লন্ডনে ইসলাম বিদ্বেষীদের ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করার আহবান
বাংলা সংলাপ ডেস্কঃটাওয়ার হ্যামলেটস একটি ডাইভার্স বারা। এখানে বর্ণবাদ ও ইসলাম বিদ্বেষের কোনো স্থান নেই। এই বারার মানুষের শান্তি ও সম্প্রীতি অক্ষুন্ন রাখতে যেকোনো ধরনের বর্ণবাদী তৎপরতা রুখে দাঁড়াতে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান জানিয়েছেন বিভিন্ন ধর্ম ও বর্ণের নেতৃবৃন্দ।
৩ মার্চ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় লন্ডন মুসলিম সেন্টারের গ্রাউন্ড ফ্লোরে ‘স্ট্যান্ড আপ-টু-রেইসিজম’ এর উদ্যোগে আয়োজিত বিক্ষোভ সমাবেশে নেতৃবৃন্দ এ আহবান জানান। সমাবেশে খ্রিস্টান, ইহুদী ও মুসলিমসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বী নেতারা বলেন, টাওয়ার হ্যামলেটস সবসময়ই ইমিগ্রান্ট কমিউনিটির জন্য সেইফ হোম। এখানে অশান্তি সৃষ্টিকারীদের কোনো স্থান নেই।
টাওয়ার হ্যামলেটস ইউনিসনের সেক্রেটারি জন ম্যাকলইন এর উপস্থাপনায় অনুষ্ঠিত সমাবেশে বক্তব্য রাখেন কাউন্সিলের নির্বাহী মেয়র জন বিগস, রুশনারা আলী এমপি, টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের সাবেক কেবিনেট মেম্বার কাউন্সিলার রাবিনা খান, ইমাম ও টিভি প্রেজেন্টার আজমাল মাসরুর, ইস্ট লন্ডন মসজিদ ও লন্ডন মুসলিম সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক দেলওয়ার খান, টাওয়ার হ্যামলেটস ইন্টারফেইথ ফোরামের চেয়ারম্যান অ্যালান গ্রীন, ইস্ট লন্ডন সিনাগগের লিডার লিওন সিলভার, ‘স্ট্যান্ড আপ টু রেইসিজম’ এর জয়েন্ট সেক্রেটারি ওয়েম্যান বেনেট, ন্যাশনাল ইউনিয়ন অব ট্রেড ইউনিয়নের ভাইস প্রেসিডেন্ট কিরি টাংকস ও শাকিরা মার্টিন।
সমাবেশে নির্বাহী মেয়র জন বিগস বলেন, টাওয়ার হ্যামলেটস সকল ধর্ম ও বর্ণের মানুষের একটি নিরাপদ আবাসস্থল। বিশেষ করে ইমিগ্রান্ট কমিউনিটির জন্য এই বারা একটি সেইফ হোম। আমরা কোনোভাবেই আমাদের শান্তি বিনষ্ট হতে দেবো না। যেকোনো ধরনের বর্ণবাদ ও ধর্মবিদ্বেষ মোকাবেলায় আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।
টাওয়ার হ্যামলেটস ইন্টারফেইথ ফোরামের প্রেসিডেন্ট অ্যালান গ্রীন ইস্ট লন্ডন মসজিদের সামনে ব্রিটেন ফার্স্টের সাম্প্রতিক বিক্ষোভের নিন্দা জানিয়ে বলেন, খ্রিস্টিয়ানিটি হচ্ছে ভালোবাসা দিয়ে মানুষের মন জয় করা, ঘৃণা ছড়িয়ে নয়। খ্রিস্টিয়ানিটির অর্থ নয় মসজিদের বাইরে দাঁড়িয়ে মুসলিম-বিরোধী শ্লোগান দিয়ে মানুষের মধ্যে আতংক সৃষ্টি করা। খ্রিস্টিয়ানিটি হচ্ছে মুসলমানেরা যেভাবে মসজিদে ব্রিটেন ফার্স্টের সদস্যদের চা-বিস্কিট দিয়ে আপ্যায়িত করে, সেভাবে অন্য ধর্ম-বর্ণের মানুষকে স্বাগত জানানো। তিনি বলেন, এভাবে ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে ‘ব্রিটেন ফার্স্টে’র ব্রিটেন জয়ের স্বপ্ন দুঃস্বপ্ন ছাড়া কিছু নয়।
কাউন্সিলার রাবিনা খান বলেন, প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তিনি পাঁচ বছরে বিশ হাজার শরনার্থীকে ব্রিটেনে পুনর্বাসন করবেন। কিন্তু আমরা এখন দেখতে পাই, তিনি ক্যালে সীমান্তে শরনার্থী আটকাতে ফ্রান্স সরকারকে ফান্ড দিচ্ছেন। তাঁকে এই দু’মুখো নীতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। তিনি বলেন, বৃটিশ সরকার যদিও গর্বের সাথে দাবী করে তাঁরা শরনার্থীদের স্বাগত জানায়, কিন্তু আসলে শরনার্থীদের স্বাগত জানানোর ক্ষেত্রে ব্রিটেনের তেমন কোনো গৌরবোজ্জল অধ্যায় নেই। ইহুদী ধর্মাবলম্বীরাও এখানে স্বাগত ছিলেন না। তাঁরা এ দেশে প্রবেশের পর বিভিন্নভাবে নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছে। ১৯৪৫ সালে আইন করে ইহুদি ধর্মাবলম্বীদের ব্রিটেন প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা সৃষ্টি করা হয়েছিলো। শরনার্থীদের প্রতি ব্রিটিশ সরকারের মনোভাব আগে যেমন ছিলো এখনও তেমনই আছে।
আমরা শরনার্থীদের এভাবে অভূক্ত ও ঠাণ্ডায় ফেলে রেখে মরতে দিতে পারি না। তাঁদের প্রবেশ বাধামুক্ত করতে আমাদেরকে ক্যাম্পেইন জোরদার করতে হবে। রুখে দাঁড়াতে হবে বর্ণবাদ। হাতে হাতে রেখে মুসলমানদের ওপর দানবীয় আচরণ প্রতিহত করতে হবে।
তিনি আরো বলেন, রিফিউজিরা এদেশে শুধু একটি ব্রিফকেস নিয়েই আসছে না। সঙ্গে তাঁদের মাথা ও ব্রেন নিয়ে আসছে। শরনার্থীরা ডাক্তার, নার্স, টিচার হয়ে এ দেশে সমৃদ্ধির পেছনে ভুমিকা রাখতে পারে। তিনি আরো বলেন, আমরা শুধু ব্রিটিশ ভেল্যু ও মুসলিম ভেল্যু নিয়ে বাগাড়ম্বর করি। আমরা কেন ইউনিভাসেল ভেল্যুর কথা বলিনা। এই ভেল্যু আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে।
ইস্ট লন্ডন মসজিদের নির্বাহী পরিচালক দেলওয়ার খান সত্তর দশকে ইস্ট এন্ডের বর্ণবাদের একটি চিত্র তুলে ধরে বলেন, ওই সময়ে প্রতি সপ্তাহেই আমাদের ঘরের দরজা-জানালায় ইটপাটকেল দিয়ে ঢিল ছুড়া হতো। আমরা স্কুলে যাওয়া-আসার পথে বর্ণবাদী হামলার শিকার হতাম। সবসময়ই আমাদেরকে আতংকের মধ্যে দিনাতিপাত করতে হতো। ’৯০ এর দশকে এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। কিন্তু ২০০০ সালের শুরুতে বিশেষ করে নাইন-এলেভেনের পর নতুন মোড়কে বর্ণবাদের অবির্ভাব ঘটে। এখন ইসলাম বিদ্বেষ হচ্ছে বর্ণবাদের চেয়ে আরো ভয়াবহ। সুতরাং এখন আমাদেরকে আমাদের পূর্বপুরুষদের মতোই বর্ণবাদ ও ইসলামফোবিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
ইমাম ও টিভি প্রেজেন্টার আজমাল মাসরুর বলেন, ছোটকালে বর্ণবাদের শিকার হওয়ার ফলে শারিরীক ও মানসিকভাবে আমরা যে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিলাম তা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারিনি। উপরন্তু দিনদিন যেভাবে ইসলাম বিদ্বেষ বাড়ছে তাতে আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ছি। মুসলমান হওয়ার কারণে আমাদেরকে গালি দেয়া হচ্ছে। মানুষ হিসেবে আমাদের গন্য করা হচ্ছে না। এটা আমাদের ছেলেমেয়েদের ওপর মারাত“ক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তাই আমাদেরকে আজ কাঁধে কাঁধ রেখে ইসলামফোবিয়া মোকাবেলায় সোচ্চার হতে হবে। তিনি বিভিন্ন ইসলাম বিদ্বেষী ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের নীরবতা ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে মুসলমানদের বিরুদ্ধে কথা বলার কঠোর সমালোচনা করে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে ইসলামফোবিয়া বৃদ্ধির পেছনে প্রধানমন্ত্রীর এসব ভুমিকা অনেকাংশেই দায়ী।
উল্লেখ্য, স্ট্যান্ড আপ টু রেইসিজম-এর উদ্যোগে আগামী ১৯ মার্চ শনিবার দুপুর ১২টায় ট্রাফালগার স্কয়ারে জাতীয় গণবিক্ষোভ কর্মসূচি আয়োজন করা হয়েছে। উক্ত বিক্ষোভ সমাবেশ সফলের লক্ষে এলএমসিতে এই সমাবেশ আয়োজন করা হয়। জাতীয় গণবিক্ষোভ সফল করতে আগামী ১৮ মার্চ পর্যন্ত টাওয়ার হ্যামলেটসের বিভিন্ন এলাকায় লিফলেট বিলিসহ বিভিন্ন প্রচারণামূলক কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে।
এর মধ্যে রয়েছে ১৩ মার্চ রোববার দুপুর সাড়ে ১২টায় ব্রিকলেনে, ১৪ মার্চ সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টা কুইনমেরী ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরি স্কয়ারে, ১৬ মার্চ বুধবার বিকেল সাড়ে ৫টায় বেথনালগ্রীন টিউব স্টেশনে, ১৭মার্চ বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে ৫টায় মাইল এন্ড স্টেশনে, ১৮ মার্চ শুক্রবার দুপুর দেড়টায় ইস্ট লন্ডন মসজিদের সম্মুখে ও বিকেল সাড়ে ৫টায় হোয়াইটচ্যাপেল টিউব স্টেশনে লিফলেট বিতরণ ক্যাম্পেইন। উক্ত গণবিক্ষোভে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে অংশগ্রহণ করতে উদাত্ত আহবান জানানো হয়েছে।