সিলেটের স্বঘোষিত দানবীর রাগীব আলী তারাপুর চা বাগানের অবৈধ দখলদার , ৫ কোটি টাকা অর্থদণ্ড
বাংলা সংলাপ ডেস্কঃঅবৈধ সম্পদের কথিত ‘স্বঘোষিত দানবীর’ সিলেটের রাগীব আলী ও তার ছেলে আবদুল হাই বহুল আলোচিত তারাপুর চা বাগানের কেউ নন। তারা জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে তথাকথিত লিজের কথা বলে চা বাগানটি এতদিন অবৈধভাবে দখলে রেখেছিলেন। রাগীব আলী বা তার ছেলে দেবোত্তর এ সম্পদের মালিক অথবা উত্তরাধিকারী হতে পারেন না। কারণ হিন্দু ধর্মের সেবায়েত কখনও অন্য ধর্মাবলম্বীর হওয়ার বিধান নেই। বাগানটি অবৈধ দখলে রেখে চা রফতানির মাধ্যমে আয়কৃত টাকা থেকে ৫ কোটি টাকা বৈধ সেবায়েতের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ। রায়ে রাগীব আলী ও তার ছেলে আবদুল হাইয়ের অবৈধ দখলে থাকা তারাপুর চা বাগানের রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালসহ সব স্থাপনা অপসারণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সব স্থাপনা উচ্ছেদে সময় দেয়া হয়েছে ৬ মাস। এসব স্থাপনা অপসারণের পর উচ্ছেদকৃত স্থানে পুনরায় চা বাগান করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে রায়ে। এছাড়া রাগীব আলীর বিরুদ্ধে করা আরও দুটি মামলা দ্রুত পরিচালনার জন্য জেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
৪৮ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়ে ১৭টি নির্দেশনা ও মন্তব্য রয়েছে উচ্চ আদালতের। জানা গেছে, রাগীব আলীর ছেলে আবদুল হাই বাগানের মালিকানা দাবি করে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ২০০৯ সালে উচ্চ আদালতে রিট করেন। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ ১২ ও ১৯ জানুয়ারি শুনানি শেষে বহুল আলোচিত এ রিটের রায় দেন। পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি আমদের কাছে এসে পৌঁছেছে।
রায়ে বলা হয়েছে, হিন্দু দেবতার সেবায়েত দাবি করে রাগীব আলী সরকারের কোষাগার থেকে ক্ষতিপূরণ বাবদ ৩০ লাখ ৭৬ হাজার ১৮৯ টাকা ২০ পয়সা উত্তোলন করেন, যা অবৈধ ও এখতিয়ারবহির্ভূত। রায়ের কপি হাতে পাওয়ার ৭ দিনের মধ্যে এ টাকা বৈধ সেবায়েতের অ্যাকাউন্টে জমা দিতে বলা হয়েছে।
আদালতের ১৭ দফা নির্দেশনায় বলা হয়েছে- ধর্মীয় উপাসনালয় বা ট্রাস্ট যখন গঠন হয় তখন তা উৎসর্গ হয় দেবতার নামে। তারাপুরে হিন্দু দেবতা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এই হিন্দু দেবতার সেবায়েত কখনও অন্য কাউকে দায়িত্ব দিতে পারেন না, যদিও তিনি কো-ট্রাস্টি। অতএব আপাতদৃষ্টিতে দেবতাই সম্পত্তির মালিক। সেবায়েতের অফিস ধর্মীয় কাজেই ব্যবহৃত হবে। প্রতিষ্ঠিত দেবতার অন্য ধর্ম বিশ্বাসীরা সেবা করতে পারেন না। ফলে দেবতার নামে দানপত্র অভিযুক্ত সেবায়েত কর্তৃক ৯৯ বছরের লিজ দেয়া অবৈধ। নির্দেশনায় বলা হয়েছে, যেহেতু কথিত লিজগ্রহীতা ও সেবায়েত বৈধ নন, তাই আগামী ৬ মাসের মধ্যে মেডিকেল কলেজ-হাসপাতাল, ছাত্রাবাস, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, হাউজিংসহ সব স্থাপনা সরিয়ে নিতে হবে। মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালকে সুবিধাজনক ভালো একটি স্থানে স্থানান্তর করতে হবে যাতে শিক্ষার্থীদের কোনো অসুবিধা না হয়। এর প্রয়োজনীয় সব খরচ রিট পিটিশনারদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি থেকে দিতে হবে। এজন্য তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করতে হবে। তারাপুর চা বাগান থেকে মেডিকেল-হাসপাতাল, বাসাবাড়ি, বাণিজ্যিক ভবন, হাউজিং উচ্ছেদ করে সেখানে নতুন করে চা বাগান সৃজন করতে হবে। ফিরিয়ে আনতে হবে পূর্বাবস্থা। এছাড়া দাতার প্রতিষ্ঠিত হিন্দু দেবতা আগের স্থানে স্থাপন করতে হবে, যদি তা সরানো হয়ে থাকে। উচ্চ আদালতের এ রায় রিট পিটিশনার আবদু হাইয়ের হাতে পৌঁছানের এক মাসের মধ্যে তারাপুর চা বাগান হিন্দু দেবতার প্রকৃত সেবায়েতের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। এসব নির্দেশনা অনুযায়ী বাগানের মালিকানা হস্তান্তর ও স্থাপনা সরিয়ে নেয়া না হলে দেবতার সেবায়েত, পুলিশ প্রশাসন ও সিটি কর্পোরেশনকে যৌথভাবে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। উচ্ছেদসংক্রান্ত সব ব্যয় রিট পিটিশনার আবদুল হাই ও তার বাবা রাগীব আলীর কাছ থেকে আদায়ের জন্য জেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। হিন্দু দেবতার বৈধ সেবায়েতের অনুপস্থিতিতে সিলেট শহরের ১০ জন যাজকের মতামত নিয়ে একজন সেবায়েত নিযুক্ত করার জন্য জেলা প্রশাসককে বলা হয়েছে। রিটকারীরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এ আদেশ মানতে ব্যর্থ হলে আইনগত ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, রিট পিটিশনারদের বিরুদ্ধে সিলেট কোতোয়ালি থানায় ২০০৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ও একই বছরের ২ নভেম্বর দায়েরকৃত জালিয়াতি মামলা দুটি দ্রুততার সঙ্গে শেষ করতে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটকে নির্দেশ দিয়েছেন উচ্চ আদালত।
জানা গেছে, ১৯১৫ সালের ২ জুলাই বৈকুণ্ঠ চন্দ্র গুপ্ত তার তারাপুর চা বাগানসহ সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি শ্রী শ্রী রাধাকৃষ্ণ জিউড় দেবতার নামে রেজেস্ট্রি দানপত্র করে দলিল করেন। তখন থেকে এ সম্পত্তি দেবোত্তর হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এরও আগে বাগানটি তৎকালীন আসাম প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত জনসন অ্যান্ড কোম্পানির নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। বৈকুণ্ঠ চন্দ্র গুপ্তের মৃত্যুর পর রাজেন্দ্র লাল গুপ্ত এ সম্পত্তির সেবায়েত নিযুক্ত হন। যুদ্ধকালীন সময়ে রাজেন্দ্র গুপ্ত প্রাণ হারালে তার ছেলে পংকজ কুমার গুপ্ত বাগানটির সেবায়েত নিযুক্ত হন। পংকজ গুপ্ত ভারত চলে গেলে কথিত পাওয়ার অব অ্যাটর্নি মূলে দেবোত্তর সম্পত্তির সেবায়েত বনে যান রাগীব আলীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয় দেওয়ান মোস্তাক মজিদ। একজন মুসলমানকে দেবোত্তর সম্পত্তির সেবায়েত করা হয় ‘পাওয়ার অব অ্যাটর্নি’ জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে। পরে মোস্তাক মজিদ রাগীব আলীর ছেলে আবদুল হাইকে ৯৯ বছরের জন্য লিজ দেন বাগানটি।