের দেশ ত্যাগের জন্য বলে থাকে যে, ছেলেমেয়েদের উন্নত জীবন ও ভালো এডুকেশনের জন্যই তারা দেশ ছেড়ে উন্নত দেশে বিশেষ করে ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের দিকে পাড়ি জমায়। আবার তাদেরকে এটিও বলতে শুনা যায় যে দেশের ভবিষ্যতের উপর তাদের কোনো আস্থা নেই। এর ফলে একদিকে যেমন ব্রেন ড্রেন হয়, অন্য দিকে মানি ড্রেনও হয়। এর ব্যতিক্রম হলো মাদ্রাসায় শিক্ষিত লোকজন।
আর উন্নত জীবন ও ভালো শিক্ষা পাওয়ার নামে দেশ থেকে চলে যায় হাজার হাজার কোটি টাকা বৈধ ও অবৈধ দুইভাবেই। বাংলাদেশে থেকেও কিন্তু উন্নত ও ভালো শিক্ষা পাওয়া সম্ভব। এই যে আমার কলেজ ও ইউনিভার্সিটির বড়ো ভাই যিনি বাংলাদেশ রাইফেলস কলেজের অধ্যাপক তার বাংলাদেশ বসবাসরত মেয়ে এবার ঢাকার মাস্টারমাইন্ড স্কুল থেকে ক্যামব্রিজ জিসিএসই পরীক্ষা দিয়ে ৯টির মধ্যে ৯টি সাবজেক্টেই এ* পেয়ে এক অসাধারণ রেজাল্ট করেছে, যা কিনা খোদ যুক্তরাজ্যে বসবাসরত হাতেগোনা কিছু ছেলে মেয়েরা করেছে। এই গল্পটি বলার কারণ হলো দেশে থেকেও কিন্তু ভালো শিক্ষা অর্জন সম্ভব তা বুঝানোর জন্য।
অন্য দিকে আমার দেশের কৃষক, দিন মজুর, গার্মেন্টস শ্রমিক, নিম্ন আয়ের লোক সকল, মধ্যবিত্ত ও বিদেশে কর্মরত শ্রমিকেরা রেমিটেন্স দেশে পাঠিয়ে দেশের অর্থিনীতির চাকা সচল রাখে, তাদের ছেলেমেয়েরা কিন্তু দেশ ছাড়ে না, দেশের টাকা বাহিরে পাচারও করে না। তারাই সত্যিকারের দেশ প্রেমিক, তারা আবার যুযোগ সন্ধানীও নয়।
তবে যে কারণেই দেশ ছাড়ুক না কেন, ইউরোপ – আমেরিকাতে বসবাসের ফলে দুটি দিক লক্ষ্য করা যায়, এক. কিছু লোক আছে যারা দেশে তেমন ধর্ম কর্ম না করলেও বিদেশে এসে ভালো ধর্ম কর্ম পালন করেন। আবার অন্য দিকে দেশে কিছু ধর্ম কর্ম করলেও নানাঃ অজুহাতে বিদেশে এসে ধীরে ধীরে ধর্ম-কর্ম থেকে দূরে সড়ে পরে মনের অজান্তেই, পরবর্তীতে ভিন্নধর্মে (পূর্ববর্তী নবীদের উম্মত) বিশ্বাসীদের সাথে বিবাহ-শাদি করে একই ছাদের নিচে বসবাস শুরু করে এই রকম লোকও একেবারে কম নয়।এভাবেই তারা আহলে কিতাবের অনুসারীদের সাথে জীবন সংসার গড়ে তোলে।
আহলে কিতাবী হচ্ছে সেই সব জাতি যাদের উপর প্রত্যাদেশ সংবলিত ধর্মগ্রন্থ অবতীর্ণ হয়েছিল। যেমন ইহুদিদেরকে তাওরাত ও খ্রিষ্টানদেরকে ইনজিল কিতাব দেওয়া হয়েছিল।যাদের কাছে আগের নবীদের আনা কোন আসমানী কিতাব ছিল, তা বিকৃত বা অবিকৃত যেভাবেই থাক না কেন, তারা তা মেনে চলতো। এই জাতিগুলো প্রধানত আব্রাহামীয় মতবাদে বিশ্বাসী। মূলত ইহুদি ও খ্রীস্ট ধর্মাবলম্বী মানুষদের ইসলামী দর্শন অনুযায়ী আহলে কিতাবী বলা হয়ে থাকে। তারা সেই সময়ে্ অর্থাৎ তাদের নবীদের সময়ে তারা মুসলিম ছিল এবং তাদের ধর্ম ছিল ইসলাম, এতে কোনো সমস্যা বা কোনো দ্বিমত থাকার সুযোগ নেই। সমস্যা শুরু হলো তখন থেকে যখন আহলে কিতাবীরা শেষ নবী মুহাম্মদ (স) কে নবী হিসেবে মেনে নিতে এবং ধর্ম গ্রন্থ কোরানকে মেনে নিতে পারছিলো না। তবে অনেক ইহুদি ও খৃষ্টানরা পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহন করেছিল এবং কুরআনকে একমাত্র জীবন বিধান হিসেবে মেনে নিয়েছিল। পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা আল কাসাস-এর ৫২ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে যে, “যাদেরকে আমি এর আগে কিতাব দিয়েছিলাম তারা এর (কুরআন) প্রতি ঈমান আনে।”যেমন সে সময় হাবশা ও ইয়াসরীবের লোকজন এসে নবী (স)এর কাছে বাইয়াত নিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। যারা পূর্বের নবীকে মানতো এবং পরের আগত নবীকে (মুহাম্মদ (স)ও মেনে নিয়েছে তাদের ইসলামে কোনো ছেদ পড়েনি। তারা পূর্বেও যেমন মুসলমান ছিলো, পরেও তেমনি মুসলমান।
শেষ নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মদ (স)এর মাধ্যমে আল্লাহ্ তাঁর মনোনীত জীবন বিধান ইসলামকে পুরনাঙ্গ করেছেন।তাই পরবর্তী যে কোন নবী-রাসূলের আনীত বিধানের সাথে পূর্ববর্তী কোন নবীর আনীত অবিকৃত ইসলামী বিধানের উপর বিশ্বাস স্থাপন ঈমানের অন্যতম শর্ত। ঠিক তেমনি করে পূর্ববর্তী নবীর উম্মতগণ যদি পরবর্তীকালে আগত কোনো সত্য নবীকে মুহাম্মদ (স) মানতে অস্বীকার করে থাকে তাহলে কেবল তখনই তারা কাফের বা অবিস্বাসী বলে বিবেচিত। এই শ্রেণীগোষ্ঠী বা আহলে কিতাবীরদের সাথে মুসলমানের সম্পর্ক কি হবে বিশেষ করে তাদের সাথে বিবাহ-শাদির সম্পর্ক কেমন হবে তা নিয়েই আজকের আলোচনা। ইসলামী শরিয়ত অনুযায়ী আহলে কিতাবদের জবাই করা পশুর মাংস খাওয়া মুসলিমদের জন্য হালাল যদি তা আল্লাহর নামে জবাই করা হয়, আল্লাহর নাম ছাড়া অন্য কারো নামে জবাই করা হলে তা আর হালাল হবে না। তাছাড়াও তাদের মহিলাদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্কের অনুমতি দিলেও (পরবর্তীতে ফকীহগণ ও সাহাবীরা তা নিরুৎসাহিত করেছেন), ইহুদী খ্রিষ্টানদের উৎসবে মুসলমানদের অংশগ্রহণ না করা, এবং তাদের যেসব বিশ্বাস ও রীতিনীতি ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক সেগুলো প্রত্যাখ্যান করাই হোল ইসলামের রীতি।যেহেতু আহলেকিতাবীরা শেষনবী মুহাম্মদ (স) উপর ঈমান আনেননি, ইসলামকে অস্বীকারকারী, তারা অবাধ্য, ও অবিস্বাসী, তাই তাদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক না রাখাই ইসলামের বিধান। আহলে কিতাবীদের সম্পর্কে পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা আল-মায়েদাহ-এর ৫১ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, “হে মুমিনগণ, তোমরা ইহুদী ও নাসারাকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে তাদের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ্ জালেমদেরকে পথ প্রদর্শন করেন না।”
আহলেকিতাবী ও মুহাম্মদ (স) এর উম্মতগণের মধ্যে বিবাহ-শাদি, ঘর-সংসার জায়েজ কি না এই ব্যাপারে আলেমদের মধ্যে রয়েছে যথেষ্ট এখতেলাফ।কিছু কিছু আলেম মনে করেন এই বিয়ে বৈধ, পাশাপাশি অনেক আলেম মনে করেন যে, এই বিয়ে বৈধ নয়। যারা বিয়ে বৈধ মনে করেন তাঁদের যুক্তি হচ্ছে, যে সব আহলেকিতাবী আল্লাহ্ তা’আলার একত্ববাদের উপর বিশ্বাসী আর মুহাম্মদ (স) উম্মতগণও আল্লাহর একত্ববাদের উপর বিশ্বাসী। পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা আল-মায়েদার ৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে “আজ তোমাদের জন্য সমস্ত পাক-পবিত্র বস্তু হালাল করা হয়েছে। আহলে কিতাবের খাদ্য দ্রব্য তোমাদের জন্য হালাল এবং তোমাদের খাদ্য দ্রব্য তাদের জন্য হালাল। আর সংরক্ষিত মেয়েরা যাদের উপর কিতাব দেয়া হয়েছিল তারা তোমাদের জন্য হালাল, যখন তোমরা তাদের মোহরানা পরিশোধ করে দিয়ে বিবাহ বন্ধনের মাধ্যমে তাদের রক্ষক হবে।” তবে এক্ষেত্রে একটি শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছে যে আহলে কিতাবধারী নারীদেরকে ‘মুহসানাত’(সংরক্ষিত মহিলা) হতে হবে। হযরত উমর (রা)’র মতে ‘মুহসানাত’ অর্থ পবিত্র ও নিষ্কলুষ চরিত্রের অধিকারী মেয়েরা। তিনি অপবিত্র চরিত্রের অধিকারী, স্বেচ্ছাচারী, ও কুলষিত মেয়েদেরকে ‘মুহসানাত’এর বাহিরে ও তাদের সাথে বিবাহ না করার ব্যাপারে তাগিদ দিয়েছেন। এ নির্দেশটির ব্যাপারে ফিকাহবিদদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাসের (রা) মতে আহলেকিতাব বলতে তাদেরকে বুঝানো হয়েছে যারা ইসলামী রাষ্ট্রের প্রজা। অন্যদিকে দারুল হারব ও দারুল কুফরের ইহুদী ও খৃস্টান (নাসারা) মেয়েদের বিয়ে করা জায়েয নয়। হানাফী ফকীহগণের মতে বহির্দেশের আহলে কিতাবের মেয়েদেরকে বিয়ে করা হারাম না হলেও মাকরূহ, এতে কোনো সন্দেহ নেই। হযরত উমরের সময়ে বেশ কিছু ইরাকে বসবাসকারী সাহাবী সেখানে আহলে কিতাবধারী মেয়েদেরকে বিয়ে করে মদিনায় ফিরলে, উমর তাদের প্রশ্ন করেছিলেন যে, কেন তারা আহলে কিতাবধারীদেরকে বিয়ে করলেন? তিনি তাদেরকে আরো জিজ্ঞেস করলেন যে তাহলে মুসলিম মেয়েদেরকে কে বা কারা বিয়ে করবেন? তিনি আহলে কিতাবধারীদের সাথে বিবাহকে অনেকটা হারাম বা নিষিদ্ধ করেছিলেন। আরেকটি বিষয় হলো আল্লাহ্ তায়ালা যেখানে ইহুদী ও খৃষ্টানদের সাথে বন্ধুত্বকে নিষেধ করেছেন, সেখানে তাদের সাথে বিয়ের অনুমোদন বা বৈধতা দেয়ার প্রশ্নটি থেকেই যায়।
এখন প্রশ্ন হলো তাহলে মুসলিম নারী কি আহলে কিতাবধারী পুরুষদেরকে বিয়ে করতে পারবে? এক্ষেত্রে সুরা বাকারার ২২১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন ” … এবং তোমরা (নারীরা) কোন মুশরিক পুরুষের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ো না, যতক্ষণ না পর্যন্ত সে ঈমান আনে। একজন মুসলমান ক্রীতদাসও একজন মুশরিকের তুলনায় অনেক ভাল, যদিও তোমরা তাদের দেখে মোহিত হও।”
এখন সমাজে একটি ট্রেন্ড দ্দেখা যাচ্ছে যে বিবাহ-শাদিকে ইউনিফাইড করার প্রবণতা। এক শ্রেণী আছে যারা বিয়ে-শাদিতে আর বিশ্বাস করছে না, লিভিং টুগেদার, স্টেই ওভার, নাইট স্টেই, নাইট ওভার, কোহেবিট, শেয়ার বেড এন্ড বোর্ড, যেমন লুটে পুটে খাওদাও ফুর্তি করাতেই জীবনকে খুজে নিতে চাচ্ছে।বিবাহ বন্ধনের মতো একটি ইসলামিক, ধর্মীয়, পবিত্র ও সামাজিক বিধানকে অস্বীকার করছে। আবার আরেক শ্রেণী হলো নিজের ধৰ্মমতে বিয়ে না করে ভিন ধর্মী মানুষে বিয়ে করে সমাজে উদারতার দৃষ্টান্ত স্হাপন করতে চায়, সিনেমা পল্লীতে এর সংখ্যাটা বেশি। আরেকটি গোষ্ঠী হলো নিরাপত্তাহীনতার অজুহাত দিয়ে বিয়ে না করে থাকা অথচ যেখানে বিয়েকে সবচেয়ে বেশি নিরাপদ, মানুষের শান্তি, আবেগ, অনুভূতি ও নিরাপত্তার জায়গা বলা হয়েছে। বিয়ে-শাদি, পরিবার ও পরিজনের মধ্যেই প্রশান্তি রয়েছে বলে সমাজ বিজ্ঞানীরা মত দিয়েছেন। থাকে সে কথা, সেটি আবার আরেক আলোচনা। ফিরে যাই মূল কথায়।
এতো কিছুর পরেও কিন্তু আহলে কিতাবধারীদের সাথে বিবাহ থেমে নেই, বিশেষ করে ইউরোপ, আমেরিকা ও পাশ্চাত্যের দেশ সমূহে। তাদের সাথে বিয়ে-শাদি হলে সমাজে অদূর ভবিষ্যতে কি প্রভাব পড়তে পারে তা তুলে ধরাই হোল আজেকের লিখার মূল কথা। দেখে নেই কি কি প্রভাব পড়তে পারে।
বাংলাদেশে আহলে কিতাবীদের সাথে বিয়ে-শাদি তেমন একটা চোখে না পড়লেও পাশ্চাত্যে হর হামেশাই দেখা যায়।এই বিয়ে-সাদীর মধ্যে ভালো দিকের চেয়ে মন্দ দিকটাই বেশী পরিলক্ষিত হয়। বর্তমান সময়ের অধিকাংশ ইসলামিক স্কলারগণ আহলে কিতাবীদের সাথে বিবাহ কে বর্তমান সময়ে অবৈধ বলে মত দিয়েছেন, কেউ কেউ এই বিবাহকে মাখরুহ বলেছেন। খৃস্টান ধর্মেও এই বিবাহকে নিষেধ করা হয়েছে। পৃথিবীর প্রায় ২৯টি মুসলিম দেশ এই ধরণের ইন্টারফেইথ বিবাহকে নিষেধ করেছে।
পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় যে বাংলাদেশ থেকে পাশ্চাত্যের দেশে স্থায়ী ভাবে বসবাস করতে যাওয়া, অথবা পড়ালেখা করতে আসা, অথবা কাজ করতে এসে পরবর্তীতে স্থায়ী ভাবে থেকে যাওয়া লোকেরাই বেশির ভাগ সময়ে আহলে কিতাবধারীদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় বিভিন্ন কারণে। এই সমস্ত শ্রেণীর লোকেরা যদিও তারা নিজেরা কোনো রকমে এই ধরনের বিয়ের প্রভাব থেকে বেচে গেলেও তাদের পরবর্তী, সেকেন্ড জেনারেশন বা থার্ড জেনারেশন কোনো না কোনোভাবে আহলে কীদাবিদের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে ও ধর্ম বিসর্জন দিয়ে থাকে; যদি না তাদের খুবই স্ট্রং মোরাল, ধর্মীয় ও পারিবারিক শিক্ষা এবং বন্ধন না থাকে। ২০১০ সালে আমেরিকাতে পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, আমেরিকাতে প্রায় ৪২% ইন্টারফেইথ বিবাহ হয়ে থাকে (শুধুমাত্র মুসলিম ও অমুসলিমদের মধ্যেই নয়, বরং অমুসলিম ও অন্য অমুসলিমের মধ্যেও ইন্টারফেইথ বিবাহ হয়ে থাকে) কোনো রকম পূর্ব-ধারণা ছাড়াই।
হযরত উমরের সেই প্রশ্ন, আমাদের মুসলিম মেয়েকে কে বিয়ে করবে? আর আহলে কিতাবধারীদের সাথে যাদের বিবাহ হয়েছে, গবেষণায় দেখা যায় তাদের পারিবারিক সম্পর্ক খুবই ভঙ্গুর হয়ে থাকে, সর্বদা কলহ-বিবাদ বিদ্যমান থাকে, পরিবারে অশান্তি ও দুই মেরুর টানা পোড়ন চলতে থাকে। ওই সমস্ত পরিবার থেকে কখনো কোনো ভালো মানের আলেম বা ইসলামিক স্কলার জন্মায় না।
আহলে কিতাবধারীদের মধ্যে একজন তার সঙ্গীর উপর নিজের বিশ্বাস বা ধর্মকে চাপিয়ে দেওয়া চেষ্টা করে, একই ঘরে দুই ধর্মের লোকের বসবাস হওয়ায় কোনো ধর্মই ভালো ভাবে চর্চা করা হয় না বা চর্চার পরিবেশ থাকেনা। বা অনেক সময় ধর্ম চর্চা নিয়ে স্বামী-স্ত্রী বিবাদে জড়িয়ে পরে, পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধার অভাব দেখা দেয়, সীমাহীন ভাবে নিজের ধর্ম, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও ধর্মীয় মূল্যবোধের চর্চা থেকে ক্রমেই সরে পড়ে, পিতা-মাতার মধ্যে অশুভ প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করা যায় যে প্রত্যেকেই তার নিজ ধর্ম বাচ্চাদের উপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে, যার ফলাফল হয় খুবই ক্ষতিকর। এই ধরণের আরেকটি নেতিবাচক দিক হলো স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকে না। সবচেয়ে বড় সমস্যা দেখা দেয় যখন তাদের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ হয় এবং সেই ঘরে যদি কোনো বাচ্চা থাকে।
বাচ্চা যদি ছোট থাকে, ভালোভাবে না বুঝে বা অল্প বয়সী হয়ে থাকে তখন এ বাচ্চা কার সাথে থাকবে, তা নিয়ে দেখা দেয় এক মহা সমস্যা, এমনকি কোর্ট কাচারী পর্যন্ত করতে হয়। অধিকাংশ সময়ই দেখা যায় বাচ্চা ছোট থাকার কারণে তাকে মায়ের কাছেই দিয়ে দেয়া হয়। আর সেই বাচ্চা ক্রমান্বয়েই মায়ের ধর্মের প্রতি আসক্ত হয়, যদিও বাচ্চাটির জন্ম হয়েছিল মুসলিম পিতার ঔরসে এবং বাচ্চাটি জন্মসূত্রে মুসলিমও ছিল কিন্তু পিত-মাতার মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদের কারনে সে আহলে কিতাবধারী মায়ের সাথে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত নিজ ধর্ম ইসলাম থেকে দূরে সরে যায়, বা খৃস্টান ও ইহুদি ধর্মের চর্চা শুরু করে, অথবা কোন ধর্মই পালন করে না, যা খুবই দুঃখ জনক।
আবার পাশ্চাত্যের দেশ সমূহে এও দেখা যায় মুসলিম স্বামী ও খৃস্টান/ইহুদি স্ত্রী মধ্যে বিবাহ স্থায়ী হয়েছে কিন্তু সন্তাদের উপর বিভিন্ন কারণে মায়ের প্রভাব বেশি থাকার ফলে সেই সংসারেও ছেলেমেয়রা পিতার মুসলিম ধর্ম (যেহেতু জন্মসূত্রে মুসলিম) চর্চা না করে মায়ের খৃষ্ট বা ইহুদি ধর্ম চর্চা করে এবং শেষ পর্যন্ত মুসলিম ধর্ম থেকে ছিটকে পড়ে।
এইতো বেশী দিন আগের কথা নয়, মাত্র ১৯৪০ সালের গোঁড়ার দিকের কথা, আমেরিকার ৪৪তম প্রেসিডেন্ট বারাক হোসেন ওবামার কথা বলছি। যার পূর্ব পুরুষেরা ছিল মুসলিম, তার দাদা-দাদি ছিল মুসলিম, তার বাবাও ছিল মুসলিম। কিন্তু তার বাবা যখন খৃস্টান মিশনারী স্কুলে পড়তো তখন তিনি স্কুলের স্টাফদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে কেনিয়ার Anglicanism ধর্ম গ্রহণ করেন।তিনি তখন তার নাম বারাকা থেকে বারাক গ্রহণ করেন এবং তিনি পরবর্তীতে আর কোনো ধর্মই পালন করতেন না। বারাক ওবামার পিতা সিনিয়র ওবামা ১৯৬৪ সালে Ruth Beatrice Baker কে বিয়ে করেন যেই বিয়েটি মাত্র চার বছর থাই হয়ে ছিল এবং তাঁদের ঘরেই জন্ম নেয় আমেরিকার ৪৪তম প্রেসিডেন্ট বারাক হোসেন ওবামা, যিনি খ্রিস্টান ধর্মকেই নিজের ধর্ম বলে পালন করেন।
এবার আসি বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের দাদা ওসমান কেমাল এবং তার বাবা আলী কেমালের কথায়, যারা ছিল মুসলিম।আলী কেমাল যখন সুইজারল্যান্ডে ছিলেন তখন সে ভালবেসে Winifred Brun কে বিয়ে করে যাদের ঘরে জন্ম নেয় ওসমান কেমাল। ওসমান কেমাল বিয়ে করেছিলেন Irene Williams কে। তাদের ঔরসে বরিসের বাবা স্যান্টলি জনসন এর জন্ম হয়। এথেকে দেখা যায় বোরিসের দাদা ওসমান কেমাল মুসলিম হয়েও আহলে কিতাবধারী এক খ্রিস্টান রমণী Irene Williams কে বিয়ে করেছিলেন। যেহেতু Irene Williams এর এরিস্টোক্রেটিক ফ্রেঞ্চ ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল বিধায় ওসমান কেমাল কখনই তার উপন তেমন প্রভাব রাখতে পারেননি বা ধর্ম কর্মেও কোনো আপত্তি করেননি। যার ফলে তাদের ওসমান কেমাল ও Irene Williams থেকেই বরিস জনসনের খৃস্টান বাবা স্ট্যানলি জনসনের জন্ম হয়।
আরেকটি একবারে টাটকা উদাহরণ দেই, প্রো ইসরাইলি ব্রিটেনের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাজিদ জাভিদ ১৯৯৭ সালে প্রণয়সূত্রে Laura King নামক খৃস্টান ভদ্র মহিলাকে বিয়ে করেন। সাজিদ জাভিদ যেখানে কোনো ধর্ম-কর্ম করেন না, তার নিকট হালাল-হারামের কোনো বালাই নেই, বা সে নিজেও যখন নিজেকে না মুসলিম না খৃস্টান মনে করে, সেখানে তার স্ত্রী Laura King নিয়মিত চার্চে বা গির্জায় যায় এবং খৃষ্টধর্ম পালন করে। ৩০শে এপ্রিল ২০১৮ Christian today প্রকাশিত সাজিদ জাভিদের এক ঐতিহাসিক উক্তিতে তিনি বলেছিলেন – সে ও তার চার ভাই বেড়ে উঠেছিলেন ঈশ্বরকে বিশ্বাস করে, কিন্তু সে কোনো ধর্ম মেনে চলে না, তার স্ত্রী খৃস্টান ধর্ম পালন করে এবং তার বাসায় একমাত্র খৃস্টান ধর্মেরই চর্চা হয়।তাহলে দেখা যায় তার তিন মেয়ে ও এক ছেলে জন্মসূত্রে মুসলিম হয়েও খৃস্টান ধর্ম পালন করছে।এই হোল আহলে কিতাবধারী সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পরিনাম।এই রকম ভুরি ভুরি বারাক হুসেইন ওবামা, বরিস জনসন ও সাজিদ জাভিদের উদাহরণ দেয়া যাবে।
আমাদের দেশেও কিন্তু এমন ঘটনা যে একেবারে নেই তা কিন্তু নয়।আমাদের দেশেও অনেক নামকরা লোকজনের সন্তানেরাও আহলে কিতাবধারীদের সাথে ঘর সংসার করছে। তাদের ভিতরের অবস্থা আসলে কি তা অনেকটাই ধোঁয়াশা। আবার পত্রিকা মাধ্যমে প্রায়ই খবরের শিরোনাম হয় ব্রাজিল, পুর্তুগাল, জার্মানি ও আমেরিকার কন্যা প্রেমের টানে সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে গিয়ে বাংলাদেশী ছেলেদের সাথে সংসার শুরু করে কিন্তু রোমন্স বা হানিমুন পিরিয়ড শেষ হলে তারাও চম্পট দেয়, পত্রিকা আর সেই সংবাদটি কষ্ট করে প্রচার করে না।
আমরা যারা পশ্চিমা দেশে বসবাস করি, বা ছেলে মেয়েদের উন্নত লেখা-পড়া, বা উন্নত ভবিষ্যত গড়ার জন্য প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে ছেড়ে ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও নিউজিল্যান্ডে বসবাসের জন্য প্রতিনিয়ত পাড়ি জমাচ্ছি, তাদেরকে একটু হলেও চিন্তা করতে হবে যে আমাদের ভবিষ্যত বংশধররা উন্নত শিক্ষা গ্রহণের অন্তরালে আবার না যেন ধর্মত্যাগী হয়ে উঠে। আবার না তারা আহলে কিতাবীদের সাথে ঘর সংসার শুরু করে দিয়ে পরবর্তীতে বা তাঁদেরই পরবর্তী জেনেরেশনে যেন বারাক ওবামা, বরিস জনসন ও সাজিদ জাভিদ না হয়ে উঠে।
যুক্তরাজ্যের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় UCL এর গবেষণায় দেখা যায় যে আহলে কিতাবধারীর মধ্যে যে বিবাহ সংঘঠিত হয় তাদের মধ্যে দুটি সমস্যা বেশি পরিলক্ষিত হয় এক. এই সমস্ত দম্পতিদের মধ্যে কেউ না কেউ স্বামী বা স্ত্রীর ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত হয় অথবা সেই ধর্ম গ্রহণ করে এবং দুই. তাদের মধ্যে ধর্মহীন জীবন শুরুহয়। এই গবেষণায় আরো দেখা যায় যে বাংলাদেশী এবং পাকিস্তানী ইয়াং জেনেরেশনের (পুরুষের মধ্যে ৫.৫% এবং মহিলারদের মধ্যে ২%) আহলে কিতাবীদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার প্রবণতা অন্য যে কোনো সংখ্যা লঘু কমিউনিটির তুলনায় অনেক বেশি। আবার এর মধ্যে Tower Hamlets,Westminster, Kensington, Chelsea, Leicester, Bradford-এ এই বিবাহের হার সবচেয়ে বেশি। এই গবেষণায় আরেকটি বিষয় যা সকলের চোখ কপালে উঠার মতো, আহলে কিতাবধারী দম্পতির মধ্যে কেউ একজন যদি খ্রিস্টান হয় এবং অন্যজন যদি খ্রিস্টান ব্যতীত অন্য ধর্মী হয়, তাহলে তাদের মধ্যে যে সমস্ত সন্তানাদি হয় তাদের ৪০% কোনো ধর্মেই বিশ্বাস করে না বা No Religion বিশ্বাসী হয়।আরও দেখা যায় যে খ্রিস্টান-মুসলিমের মধ্যে যে বিয়ে হয় তাদের সন্তানদের মধ্যে ৩৩% খৃস্টান হয়, ২৮% মুসলিম হয়, এবং ৩৯% কোনো ধর্মেই(No Religion) বিশ্বাস করে না। এই তথ্য উপাত্ত থেকে দেখা যায় যে আহলে কিতাবধারিদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার এক করুন পরিনতি যা মুলত ধর্ম হীনতা বা ধর্ম বিসর্জন অথবা নিজ ধর্ম ইসলাম ত্যাগ করে পরবর্তী জেনারেশন খ্রিস্ট/ইহুদি ধর্ম গ্রহন করা।
বাংলাদেশে থেকেও যে ভাল শিক্ষা অর্জন বা ভালো রেজাল্ট করা সম্ভব তা আমি লিখার শুরুতেই বলেছি। পশ্চিমা দেশে বসবাস বা উন্নত শিক্ষা গ্রহণ দোষের কিছু নয়, তবে সে ক্ষেত্রে পিতা-মাতাকে আরো বেশি যত্নশীল, ও দায়িত্ববান ভূমিকা পালন করতে হবে। পিতা-মাতাকে সর্বদা খেয়াল রাখতে হবে তাদের সন্তানদের উপর। দিতে হবে নৈতিক, ইসলামিক ও মূল্যবোধের শিক্ষা। তাদের সামনে তুলে ধরতে হবে সত্যিকার ইসলামের সৌন্দর্য, একেকটি পরিবারকে গড়ে তুলতে হবে ইসলামী কৃষ্টি-কালচারের সমন্বয়ে এক আদর্শ পরিবার। পরিবারই হলো মৌলমানবিক ও ইসলামী শিক্ষার সূতিকাগার, পরিবার থেকে যদি ইসলাম প্র্যাক্টিস করার যুযোগ পায় এবং পিত-মাতা যদি নিজেরা ধর্ম-কর্ম পালন করে সন্তানের সামনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন, তাহলে সন্তানেরাও ধর্ম-কর্ম করতে উদ্বুদ্ধ হবে এবং পরবর্তী জীবনেও ইসলাম মেনে চলতে সচেষ্ট থাকবে।
পরিশেষে ইবনে আল জাওযি (র) এর একটি উক্তি দিয়ে আজকের আলোচনার ইতি টানছি, তিনি বলেন “A person who truly fears his lord does not care about others and does not put himself in a position where his religion is at risk-যে ব্যক্তি সত্যিকার অর্থে আল্লাহকে ভয় করে, সে অন্য লোকে কি মনে করলো তা নিয়ে চিন্তা করে না এবং নিজেকে এমন কোনো অবস্থায় পড়তেও দেয় না যেখানে তার ধর্মের ঝুঁকি রয়েছে”।ইসলামের অনুশাসনেই রয়েছে শান্তি, সমৃদ্ধি আর কল্যান। কেবলমাত্র বিবেকবানরাই তা উপলব্দি করতে পারে।
লেখকঃ ওয়াহিদ মুহাম্মাদ মাহবুব, সলিসিটর, ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস