জো বাইডেনের ক্ষমতা গ্রহণের পূর্বেই বিশ্ব রাজনীতিতে পরিবর্তনের হাওয়া
মধ্য এশিয়ার এরাবিয়ান পেনিনসুলার অনেকটা দ্বীপরাজ্যের মতো ছোট্র একটি দেশ কাতার, যার সরকারি নাম হলো স্টেট অফ কাতার, আরব ভূখণ্ডের খুবই ছোট্র একটি স্বাধীন দেশ। বাংলাদেশের সমসাময়িক সময়ে ১৯৭১ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ কলোনী থেকে মুক্ত হয়ে বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন সার্বোভৌম দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। অল্প সময়ের ব্যবধানে ওই একই বছরে দেশটি জাতিসংঘের সদস্য পদও লাভ করে। শুধুমাত্র পার্শ্ববর্তী দেশ সৌদি আরবের সাথে স্থলপথে যোগাযোগ সমৃদ্ধ ছোট্র এই দেশটির আয়তন হলো ১১৫৮১ বর্গ কিঃমিঃ যা আয়তনের দিক দিয়ে পৃথিবীর ১৫৮তম দেশ (বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১৩ভাগ ছোট একটি দেশ)। জাতিসংঘের ২০১৯ সালের রিপোর্ট অনুসারে কাতারের মোট জনসংখ্যা হলো ২৮৩২০০০ জন, জনসংখ্যার দিকদিয়ে পৃথিবীর ১৩৯তম দেশ। তেল ও গ্যাস সমৃদ্ধ একটি ধনী দেশ যেখানে বলা চলে কোনো গরিব লোক নেই, আর তাদের মাথাপিছু আয় অনেক বেশি। পৃথিবীর নামকরা সংবাদ মাধ্যম আল-জাজিরার প্রধান কার্যালয়ের অবস্থান এই দেশে। আল-জাজিরা সংবাদ মাধ্যমকে নিয়েই মূলত আরব ভূখণ্ডের অন্যান্য দেশ সমূহ সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও সৌদি আরবের যত মাথা ব্যথা। সন্ত্রাসবাদের মদদদাতা, ফিলিস্তিনকে সহযোগিতা করা, হামাসের সহযোগিতা ও মুসলিম ব্রাদারহুডের সাথে সম্পর্কের অভিযোগে সৌদি কর্তৃত্বাধীন মধ্য এশিয়ার অন্যান্য দেশ সমূহ সর্বদাই কাতারের পিছু লেগে আছে। কাতার তাদের এই অভিযোগকে সর্বদাই অস্বীকার করে আসছে।
অন্যদিকে ইয়েমেন সরকারকে সমর্থন ও সাহায্য সহযোগিতা করে আসছে সৌদি আরব আর বিদ্রোহীগ্রুপ হুথীদেরকে সমর্থন করছে ইরান। রিয়াদ সরকার চায় যে তাদের এই কাজে কাতারও সহযোগিতা করুক, কিন্তু দোহা সরকার বরাবরই সৌদির এই অন্যায় আবদারকে অগ্রাহ্য করেছে। এরই জের ধরে কাতারের সাথে গত ৫ই জুন ২০১৭ সালে, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন এবং মিশর সমস্ত কূটনৈতিক এবং বাণিজ্য সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করেছে মার্কিন মুল্লুকের প্রেসক্রিপশনে। সৌদি সরকার কাতারের একমাত্র স্থলসীমা বন্ধ করে দেয়, পার্শ্ববর্তী দেশসমুহের নৌ ঘাঁটিতে কাতারের জাহাজের নোঙর বন্ধ করে নৌবন্দর ব্যাবহার নিষিদ্ধ করে। এই নিষেধাজ্ঞার অবসানের শর্ত হিসাবে দেশগুলি ১৩ টি দাবি নিয়ে কাতারের সামনে উপস্থিত হয়েছিল। এর মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য ছিল আল জাজিরা এবং কাতারের অর্থায়নে পরিচালিত অন্যান্য সংবাদপত্র বন্ধ করা, ইরানের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক হ্রাস করা, কাতারে অবস্থিত তুর্কি সামরিক ঘাঁটি বন্ধ করা এবং অন্যান্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কাতারকে হস্তক্ষেপ না করা।কাতার তাদের কোনো শর্ত মেনে নেয়নি। ফলশ্রুতিতে কাতারের সাথে আরব দেশ সমূহের বানিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা চলতে থাকে।তবে ছয় সদস্যের উপসাগরীয় সহযোগিতা কাউন্সিলের (Gulf Co-operation Council,GCC)অপর দুটি রাষ্ট্র কুয়েত ও ওমান নিরপেক্ষ থেকে কাতারের সাথে তাদের নিয়মতান্ত্রিক সম্পর্ক বজায় রেখেছিলো।এর মধ্যে ইরান এবং তুরস্ক ত্রাণকর্তা হিসেবে এগিয়ে আসে আর কাতারও তাদের সাথে নতুন বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলে। আঙ্কারা সরকার সৌদি নেতৃত্বাধীন এই অবরোধের তীব্র সমালোচনা করে একে অনৈসলামিক বলে অভিহিত করেছিলো এবং কাতারের পাশে থাকার আশ্বাসও পুনর্ব্যক্ত করেছিলো। ইরান সরকারও কাতারের জন্য তাঁদের আকাশসীমা ও স্থল বন্দর উমুক্ত করেছিল, যার ফলে দুই দেশের মধ্যে গড়ে উঠে এক অভুত সম্পর্ক।
গত ৫ই জানুয়ারী ২০২১ সৌদী আরবে সমাপ্ত হলো GCC সম্মেলন যেখানে কাতারের আমির তামিম আল থানি অংশগ্রহণ করেন।কুয়েতের নিরলস প্রচেষ্টা আর তুরস্কের ঐকান্তিক সহযোগিতায় সৌদি ও কাতারের মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়ন পরিলক্ষিত হয় যারই ফলস্বরূপ এবারের GCC সম্মেলনে অবশেষে সৌদি আরব কাতারের উপর থেকে তাদের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। আমিরাত, বাহরাইন ও মিশরও তাদের নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে সম্মত হয়েছে।
হঠাৎ অতিদ্রুত কেন এই পরিবর্তন? সৌদিই বা কেন কাতারের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে মরিয়া হয়ে উঠেছে? আপনাদের নিশ্চই মনে আছে ওয়াশিংটন পোস্টের বিশিষ্ট সাংবাদিক সৌদি সরকারের একজন কঠোর সমালোচক জামাল খাশোগগির কথা। তুরস্কের রাজধানী ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটের ভিতরে সৌদি এজেন্টদের একটি দল জামাল খাশোগগিরকে নির্মম ভাবে হত্যা করেছিল ২রা অক্টোবর ২০১৮ তারিখে।গোটা বিশ্ববাসি এই হত্যাকাণ্ডের জন্য সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের (যিনি এমবিএস নামে বেশি পরিচিত)দিকে সন্দেহের তীর উত্তোলন করেন বা এমবিএসকে দায়ী করেন। যদিও রিয়াদ সরকার অস্বীকার করে এটিকে একটি “দুর্বৃত্ত অপারেশন” বলে প্রচারের অপচেষ্টা করে এবং পরবর্তীতে ১১ জন নামহীন ব্যক্তিকে বিচারের মুখোমুখি করে বিচারের নামে এক নাটক মঞ্চস্থ করে।সমগ্র পৃথীবি যখন এমবিএসকে দায়ী করেন তখন তাকে উদ্ধারের জন্য এগিয়ে আসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং এরই মধ্য দিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট এমবিএসের কাছ থেকে মিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নেন। মার্কিন মুল্লকে ক্ষমতার পালা বদলের সাথে সাথে জামাল খাশোগগির হত্যার ও ন্যায় বিচারের ও কাতারের উপর নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি আলোচনায় চলে আসে। আমেরিকার সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে যেহেতু Republican Partyর ভরাডুবি এবং Democratic Party থেকে জো বাইডেন আমেরিকার ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে কিছু দিনের মধ্যেই শপথ নিতে যাচ্ছেন, তাই দ্রুত সময়ের মধ্যেই এমবিএস আমেরিকাকে একটি বার্তা দিতে চায় যে রিয়াদের সাথে আরব ভূখণ্ডের অন্যান্য দেশে সমূহের সাথে সুসম্পর্ক রয়েছে।যেহেতু এমবিএসের পূর্বেকার কর্মকাণ্ডগুলোকে Democratic Party ভালোভাবে দেখেনি, এবং জো বাইডেনের ফরেন পলিসি কি হবে GCC অঞ্চলে, এ নিয়ে চরম উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা রয়েছে এমবিএসের মধ্যে; তাই জো বাইডেন ক্ষমতা গ্রহণের আগেই রিয়াদ তাকে এই বলে আস্বস্থ করতে চায় যে তাঁদের সাথে উপসাগরীয় অন্যান্য দেশ সমুহের সঙ্গে সুন্দর ও ভালো সম্পর্ক বজায় রয়েছে।
নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলেই যে কাতার ও সৌদি সম্পর্ক ভালো হয়ে যাবে তা বলা খুবই মুশকিল হলেও GCC অঞ্চলে যে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে সেটি অনেকটা নিশ্চিত।তবে আসলেই তাদের সাথে সম্পর্কের উন্নতি হবে কিনা এই নিয়ে রয়েছে যথেষ্ট রকমের সন্দেহ। কেননা গত ৪০ বছরেও এই সকল দেশের মধ্যে একটি সুন্দর সম্পর্ক পৃথিবীবাসী তাদের কাছ থেকে দেখতে পায়নি। বরং প্রতিটি দেশের সাথেই রয়েছে ইন্টারনাল সমস্যা।
কাতারের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে সৌদির দৌড় ঝাঁপ আমাদেরকে কেন যেন ভাবতে বাধ্য করে যে গোটা পৃথিবী যখন নিজ নিজ দেশের করোনা (কোভিড-১৯) মোকাবেলায় এবং নিজ দেশের জনকল্যানে বেশি ব্যতিব্যস্ত সেখানে মধ্য এশিয়ার দেশ, বিশেষ করে সৌদি আরব মার্কিন সরকারের তোষামোদী করে তাদেরকে তুষ্ঠ রেখে ক্ষমতার চেয়ার যেন নড়বড়ে না হয় সেদিকেই বেশি তটস্থ, এমবিএসের বক্তব্যে তেমনটাই পরিলক্ষিত হয়েছে।জো বাইডেনকে নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোও রয়েছে এক অস্বস্থির মধ্যে, কেমন হবে নতুন মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি, কোন দল তার বেশি পছন্দনীয়, কাকে তারা ক্ষমতায় দেখতে চায় এ নিয়ে শুরু হয়েছে জল্পনা কল্পনা।ক্ষমতাশীল সরকার চাইছে তাদের মতো করে নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টের সাথে উষ্ণ সম্পর্ক তৈরি করতে।
আমেরিকার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ক্ষমতায় আসীন হওয়ার আগেই ভূরাজনীতিতে পরিবর্তন শুরু হয়েছে।মার্কিন তোষামোদ হোক বা আর যাই হোক আমরা সৌদি-কাতার সম্পর্ক উন্নয়নকে ইতিবাচক হিসেবেই বিবেচনা করতে চাই।ঠিক যেমনটি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ স্যামুয়েল রামানি(Samuel Ramani) বলেছেন “কাতার, সৌদি আরব, বাহরাইন এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের মধ্যকার উত্তেজনা দূরীকরণের ফলে কোভিড-১৯ মহামারীর দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক পরিণতি মোকাবিলার জন্য জিসিসি রাষ্ট্রসমূহের ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে এবং অর্থনৈতিক বৈচিত্র্যকরণ কৌশলগুলিতে সহযোগিতা সহজ হবে”।
এক মুসলিম রাষ্ট্র কর্তৃক অন্য মুসলিম রাষ্ট্রের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ ও সম্পর্ক ছেদ করা ইসলামিক রীতি-নীতি বহিঃর্ভুত।আমাদের বিশ্বাস এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ কখনো পরস্পর পরস্পরের মধ্যে বিভক্তি, বিভাজন, বিচ্ছিন্নকরণ ও উত্তেজনা শেখায় না বরং আমরা দেখতে পাই আমাদের মধ্যে বিভিন্ন কারনে মতপার্থক্য থাকলেও আমাদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সাধারণ বিশ্বাস রয়েছে যার ভিত্তিতে একে অন্যের সাথে, এক দেশ অন্য দেশের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করে।এক মুসলিম অন্য মুসলিমের সাথে সুন্দর সুসম্পর্কের মাধ্যমে এক উম্মাহ গঠনে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে।
লেখকঃ ব্যারিস্টার ওয়াহিদ মুহাম্মাদ মাহবুব, সলিসিটর, ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস