আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনকে যেভাবে ধ্বংস করার পরিকল্পনা হচ্ছে
ডেস্ক রিপোর্টঃ প্রায় আড়াই দশক ধরে মহাকাশে নভোচারীদের আবাসস্থল হিসেবে কাজ করছে আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশন বা আইএসএস । কিন্তু তার এখন বিদায় নেবার সময় হয়েছে। আর কয়েক বছরের মধ্যেই এটিকে কক্ষপথ থেকে ছাড়িয়ে পৃথিবীতে নামিয়ে এনে ধ্বংস করে ফেলা হবে বলে পরিকল্পনা করছে নাসা। কিন্তু এ মহাকাশ স্টেশনকে কি অন্য কোন কাজে লাগানো সম্ভব?
একটা ফুটবল মাঠের সমান বড়, আর ২০০টি হাতির মোট ওজনের চেয়েও ভারি এই বিশাল আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন।
একে কক্ষপথ থেকে নামিয়ে আনা এক অত্যন্ত জটিল চ্যালেঞ্জ।
কিন্তু সেটাই ঘটতে যাচ্ছে আগামী আট বছরের মধ্যে – কারণ মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসা এমনই এক পরিকল্পনা তৈরি করেছে।
আপনি যদি সে সময় ঘটনাচক্রে প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে থাকেন – তাহলে দেখতে পাবেন সেই আশ্চর্য দৃশ্য।
প্রায় ৪০০ টন ধাতব পদার্থ দিয়ে তৈরি আইএসএস তীব্র গতিতে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ঢুকছে, বাতাসের সাথে সেই ঘর্ষণে তার গায়ে আগুন ধরে যাচ্ছে, তার পর সেই জ্বলন্ত অগ্নিগোলক আছড়ে পড়ছে সাগরের বুকে।
সমুদ্রের কয়েক হাজার কিলোমিটার এলাকার মধ্যে কোথাও ঘটবে এ ঘটনা।
আর এর সাথেই শেষ হবে মানবজাতির মহত্তম প্রকল্পগুলোর একটি এই আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের জীবনকাল।
মহাকাশে নভোচারীদের ‘বাড়ি’
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনটি তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল ১৯৯৮ সালে। তখন থেকেই এটি পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে।
প্রথম এখানে নভোচারীরা থাকতে আসেন ২০০০ সালে। তার পর থেকে ২০টি দেশের আড়াইশো’রও বেশি লোক এখানে এসে থেকেছেন।
“এই মহাকাশ স্টেশন এক বিরাট সাফল্য” বলছেন জোসেফ এ্যাশবাকার, ইউরোপিয়ান মহাকাশ সংস্থা ইএসএ’র প্রধান – যারা এই কর্মসূচির অনেকগুলো অংশীদার দেশ ও সংস্থার একটি।
এই আইএসএস ছিল আন্তর্জাতিক সহযোগিতারও একটি কেন্দ্র – বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের কিছুদিন পর থেকেই রাশিয়া এ প্রকল্পে যোগ দেয়।
নাসার সাবেক বিজ্ঞানবিষয়ক প্রধান টমাস জারবুশেন বলছেন এটা হচ্ছে বড় আন্তর্জাতিক বিজয়গুলোর অন্যতম।
যন্ত্রপাতি পুরোনো হয়ে গেছে
কিন্তু এর যন্ত্রপাতিগুলোর অধিকাংশই এখন কয়েক দশকের পুরোনো হয়ে গেছে।
এর ফলে ভবিষ্যতে এই স্টেশনটা বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে, এমনকি সঠিক কক্ষপথে রাখার জন্য তাকে নিয়ন্ত্রণ করাও অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে।
১৯৮৫ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের স্যালুট-৭ স্পেস স্টেশনের বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গিয়ে এমনটাই ঘটেছিল।
তখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দুজন নভোচারী সেটাকে আবার চালু করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
“এমনটা আবার ঘটুক তা আমরা চাই না” – বলছেন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল এয়ার এ্যান্ড স্পেস মিউজিয়ামের ইতিহাসবিদ ক্যাথি লুইস।
কেন ধ্বংস করে ফেলা হবে আইএসএসকে
এধরনের কোন বিপর্যয় ঠেকানোর জন্যই নাসা পরিকল্পনা করেছে যে আগামী ২০৩১ সালে আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনকে ‘ডি-অরবিট’ করা হবে – অর্থাৎ কক্ষপথ থেকে নামিয়ে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ঢুকিয়ে এটিকে নিরাপদে সাগরে আছড়ে ফেলা হবে।
আজ পর্যন্ত যত মহাকাশযান পৃথিবীতে ফিরে এসেছে – তার মধ্যে এটিই হবে বৃহত্তম ।
টাগবোট নামের ছোট নৌযান দিয়ে যেমন বড় জাহাজ টেনে নিযে যাওয়া হয়, ঠিক তেমনি একটি “স্পেস টাগ“ তৈরির করার জন্য গত মার্চ মাসে মার্কিন কংগ্রেসের কাছে অর্থ চেয়েছে মহাকাশ সংস্থা নাসা ।
এই স্পেস টাগ হবে এমন এটি মহাকাশযান যা আইএসএসকে ঠেলে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে নিয়ে আসবে। এরকম একটা যান তৈরি করতে প্রায় ১০০ কোটি ডলার খরচ হবে – বলেছেন নাসার হিউম্যান স্পেসফ্লাইট কর্মসূচির প্রধান ক্যাথি লুডার্স।
ঠিক কীভাবে আইএসএসকে তার কক্ষপথ থেকে বের করে আনা হবে তা এক বিশাল চ্যালেঞ্জ।
পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে ঢোকার সময় বড় বড় মহাকাশযান পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। যেমন ২০০১ সালে রাশিয়ার মির স্পেস স্টেশন, এবং ১৯৭৯ নাসার স্কাইল্যাব।
তবে আইএসএসের ক্ষেত্রে সমস্যাটা আরো জটিল – কারণ এটা মিরের চেয়ে তিনগুণেরও বেশি বড়।
হার্ভার্ড-স্মিথসোনিয়ান সেন্টার ফর এ্যাস্ট্রোফিজিক্সের মহাকাশবিজ্ঞানী জোনাথন ম্যাকডাওয়েল বলছেন, এটা এক বড় চ্যালেঞ্জ, কারণ ৪০০ টন ওজনের একটা জিনিস আকাশ থেকে খসে পড়ছে – এটা কোন সহজ ব্যাপার নয়।
বিশাল এক মহাকাশ স্টেশন
আইএসএসের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৯৮ সালে রাশিয়ার তৈরি জারিয়া মডিউল দিয়ে। আজকে এ স্টেশন বিরাট রূপ নিয়েছে।
এর দৈর্ঘ্য ১০৯ মিটার – একটা ফুটবল মাঠের সমান এই আইএসএস হচ্ছে মহাশূন্যে মানুষের তৈরি বৃহত্তম কাঠামো।
এতে আছে ১৫টি মডিউল। বিশাল ধাতব ফ্রেমের ওপর বসানোর অতিকায় সৌরশক্তির প্যানেল। এতে পালা করে থাকেন সাতজন ক্রু।
মহাশূন্য বিশ্লেষক লরা ফরজাইক একে তুলনা করেছেন গিজার পিরামিডের সাথে।
আইএসএসকে পরিত্যক্ত করার চিন্তা আগেও হয়েছে, কিন্তু তার পর আবার বেশ কয়েক দফায় তার জীবনকাল বাড়ানো হয়েছে। তবে এখন অধিকাংশ বিশেষজ্ঞই একমত যে ২০৩০ সালের পর এটাকে ব্যবহার করা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে।
বিকল্প হিসেবে কখনো কখনো বলা হয়েছে আরো উঁচুতে নিরাপদ কোন কক্ষপথে এটিকে নিয়ে যাওয়ার কথা।
কিন্তু এটাকে অবাস্তব চিন্তা বলেই মনে করছে নাসা।
নাসা বলছে, আইএসএসকে ঠেলে উচ্চতর কক্ষপথে নিয়ে যেতে হলে অনেকগুলো মহাকাশযান লাগবে।
এর পরিবর্তে নাসা গত বছর এক পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে। তা হলো আইএসএসকে ঠেলে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে নিয়ে আসা হবে।
কীভাবে নামিয়ে আনা হবে আইএসএসকে
আইএসএসকে পর্যায়ক্রমে কক্ষপথ থেকে নামিয়ে আনার কাজটা শুরু হবে ২০২৬ সাল থেকে।
প্রথমে একে আপনা থেকেই কিছুটা নিচে নেমে আসতে দেয়া হবে। বর্তমানে এটা আছে মাটি থেকে ২৫০ মাইল ওপরে, আর ২০৩০ সালের মাঝামাঝি নাগাদ এটা নেমে আসবে ২০০ মাইল উচ্চতায়।
তখন এই স্টেশনে শেষবারের মত একদল ক্রু পাঠানো হবে। তারা আইএসেএসের ভেতরে কোন যন্ত্রপাতি বা ঐতিহাসিক গুরুত্বসম্পন্ন কোন জিনিস যেন রয়ে না যায় – তা নিশ্চিত করবেন। এভাবে আইএসএসের ওজনও খানিকটা কমিয়ে ফেলা হবে।
ক্রুদের এই শেষ দলটি আইএসএস ছেড়ে চলে যাবার পর মহাকাশ স্টেশনটি আরো খানিকটা নিচে – ২৮০ মাইল উচ্চতায় – নেমে আসবে।
মনে করা হয় যে এটিই হচ্ছে ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্ন ‘ – অর্থাৎ এর পর আইএসএসকে আর ওপর দিকে ঠেলে ওঠানো যাবে না – কারণ এ উচ্চতায় পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ওপরের স্তরের ঘনত্ব বেড়ে যাবে। এ প্রক্রিয়াটির জন্য সময় লাগবে কয়েক মাস।
এখানেই আইএসএসকে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ভেতরে ঠেলে দেবার কাজটা করবে ‘প্রগ্রেস’ নামের রুশ মহাকাশযান।
অবশ্য সম্প্রতি প্রগ্রেস মহাকাশযানের কিছু সমস্যা এবং রাশিয়া-আমেরিকা রাজনৈতিক সম্পর্ক খারাপ হতে থাকার কারণে নাসা এই বিকল্পটি নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা করছে। রাশিয়া এমন আভাসও দিয়েছে যে তারা হয়তো ২০২৫ সাল নাগাদ আইএসএস প্রকল্প থেকে বেরিয়ে যেতে পারে।
তবে যে মহাকাশযানই ব্যবহার হোক না কেন – তার ধাক্কায় আইএসএস নেমে আসবে ৭৫ মাইল উচ্চতায়।
পৃথিবীতে ফেরার আসল পর্ব শুরু
এখানে স্পেস স্টেশনটি পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের অপেক্ষাকৃত ঘন গ্যাসের স্তরে ঢুকে পড়বে।
এসময় তার গতি হবে ঘন্টায় ২৯,০০০ কিমি বা ১৮,০০০ মাইল।
এ পর্যায়ে প্রথমেই আইএসএসের সোলার প্যানেলগুলো মূল অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।
স্পেস স্টেশন মিরকে যখন পৃথিবীতে নামানো হয়েছিল সেসময়কার অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, আইএসএসের ক্ষেত্রে মোটামুটি ৬২ মাইল উচ্চতায় আসতে আসতেই সবগুলো সোলার প্যানেল ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে।
আইএসএস ৫০ মাইল উচ্চতায় নেমে এলে মূল মডিউলগুলো আলাদা হয়ে যেতে শুরু করবে। তখন এগুলোর তাপমাত্রা হবে কয়েক হাজার ডিগ্রি। এই প্রচণ্ড তাপে এগুলো গলে যাবে এবং ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে তাতে আগুন ধরে যাবে।
স্পেস স্টেশন মিরকে যখন নামিয়ে আনা হয় – সেই দৃশ্য টিভির দর্শককে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিল।
কিন্তু মিরের ওজন ছিল ১৪০ টন, আর আইএসএসের ওজন হচ্ছে এর প্রায় তিন গুণ – ৪০০ টন।
তাই আইএসএসের পৃথিবীতে ফেরার দৃশ্য হবে আরো বেশি চমকপ্রদ।
ম্যাকডাওয়েল বলছেন, “আপনি দেখবেন ৪০০ টনের একটি বিশাল জ্বলন্ত কাঠামো কিভাবে হাজার হাজার মাইল গতিতে বায়ুমন্ডলের ভেতর দিয়ে ছুটে যাচ্ছে।“
মাটিতে থাকা মানুষের কি কোন বিপদ হতে পারে?
আশা করা হচ্ছে সবকিছুই পরিকল্পনা মতো কাজ করবে, এবং আইএসএসের পতনশীল জ্বলন্ত টুকরোগুলো মানুষের জন্য কোন বিপদ সৃষ্টি করবে না।
আইএসএসের এক বিরাট অংশই পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলেই পুড়ে ছাই হয়ে যাবে।
যতটুকু অবশিষ্ট থাকবে – সেগুলো এসে পড়বে ‘পয়েন্ট নেমো’ নামে প্রশান্ত মহাসাগরের একটি বিস্তীর্ণ এলাকায় – যা নিউজিল্যান্ড ও দক্ষিণ আমেরিকার মাঝখানে।
এ জায়গাটিকে প্রায়ই মহাকাশযানের কবরখানা হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
কারণ এ জায়গাটি মানুষের বসতি থেকে অনেকটা দূরে এবং এখানকার পানিতে সামুদ্রিক প্রাণীও খুবই কম।
তার পরও আইএসএসের ধ্বংসাবশেষ যে জায়গাটিতে পড়বে তা প্রায় ৬,০০০ কিমি দীর্ঘ এবং বেশ কয়েক কিলোমিটার চওড়া।
সুতরাং এ এলাকাটিতে সেই সময় বিমান ও জাহাজ চলাচলের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করতে হবে – যাতে কোন প্রাণহানির সম্ভাবনা কমানো যায়, বলছেন ম্যাকডাওয়েল।
পরিত্যক্ত স্পেস স্টেশনটি কি অন্য কাজে লাগানো যায় না?
আইএসএস ধ্বংস হবার দৃশ্য দেখতে যতই দারুণ লাগুক – কিছু লোক মনে করেন যে এভাবে এটিকে কক্ষপথ থেকে নামিয়ে আনাটা আসলে অর্থের অপচয়।
একটা কারণ , এতে আছে অনেক মূল্যবান যন্ত্রপাতি, এবং এর কাঠামো আর সোলার প্যানেলে ব্যবহৃত ধাতু অনেক দামি। এগুলো মহাকাশে নিয়ে যেতেও বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়েছে।
“আমাদের উচিৎ এর যতটা পারা যায় ততটাই পুনর্ব্যবহার করা” – বলেন জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাশূন্য নীতি বিশেষজ্ঞ জন ক্লাইন।
যুক্তরাষ্ট্রের কিছু কোম্পানি ২০২২ সালের শেষ দিকে এরকমই কিছু প্রস্তাব হোয়াইট হাউসের কাছে পেশ করেছে। তাতে এসব ধাতব পদার্থকে অন্য কোন কাঠামো বা যান নির্মাণে ব্যবহার করা, মডিউলগুলোকে খুলে অন্য স্পেস স্টেশন নির্মাণে কাজে লাগানো – এরকম নানা প্রস্তাব আছে। নাসা যে কোন নতুন আইডিয়াকে স্বাগত জানালেও তারা এখনো নতুন কোন প্রস্তাব আহ্বান বা গ্রহণ – কোনটাই করেনি।
তাদের পরিকল্পনা এখনো অপরিবর্তিতই আছে।
আর তা হলো, আইএসএসকে পৃথিবীতে নামিয়ে এনে তার ধ্বংসাবশেষ প্রশান্ত মহাসাগরে কবরস্থ করা।
মানুষের মহাশূন্য অভিযানের এক অসাধারণ কীর্তির নাটকীয় সমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে হয়তো এভাবেই।