গণতন্ত্র ফিরিয়ে দিন : খালেদা জিয়া
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, জুলুম নির্যাতন বন্ধ করে গণতন্ত্র ফিরিয়ে দিন। নয়াপল্টনে ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ উপলক্ষে আয়োজিত জনসভায় যোগ দিয়ে তিনি বলেন, কথায় কথায় নতুন আইন করা হয় শুধুমাত্র বিরোধী দলকে বন্দি করা রাখার জন্য।
৫ জানুয়ারি গণতন্ত্র হত্যা দিবস উপলক্ষে আজ মঙ্গলবার বেলা ২টা থেকে রাজধানীর নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশের আয়োজন করে বিএনপি। দীর্ঘ এক বছরের বেশি সময় পর উন্মুক্ত স্থানে বড় ধরনের কোনো রাজনৈতিক সমাবেশে এই প্রথম যোগদান করলেন খালেদা জিয়া। নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে মঙ্গলবার দুপুর ২টা ১০ মিনিটে পবিত্র কোরআন তেলোয়াতের মাধ্যমে সমাবেশ শুরু হয়। দলীয় চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দুপুর ২টা ৫০ মিনিটে মঞ্চে উপস্থিত হন।
৫ জানুয়ারির নির্বাচন করে গণতন্ত্রকে হত্যা করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। বেগম জিয়া বলেন, ৫ জানুয়ারি দেশে কোনো নির্বাচন হয়নি। সেদিন কোনো ভোট হয়নি। জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। সরকার যেমন অবৈধ ও সংসদও অবৈধ। জনগণ যখন ভোট দিতে পারেনি, ভোট ছাড়া নির্বাচিতদের জনগণের প্রতিনিধি বলা যায় না। সরকার বৈধ নয় বলে যে কাজ করছে তা অবৈধ। সরকারের আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন মেরুদন্ডহীন। প্রত্যেকটি নির্বাচনে দেখেছি প্রধাননির্বাচন কমিশনার আওয়ামী লীগের কাছে শেখ হাসিনার কাছে সাহায্য চায়। তাহলে ব্যর্থ ও অসহায় বলে পদ ছেড়ে দেয়া উচিত।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি কুকুরই ভোট দিয়েছিল বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, ৫ জানুয়ারি ভোট কেন্দ্রে কোন ভোটার ছিলনা, যেহেতু ভোটার ছিলনা সে কারণে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীরও প্রয়োজন ছিলনা। অনেক কেন্দ্রে তাই কুকুরকে পাহারা দিতে দেখা গেছে। যেহেতু ভোটার কেন্দ্রে যায়নি সুতরাং তাদের (আওয়ামী লীগের) দাবিকৃত ভোট কুকুরই দিয়েছিল।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর যে নির্বাচন হয়েছিল তা পাতানো ছিল বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, মঈন উদ্দিন-ফখরুদ্দিনের দু’বছরের সকল অপকর্ম আড়াল করার কমিটমেন্ট দিয়ে পাতানো নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। পৌর নির্বাচনে জনগণ ভোট কেন্দ্রে এসে নিজের পছন্দমত ভোট দিতে পেরেছে বলেই বিএনপির মেয়র প্রার্থীরা বিপুল ভোটে জয়ী হয় বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া।
তিনি বলেন, বিগত সিটি নির্বাচনে বিএনপি মেয়র প্রার্থীদের জনপ্রিয়তা দেখে ভয় পেয়ে আওয়ামী লীগের গুন্ডারা জাল ভোট দিয়ে নিজেদের প্রার্থীদের জয়ী করে নেয়।
খালেদা বলেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মানুষ হত্যা করে দেশে রাজতন্ত্র কায়েম করার চেষ্টায় আছে। বহু চেষ্টা করেছেন। এর আগে একবার চেষ্টা করেছেন একদলীয় শাসন কায়েম করার। এখন আবার করছেন। মানুষ গুম করে, খুন করে রাজতন্ত্র কয়েম করার যে চেষ্টা আপনারা করছেন, আমার মনে হয় তা কোনো ভালো ফল বয়ে আনবে না।
তিনি বলেন, গণতন্ত্রকে হত্যা করা হয়েছে বলে প্রতিবছর সমাবেশ করতে আইন হলে সকলের জন্যে হওয়া উচিত। তারা জনগণকে ভয় পায় বলে সমাবেশের স্থান বেঁধে দেয়। এই সরকার শুধু গণতন্ত্রই হত্যা করেনি, মানুষকেও গুম-খুন করে চলছে। তাদের সব কাজই অবৈধ। আমরা এই গণতন্ত্র হত্যা দিবসে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করতে চেয়েছিলাম; কিন্তু সেই সুযোগ গতবার আমাদের দেয়া হয়নি। এবারই অনুমতি দিলো, তাও কয়েক ঘণ্টা আগে।
সমাবেশের অনুমতি দেয়ার সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়ে তিনি সরকারকে বাকি গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে দিতে আহ্বান জানান। তিনি বলেন, অনেক দিন পর সামনে আসতে পেরে আমিসহ সবাই আনন্দিত ও উৎফুল্ল।
খালেদা জিয়া বিশ্বের বিভিন্ন স্বৈরশাসনের উদাহরণ টেনে বলেন, আপনারা টিকতে পারবেন না; একদলীয় শাসনের পথ থেকে ফিরে আসুন; গণতন্ত্রের পথে আসুন। আপনারা সরকারের অন্যায় আবদার মানবেন না, অন্যায়ের পথ থেকে ফিরে আসুন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ একটি ছোট দেশ; আমরা সবাই মিলেমিশে থাকতে চাই। সবাই মিলেই দেশকে এগিয়ে নিতে চাই। সরকারকে গুম, খুন বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, গুম, খুন করে কেউ ক্ষমতায় থাকা যায় না। কেউ থাকতে পারেনি। সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘দয়া করে সঠিক পথে আসুন। কারণ জনগণ কখন জেগে উঠবে কেউ বলতে পারে না।
অবিলম্বে জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, যেহেতু এখন আপনারা (আওয়ামী লীগ) সরকারে আছেন, নির্বাচনের উদ্যোগ নেয়ার দায়িত্ব আপনাদেরই।
খালেদা জিয়া বলেন, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ, দেশের মানুষ চায় আমরা একসঙ্গে কাজ করি। আমরাও তা-ই চাই। দেশের প্রয়োজনে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে বলেও উল্লেখ করেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী।
‘আওয়ামী লীগ প্রতিহিংসার রাজনীতি করে’। তারা দেশের মানুষকে যন্ত্রনার মধ্যে রেখেছে। দেশে সাংবাদিকদের মূল্যায়ন করা হয় না। তাদের কাজে বিভিন্ন কায়দায় বাধা দেয়া হয়। দেশে অনেক টিভি চ্যানেল থাকলেও তারা ঠিকভাবে চাকরী পাচ্ছেন না। সাগর-রুনির হত্যার বিচার হয়নি, একমাত্র শিশুর খবর কেউ রাখে না ।
মানুষ সত্য কথা বলতে পারে না, মুখ খুলতে পারে না। এদেশের মানুষ টকশো দেখে। সেখান থেকে মানুষ অনেক কিছু জানতে পারত। কিন্তু সেগুলো এখন নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। সরকারের বিরুদ্ধে কিছু বললেই তার বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হবে। টকশোতে কথা বলায় মামলা হয়েছে, মামলার কারণে দেশ ছাড়তে হয়েছে।
শিক্ষকদের অবহেলা করার সুযোগ নেই। তাদের যথাযোগ্য সম্মান দিতে হবে। শিক্ষকসহ সব ক্যাডারকে অবহেলা করা হচ্ছে। দু-একটা ক্যাডারকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এভাবে বৈষম্য বাড়ানো হচ্ছে। এভাবে শান্তি আসবে না।
খালেদা জিয়ার বক্তব্যের এক পর্যায়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভ্যাট বিরোধী আন্দোলন নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, ছাত্রদের প্রতিবাদ সারা দেশে ছড়িয়ে যাবে, নিয়ন্ত্রণে থাকবে না এমন ভয় পেয়ে ভ্যাট প্রত্যাহার করেছে সরকার।
মঞ্চের সামনে থাকা ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে খালেদা জিয়া বলেন, কাজেই ছাত্ররা, তোমাদের বলি, তোমাদেরকে কথা শুনলে, হাত তালি দিলে, স্লোগান দিলে হবে না। দেশ প্রেম থাকতে হবে। দেশটা শেষ হয়ে যাচ্ছে। তোমাদের জেগে উঠতে হবে। আমি বলি না মারামারি-গোলাগুলি-বোমাবাজি করা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য সোচ্চার হতে হবে, সকলকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
বিএনপির চেয়ারপারসন বলেন, ভ্যাট বিরোধী আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগের একজন নেতা বলেছিলেন, বাঘে ধরলেও ছাড়ে, কিন্তু ছাত্ররা ধরলে ছাড়ে না। ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, কাজেই তোমরা যখন ধরবা, তারপর আর যেন না ছাড়ে বিদায় করে ছাড়বা।
শিল্প-কারখানাকে বাঁচাতে হবে। অনেক শিল্প কল-কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে গেছে। গার্মেন্ট শিল্প ধ্বংসের পথে। সমাবেশে বিএনপি নেতা মাহমুদুর রহমান মান্নার মুক্তি চেয়েছেন বেগম খালেদা জিয়া।
মঞ্চে নির্দিষ্ট সংখ্যক আসন রাখা হয়েছে। সেখানে উপস্থিত আছেন- বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ, মাহবুবুর রহমান, আ স ম হান্নান শাহ, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, সেলিমা রহমান, আবদুল্লাহ আল নোমান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার মাহবুব হোসেন, এ জেড এম জাহিদ হোসেন ও অ্যাডভোকেট জয়নাল আবেদিন।