বিশেষ নিবন্ধঃ একজন মানিকের নৈতিক অধঃপতন ও কলঙ্কিত বিচার বিভাগ
মোঃ মশাহিদ আলী:
একজন মানিক । যিনি না কি বাংলাদেশের হাইকোর্ট এবং সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি ছিলেন । তার এতটা ক্ষমতা ছিল যে, বাংলাদেশের কোন মানুষকে মানুষ হিসেবে মনে করেননি তিনি । কেউ কিছু বললেই তার বিরুদ্ধে আদালত আবমাননা বলে রুল ইস্যু , পুলিশী নির্যাতন চালিয়ে হেনস্থা করা এসব ছিল তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য । দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়ে হাইকোর্ট এবং সুপ্রীম কোর্টে বিচার কার্য চালিয়ে গেছেন এই শামসুদ্দিন চৌঃ মানিক । দেশের কোন আইন কানুনের তোয়াক্কা করেননি অতি ক্ষমতাবান এই বিচারপতি । বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ যেখানে বসে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা আইন প্রনয়ন করেন সেই সংসদ কেও তোয়াক্কা করেননি মানিক । তার ক্ষমতা এতো বেশি ছিল যে সংসদ সদস্যদের ক্ষমতার লড়াইয়ে হার মানতে হয়েছে ।বর্তমান রাষ্ট্রপতি তৎকালীন স্পিকার এডভোকেট আব্দুল হামিদকেও তোয়াক্কা করেননি মানিক । সেই সময়ে তিনি আরেকধাপ এগিয়ে হাইকোর্ট থেকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান । মানিকের বিরুদ্ধে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে প্রায়ই সদস্যরা সমালোচনা করেছেন, একমাত্র বাহবাহ পেয়েছেন তিনি প্রধানমন্ত্রীর । বলা হয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ এজেন্ডা বাস্তবায়নের লক্ষে তিনির এত ক্ষমতা , এতো দাপট ! তা না হলে কি এতো সমালোচনা সত্বেও হাইকোর্ট থেকে সুপিম কোর্টে প্রমোশন হয় ? মানিক সর্বশেষ প্রধান বিচারপতি হবার স্বপ্নও দেখেছিলেন । কিন্তু সেই সপ্ন আর পুরন হয়নি ।আর এই কারনেই প্রধান বিচারপতি সিনহার সংগে তার বিরুধ । শামসুদ্দিন মানিক এতোটা নিচু ও হীন মনের মানুষ যে ,যার কারনে বাংলাদেশের বিচারবিভাগ আজ কলংকিত । দলীয়করন – স্বজনপ্রিতি তো আছেই , তবে মানিকের প্রধানমন্ত্রী প্রীতিটা ছিল এতো বেশি যে , যাকে ইচ্ছা তাকে নির্যাতন , হয়রানী করতে বিন্দু পরিমান দ্বিধাবোধ করেননি তিনি । একজন দলীয় কর্মী হয়ে তিনি বিচার বিভাগে নিয়োগ প্রাপ্ত হন কিভাবে ? সেই সাথে হাইকোর্ট , সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি হয়ে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ন মামলা গুলোর রায় লিখে বিচার বিভাগকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন মিঃ মানিক । একজন দলীয় মন মানসিকতা সম্পন্ন ব্যক্তি যদি কোন মামলার রায় লিখে থাকেন সেটা নিসংন্দেহে নিরপেক্ষ হতে পারেনা । যুদ্ধাপরাধী মামলার যে সকল রায় তিনি লিখেছেন তার সবগুলই প্রশ্নবিদ্ধ এটা অকপটে বলা যায় ।স্কাইপি কেলেংকারি সহ নানা ঘটনার জন্ম দেয়া এই মানিক কখনও নিরপেক্ষ বিচারপতি হতে পারেন না । যে ব্যক্তি বিচারপতি থাকাকালিন সময়ে বিরোধি দলের সমালোচনা করে পাবলিক মিটিং বা টকশোতে বক্তব্য রাখতে পারে সে ব্যক্তি কি করে সুপীম কোর্টের মতো জায়গায় বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পায় ? এটাই প্রশ্ন । তিনি বাংলাদেশের বিচার বিভাগকে এতোটা কলংকিত করেছেন যে, যা কোন কালে কোন সরকারের আমলে হয়নি । ভাবতে অবাক লাগে সুপীম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন সাবেক বিচারপতি যিনি না কি মাওলানা সাঈদি সহ অন্য যুদ্ধাপরাধী মামলার রায় লিখেচ্ছেন । তিনি বিরোধী দলীয় নেত্রির বাড়ী ঘেড়াও করতে মানব বন্ধন কর্মসূচীতে অংশ নেন । তার এই ক্ষীন ও দলিয় মানসিকতার পরিচয়কে দেশের মানুষ ধিক্ষার জানিয়েছে নিসংন্দেহে ।
বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই । মানি লন্ডারিং (মুদ্রা পাচার), বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় আইন ভঙ্গ ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে সম্পদের হিসাব গোপন এবং সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের শপথ ও আচরণবিধি ভঙ্গের সুনির্দিষ্ট ২৯টি অভিযোগ করেছিলেন বাংলাদেশে দৈনিক আমার দেশ’র ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান।
২০১২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর মাহমুদুর এসব অভিযোগ উত্থাপন করেছিলেন। তখন হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি ছিলেন তিনি। একই সময়ে লন্ডনে বাংলা মিডিয়ায় মানিকের অকর্ম ঘটনা তুলে ধরে সংবাদ প্রকাশ করে । বাংলাদেশে একমাত্র আমারদেশ পত্রিকা ছাড়া মামলার – হামলার ভয়ে কেউ সাহস করে লিখেননি । মানিক সে সময় লন্ডনের সবকটি পত্রিকার বিরুদ্ধে মামলা টুকে দেন । পক্ষে অথবা বিপক্ষে কোন কিছু বাদ বিচার না করেই সবকটি পত্রিকার সম্পাদক – প্রকাশক কে আসামি করে লন্ডনের আদালতে মামলা করেন তিনি । এ সময় তার হিংস্র মানসিকতা থেকে বাংলাদেশ সরকার দলিয় সমর্থক আইনজীবীরাও রক্ষা পায়নি । যে সত্য কথা বলেছে তার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন তিনি । বলা যায় একটা মামলাবাজ লোক হিসেবে তিনি সে সময় আবির্ভূত হয়েছিলেন লন্ডনে বাংলাদেশি কমিউনিটির মানুষের কাছে । মামলা করে ক্লান্ত থাকেননি , টাকা ইঙ্কামের ফন্দিও এঁকে দেন মানিক । গড়ে তুলেন নিজস্ব গোন্ডা বাহিনী । অত্যন্ত সুকৌশলে তার গোন্ডা বাহিনীরা সবার সাথে যোগাযোগ করে আপসের প্রস্তাব দেই । বলা হয় আপস না করলে বাংলাদেশে গেলে গ্রেপ্তার হতে হবে সেই সাংবাদিকদের । মানিক বাহিনীর কাছে ভয়ে আতংকে আপোসে রাজি হয়ে যায় অনেকগুলো পত্রিকা । এদের সবাইকে মামলার খরছের টাকা দিয়ে আপোস করতে হয় বলে জানা যায় । তবে যারা সত্য ও ন্যায়ের উপর অবিচল আস্তা ও বিশ্বাস নিয়ে সাংবাদিকতা করে তারা কখনও মানিকের গোন্ডাবাহিনির কাছে মাথা নত করেনি ।অত্যন্ত দুঃখজনক যে তৎকালিন সময়ে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতির কাছে যে সুর্নিদিষ্ট ২৯ অভিযোগ দায়ের করা হয় তা আদৌ আমলে নেয়নি বাংলাদেশ সরকার । যে কারনে মানিকের দাপট ও ক্ষমতার দম্ব একটু বেড়ে যায় ।
মানিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল , মানিলন্ডারিং (মূদ্রা পাচার) আইন, বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় আইন ও আয়কর আইন অনুযায়ী বিচারক এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে টাকা আত্মসাতের অভিযোগে বিচারপতি মানিকের বিরুদ্ধে লন্ডনের একটি আদালতে মামলা ।
মানিলন্ডারিং আইন ভঙ্গের অভিযোগে বলা হযয়েছিল , বিচারপতি মানিক ২০১০-১১ সালের আয়কর হিসাবে দেখিয়েছেন লন্ডনে তার তিনটি বাড়ি রয়েছে। এই বাড়িগুলো কিনেছেন ৪০ লাখ টাকার বিনিময়ে। তিনটি বাড়ির মধ্যে একটি বাড়ির ঠিকানাও অসম্পূর্ণ বা ভুল দেয়া হয়েছে। আয়কর নথিতে উল্লেখ করা 6 Ruskin Wa, London SW17 বাড়িটির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। আয়কর নথিতে দেখানো হয় তিনি ৫০ লাখ টাকায় এলিফ্যান্ট রোডের একটি বাড়ি বিক্রি করেছেন। এর মধ্যে ৪০ লাখ টাকা লন্ডনে তিনটি বাড়ি ক্রয় করতে ব্যয় হয়।
কিন্তু আয়কর নথিতে উল্লেখিত ৩টি বাড়ির বাইরেও লন্ডনে তার অপর একটি বাড়ি রয়েছে। আয়কর নথিতে লন্ডনে তিন বাড়ি ক্রয়ে যে পরিমাণ টাকা ব্যয় দেখিয়েছেন তার কয়েক গুণ বেশি মূল্য পরিশোধ করা হয়েছে। অতিরিক্ত এই টাকার কোনো হিসাব বা উৎস আয়কর নথিতে দেখানো হয়নি।
বাংলাদেশ থেকে টাকা লন্ডনে কী উপায়ে পাঠানো হয়েছে তার কোনো উল্লেখ আয়কর নথিতে নেই। বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় আইন ও মানিলন্ডারিং (মূদ্রা পাচার) আইন অনুযায়ী বাংলাদেশের বাইরে এত বিপুল পরিমাণ টাকা সরাসরি পাঠানোর কোনো সুযোগ নেই।
লন্ডনের ভুমি অফিসের তথ্য অনুযায়ী বিচারপতি মানিকের লন্ডনের 108 Sheppey Road, Dagenham (RM9 4LB) ঠিকানার বাড়িটি কিনেছেন সেখানকার স্থানীয় মুদ্রা এক লাখ ৮৬ হাজার পাউন্ডে। বাংলাদেশি টাকায় যার পরিমাণ ২০০৮ সালের ৭ অক্টোবর তিনি এই টাকা পরিশোধ করে সম্পত্তি রেজিস্ট্রি করেছেন।
লন্ডন ভূমি অফিসের তথ্য অনুযায়ী 26 The Warrent, London (E12 5HY) ঠিকানার বাড়িটির মালিক হলেন বিচারক এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী। ২০০৭ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তিনি এই বাড়িটি কিনেছেন। রেজিস্ট্রি দলিলের তথ্য অনুযায়ী বাড়িটির ক্রয় মূল্য হচ্ছে লন্ডনের স্থানীয় মুদ্রায় ২ লাখ ৪০ হাজার পাউন্ড।
ভুমি অফিসের রেকর্ড অনুযায়ী 94 East Hill. London (SW18 2HF) বাড়িটির মালিক হলেন বিচারপতি মানিক এবং নাদিয়া চৌধুরী। ২০১১ সালের ২১ নভেম্বর বাড়িটি তাদের নামে রেজিস্ট্রি করা হয়। এর ক্রয় মূল হচ্ছে লন্ডনের স্থানীয় মূদ্রায় ১০ হাজার পাউন্ড। এই বাড়িটির ক্রয় রেজিস্ট্রারে তাদের ঠিকানা দেখানো হয়েছে 108 Sheppey Road, Dagenham (RM9 4LB)| 94 East Hill. London (SW18 2HF এই সম্পত্তিটি আয়কর নথিতে দেখানো নেই।
তার আয়কর নথিতে 6 Ruskin Way, London SW17 ঠিকানায় আরো একটি সম্পত্তি দেখানো হয়েছে। এই ঠিকানাটি ভূল অথবা অসম্পূর্ণ অথবা তিনি ঠিকানা গোপন করেছেন। লন্ডন ভূমি অফিসের রেকর্ডে এই ঠিকানায় কোনো সম্পত্তি তার নামে নেই।
বিচারপতি মানিকের Sheppey Road, Dagenham (RM9 4LB) ঠিকানার বাড়িটি ক্রয়ের ক্ষেত্রে Mortgage express নামের একটি অর্থ ঋন কোম্পানি থেকে ঋণের জন্য আবেদন করেন। এই আবেদনে তিনি নিজেকে লন্ডনের একটি কোম্পানিতে মার্কেটিং ম্যানেজার হিসাবে কর্মরত বলে দাবি করেন। মার্কেটিং ম্যানেজার হিসাবে তিনি বছরে লন্ডনের স্থানীয় মুদ্রায় ৩৪ হাজার ৪৫০ পাউন্ড বেতন পান বলেও উল্লেখ করা হয় ঋণের আবেদনে।
ঋণের আবেদনে তিনি ২০০৩ সালের ১ জুন তারিখে এই বর্ণনা উল্লেখ করেন। অথচ তিনি তখন সুপ্রিম কোর্টের হাই কোর্ট বিভাগে কর্মরত একজন বিচারক। তিনি হাইকোর্ট বিভাগে ২০০৩ সালের ২ জুলাই পর্যন্ত অস্থায়ী বিচারক হিসাবে কর্মরত ছিলেন।
আবেদনে বলা হয় সুপ্রিম কোর্টের আচরণ বিধি অনুযায়ী বিচারপতি মানিককে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক থাকা অবস্থায় ভিন্ন কোনো চাকরি করতে পারেন না। তিনি বিচারক থাকা অবস্থায় লন্ডনে ঋণের আবেদনে নিজেকে সেখানে একটি কোম্পানির মার্কেটিং ম্যানেজার হিসেবে দাবি করে আচরণ বিধি লঙ্ঘন করেছেন।
২০১২ সালের ২৫ জুন জিসান নাসিম নামে এক ব্যক্তি লন্ডনের আদালতে বিচারপতি মানিকের বিরুদ্ধে প্রতারণা মামলা দায়ের করেন। মামলায় দাবি করা হয় ওই ব্যক্তির কাছে বিচারপতি মানিক নিজেকে একজন ইমিগ্রেশন অ্যাডভাইজার হিসেবে পরিচয় দেন। ইমিগ্রেশন অ্যাডভাইজার হিসেবে তিনি ওই ব্যক্তিকে লন্ডন ওয়েস্টমিনিস্টার কলেজে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দেন এবং বলেন এই কলেজের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা রয়েছে। ওই মামলায় দাবি করা হয় বিচারপতি মানিক ইমিগ্রেশন অ্যাডভাইজারের পাশাপাশি নিজেকে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারক হিসাবে দাবি করে এবং তাকে কলেজটিতে ভর্তি হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন।
বিচারপতি মানিকের পরামর্শে সেই কলেজে ভর্তি হয়ে জিসান নাসিম ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় লন্ডনের স্থানীয় মুদ্রায় ১৫ হাজার পাউন্ড ক্ষতিপূরণের মামলা দায়ের করেছেন। লন্ডনের The Northhampton County Court-এ দায়ের করা মামলাটির নম্বর হচ্ছে 2QT70489।
মামলার নোটিশ পাওয়ার পর ২০১২ সালের ৭ জুলাই বিচারপতি মানিক আদালতে একটি সময়ের আবেদন জানান। মামলাটির নোটিশের জবাব দিতে সময়ে আবেদনে তিনি নিজেকে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাই কোর্ট বিভাগের একজন বিচারক হিসেবে উল্লেখ করেন। এছাড়া ভিত্তিহীন অভিযোগে তার বিরুদ্ধে এই মামলা দায়ের করা হয়েছে দাবি করে বলা হয় জবাবে জন্য পর্যাপ্ত সময়ের দরকার।
বিচারপতি মানিক বিভিন্ন সময়ে লন্ডনে গিয়ে টেলিভিশন টক শো-তে অংশ নিয়ে রাজনৈতিক বক্তব্য রাখেন। বর্তমান শাসকদলের পক্ষে ও বিরোধী দলের বিপক্ষে বক্তব্য রাখেন এসব টক শো-তে।
পুলিশের নির্যাতনে ২০১১ সালের ২৬ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এম ইউ আহমদ নিহত হন। এই ঘটনার পর সেপ্টেম্বরে বিচারপতি মানিক লন্ডনে চ্যানেল আই-তে একটি অনুষ্ঠানে অংশ নেন। এই টক শো-তে বিচারপতি মানিক বিভিন্ন রাজনৈতিক বিতর্কিত বিষয়ে বক্তব্য দেন। পুলিশি নির্যাতনে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী এম এউ আহমদের হত্যাকাণ্ডের বিষয়েও তিনি বিশদ বক্তব্য রাখেন। তার এই বক্তব্যের সমালোচনা করায় সরকার দলিয় আইনজীবীদের বাংলাদেশে মামলার সম্মুখিন হতে হয় । লন্ডন থেকে দেশে গিয়ে তারা মামলার হাজিরা দেন । ঘটনাস্থল লন্ডন হলেও মানিকের ক্ষমতার কারনে বাংলাদেশে পর্যন্ত যেতে হয় এসকল ব্রিটিশ বাংলাদেশি আইনজীবীদের ।
টকশোতে মানিক সুস্পষ্ট করে বলেন, এই ইউ আহমদের বিভিন্ন ধরনের রোগ ছিল। পুলিশের নির্যাতনে নয়, তিনি রোগে মারা গেছেন। তদন্তাধীন ও বিচারাধীন কোনো বিষয় নিয়ে উচ্চ আদালতের বিচারক এ ধরনের প্রকাশ্য বক্তব্য দিয়ে বিচারকদের জন্য তৈরি করা আচরণ বিধি লঙ্ঘন করেছেন বৈকি ?
বিচারপতি মানিকের গাড়ি ট্রাফিক সিগন্যালে লালবাতির কারণে আটকে দেয়ায় পুলিশ ও ট্রাফিক সদস্যদের রাস্তায় কান ধরিয়ে উঠা-বসা করানো, রুল জারি করে আদালতে ডেকে এনে গালাগালি করা, সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের সম্মানিত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে রুল জারি করে তলব করা এবং তাদের অকথ্য ভাষায় গালি দেয়ার বিষয়টিও সে সময়ে তার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত আবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল । এবং এতে বিচারকদের জন্য সর্বশেষ প্রণীত আচরণবিধির ১, ২, ৩, ৯ ও ১১ লঙ্ঘিত হয়েছে বলেও দাবি করা হয় রাষ্ট্রপতি এবং প্রধান বিচারপতির কাছে করা আবেদনে।
এর আগে ২০১২ সালের ৬ জুন বিচারপতি মানিকের বিরুদ্ধে অসদারণের বেশ কিছু অভিযোগ এনে তাকে অপসারণে দ্রুত সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে তদন্ত করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোজাম্মেল হক। তবে এসব আবেদনের বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
এছাড়া জাতীয় সংসদের স্পিকারের বিষয়ে বিচারপতি মানিক মন্তব্য করে তার বিরুদ্ধে সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে সংসদ সদস্যরা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনে সংসদের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতিকে প্রস্তাব পাঠানোর দাবি করেন।
তবে সেই দাবি নাকচ করে ২০১২ সালের ১৮ জুন তৎকালীন স্পিকার আব্দুল হামিদ জাতীয় সংসদের রুলিংয়ে এ বিষয়ে ভেবে ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানান প্রধান বিচারপতিকে। কিন্তু স্পিকারের রুলিংকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে রায় দেয় হাই কোর্ট বিভাগের বিচারক হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও এবিএম আলতাফ হোসেনের বেঞ্চ।
বিচারপতি মানিক হাইকোর্টে থাকাকালে একটি মামলায় অভিযুক্তদের পাকিস্তানের পাঠিয়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে সমালোচিত হয়েছিলেন। আপিল বিভাগে এসেও তিনি বাংলাদেশে কর্মরত ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যানকে এজলাস থেকে বের করে দিয়েছিলেন।
তবে এতোসব অভিযোগ ও সমালোচনা সত্ত্বেও বিচারপতি মানিকের কিছুই হয়নি। উপরন্তু ২০১৩ সালের ৩১ মার্চ তাকে আপিল বিভাগে নিয়োগ দেয়া হয়।
১৯১২ সালে বাংলাদেশের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জনাব আব্দুল হামিদ যখন স্পিকার ,তখন একটি মন্তব্যকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক অপরাধের শামিল’ বলে হাইকোর্টের বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক মন্তব্য করলে ১৮ জুন অধিবেশন শুরুর সাথে সাথেই স্পীকার রুলিং দিয়ে বলেন যে “ওই বিচারপতি যেসব মন্তব্য করেছেন তা কোনো বিবেকবান মানুষ করতে পারে না। তবে একজন বিচারপতির অশোভন উক্তির কারণে সংসদ এবং বিচার বিভাগ মুখোমুখি হতে পারে না।” স্পিকার ওই বিচারপতির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়িত্ব প্রধান বিচারপতির ওপর ছেড়ে দিয়েছিলেন । তিনি বলেছিলেন , ‘‘আদালতের এ ধরনের আচরণে কি করণীয় থাকতে পারে, মাননীয় প্রধান বিচারপতি সে বিষয়টি ভেবে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন তাতে আমাদের সমর্থন থাকবে। এর ফলে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা হয়তো সম্ভব হবে।” কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য তৎকালীন প্রধান বিচারপতি অদ্যাবধি জনাব মানিকের বিরুদ্ধে কোন একটি বাক্য বলেছেন বা লিখেছেন বা কোন প্রসিডিং হাতে নিয়েছেন বলে এই প্ল্যানেটের কারুরই জানা নেই।
লন্ডনে নিজ দলীয় আইনজীবী ব্যারিস্টার আশরাফুল ইসলাম শামসুদ্দিন মানিক সম্পর্কে মন্তব্য করায় বাংলাদেশে যাওয়ার পর পরই তাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়। দলীয় পদ এখানে আশরাফুলের কোন কাজে লাগেনি। শেখ হাসিনার কাছে দলীয় নেতা কর্মীর চেয়ে দলীয় অনুগত বিচারপতির মুল্য অনেক বেশী ছিল এটাই তখন পরিস্কার হয়ে উঠে। লন্ডন প্রবাসী ব্যারিস্টার আশরাফুল বিমানযোগে ঢাকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামলে তাকে আটক করে ডিবি পুলিশ। তাকে ঢাকার সিএমএম আদালতে হাজির করা হয়। মামলার ধারাগুলো জামিনযোগ্য। কিন্তু মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আতিকুর রহমান তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। ঘটনা বুঝেই আশরাফ কোন জামিন চান নি তখন ।
শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বিচারকের আসনে বসে রাজনৈকি কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন মর্মে আপত্তি জানিয়ে ইউকে বিএনপির কতিপয় নেতা একটি সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে বিচারপতি মানিকের বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বিস্তারিত তুলে ধরে বিচারপতিদের জন্য নির্ধারিত আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ করা হয়। সংবাদ সম্মেলনের লিখিত বক্তব্যে শামসুদ্দিন চৌধুরীকে কালো মানিক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্য লন্ডন থেকে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত সংবাদ মাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত হয়। এতে মানিক সাহেব সংক্ষুব্ধ হয়ে তাদের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেন। মানহানির জন্য তিনি ক্ষতিপূরণ দাবি করেন। ইউকে হাইকোর্টের কিংবেঞ্চ একটি রায়ে সংবাদপত্র এবং বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে আনিত মানিকের করা মামলাটি খারিজ করে দিয়ে একই সঙ্গে বিবাদীদের মামলার আইনি খরচ দেয়ার জন্য শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের প্রতি নির্দেশ দেয়।একই সংবাদ ঘটনার অন্য মানিকের করা আরেকটি মামলা হাইকোর্টে বিচারাধীন রয়েছে । শামসুদ্দিন মানিকের এসকল অনৈতিক কার্যকলাপ কেন শাস্তিযোগ্য অপরাধ হবে না ? একজন ব্যক্তির কারনে দেশের বিচার বিভাগকে কলুষিত করার শাস্তি কেন তিনি ভোগ করবেন না । বাংলাদেশের বিচার বিভাগ যতই দলিয়করন আর স্বজনপ্রীতিতে ভরপুর থাকুক না কেন মিঃ মানিক যে কলংকের দাগ লাগিয়েছেন সেটা দলিয়করন – স্বজনপ্রীতির চেয়েও আরো নিকৃষ্ট । আমরা আশা করব বাংলাদেশের বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনতে প্রধান বিচারপতি যে উদ্যোগ নিয়েছেন তা সমর্থন যোগ্য এবং রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্র থেকে তাঁকে সহযোগিতা করা নৈতিক দায়িত্ব ।একই সাথে শামসুদ্দিন মানিককে বিচারের কাটগড়ায় দাঁড় করে বাংলাদেশ বিচার বিভাগকে কলংকমুক্ত করা হবে বলে সরকারের প্রতি আমাদের বিশ্বাস । লেখক-সম্পাদক,বাংলা সংলাপ,লন্ডন