মদ্যপানের ভয়াবহতাঃ একটু ভেবে দেখেছি কি আমরা?

Spread the love

গত কয়েকদিন আগে আমার এক ফ্রেন্ড আমাদের ইউনিভার্সিটির গ্ৰুপে একটি পোস্ট দিয়েছে। রাত ১২টার দিকে আমার বন্ধুটি ও তার স্ত্রী বাইরে থেকে বাসায় ফিরছিল, হঠাৎ ওরা দেখতে পেল যে একটি ছেলে এলোমেলো হয়ে বাইক চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। কিছুক্ষনের মধ্যেই ওদের সামনে পথেই এক্সিডেন্ট করে ছেলেটি। আমার ফ্রেন্ড ও তার স্ত্রী দৌড়ে গিয়ে তাকে সহায়তা করার চেষ্টা করে।সেই ছেলেটি মদ্যপ ছিল। মুলত এই ঘটনাটি আমাকে একটু ভাবিয়ে তুলেছে, যার প্রেক্ষিতে আজকের লেখা।

বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্প্রতি ‘মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮’-এর অধীনে ‘অ্যালকোহল নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা, ২০২২’ প্রণয়ন করেছে। এর মধ্য দিয়ে দেশে প্রথমবারের মতো অ্যালকোহল বা মদ উৎপাদন, কেনাবেচা, পান করা, পরিবহন, আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে নিয়মনীতি স্পষ্ট করা হয়েছে। এর আগে ‘মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮’, ‘অ্যালকোহল নিয়ন্ত্রণ (লাইসেন্স ও পারমিট ফিস) বিধিমালা ২০১৪’, ‘মুসলিম প্রহিবিশন রুল ১৯৫০’ ইত্যাদি এবং বিভিন্ন সময়ে নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে অ্যালকোহল সংক্রান্ত বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করা হতো। ২০২২ এর বিধিমালায় বলা হয়েছে যে ২১ বছরের নীচে কেউ মদ্যপানের পারমিট বা অনুমতি পাবে না, অর্থাৎ মদ্যপানের সর্বনিম্ন বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে ২১ বছর আর ১০০ জন পারমিটধারী এক হলেই মদ বিক্রির লাইসেন্স পাবেন।

এই পারমিটের কারনে তরুণদের মধ্যে মদ্যপানে উৎসাহ বাড়তে পারে। যারা এতদিন লুকিয়ে লুকিয়ে, বা চুরি করে, গোপনে মদ্যপান করত এখন তারা প্রকাশ্যে করবে। পাশাপাশি মদের বার, মদ্যপানের ক্লাব, আখড়া, টং ঘর, চিপা-চাপার গলির দোকান বাড়বে, আর লাইসেন্স তো বাড়বেই। কে দেখবে কার বয়স ২১? ইউকের মতো একটি স্যাকুলার দেশেও কিন্তু মদ কেনার জন্য বয়স যাচাই করা হয়। এদের আইনে ১৮ বছর বয়সে মদ কেনার অনুমতি থাকলেও ক্রেতাকে দেখতে ২৫ বছর বয়সীর মতো হতে হবে। ১৮-২৫ বছর বয়সীদের জন্য মদ কেনা অতটা সহজ নয়, বরং তাদেরকে তাদের ফটো আইডি দেখিয়ে বয়স প্রমাণসাপেক্ষে মদ কিনতে হয়। বলা হয়ে থাকে বাংলাদেশে এখন ১২১টি প্রতিষ্ঠানের অধীনে ১৬৫টি মদের বার রয়েছে; যদিও বাস্তব অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন।একটা গবেষণায় দেখা যায় যে ঢাকা শহরে শুধুমাত্র টিকাটুলি থেকে ধানমন্ডি হয়ে গুলশান পর্যন্ত ৯০টি লাইসেন্সধারী বার (মদ বিক্রয় ও সেবনের) আস্তানা রয়েছে। ঢাকা শহরের সমস্ত নামী দামী হোটেলগুলোতে রয়েছে এই বার। লাইসেন্স বিহীন যে কতগুলো বার রয়েছে তা আল্লাহ মালুম। অনেকেতো আবার বাসা বাড়ির ভিতরেও মদ্যপানের বার তৈরি করে রেখেছে মদের গুপ্ত ভাণ্ডার। আর লাইসেন্স পাওয়ার পরে যে কি হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়!

গত দুই সপ্তাহ বিভিন্ন জার্নাল, ম্যাগাজিন, অনলাইন ও অফলাইণে কিঞ্চিৎ পড়াশুনা করে মদ্যপানের শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও পারিবারিক যে ক্ষতিকর বিষয় আমার নজরে আসল তা তুলে ধরাই হলো আজকের লেখার প্রতিপাদ্য।

১। মদ্যপানের শারিরীক ক্ষতিকর দিক সমূহের মধ্যে রয়েছে যেমন-মানুষের ইমিউন সিস্টেমকে দুর্বল করার সাথে সাথে যক্ষা, নিউমোনিয়া ও ক্যান্সার বৃদ্ধি করে। পাশাপাশি হাঁড় ক্ষয় বৃদ্ধি, হাঁড় পাতলা হয়ে যাওয়া, হাঁড় ভাঙা বৃদ্ধি পাওয়া, পেশী দুর্বল, সংকুচিত হওয়া। এছাড়াও পুরুষের ক্ষেত্রে ইরেকটাল ডিজফাংশন এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে মাসিকের সমস্যা, বন্ধ্যাত্ব এবং স্তন ক্যান্সারের মতো রোগ বালাই বৃদ্ধি করে থাকে। মদ্যপান হার্টের অসংখ্য সমস্যার মধ্যে হৃদপিন্ডের পেশী কোষের বিষক্রিয়া, অনিয়মিত হৃদস্পন্দন, উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক বা হার্ট অ্যাটাকের মাত্রা বৃদ্ধি করে থাকে। লালা গ্রন্থির ক্ষতি, মাড়ির রোগ এবং দাঁতের ক্ষয়, লিভার সিরোসিস, খাদ্যনালীর আলসার, গ্যাস্ট্রাইটিস, অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ এবং হেমোরয়েডস এর মতো রোগের বাসা বাধে মানুষের শরীরে এই মদপানের কারনে। যা অল্প বয়সেই একজন যুবককে রোগ ব্যাধির কারখানা পরিনত করে।। চোখে ঝাপসা দেখা, বিস্মৃত হওয়া, স্বাভাবিক কথা বলার ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্থ করা, অস্থায়ী পক্ষাঘাত সৃষ্টি এবং দীর্ঘমেয়াদী মস্তিষ্কের সমস্যা তৈরী করে থাকে মদ্যপান। এসসর এমবি, শের্ক এ, লিউ ওয়াই তাদের ডেথ এন্ড ইয়ার্স অফ পোটেনশিয়াল লাইফ লস্ট ফ্রম এক্সসেসিভ এলকোহল ইউজ নামক গ্রন্থে মদ্যপানের স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির কথা বলেছেন।এছাড়াও ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন ২০১৮ সালে গ্লোবাল স্ট্যাটাস রিপোর্ট অন এলকোহল এন্ড হেলথ নামক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, যাতে দীর্ঘকালীন শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির এক বিশদ বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। যার মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, স্ট্রোক, লিভারের রোগ, হজমের সমস্যা, স্তন, মুখ, গলা, খাদ্যনালী, ভয়েস বক্স, লিভার, কোলন এবং মলদ্বারের ক্যান্সার অন্যতম। ইমিউন সিস্টেমের দুর্বলতা, স্মৃতিভ্রংশ এবং দুর্বল কর্মক্ষমতা, বিষণ্নতা এবং উদ্বেগ সহ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, পারিবারিক সমস্যা, চাকরি সংক্রান্ত সমস্যা এবং বেকারত্ব সহ সামাজিক সমস্যার দীর্ঘ তালিকা দেয়া আছে সেখানে।

মদ্যপানে মানুষের মধ্যে যে সমস্ত মানসিক সমস্যা তৈরি হয় তার মধ্য অন্যতম হোল বিষণ্ণতা, (মেহ্রাবিয়ান ২০০১)। বিষণ্ণতা দ্বারা আক্রান্ত ও প্রভাবিত হয়ে সাময়িক শান্তি পাওয়ার আশায় ও নেশায় মানুষ মদ্যপানে আসক্ত হয়, পরবর্তীতে আর সেখান থেকে ফিরতে পারে না। যদিও এই সমস্যাটা সমাজের বিত্তশালীদের মধ্যে বেশী দেখা যায়। মদ্যপান মানুষের রাগ, অনুভূতি, চিন্তাভাবনা এবং আচরণে দারুন বৈরী প্রভাব ফেলে, অসহনীয় উদ্বেগ তৈরি করে। অনেক সময় দেখা যায় মদ্যপ ব্যক্তি সমাজের স্বাভাবিক ও নির্মল জীবন ছেড়ে দিয়ে একাকীত্বকে বেছে নেয় যা তার নিজের, পরিবারের ও সমাজের জন্য ক্ষতিকর। উদ্বেগের বশবর্তী হয়ে অনেক সময় অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনায় পতিত হয় এই মদ্যপ মানুষগুলো। এই ক্ষেত্রে সড়ক দুর্ঘটনার হার অনেক বেশী, তাই ইউরোপ এর দেশগুলোতে সড়ক দুর্ঘটনা হলে সবার আগে রক্তে মদের পরিমাণ চেক করা হয় ( রেম ২০০৩)। মদ্যপানের বশবর্তী হয়ে সঙ্ঘবদ্ধ ক্রাইমের সংখ্যা অগনিত, আর আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়ার দৃষ্টান্তও কম নয়, (গ্রাহাম এন্ড ওয়েস্ট ২০০১)। আমরা অনেক সময়ই পত্রিকার শিরোনাম দেখতে পাই মদ্যপানের ফলে মৃত্যু।

অন্যদিকে, অস্ট্রেলিয়ার প্রায় ২০% লোক মানসিক সমস্যায় ভোগে যাদের বয়স ১৬-৮৫ এবং যারা নিয়মিত মদ্যপান করে। এছাড়াও মদ্যপানে আসক্ত মানুষ সাধারন ও স্বাভাবিকভাবে চিন্তা করতে পারেনা, সাবলীল ও স্বাভাবিকভাবে তাদের মতও প্রকাশ করতে পারেনা। সমাজের অন্যান্য স্বাভাবিক মানুষের চাইতে তাদের জীবনাচরণ হয়ে উঠে অস্বাভাবিক। মিলার জে ডব্লিউ, নাইমি টিএস, ব্রেয়ার আরডি, জোনস এসই লেখকবৃন্দ তাদের বিং ড্রিঙ্কিং এন্ড এসোসিয়েটেড হেলথ রিস্ক বিহেভিয়ার্স এমং হাই স্কুল স্টুডেন্টস নামক আর্টিকেলে বলেছেন, মদ্যপান কিভাবে মানুষের মধ্যে আত্মহত্যা এবং আত্ম-ক্ষতির প্রবনতা তৈরি করে, কিভাবে কু-চিন্তায় ব্যাধিগ্রস্থ হয়ে পরে এরা। মদ্যপান সুস্থ্য ও স্বাভাবিক চিন্তাভাবনা প্রক্রিয়া এবং যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে এবং সহিংসতা বা আক্রমণাত্মক আচরণের সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দেয়, দ্বন্দ্ব সমাধান করার সক্ষমতা হ্রাস করে দেয়।মদ্যপানকারী রাতে ভালো ঘুমোতে পারেনা, যা তার দৈনন্দিন কার্যক্রমকে বাঁধাগ্রস্ত করে এবং সুখী জীবনকে বিষিয়ে তোলে।

আমরা বিগত সময়ে পত্রিকার হেডলাইন দেখেছি, মদ্যপানের ফলে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় মৃত্যুর অসংখ্য ঘটনা। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে ১৯৯৮ সালে গাইবান্ধায় বিষাক্ত মদ পান করে ৭১ জনের প্রাণহানি? ১৯৯৯ সালের ৭ মে নরসিংদীতে বিষাক্ত মদ পানে শতাধিক ব্যক্তির মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। ২০০০ সালে বগুড়ায় বিষাক্ত মদে ২২ জনের মৃত্যু হয়। ২০২০ এর ফেব্রুয়ারিতে বগুড়ায় বিষাক্ত মদ পানে ১৮ জন মারা যায়। ২০২০ এর মে মাসে দিনাজপুরের বিরামপুরে বিষাক্ত মদ পানে নিহত হয় ১০ জন। একই মাসে রংপুর সদরের শ্যামপুর ও পীরগঞ্জ থানা এলাকায় মদ পান করে ৯ জনের মৃত্যু হয়।এছাড়াও আরও অনেক প্রানহানির ঘটনা রয়েছে।

৩। মদ্যপানের শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির পাশাপাশি রয়েছে মারাত্মক রকমের সামাজিক ক্ষতি সমূহ। এই ক্ষেত্রে এইচ ক্লিনজমান জি, মেল এর ম্যাপিং দ্যা সোশ্যাল কংসেকুয়েন্সেস অফ এলকোহল কনজামশন নামক গ্রন্থে বলা হয়েছে – কর্মক্ষেত্রে ভারী মদ্যপান নিশ্চিত উৎপাদনশীলতা হ্রাস করে, মদ্যপানে অভ্যস্ত কর্মীদের কাজে অনুপস্থিতির হার বেশি এবং অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে অসুস্থ হয়ে কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিত কর্মীদের সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য যথেষ্ট ব্যয় বহন করতে হয় মালিকপক্ষকে।যদিও বাংলাদেশে সরকারি বা বেসরকারিভাবে সামাজিক নিরাপত্তার জন্য কোনো ব্যয় বহন করতে হয় না। এছাড়াও আরো যে সমস্ত সামাজিক সমস্যা বৃদ্ধি পায় তার মধ্যে অন্যতম খুন, হত্যা, মানসিক বিকারগ্রস্থতা, সংঘবদ্ধ ক্রাইম, সড়ক দুর্ঘটনা, গ্যাং-কালচার, হৈ-হুল্লোড়, উশৃঙ্খলতা, লাগাতার বাদ্যবাজনা ও শব্দ দূষণের মতো ঘটনা। মদ্যপানের সাথে ওতপ্রোতভাবে রয়েছে অশ্লীলতা, যেনা, ব্যাভিচার এবং জেল হাজত। এইতো গত কয়েক বছরে আমরা দেখলাম মদ্যপানকে কেন্দ্র করে উত্তরা বোট ক্লাব এবং গুলশান ক্লাবের ভাংচুর, ঢাকার ক্যাসিনো ব্যবসায়ীদের মদ, জুয়া, নারীদের দেহ ও যৌন ব্যবসা; যার পরবর্তী গন্তব্য ছিল জেল হাজত। তবে আইনের ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে অতি সহজেই ও স্বল্প কসরতে বাংলাদেশের এই অপরাধীরা জেল হাজত থেকে ছাড়া পেয়ে যায়।

৪। মদ্যপানের পারিবারিক প্রভাব খুবই সাংঘাতিক। যেমনটি মেল্ এন্ড রেম (২০০৩) তাদের দ্যা রিলেশনশিপ অফ অ্যাভারেজ ভলিউম অফ এলকোহল কনজামশন এন্ড প্যাটার্নস অফ ড্রিংকিং তো বার্ডেন অফ ডিজিস: এন ওভারভিউ নামক আর্টিকেলে বলেছেন- মদ্যপান সঙ্গীর পাশাপাশি সন্তানদের জন্যও অনেক নেতিবাচক পরিণতি বয়ে আনে। গর্ভাবস্থায় মায়ের মদ্যপানের ফলে শিশুদের মধ্যে ভ্রূণ অ্যালকোহল সিন্ড্রোম হতে পারে এবং পিতামাতার মদ্যপানের কারনে শিশু নির্যাতন ঘটে হরহামেশাই। এছাড়াও নারী নির্যাতন, ধর্ষণ আর বিবাহ বিচ্ছেদও রয়েছে এই লিস্টে।মদ্যপানের জন্য কর্মক্ষমতা নষ্ট হয় । তাছাড়া মদ্যপানের জন্য অনেক সময়ে বার, রেস্টুরেন্ট, ক্লাবে অধিক সময় অতিবাহিত করতে হয়, যার কারনে পরিবারকে, স্ত্রী, সন্তান্ ও পিতা-মাতাকে সময় দেওয়া যায় না, যার ফলে ঘটে পারিবারিক বিশৃঙ্খলা, অনাচার, অশান্তি, পারিবারিক দুর্ঘটনা ও সহিংসতা। পরিবারের সদস্যরা বঞ্চিত হয় স্নেহ, মমতা আর ভালোবাসা থেকে। মদ্যপান দারিদ্রতা ডেকে আনে। মদ্যপানের জন্য যে অর্থ খরচ হয় যা পরিবারের আয় ও সম্পদের উপর প্রভাব ফেলে, আয় হ্রাস করে এবং পরিবারকে নিঃস্ব করে দেয়। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের গ্লোবাল স্ট্যাটাস রিপোর্ট অন অ্যালকোহল (২০০৪) মেক্সিকোর এক গবেষণায় বলা হয়েছে মদ্যপানে আসক্ত স্বামী দ্বারা ৭৩% নারী উদ্বেগ, ভয় এবং বিষণ্নতায় ভুগে, ৬২% স্ত্রী শারীরিক বা মৌখিক নির্যাতনের স্বীকার, এবং ৩১% শিশুদের পারিবারিক বিচ্ছিন্নতার স্বীকার হতে হয় ।উক্ত গবেষণায় আরও দেখানো হয়েছে যে ইন্ডিয়ার লোকদের মধ্যে যারা বেশী মদ্যপান করে তাদের পরিবারে খুব সামান্যই অর্থ বৃত্ত থাকে আর মালয়েশিয়ার লোকেরা তীব্র দারিদ্রতায় ও অর্থ কষ্টে দিনাতিপাত করে,( রুম ২০০২)।

আপানরা অনেকেই দেখেছেন মদ্যপানের ফলে অনেক কোটিপতিও পথের ফকির বনে গেছে। এটিও দেখেছেন সুন্দর সু-স্বাস্থ্যের অধিকারী সুদর্শন যুবক-যুবতী কিভাবে ভগ্ন স্বাস্থ্যের স্বীকার হয়েছে, পাগল ও বিকৃত-মস্তিস্ক হিসেবে রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছে, আবার সমাজ থেকে ছিটকে পরে একাকী নিঃসঙ্গ হয়ে পরেছে। নিশ্চয়ই এটিও দেখেছেন সুখী দাম্পত্য জীবন কিভাবে মদ্যপান ও মাদকের করাল গ্রাসে ভেঙ্গে খান খান হয়ে পড়েছে?

মদ্যপানের ভয়াবহতার কথা ভেবে পৃথিবীর অনেক দেশ যেমন ইয়েমেন, শারজা, সৌদি আরব, সোমালিয়া, মৌরিতানিয়া, মালদ্বীপ, পাকিস্তান, লিবিয়া, কুয়েত, ইরান, ব্রুনাই এমনকি ভারতের বেশ কিছু অঞ্চলে যেমন গুজরাট, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম, মণিপুর, লক্ষদ্বীপ ও বিহারের রাজ্যসীমানার ভেতর মদ বিক্রি ও পানকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।আরও কিছু অঞ্চলে স্থানীয়ভাবে মদ নিষিদ্ধ। ইসলাম ধর্মের পাশাপাশি অনেক ধর্মেই মদ্যপানকে হারাম বা নিষিদ্ধ করেছে। খ্রিস্টান ধর্মে, বুদ্ধ ধর্মে, এমন কি সনাতন হিন্দু ধর্মেও মদ্যপানকে নিষেধ করা হয়েছে।

পবিত্র কুরআন মাজিদে বলা হয়েছে – হে মুমিনগণ, এই যে মদ, জুয়া, প্রতিমা এবং ভাগ্য নির্ধারক শরসমূহ এসব শয়তানের অবিত্র কাজ ছাড়া আর কিছুই নয়। অতএব, এগুলো থেকে বেঁচে থাকো – যাতে তোমরা কল্যানপ্রাপ্ত হতে পারো, (সূরা আল মায়েদা – ৯০)। নাবী করীম (সঃ) থেকে বর্ণিত একটি সহীহ হাদীসে বলা হয়েছে, রাসূলে কারীম (সঃ) কে মদ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়। তিনি বলেন, তা সেবন করা যাবে না। পুনরায় জিজ্ঞেস করা হলে, তিনি একই উত্তর দেন। এরপর বলা হলো : হে আল্লাহর রাসূল, এটি তো ওষুধ? জবাবে রাসুল(সঃ) বলেন-না, বরং এটি রোগ, (সুনানে আবু দাউদে- ৩৮৭৩)। অন্য আরেকটি হাদীসে রাসুল(সঃ)বলেন-যে নেশাজাতীয় বস্তু অধিক পরিমাণে খেলে নেশা হয় তা সামান্য পরিমাণে সেবন করাও হারাম, (তিরমিযী-১৮৬৫)। আরেকটি হাদীসে নবী করীম (সঃ) বলেছেন-মদ কম ও বেশি যে কোনো পরিমাণে সেবন করা হারাম, (সুনানে নাসায়ী-৫৬৮৪)।

মদ্যপানের যে শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও পারিবারিক ক্ষতির ভয়াবহতা আমরা দেখলাম, তা রীতিমত শিউরে উঠার মতো, এবং যেকোনো চিন্তাশীল সচেতন ব্যক্তিকে চিন্তা করতে বাধ্য করবে। আল্লাহ আমাদেরকে, বিশেষ করে আমাদর নতুন প্রজন্ম, অনুজ, এবং যুব সমাজকে মদ্যপানের ভয়াবহতা উপলব্ধি করে মদ্যপান থেকে শুরু করে সমস্ত মাদক থেকে দূরে রাখুন।

লেখকঃ ব্যারিস্টার ওয়াহিদ মুহাম্মাদ মাহবুব
সলিসিটর, সিনিয়র কোর্ট অব ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস।
১০/০৩/২০২২, লন্ডন।


Spread the love

Leave a Reply