ব্রিটেনের কিচেনে বাংলার রাজনীতি !
রাজনীতির সাথে বাঙালীর দুধেভাতে সম্পর্ক।রক্তমাংসে মিশে আছে রাজনীতি। রাজনীতি ছাড়া বাঙালীর ভাত হজম হয় না। জীবন অচল, অর্থহীন। সবকিছুতেই রাজনীতি।শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই রাজনীতি বুঝে।নেতানেত্রী বুঝে। দল বুঝে।মার্কা বুঝে।প্রার্থীর চরিত্রও বুঝে।আমার বিশ্বাস পৃথিবীর আর কোন জাতি বাঙালীর মতো এতো রাজনীতিপ্রেমি নয় ! কিন্তু এতো প্রেম থাকলে কি হবে, নেগেটিভটাই বেশি বুঝে এবং বেছে নেয় উল্টো পথ।অর্থাৎ দলাদলি,বিভক্তি, রেষারেষি, কোন্দল এবং কাঁদা ছোঁড়াছুঁড়ি।আর বিতর্ক তো আছেই।জাতির পিতা, স্বাধীনতার ঘোষক, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক-এসব বিতর্ক চলছে যুগ যুগ ধরে।এতো বিতর্কসৃষ্টিকারী জাতি বাঙালী ছাড়া আর কে হতে পারে ! অথচ এই বাঙালীরাই ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন করেছে মুক্ত স্বদেশের জন্য। দখলদার পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে দুর্বার আন্দোলন করেছে।সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ফলশ্রুতিতে ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনও করেছে ঐক্যবদ্ধ চেতনায়। প্রতিটি গণতান্ত্রিক এবং ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে বাঙালীর স্বত:স্ফুর্ত এবং ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের সমৃদ্ধ ইতিহাস এখনো জ্বাজল্যমান ।
বস্তুতপক্ষে এখানে আলোকপাত করতে চেয়েছি ব্রিটেনের ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টগুলোর কিচেনের রাজনীতি এবং আনুসাঙ্গিক অন্যান্য বিষয় প্রসঙ্গে। কিন্তু অবধারিতভাবেই যেন বাংলার রাজনীতির বিষয়বস্তু শুরুতে চলে এসেছে।কারণ এসব কিচেনে কাজ করেন বাঙালীরা ।ব্রিটেনের মতো একটি উন্নত এবং উদার গণতান্ত্রিক ও চরম সভ্য দেশে অবস্থান করেও আমরা নোংরা রাজনীতির খোলস থেকে বেরিয়ে আসতে পারিনি কিংবা বের হওয়ার চেষ্টাও করিনা। ফলশ্রুতিতে অশুভ রাজনীতির কালোছায়ার চক্রবাঁকে ঘুরপাক খাচ্ছি প্রতিনিয়ত।
প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, ব্রিটেনের ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টগুলোর শতকরা নব্বইভাগই বাংলাদেশী মালিকানাধীন। এই রেস্টুরেন্টগুলোর শতকরা পঁচানব্বই ভাগের গাভনার অর্থাৎ মালিক হচ্ছেন সিলেটী। সংখ্যাধিক্য কর্মীরাও সিলেটী। বলা যায় সিলেটীদের একচ্ছত্র আধিপত্য পুরো ব্রিটেনজুড়ে।
যাক, কিচেনে যে ধরনের রাজনীতি প্রত্যক্ষ করা যায় তার কিছু চিত্র তুলে ধরার প্রয়াসে মূলত এ নিবন্ধটির অবতারণা। আগেভাগে বলে রাখি সব কিচেনের অবস্থা যে সমান তাও নয়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কাকতালীয় মিলের ঘটনা লক্ষ্যনীয়।কিন্তু বাস্তবতা তুলে ধরতে গেলে কিছু অপ্রিয় সত্য চলে আসবে।তারজন্য কেউ ব্যথিত হলে আগাম ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। কারো প্রতি অনুরাগ বা বিরাগ নয়, শুধুমাত্র বাস্তব চিত্র তুলে ধরার প্রয়াস চালিয়েছি মাত্র।
ব্রিটেনের ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টগুলোর কিচেনে পরিলক্ষিত হয় নানাবিধ রাজনীতি।তা পর্যায়ক্রমে তুলে ধরছি।
শেফের কর্তৃত্ব: কিচেনের কর্মীরা থাকেন বিভিন্ন পদে সমাসীন।কিচেন পোর্টার, কুক, তান্দুরী শেফ, সেকেন্ড শেফ এবং মেইন শেফ।অবশ্য ব্যবসার ভিজি’র উপরে কর্মী নিয়োগ দেন গাভনার। বেশিরভাগ কিচেনে ৪/৫জন কর্মী থাকেন নিয়মিত।প্রায় সব কিচেনে অবধারিতভাবে শেফের কর্তৃত্ব বিরাজমান। এক কথায় শেফের হুকুমে চলে পুরো কিচেন; এমনকি গাভনাররাও শেফকে তোয়াজ করে চলেন। কারণ শেফের উপরই ব্যবসা অনেকটা নির্ভরশীল। শেফ ইচ্ছে করলে ব্যবসায় ধ্বস নামাতে পারেন, আবার চাঙ্গাও করে দিতে পারেন । তাই শেফকে সচরাচর বিগড়াতে চান না কেউ। এই সুযোগটাই নেন অনেক শেফ (তবে সবাই নন)। তারা অন্যান্য কর্মীর সাথে দুর্ব্যবহার করতেও কুন্ঠাবোধ করেন না, বিশেষ করে কিচেন পোর্টার এবং কুক-এর উপর দিয়ে যায় সব ঝড় ।অনেক কিচেনে মাঝেমধ্যে লংকাকান্ডও ঘটে থাকে ! মূলত কারো কাগজজনিত সমস্যা কিংবা দেশ থেকে নতুন আগত মাইগ্র্যান্ডরা রোষানলের স্বীকার হন বেশি।তবে যারা শেফকে তোয়াজ করে চলেন, বিনা বাক্যব্যয়ে সব নির্যাতন-যাতনা সহ্য করে যান তারা সুবিধা পান বেশি এবং কাজও দ্রুত শিখে নিতে পারেন এবং তাড়াতাড়ি প্রমোশনও লাভ করেন। প্রমোশন অর্থাৎ কিচেন পোর্টার থেকে কুক, কুক থেকে সেকেন্ড শেফ বা তান্দুরী শেফ এবং তান্দুরী শেফ থেকে মেইন শেফ। প্রমোশনের সাথে বেতনও বৃদ্ধি পায়।তবে প্রমোশনের জন্য বেশিরভাগ কর্মীকে রেস্টুরেন্ট বদলাতে হয়। কেউ কেউ আবার সমান রেস্টুরেন্টে থেকে যান দীর্ঘদিন সমান পোস্টে অথবা প্রমোশন লাভ করে।
গ্রুপিং: কিচেনের কর্মীদের সাথে ওয়েটারদের একটা মনস্তাত্বিক দ্বন্দ্ব থাকে।কিচেনের কর্মীরা কাজ করেন বেশি। প্রায় সময়ই তাদের নানাবিধ কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। সে তুলনায় ওয়েটারদের কাজ কম এবং হাল্কা থাকে। কিচেনের কর্মীরা সব ভারী এবং কষ্টের কাজ করেন। কাস্টমার এলে ওয়েটাররা ব্যস্ত থাকেন।নতুবা ইউনিফর্ম পরে বাবু সেজে ঘোরাঘুরি করেন।বসে থাকেন।গল্পগুজব করেন কিংবা মোবাইল নাড়াচাড়া করেন। এসব বিষয় কিচেনের বেশিরভাগ কর্মী মেনে নিতে পারেন না !
খাবার দ্বন্দ্ব : কিচেনের কর্মীরা খাবার প্রস্তুতির সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকেন বলে যখন তখন যা খুশি খেতে পারেন। সেক্ষেত্রে ওয়েটাররা কাঙালের মতো ধর্না দেন কিচেন কর্মীদের পিছু পিছু। কিচেন কর্মীদের মর্জি মেজাজ ভাল থাকলে সাথে সাথে খাবারের ব্যবস্থা করেন, নতুবা ক্ষুধার্থ থেকে রেস্টুরেন্ট বন্ধ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষার প্রহর গুনতে হয় ওয়েটারদের।অবশ্য বেশিরভাগ রেস্টুরেন্টে কর্মীরা কাজের ফাঁকে ফাঁকে পালাক্রমে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাতের খাবার সম্পন্ন করেন।
রাজনীতি: কিচেনের রাজনীতির পরিবেশ থাকে ভয়াবহ । এখানে বেশিরভাগই আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি সাপোর্টার। শুক্র- শনিবার রেস্টুরেন্ট বেশি ভিজি থাকায় আলোচনা কিংবা তর্ক-বিতর্ক হয় কম। বাকী পাঁচদিন কিচেন থাকে উত্তপ্ত; অর্থাৎ রাজনৈতিক পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করে। এক পক্ষ অন্য পক্ষকে ঘায়েল করতে সত্যমিথ্যা যা আছে সব তুলে ধরেন। কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি হন না। সবাই নিজ দলীয় আদর্শে অটল থেকে কঠোর ভাষায় তর্কযুদ্ধ চালিয়ে যান। তাদের ভাষা প্রয়োগে মনে হবে নিজ দলের প্রধানরাও এমন ভাষা কিংবা মনোভাব পোষণ করেন কিনা সন্দেহ।তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো এসব লড়াকু রাজনৈতিক কর্মীদের অনেকেই কখনো কোনকালে সরাসরি রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন না কিংবা জড়িতও থাকেন না। কেউ কেউ অন্য দল ভাল পান না বলে বিরোধী পক্ষে অবস্থান নেন এবং তেজি মনোভাব পোষণ করেন।
মতৈক্য: কিচেনে রাজনৈতিক লড়াইয়ের পর রাতে খাওয়ার পরে একসাথে আবার সবাই আড্ডা দেন। টিভি দেখেন। আনন্দ শেয়ার করেন। কেউ কেউ রাত জেগে ডমিনো, ক্যারম কিংবা কার্ড (তাস) খেলেন। কেউবা আবার দেশে বিদেশে ফোনালাপে রাত কাটান।কেউবা আত্মীয় পরিজন, কেউবা স্ত্রী, কেউবা প্রেয়সীর সাথে মান অভিমান আবেগ কিংবা ভবিষ্যত পরিকল্পনার ফুল ফোটান। ভোরের সূর্য উঁকিঝুঁকি দেয়ার প্রাক্কালে কেউ কেউ ঘুমান। তারপর লম্বা একটা ঘুম দিয়ে দুপুর একটা/দুইটায় উঠেন। হাতমুখ ধুয়ে কিংবা গোসল-নামাজ পড়ে কেউ কেউ কাজে নেমে যান।কাজের ফাঁকে ফাঁকে কিছু খান। আস্তে আস্তে কাস্টমারদের জন্য কুকিং-এর ব্যবস্থা করতে থাকেন।
স্টাফ কারী: রেস্টুরেন্টের কর্মীদের খাবারের জন্য আলাদা রান্না করা হয়।এটাকে ‘স্টাফ কারী’ বলে।অপ্রাসঙ্গিক হলেও বলতে হচ্ছে কিচেন কর্মীরা কাস্টমারদের জন্য রকমারী রান্নাবান্না করেন কিন্তু নিজেদের জন্য রান্না করতে খুবই বিরক্তিবোধ করেন। একজন অন্য জনের হাতের দিকে তাকান। গড়িমসি করতে দেখা যায় প্রায়ই। অর্থাৎ নিজেরা তেমন ভাল খেতে উদ্যোগী হন না। কোন রকমে কিছু খেয়ে চালিয়ে দেন কর্মময় দিনগুলো !
সত্যি বলতে কি ব্রিটেনের রেস্টুরেন্ট কর্মীরা প্রচুর শ্রম দেন।প্রচন্ড শীতের মধ্যেও ঘামে ভেজা থাকেন। খেয়ে না খেয়ে দিনাতিপাত করেন । সপ্তাহ শেষে পাউন্ড পেয়ে বেশির ভাগ কর্মী পাঠিয়ে দেন দেশে, আত্মীয় পরিজনের কাছে। নিজে শখ করে দামী কাপড় পরেন না, ভাল কিছু খানও না।অবশ্য সবাই যে তা করেন তাও ঠিক নয়, তবে বেশিরভাগের অবস্থা এরকম।
শেষ করবো আমার এক বন্ধুর আবেগময় উক্তি দিয়ে। তিনি প্রায়ই বলেন, ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টগুলোতে যারা কাজ করেন তাদের কষ্ট যাতনা দেখলে কোন মায়ের মুখে ভাত যাবে না ! কথাটি কিন্তু মোটেও অমূলক নয়।