মৃত্যু অবধারিতঃ করোনা নয় ভয় করুন স্রষ্টাকে
একদিন দুপুরে হযরত সুলাইমান (আ.) তার শাহী দরবারে বসে আছেন। এমন সময় এক লোক হন্তদন্ত হয়ে সেখানে ছুটে এল। লোকটি আল্লাহর নবীকে দেখেই হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। হযরত সুলাইমান তার এরকম অবস্থা দেখে খানিকটা অবাক হয়ে গেলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে তোমরা? এমন করছ কেন? কী চাও তুমি?”
লোকটি বহু কষ্টে নিজেকে সামনে নিয়ে বলল: “হে আল্লাহর নবী! হে মহান বাদশাহ!! আমাকে আজরাইলের হাত থেকে বাঁচান। আমি আজ আজরাইলকে দেখেছি। আমার দিকে ভীষণ ক্রোধের সঙ্গে তাকিয়ে ছিল। আমাকে ভয় দেখিয়ে পাশ কেটে চলে গেল। আমার ভয় হচ্ছে আজরাইল আবার ফিরে আসব এবং আমার জান কবজ করে নেবে।”
হযরত সুলাইমান নবী লোকটিকে অভয় দিয়ে বললেন, “এতে ভয়ের কী আছে! আজরাইল হচ্ছেন আল্লাহর মহান ফেরেশতা। তিনি কেবল আল্লাহর হুকুমেই জান কবজ করেন। আমি তো প্রায় প্রতিদিনই আজরাইলকে দেখি কিন্তু কই আমি তো ভয় পাই না। যাইহোক, এখন বলো, তোমার জন্য আমি কী করতে পারি, তুমিইবা কী চাও?”
লোকটি বলল: “আপনি ভয় না পেলে কী হবে, আমি আজরাইলকে ভীষণ ডরাই। কিন্তু আজ তার রাগ দেখে আরও ভয় করছে। তার কাছ থেকে আমি বাঁচতে চাই। লোকেরা বলে থাকে বায়ু সুলায়মান নবীর হুকুম পালন করে। এখন আপনি বায়ুকে হুকুম করুন আমাকে এ দেশ থেকে দূরে নিয়ে যাক। মানুষ একথাও বলে থাকে যে, সুলাইমান বাদশাহ মানুষের চাওয়া-পাওয়া পূরণ করে থাকেন। এখন আমার দাবি হল- বাতাসকে এক্ষুণি হুকুম দিন আমাকে হিন্দুস্তান নামক দেশে নিয়ে যাক। আমি চাই আজরাইল যেহেতু এদেশে আমার ঠিকানা জেনে গেছে সেহেতু এদেশে আর থাকব না। আপনি দয়া করে আমাকে হিন্দুস্তানে পাঠানোর ব্যবস্থা করুন।”
হযরত সুলাইমান (আ.) বেচারার কাকুতি-মিনতি ও কান্নাকাটি দেখে বললেন, “বেশ ভালো কথা। জীবন-মরণের ভার আমার হাতে নেই। তবে বায়ু আমার কথা শুনে থাকে। যাও তোমার দাবি আমি পূরণ করব। এক্ষুণি বায়ুকে বলছি তোমাকে হিন্দুস্তানে নিয়ে যাক।”
হুকুম পেয়ে বাতাস লোকটিকে হযরত সুলাইমানের গালিচায় বসিয়ে কয়েক মুহূর্তেই বনবাদাড়, মরু সাহারা, নদ-নদী ও সাগর-দরিয়া পার হয়ে হিন্দুস্তানের এক শহরে পৌঁছে দিল।
সেদিন পার হল। পরের দিন হযরত সুলাইমান তার দরবারে বসে আছেন। এমন সময় হযরত আজরাইল (আ.) সেখানে উপস্থিত হলেন। তাকে দেখেই সুলাইমান নবী জিজ্ঞেস করলেন, “হে আজরাইল! গতকাল এক লোক ভীত অবস্থায় আমার দরবারে এসেছিল এবং তোমার বিরুদ্ধে নালিশ করেছে। সে বলেছে, তুমি নাকি তার দিকে মারাত্মক ক্রোধের দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল! লোকটি আমার কাছে অনুরোধ জানাল আমি যেন বাতাসকে নির্দেশ দেন যাতে তাকে ওই মুহূর্তেই এই শহর থেকে হিন্দুস্তানে পৌঁছে দেয়। আমি তাকে হতাশ করতে চাইনি। বাতাসকে তার ইচ্ছেমতো হিন্দুস্তানে পৌঁছে দিতে হুকুম করলাম। এখন সে হয়ত হিন্দুস্তানেই আছে। কিন্তু আমি খুব তাজ্জব হয়েছি যে, আল্লাহর এত বড় একজন ফেরেশতা হয়ে তুমি কেন তাকে ভয় দেখালে। বেচারা তোমার ভয়েই আজ ঘরবাড়ি ও দেশছাড়া হল।”
হযরত সুলাইমানের কথা শুনে আজরাইল (আ.) বললেন, “আমি আল্লাহর হুকুম পালন ও তার আদেশ মানা ছাড়া আর কিছুই করি না। ওই লোকটির প্রতি আমি রাগ করে কিংবা ক্রোধের দৃষ্টিতে মোটেই তাকাইনি। সে ঠিকই বলেছে, আমি তাকে গতকাল এই বায়তুল মুকাদ্দাস শহরে দেখেছি। তার প্রতি আমি যে দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম তা আসলে বিস্ময়ের দৃষ্টি ছিল। কারণ আল্লাহর নির্দেশ ছিল গতকালই যেন হিন্দুস্তানে তার জান কবজ করি। তাই তাকে তার মৃত্যুর মাত্র কয়েক মুহূর্ত আগে বায়তুল মুকাদ্দাসে দেখে ভীষণ আশ্চর্য হয়ে যাই যে, কী করে সে এখন এই এলাকায় ঘোরাফেরা করছে! তাকে দেখে আমি মনে মনে ভাবলাম, তার যদি শত শত পাখাও গজায় তাহলেও সে আছরের আগে হিন্দুস্তান পৌঁছুতে পারবে না। যাইহোক, যেহেতু তখনো তার মরণের সময় উপস্থিত হয়নি সেহেতু খুব আশ্চর্য হয়েই তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম এবং পাশ কেটে হিন্দুস্তানে চলে গেছি। কিন্তু সময়মতো হিন্দুস্তানে পৌঁছেই দেখি সেখানে নির্ধারিত স্থানে হাজির! এরপর আর দেরি না করে তার জান কবজ করে নেই।”
সব শুনে হযরত সুলাইমান (আ.) বললেন, একদম ঠিক কথা। সব কিছু থেকে পালানো সম্ভব কিন্তু মৃত্যুর হাত থেকে পালানো সম্ভব নয়। তার সেই মুহূর্তে অবশ্যই হিন্দুস্তানে থাকা দরকার ছিল। কিন্তু বায়ু ছাড়া তাকে সেই মুহূর্তে সেখানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। সে নিজেই নিজ ইচ্ছায় আমার কাছে ছুটে এল এবং নিজের মুখেই কাকুতি-মিনতি করে নিশ্চিত পরিণতির দিকে ছুটে গেল।
এই হচ্ছে আমাদের দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবণ। অথছ এই ক্ষুদ্র জীবণকে নিয়ে কতই না অহঙ্কার আমাদের। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পাঠানো অদৃশ্য এক শত্রু আজ চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে কতো তুচ্ছ আমরা। আমাদের এই শক্তি, সময় অথবা সভ্যতার বড়াই এর সবকিছুই ঠুনকো প্রমাণিত। আমি যে দেশে থাকি তারা নিজেদের বিশ্ব সভ্যতার মোড়ল হিসাবে দাবী করে। অথছ আজ পর্যন্ত করোনা ভাইরাসে এই নিধিরাম সর্দাররা কেমন নাস্তানাবুদ হয়েছেন তার পরিসংখ্যান কি জানেন। এখন পর্যন্ত কোভিড-১৯ ভাইরাসে তাদের আক্রান্তের সংখ্যা তিন মিলিয়ন ছাড়িয়েছে এবং মৃতের সংখ্যা প্রায় তিন অঙ্ক ছুঁই ছুঁই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই নীল রক্তধারী অভিজাত জাতী এতো ক্রাইসিসে কোনোদিন পড়ে নি। যে National Health Service (NHS) নিয়ে তারা অনেক গর্ব করতো তা বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হিমশিম খাচ্ছে। হাসপাতালগুলোতে তিল ধরনের জায়গা নেই। এম্বুলেন্স সময়মতো রুগীদের কাছে পৌছতে পারছে না। অনেক এলাকায় হাসপাতালে বেডের অভাবে চিকিৎসা চলছে এম্বুলেন্সেই। কবরস্থাগুলোতে মৃত্যুর মিছিল। একই পরিবারের ভাইয়ের পর ভাই, মা-মেয়ে, বাবা-ছেলে অথবা স্বামী-স্ত্রী অবুঝ সন্তানদের রেখে মৃত্যু বরণ করছেন। যেখানে কবরে শুয়ানোর পর আমাদের একা হওয়ার কথা সেখানে করোনা আক্রান্ত একজন ব্যক্তি মৃত্যুর পূর্বেই একা হয়ে যাচ্ছে। পরিবার পরিজন, আত্মীয় স্বজন কাছে ঘেষতে পারছে না। এরচেয়ে দুঃখজনক আর কি হতে পারে আমাদের জীবণে।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআন পাকে এরশাদ করেন “তোমরা যেখানেই থাক না কেন; মৃত্যু কিন্তু তোমাদেরকে পাকড়াও করবেই। যদি তোমরা সুদৃঢ় দূর্গের ভেতরেও অবস্থান কর, তবুও। বস্তুতঃ তাদের কোন কল্যাণ সাধিত হলে তারা বলে যে, এটা সাধিত হয়েছে আল্লাহর পক্ষ থেকে। আর যদি তাদের কোন অকল্যাণ হয়, তবে বলে, এটা হয়েছে তোমার পক্ষ থেকে, বলে দাও, এসবই আল্লাহর পক্ষ থেকে। পক্ষান্তরে তাদের পরিণতি কি হবে, যারা কখনও কোন কথা বুঝতে চেষ্টা করে না”। (সূরা আন নিসা: ৭৮)
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের টাইমলাইনগুলো কে কখনও মনে হচ্ছে মৃত্যুর স্কোর কার্ড আর কখনও মনে হচ্ছে বিরান ভূমি। এই মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায় তা একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামীনই ভালো জানেন। আমাদের শক্তিমত্তা, বিত্ত বৈভব ও সভ্যতার এই মিথ্যা অহঙ্কার বা বড়াই সবকিছুই ইতোমধ্যে ঠুনকো প্রমাণিত হয়েছে। একের পর এক পরিচিত লোকজন চলে যাচ্ছেন। যদিও মৃত্যু বা রোগাক্রান্তদের খবরের হতাশা প্রচার করে আরো বেশি আতঙ্কগ্রস্থ কাউকে করতে চাই না। বরং মানসিক শক্তি ও আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল বৃদ্ধির জন্য কাজ করাই আজ বেশী প্রয়োজন। একমাত্র তাঁর রেজাবন্দি ও নৈকট্যই আমাদের এই মহাবিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারবে।
আল্লাহ পাকের উপর তাওয়াক্কুলের পাশাপাশি এই মহামারী থেকে বাঁচার জন্য সকল ধরণের প্রস্তুতিও থাকতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি ও সরকারের গাইডলাইন মেনে চলতে হবে। আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল কেমন হবে এ ব্যাপারে রাসুল সাঃ এর কয়েকটি সুন্দর হাদিসের মধ্যে একটি আপনাদের জন্য তুলে ধরছি। একবার এক বেদুইন হযরতের দরবারে আসলেন। হযরত তাকে জিজ্ঞাসা করলেন তোমার বাহন উট কোথায় রেখেছ? বেদুইন সাহাবি বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! মসজিদের বাইরে খোলা অবস্থায় রেখেছি। আমি আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করেছি। আল্লাহই দেখবেন আমার উট। হযরত (সা.) তখন বললেন, আগে তোমার উটের পা বাঁধ, তারপর তাওয়াক্কুল কর।
একমাত্র সেই রাজাধিরাজই পারেন পুরা দুনিয়াকে এই মহামারী থেকে উদ্ধার করতে। তাই কায়মনোবাক্যে আসুন তার কাছেই বলি –
اللَّهمَّ إِنِّي أَعُوُذُ بِكَ مِنَ الْبرَصِ، وَالجُنُونِ، والجُذَامِ، وسّيءِ الأَسْقامِ.
বাংলা উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইন্নি আ’য়ুজুবিকা মিনাল বারাছ, ওয়াল জুনুন ওয়াল জুযাম, ওয়া সায়্যিইল আসক্বাম।
বাংলা অর্থ: হে আল্লাহ, আমি তোমার নিকট ধবল, কুষ্ঠ এবং উন্মাদনা সহ সব ধরনের কঠিন দূরারোগ্য ব্যাধি থেকে পানাহ চাই।
(লেখকঃ সোয়ালেহীন করিম চৌধুরী)