লকডাউন তুলে ব্রিটেন কি ভুল করছে ?

Spread the love

বাংলা সংলাপ ডেস্কঃ কোভিড মহামারি শুরুর পর এই প্রথম ব্রিটেন আগামী সপ্তাহে এমন এক পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে, যার ফল দেখার জন্য তাকিয়ে আছে বিশ্বের অনেক দেশ। প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ঘোষণা দিয়েছেন, ১৯শে জুলাই হতে ইংল্যান্ডে সব কর্মকাণ্ড চালু হবে, প্রায় সব কোভিড বিধিনিষেধ উঠে যাবে।

তিনি এই দিনটিকে তাই ব্রিটেনের জন্য ‘ফ্রিডম ডে’ বা স্বাধীনতা দিবস বলে বর্ণনা করছেন।

এর আগে আরও কিছু দেশও কোভিড লকডাউন শিথিল করেছে। কিন্তু ব্রিটেন হচ্ছে বিশ্বের প্রথম কোন দেশ, যারা জনসংখ্যার এক বিপুল অংশকে টিকা দেয়ার পর বিধিনিষেধ তুলতে যাচ্ছে ( ব্রিটেনে বৃহস্পতিবার, ১৫ জুলাই পর্যন্ত ৮৭.৪ শতাংশ মানুষ টিকার প্রথম ডোজ, এবং ৬৬.৭ শতাংশ দুটি ডোজ পেয়েছে)।

কাজেই এই টিকা মহামারিকে থামাতে আসলেই কাজ করছে কী-না, তার একটি পরীক্ষা হবে ব্রিটেনে।

দ্বিতীয় আরেকটি কারণেও ব্রিটেনের দিকে সারা দুনিয়ার বিশেষজ্ঞদের নজর। ইংল্যান্ডে সব বিধিনিষেধ তুলে দেয়া হচ্ছে এমন এক সময়ে, যখন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ছে নাটকীয়ভাবে, লাফিয়ে লাফিয়ে।

সর্বশেষ তথ্যে দেখা যাচ্ছে, বুধবার পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় আরও ৪২ হাজারের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। অগাস্ট মাস নাগাদ সংক্রমণের দৈনিক সংখ্যা লাখে পৌঁছাতে পারে এমন আশঙ্কাও আছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কোভিড-১৯ বিষয়ক বিশেষ দূত ডেভিড নাভারো বিবিসিকে বলেন, ব্রিটেন লকডাউন খুলে দেয়ার মাধ্যমে যে পরীক্ষাটি চালাতে যাচ্ছে, সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের অনেক দেশই ব্রিটেনের দিকে নজর রাখে জনস্বাস্থ্য বিষয়ে দেশটির বিশেষায়িত জ্ঞান এবং উচ্চমানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার কারণে।

“কাজেই আগামী এক মাস ব্রিটেনে কী পরিস্থিতি দাঁড়ায়, সেদিকে অনেক দেশই তাকিয়ে আছে”, বলছেন তিনি।

তবে তিনি কোভিড-১৯-এর বিষয়ে তিনটি কড়া হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন।

প্রথমত, তার মতে, এই করোনাভাইরাসটি খুবই বিপদজনক। দ্বিতীয়ত: সারা বিশ্বে এই মহামারি এখনও সাংঘাতিক জোরালোভাবে ছড়াচ্ছে। আর তৃতীয়ত: এই মহামারি এখনও তার সবচেয়ে খারাপ পর্বটি পার করেছে বলে তিনি মনে করেন না।

‘স্বাভাবিক প্রাণচাঞ্চল্য’
লন্ডনের প্রাণকেন্দ্রে রাস্তাগুলো এখন প্রায় আগের মতই ব্যস্ত বলে মনে হয়, যেমনটা দেখা যেত করোনাভাইরাস মহামারি শুরুর আগে।

১৯শে জুলাই থেকে ইংল্যান্ডের প্রায় সব কোভিড-১৯ বিধিনিষেধ উঠে যাচ্ছে, যদিও ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের কারণে সংক্রমণ খুব দ্রুত বাড়ছে।

সরকার এই দিনটিকে ‘ফ্রিডম ডে’ বা স্বাধীনতা দিবস বলে বর্ণনা করলেও সমালোচকরা সব কিছু খুলে দেয়ার এই সরকারি সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে বলছে, এটি খুবই ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন’ এবং জুয়া খেলার মতো একটা কাজ হতে যাচ্ছে।

ওই দিন থেকে ইংল্যান্ডে সব নৈশক্লাব খুলে যাবে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার নিয়ম আর থাকবে না। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কত লোককে আমন্ত্রণ জানানো যাবে, তার ওপর যে বিধিনিষেধ চলমান, সেটাও উঠে যাবে।

বেশিরভাগ জায়গায় আর মাস্ক পরতে হবে না, তবে লন্ডনের বাসে-ট্রেনে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলকই থাকছে।

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলছেন, যুক্তরাজ্যের টিকাদান কর্মসূচি যেহেতু অনেক এগিয়ে আছে, তাই পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়ার জন্য দেশ এখন প্রস্তুত।

তিনি বলেছেন, কোভিডের কারণে আরও মানুষের মৃত্যু হতে পারে, আরও অনেককে হাসপাতালে ভর্তি হতে পারে। কিন্তু তিনি মনে করেন বাকী বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য “এটাই সঠিক সময়।”

কিন্তু ব্রিটিশ সরকারের এই সিদ্ধান্তের ঝুঁকি অনেক।

সংক্রমণ এখনও বাড়ছে
যুক্তরাজ্যে কোভিডের সংক্রমণ এখন বেশ দ্রুত হারেই বাড়ছে।

গত জানুয়ারিতে অনুমান করা হচ্ছিল যে যুক্তরাজ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত প্রতি ১০ জনের একজনকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হচ্ছে, আর আক্রান্ত প্রতি ৬০ জনের মধ্যে একজনের মৃত্যু ঘটছে।

আর এখন প্রতি ৪০ হতে ৫০ জনের মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ঝুঁকি একজনের, আর মৃত্যুর ঝুঁকি প্রতি ১০০ জনে একজনের।

যুক্তরাজ্যে প্রাপ্তবয়স্কদের প্রায় ৮৭ শতাংশ অন্তত একটি করে টিকার ডোজ পেয়েছেন, আর পুরোপুরি টিকা দেয়া হয়েছে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠীকে।

যুক্তরাজ্যে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টি সরকারের প্রথম পরিকল্পনা ছিল ইংল্যান্ডে ১২ই জুন হতে সবধরণের বিধিনিষেধ তুলে দেয়া। কিন্তু পরে এটি পিছিয়ে দেয়া হয় যাতে করে আরও বেশি মানুষকে টিকা দেয়া সম্ভব হয়।

প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেছেন, মহামারি এখনও শেষ হয়নি, কাজেই সতর্কতা অবলম্বন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

‘সীটবেল্ট ছুঁড়ে ফেলা হচ্ছে’
তবে সমালোচকরা বলছেন, সরকার যদিও তার কথাবার্তায় এখন কিছুটা রাশ টেনে ধরেছে, তারপরও সবকিছু খুলে দেয়ার এই পরিকল্পনা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।

লেবার পার্টির একজন এমপি জোনাথান অ্যাশফোর্ড বলেছেন, “সরকার একদিকে যেন গাড়ির এক্সিলারেটর পা দিয়ে জোরে চেপে ধরে আছে, অন্যদিকে সীটবেল্ট খুলে ছুঁড়ে ফেলছে।”

পরিবহণ শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্ব করে যে ট্রেড ইউনিয়ন, সেই ‘ইউনাইট ইউনিয়ন’ বলেছে, গণপরিবহনে মাস্ক পরার নিয়ম তুলে দেয়া একটা ‘চরম অবহেলার’ কাজ। কারণ মাস্ক পরলে সেটি ব্যবহারকারী যেমন নিরাপদে থাকেন, তেমনি গণপরিবহণের কর্মীরাও নিরাপদ বোধ করেন।
ব্রিটিশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান ডাঃ চান্দ নাগপাল বলেন, সরকারের এই সিদ্ধান্ত খুবই ‘বিপদজনক’ এবং এর একটা ‘মারাত্মক বিধ্বংসী পরিণতি’ হতে পারে।

এর আগে তিনি এই বলে সরকারের সমালোচনা করেছিলেন যে, সরকার ‘জনগণের মধ্যে এ রকম একটা প্রত্যাশা তৈরি করেছে যেন আমরা কোভিড-পূর্ববর্তী এক সমাজে আছি, যেখানে কাউকেই সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য কোন পদক্ষেপ নিতে হবে না।”

ইম্পেরিয়াল কলেজ, লন্ডন এক সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখতে পেয়েছে, ২০শে মে হতে ৭ই জুন এবং ২৪শে জুন হতে ৫ই জুলাইয়ের মধ্যে সংক্রমণ চারগুণ বেড়েছে – এটা মোটামুটি সেই সময় যখন ইউরো ২০২০-এর খেলাগুলো হচ্ছিল।

এতে দেখা গেছে, প্রতি ছয় দিনে সংক্রমণ দ্বিগুন বাড়ছিল, এবং এই প্রথম পুরুষদের মধ্যেই (৩০ শতাংশ) তা বেশি ঘটছিল।

ইউনিভার্সিটি অব লেস্টারের একজন ভাইরোলজিস্ট ডঃ জুলিয়ান ট্যাং বলেন, সরকার আসলে টিকার কার্যকারিতাকে খুব বেশি বাড়িয়ে দেখছে।

তিনি মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে টিকা নিলেই আসলে সব মানুষ সুরক্ষিত নয়, টিকা নেয়ার পরও অনেকে ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে এবং অসুস্থ হতে পারে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন ভ্যারিয়েন্ট এই টিকার কার্যকারিতাও ক্ষুণ্ন করতে পারে।

তিনি বলেন, লকডাউন খুলে দেয়ার কৌশলটি আরও সতর্কতার সঙ্গে করা উচিত ছিল। তিনি বলেন, “সবকিছু একসঙ্গে খুলে দেয়ার কোন দরকার নেই।”

“আমাদের জন্য কোন স্বাধীনতা দিবস নেই”
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে অনেক মানুষ – বিশেষ করে যাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেশি বলে মনে করা হয় – বলেছেন, এই স্বাধীনতা দিবস নিয়ে তারা ভয়ে আছেন।

রোজি ডাফিনের বয়স ৭৪, তার সেকেন্ডারি স্তন ক্যান্সার হয়েছে। তাকে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ একজন রোগী বলে মনে করা হয়। যদিও তিনি টিকা নিয়েছেন, তারপরও যখন শুনলেন মুখে মাস্ক পরার নিয়ম তুলে দেয়া হচ্ছে, তখন তিনি আঁতকে উঠেছিলেন।

“মাস্ক পরার বাধ্যবাধকতা থেকে এই স্বাধীনতা কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমার নিত্যদিনের স্বাধীনতা অনেক কমিয়ে দেবে”, বলছেন তিনি।

“এটা হয়তো অন্যদের জন্য স্বাধীনতা, কিন্তু আমাদের জন্য মোটেই তা নয়।”

তবে সরকারের বিশ্বাস পরের দিকে কোভিডের বিধিনিষেধ তুলে নেয়া আরও কঠিন হবে, বিশেষ করে শরৎকালে, কারণ তখন ব্রিটেনে ইনফ্লুয়েঞ্জা ছড়াতে শুরু করে।

এক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে ইউরো ২০২০ টুর্ণামেন্টের খেলার সঙ্গে সংক্রমণ বৃদ্ধির সম্পর্ক আছে

ব্রিটেনের নবনিযুক্ত স্বাস্থ্যমন্ত্রী সাজিদ জাভিদ বলেছেন, “অন্য ফ্লুর সঙ্গে যেভাবে মানুষ মানিয়ে নিয়েছে, এই কোভিডের সঙ্গেও কিভাবে মানিয়ে নিতে হয়, সেটা শিখতে হবে।”

বিবিসির স্বাস্থ্য বিষয়ক সংবাদদাতা নিক ট্রিগল বলেন, দ্রুত হারে বাড়তে থাকা সংক্রমণের মধ্যেও ইংল্যান্ড যে কাজটা করতে চলেছে, সেটি বিশ্বের আর কোন দেশ এ পর্যন্ত চেষ্টা করেনি।

“তবে আবার এটাও মনে রাখা দরকার, টিকা দেয়ার ফলে এবং স্বাভাবিকভাবে সংক্রমণের শিকার হয়ে, এত বেশি হারে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বিশ্বের আর কোন দেশের মানুষের মধ্যে তৈরি হয়নি।”

ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের ড. আলেহান্দ্রো মাদ্রিগাল বলেন, নানা রকম সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বিষয় সরকারের মহামারি বিষয়ক কৌশল নির্ধারণে প্রভাব ফেলছে।

“এ রকম অনেক প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল যে এটা খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাবে। আর বিভিন্ন দেশ যে এ রকম একটা স্বাস্থ্য সংকট থেকে যত দ্রুত সম্ভব বেরিয়ে আসতে চাইবে, সেটাও বেশ স্বাভাবিক।”

কিন্তু ব্রিটিশ সরকার এই জুয়ায় জিতবে, নাকি তাদের আবার উল্টো ব্যবস্থা নিতে হবে – সেটা এখনই বলা সম্ভব নয়।

ডঃ মাদ্রিগাল বলেন, “কিভাবে শেষ পর্যন্ত এই বিশ্ব মহামারি নিয়ন্ত্রণে আসবে সেটা জানার জন্য আমাদের হয়তো আরও ছয় মাস হতে এক বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।”

তবে ব্রিটেনের আগে আরও কিছু দেশে লকডাউন শিথিল করা হয়েছিল সেসব দেশের অভিজ্ঞতা ছিল বেশ মিশ্র। লকডাউন শিথিল করার এমন ছয়টি দেশ হচ্ছে ইসরায়েল, নেদারল্যান্ডস, দক্ষিণ কোরিয়া, সুইডেন, অস্ট্রেলিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র ।


Spread the love

Leave a Reply