রোজাদার ফুটবলারদের জন্য ইংলিশ ফুটবলে ‘বিশেষ নির্দেশনা’
ডেস্ক রিপোর্টঃ রমজান মাস উপলক্ষ্যে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ এবং ইংলিশ ফুটবল লিগে খেলা চলাকালে খেলোয়াড়দের বিরতি দেয়াসহ রেফারিদের বেশকিছু বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছে ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন-এফএ।
এর অর্থ হচ্ছে, এখন থেকে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের প্রত্যেক ম্যাচের সময় রোজা রাখা মুসলিম ফুটবলার এবং ম্যাচ কর্মকর্তাদের জন্য বিশেষ বিরতি দেবেন রেফারিরা।
এর আগে ফুটবলাররা নিজে থেকে বিরতি বা ইফতারের সময় খুঁজে নিতেন।
কিন্তু এবার রমজান শুরুর আগেই এফএ’র বিশেষ চার্টারে সবগুলো ক্লাব সম্মত হয়েছে। এর ফলে রোজা রাখবেন যেসব মুসলিম ফুটবলার ইফতারের সময় তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে বিরতি দেয়া হবে।
এর আগে ২০২১ সালে ‘মুসলিম অ্যাথলিট চার্টার’ নামে একটি সনদে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মতি জানিয়েছিল কয়েকটি ক্লাব।
ওই চার্টারটি সকল মুসলিম অ্যাথলিটদের জন্য তৈরি করা হয়েছিল।
কিন্তু এবার এফএ’র নতুন নির্দেশনায় বিষয়টি এখন থেকে সব ফুটবল ম্যাচের জন্য প্রযোজ্য হবে।
মুসলিম ফুটবলারদের জন্য ‘বিশেষ চার্টার’
রেফারিদের দেয়া নতুন নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ম্যাচ শুরুর আগেই কোন কোন ফুটবলার রোজা রেখেছেন তাদের সাথে কথা বলে নিতে।
এরপর ম্যাচ চলাকালে একটা আনুমানিক সময় বাছাই করতে, যখন একটি বিরতি দেয়া হবে এবং ওই সময়ে তারা রোজা শেষে ইফতার করতে পারবেন।
রেফারিদের বলা হয়েছে, বিরতিতে রোজাদার ফুটবলাররা তরল, এনার্জি জেল কিংবা সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করতে পারবেন, যাতে রোজা রাখার পরেও শরীরে যথেষ্ট শক্তি থাকে এবং ধর্মীয় রীতিও পালন করতে পারেন একজন ফুটবলার।
ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ফুটবলার ইসলাম ধর্মের অনুসারী।
লিভারপুলের মোহামেদ সালাহ, চেলসির এনগোলো কান্দে, ম্যানচেস্টার সিটির রিয়াদ মাহারেজরা রোজা রাখেন বলে জানা গেছে।
মাঠে এই ফুটবলারদের নানা ধরণের ধর্মীয় আচার পালন করতে দেখা যায়। বিশেষত খেলা শুরুর আগে দোয়া করা কিংবা গোল দেয়ার পর তা নিয়ে আনন্দ প্রকাশের সময়।
দুই হাজার একুশ সালে করা মুসলিম চার্টারে সব মিলিয়ে ১০টি পয়েন্ট ছিল, যার মধ্যে অ্যালকোহল পরিহার এমনকি কোন উদযাপনের সময়েও, প্রার্থনার জন্য উপযোগী স্থানের ব্যবস্থা করা, হালাল খাবার এবং রমজান মাসে রোজা রাখার অনুমতি দেয়া।
সেসব পয়েন্ট এখনো বলবৎ আছে।
অলাভজনক সংস্থা নুজুম স্পোর্টসের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী এবাদুর রহমান বিবিসি স্পোর্টকে সেসময় বলেছিলেন, “আমি খেলাধুলার জগতে কাজ করার সুবাদে জানি যে এখানে আমার ধর্ম মেনে চলা কতটা কঠিন।”
“খেলোয়াড় ও ক্লাবগুলোর সাথে কথা বলে আমরা এটা অনুভব করেছি যে যুক্তরাজ্যে একটি মুসলিম অ্যাথলিট চার্টার চালু করার এটাই সঠিক সময়। আমরা বিশ্বাস করি এটাই প্রথম এবং এর মতো কিছু আগে হয়নি,” তিনি বলেন।
মি. রহমান ওই চার্টারকে সংহতি, সমতা এবং নিজেদের ক্লাব ও টিমে মুসলমান খেলোয়াড়রা যে অবদান রাখছে তাকে স্বীকৃতি দেয়ার ইতিবাচক আন্দোলন বলে বর্ণনা করেছিলেন।
তবে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে এর আগেও ইফতার করার জন্য বিরতি দেয়া হয়েছিল।
দুই হাজার একুশ সালে লেস্টার সিটি এবং ক্রিস্টাল প্যালেসের মধ্যকার একটি ম্যাচে রেফারি গ্রাহাম স্কট বিরতি দিয়েছিলেন, সেই ম্যাচে ওয়েসলি ফোফানা এবং শেইখো কোয়াটে সূর্য ডোবার সময় রোজা ভেঙ্গেছিলেন।
সেসময় ফোফানা টুইট করে প্রিমিয়ার লিগ কর্তৃপক্ষ এবং ক্রিস্টাল প্যালেসের গোলকিপার ভিসেন্তে গুয়াইতাকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন, এই গোলকিপার গোলকিকের সময় মুসলমান ফুটবলারদের অনুরোধে বিরতি দিয়েছিলেন এবং রেফারি অনুমোদন দিয়েছিলেন ইফতারি করার জন্য।
ইংল্যান্ডে ২৩শে মার্চ থেকে ২২শে এপ্রিল পর্যন্ত রমজান মাস চলবে।
মুসলিম ফুটবলাররা কী বলছেন
ইংল্যান্ডের ক্লাব পর্যায়ের দলগুলো এবং একাডেমিতে মোট ২৫৩ জন মুসলমান ফুটবলার আছেন।
নুজুম স্পোর্টস নামে একটি অলাভজনক সামাজিক সংগঠন এই ফুটবলারদের অধিকার নিয়ে কাজ করে।
ইসলামে রমজান মাস পবিত্র মাস হিসেবে বিবেচিত এবং এই মাসে যারা রোজা রাখেন তাদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতাকে বিবেচনায় রাখার পরামর্শ দিচ্ছে নুজুম স্পোর্টস।
ইংলিশ ক্লাব এভারটনের মিডফিল্ডার আবদুলায়ে ডুকোওরে বিবিসি স্পোর্টকে বলেন, “আমি রমজান ভালোবাসি। কখনো কখনো রমজানে ফুটবল খেলা কঠিন, বিশেষত গ্রীষ্মকালে যখন রমজান মাস আসে।
কিন্তু আমি সবসময় রোজা রাখি এবং এটা আমার খেলায় কোনও প্রভাব ফেলেনি।”
ডুকোওরের মতো অনেক মুসলিম ফুটবলারের জন্য ধর্মীয় রীতিনীতি বড় প্রভাব রাখে তাদের জীবনে।
ডুকোওরে বলেন, “ধর্ম আমার জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, আমি সবসময় ধর্ম আগে রাখি, এরপর আমার কাজ। দুটো একসাথে যদি চলে আমি কোনও সমস্যা দেখিনা।”
তিনি নিয়মিত মসজিদে যান, বৃহত্তর ম্যানচেস্টারে তার পরিবার নিয়ে থাকেন তিনি যারা সবাই খুব ধার্মিক।
ডুকোওরে ইংল্যান্ডকে ইউরোপের সেরা দেশ মনে করেন, কারণ তিনি এখানে নিজের ইচ্ছামতো ধর্মীয় আচার পালন করতে পারেন।
এভারটনে তিনজন মিডফিল্ডার খেলেন তিনজনই মুসলিম।
ডুকোওরে বলেন তাদের মধ্যে খুব ভালো সম্পর্ক, তারা ড্রেসিংরুমে একসাথে প্রার্থনা করেন বা নামাজ পড়েন।
এতে ইদ্রিসা গুয়ে ইমামের দায়িত্ব পালন করেন। তারা একসাথে জুম্মার নামাজ পড়তে মসজিদে যান।
গত বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে রমজান মাসে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের মোট ৫২টি ম্যাচ মাঠে গড়িয়েছিল, এর মধ্যে নয়টি ম্যাচের মধ্যে ইফতারের সময় মাঠে খেলা চলছিল।
যদিও মুসলিম ফুটবলারদের কোনও ধরনের সমস্যা হয়নি, তবে এবার প্রিমিয়ার লিগ রোজা রেখে খেলার বিষয়টিকে আরও গুরুত্বের সাথে দেখছে।
নুজুম স্পোর্টস রেফারিদের পেশাদার সংগঠন প্রফেশনাল গেম ম্যাচ অফিসিয়ালস লিমিটেডের সাথে একটি কর্মশালার আয়োজন করেছে, যেখানে রেফারিদের রোজার মৌলিক বিষয়গুলো সম্পর্কে ধারণা দেয়া হয়েছে।
মুসলিম চ্যাপলেইন্স ইন স্পোর্ট ২০১৪ সাল থেকেই যুক্তরাজ্যে মুসলিম অ্যাথলিটদের নিয়ে কাজ করছে, তাদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে আছে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ ও ইএফএল।
প্রিমিয়ার লিগ ইসলাম সংক্রান্ত নানা বিষয়ে এই প্রতিষ্ঠান থেকে পরামর্শ নিয়ে থাকে।
কীভাবে অনুশীলন করলে এবং কী ধরনের খাবার একজন ফুটবলারকে রোজা রেখে খেলতে সাহায্য করবে এ বিষয়ে গবেষণাও হয়েছে বিস্তর।
এই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইসমাইল ভামজি বিবিসি স্পোর্টকে বলেছেন, মুসলমান ফুটবলাররা বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রিমিয়ার লিগে এসেছেন। তাদের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট আছে। এসব বিষয়ে মাথায় রেখেই আমরা কাজ করছি।
“প্রিমিয়ার লিগের শীর্ষ দুই ক্লাব ম্যানচেস্টার সিটি এবং লিভারপুল আমাদের থেকে সাহায্য নিয়ে থাকে, এই ক্লাব দুটির মৌলিক বিষয়গুলো খুব পোক্ত। পেপ গার্দিওলা এবং য়ুর্গেন ক্লপও কোচ হিসেবে উদার মনের, তারা ফুটবলারদের সুবিধা-অসুবিধা বোঝেন,” তিনি বলেন।
ইংল্যান্ডজুড়েই রমজানকে আলাদাভাবে পালন করা হচ্ছে এখন, লন্ডনের ক্লাব চেলসি ২৬শে মার্চ তাদের স্টেডিয়াম স্ট্যামফোর্ড ব্রিজে ইফতার পার্টি আয়োজন করবে।
এটাকে যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে বড় কমিউনিটি ইভেন্ট বলছে ক্লাবটি।
স্থানীয় মসজিদগুলোর সদস্যরা এবং চেলসির মুসলিম সমর্থক গোষ্ঠীদের আলাদাভাবে দাওয়াত দিচ্ছে ক্লাব কর্তৃপক্ষ।
বাকিরা টিকিট কেটে এই ইফতার পার্টিতে অংশ নিতে পারবেন।