রানি এলিজাবেথের সাথে প্রিন্সেস ডায়ানার সম্পর্ক ছিল রাজতন্ত্রের জন্য বড় পরীক্ষা
বাংলা সংলাপ রিপোর্টঃ রানির কাছে শেষ পর্যন্ত তিনি ছিলেন “সেই ত্যাড়া মেয়ে।” ডায়ানা অবশ্য বলতেন তার শাশুড়িকে তিনি “দারুণ শ্রদ্ধা” করেন এবং তাঁর জন্য সব কিছু করতে রাজি আছেন।
কিন্তু মনে হয় না রানি তেমনটা অনুভব করতেন, কারণ রানি দেখেছিলেন ডায়ানা তাঁর জীবদ্দশায় এবং মৃত্যুর পর রাজতন্ত্রের উপর কীধরনের প্রভাব ফেলেছিলেন।
রাজ পরিবারের বাইরে থেকে এসে রাজ পরিবারের কাউকে বিয়ে করা একটা সাহসী পদক্ষেপ- এমনকী ডায়ানার মত একজনের পক্ষেও যিনি রাজ পরিবারের ধারা সম্পর্কে অতি পরিচিত ছিলেন।
এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম হয়েছিল ডায়ানার, ছোটবেলায় তার বছর কয়েক কেটেছিল পার্ক হাউস নামে এক বাড়িতে যেটি ছিল রানির অন্যতম একটি আবাস স্যান্ড্রিংহামের ঢিল-ছোঁড়া দূরত্বে।
রানি নিঃসন্দেহে মনে করতেন এই মেয়েটির রাজ পরিবারে প্রিন্সেস হবার সবরকম যোগ্যতা আছে।
তবে খুব শিগগিরি এটা বেশ স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে আবেগপ্রবণ উঠতি বয়সের তরুণী ডায়ানা প্রাসাদের কঠোর মধ্যযুগীয় নিয়মনীতি নির্ভর জীবনের জন্য তখনও তৈরি ছিলেন না।
এ ব্যাপারে তাঁর ভাবী স্বামীর সাহায্যও তিনি পান নি। চার্লসের রাশভারী চরিত্র ছিল ডায়ানার উচ্ছ্বল ও বর্হিমুখী চরিত্রের বিপরীত। এছাড়াও চার্লসের মনেপ্রাণে তখনও ছায়া ফেলে রেখেছিলেন তাঁর প্রাক্তন প্রেমিকা ক্যামিলা পার্কার-বোলস্।
চার্লস ও ডায়ানার বাগদানের পর এক টিভি সাংবাদিক যখন চার্লসকে জিজ্ঞেস করেছিলেন তিনি কি ডায়ানার প্রেমাসক্ত – তখন চার্লসের দায়সারা গোছের জবাব, “ওই প্রেম বলতে যা বোঝায় আর কী”- সেটাই ওই দম্পতির সম্পর্ক কেমন হতে যাচ্ছে সে বিষয়ে একটা ইঙ্গিত দিয়েছিল।
রানি তার ছেলেমেয়েদের বিয়ের ব্যাপারে খুব কমই নাক গলানোর নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন।
মুডের সমস্যা
অনেক ভাষ্যকার বলেছেন রানির আসলে উচিত ছিল রাজ পরিবারে নতুন সদস্য যারা আসছেন , তাঁদের পরিবারের রীতিনীতি সম্পর্কে পরামর্শ ও নির্দেশ দেওয়া।
ডায়ানা রাজ পরিবারের এসে অসহায় ও বিচ্ছিন্ন বোধ করতেন- বুঝতে পারতেন না তাঁর কাছে প্রত্যাশা কী-এবং ভাল কিছু করলে কখনও প্রশংসা না পেয়ে হতাশ বোধ করতেন।
প্রিন্স চার্লসের মত রানিও প্রিন্সেস ডায়ানার ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশে অস্বস্তি বোধ করতেন- বুঝতে পারতেন না কীভাবে পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে। রানির বড় হয়ে ওঠার অভিজ্ঞতা ছিল ভিন্ন। তাঁর সময়ে মনের ভাব বা অনুভূতি প্রকাশ করার চল ছিল না।
ডায়ানার মেজাজ-মর্জি এবং নজর কাড়ার জন্য তাঁর নেওয়া নাটকীয় কিছু পদক্ষেপ তারা কীভাবে সামলাবেন আসলে সেটা তারা বুঝতে পারতেন না।
অনেকে মনে করতেন জনমত কীভাবে নিজের দিকে টানতে হয়, সে ব্যাপারটা ডায়ানা ভাল বুঝতেন এবং তা ব্যবহারও করতেন। রাজ পরিবার এব্যাপারেও অদক্ষ ছিল।
রানি দেখলেন ডায়ানা এবং চার্লসের বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে। অথচ এই বিয়ে থেকে অনেক কিছু আশা করেছিলেন তিনি।
তিনি পাশ থেকে শুধু শান্তি বজায় রাখার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি খুব ভাল করেই বুঝতে পারছিলেন এক্ষেত্রে তাঁর ছেলের ব্যর্থতা এবং পরিণামে এই বিয়ের ব্যর্থতা রাজতন্ত্রের ভবিষ্যতের উপর একটা বড়ধরনের আঘাত হয়ে আসবে।
শেষ চেষ্টা
চার্লস আর ডায়ানার মধ্যে সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটার পর রানি ছেলের বিবাহিত জীবনে নাক না-গলানোর যে নীতি মেনে চলছিলেন তার থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি দুজনকে কথা বলতে ডেকে পাঠান এবং তাদের অুনরোধ করেন এই বিয়ে টিঁকিয়ে রাখতে তারা যেন শেষবারের মত চেষ্টা করেন।
কিন্তু তাতে কোন ফল হল না। ডায়ানা বিবিসির প্যানোরামা অনুষ্ঠানে এক সাক্ষাৎকারে তাঁর কাহিনি বিশ্বের সামনে তুলে ধরার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর রানি আবার এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের সিদ্ধান্ত নিলেন।
তিনি দুজনকেই আলাদা করে চিঠি লিখে বললেন তাদের সামনে এখন একটাই পথ খোলা আছে -বিবাহবিচ্ছেদ।
নাতিদের কথা মাথায় রেখে রানি ডায়ানার সঙ্গে ভাল সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। কিন্তু তাদের ডিভোর্সের পর রানি ও ডায়ানার সম্পর্কে আরও অনেক দূরত্ব তৈরি হয়।
ডায়ানার মৃত্যুর পর রানির বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, তিনি জনগণের মনমানসিকতা বুঝতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। রানি তখন তাঁর শোকাহত দুই নাতিকে সান্ত্বনা দিতে ছিলেন বালমোরাল প্রাসাদে।
এই ঘটনার পর বহু সংবাদপত্রে ডায়ানার মৃত্যুতে রানির প্রতিক্রিয়ার প্রতি ইঙ্গিতপূর্ণ নাটকীয় নানা শিরোনাম আসায় আর জনমতেও এর প্রতিফলন ক্রমশ বাড়তে থাকায় তিনি লন্ডনে ফিরে আসতে বাধ্য হন।
ডায়ানার শেষকৃত্যের আগের দিন রানি নজিরবিহীন এক টেলিভিশন ভাষণ দেন, যাতে তিনি তাঁর পুত্রবধূ সম্পর্ক খোলামেলা কথা বলেন।
তাঁর সেই সম্প্রচার ছিল যুগান্তকারী। এতে রানি, রাজকুমারী ডায়ানার আবেগ এবং সমাজে তাঁর অবদানকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।
বলা হয়, রানি তাঁর এই ভাষণের মধ্যে দিয়ে রাজতন্ত্রকে একটা বিপর্যয়ের দোরগোড়া থেকে উদ্ধার করেছিলেন।
রাজকুমারী ডায়ানার মরদেহ নিয়ে কফিন বাকিংহাম প্রাসাদের ফটক অতিক্রম করার সময় রানি তাঁর পুত্রবধূকে শেষ বিদায় জানিয়েছিলেন।
যে তরুণ রাজকুমারী এত লক্ষ লক্ষ মানুষের ভালবাসা আর সম্মানে সিক্ত হয়েছিলেন, কিন্তু শাশুড়ির কাছে থেকে গিয়েছিলেন একটা হেঁয়ালি হয়ে, সেই নারীর শেষ বিদায়ে মাথা নুইয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন রানি এলিজাবেথ।