ইথিওপিয়ার রাজপুত্রের দেহাবশেষ কেন ফেরাতে নারাজ ব্রিটিশ রাজপরিবার
প্রায় ১৪৫ বছর আগে যুক্তরাজ্যে মাত্র ১৮ বছর বয়সে মারা যান ইথিওপিয়ার যুবরাজ প্রিন্স আলেমায়েহু।
যুবরাজ আলেমায়েহুর এক বংশধর ফাসিল মিনাস বিবিসিকে বলেছেন, “আমরা পরিবারের তরফ থেকে এবং ইথিওপিয়ার জনগণের পক্ষ থেকে তার দেহাবশেষ ফেরত চাই, কারণ ইংল্যান্ড তো তার জন্মস্থান নয়!”
“তাই যুক্তরাজ্যে তাকে কবর দেওয়া সঠিক ছিল না,” তিনি বলেন।
কিন্তু বাকিংহাম প্রাসাদের একজন মুখপাত্র এক বিবৃতিতে বিবিসিকে জানিয়েছেন যে উইন্ডসর প্রাসাদের সেন্ট জর্জেস চ্যাপেল থেকে তার মৃতদেহ খুঁড়ে তোলা যাবে না। তাতে কবরস্থ অন্য মৃতদেহগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
কিন্তু কী পরিস্থিতিতে মৃত্যু হয় যুবরাজের আর কেনই বা তাকে কবর দেওয়া হয় ব্রিটিশ রাজপরিবারের ব্যক্তিগত সমাধিক্ষেত্রে? পড়ুন সেই অজানা কাহিনি।
বৈরিতার শুরু
প্রিন্স আলেমায়েহুকে যখন ব্রিটেনে আনা হয় তার বয়স ছিল মাত্র সাত। অনাথ অবস্থায় যুক্তরাজ্যে পা রাখেন শিশু যুবরাজ। মায়ের সাথে তাকে আনা হচ্ছিল ব্রিটেনে। কিন্তু যাত্রা পথে মৃত্যু হয় তার মায়ের।
কিন্তু বালক আলেমায়েহুকে এত শিশু বয়সে তার মা সহ যুক্তরাজ্যে আনার পেছনে কী ছিল কাহিনি?
এর পেছনে ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ আর কূটনৈতিক ব্যর্থতার এক ইতিহাস।
সালটা ছিল ১৮৬২। যুবরাজের পিতা ইথিওপিয়ার প্রতাপশালী সম্রাট দ্বিতীয় টিওড্রোস তার সাম্রাজ্যের ভিত আরও শক্ত করার প্রয়াসে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে জোটবদ্ধ হতে চেয়ে চিঠি লিখেছিলেন রানি ভিক্টোরিয়াকে। কিন্তু তার চিঠির কোন উত্তর দেননি রানি ভিক্টোরিয়া।
এই নীরবতায় ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন সম্রাট টিওড্রোস। তিনি বেশ কয়েকজন ইউরোপিয়ানকে পণবন্দী করেন। তাদের মধ্যে ছিলেন ইথিওপিয়ায় ব্রিটিশ রাজপ্রতিনিধিও।
এর জবাবে শুরু হয় ইথিওপিয়ার সম্রাটের বিরুদ্ধে বিশাল এক সামরিক অভিযান। পণবন্দীদের উদ্ধারে লড়াইয়ে নামে ১৩ হাজার ব্রিটিশ ও ভারতীয় সেনা।
বাহিনীর মধ্যে এমনকি ছিলেন ব্রিটিশ যাদুঘরের একজন কর্মকর্তাও।
অবরোধ ও লুটপাট
উত্তর ইথিওপিয়ার মাগডালায় পাহাড়ের মাথায় সম্রাট টিওড্রোসের দুর্গ অবরোধ করে এই বাহিনী ১৮৬৮ সালে, এবং মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সম্রাটের প্রতিরোধ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয় তারা।
সম্রাট ব্রিটিশদের হাতে বন্দি হবার বদলে আত্মঘাতী হবার সিদ্ধান্ত নেন। আর সে কারণে ইথিওপিয়ার জনগণের কাছে তিনি হয়ে ওঠেন একজন বীর নায়ক।
যুদ্ধ শেষে, ব্রিটিশ সেনারা সেখান থেকে হাজার হাজার সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন লুটপাট করে, যার মধ্যে ছিল সোনার মুকুট, প্রাচীন পাণ্ডুলিপি, গলার হার এবং রাজকীয় পোশাক পরিচ্ছদ।
ঐতিহাসিকরা বলেন এত বিপুল ধনসম্পদ ব্রিটিশরা লুট করেছিল যা বহন করে আনতে লেগেছিল কয়েক ডজন হাতি এবং শত শত খচ্চর।
এসব পুরাতাত্ত্বিক সম্পদ এখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে শোভা পাচ্ছে ইউরোপের বিভিন্ন যাদুঘর আর লাইব্রেরিতে, এবং স্থান পেয়েছে বিভিন্ন মানুষের ব্যক্তিগত সংগ্রহশালায়।
যুবরাজ ও তার মায়ের পরিণতি
ব্রিটিশরা সঙ্গে নিয়ে আসে যুবরাজ আলেমায়েহু এবং তার মা সম্রাজ্ঞী তিরুওয়ার্ক উবে-কে।
ব্রিটিশদের যুক্তি ছিল তাদের নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে এবং সম্রাট টিওড্রোসের শত্রুদের হাতে তাদের ধরা পড়া ও সম্ভাব্য হত্যা ঠেকাতে তারা এই পদক্ষেপ নেয় – লিখেছেন যুবরাজ আলেমায়েহুর জীবন নিয়ে লেখা প্রিন্স অ্যান্ড প্লান্ডার বইয়ের লেখক অ্যান্ড্রু হেভেন্স।
তিনি লিখছেন সম্রাটের শত্রুরা সেসময় মাগডালা দুর্গের আশেপাশেই ওঁত পেতে ছিল।
অনাথ বালক আলেমায়েহু ১৮৬৮ সালে ব্রিটেনে পৌঁছনর পর তার দুর্দশা ও অনাথ অবস্থা দেখে সমবেদনা প্রকাশ করেন রানি ভিক্টোরিয়া। ইংল্যান্ডে দক্ষিণ উপকূলের অদূরে আইল অফ ওয়াইটে রানির অবকাশযাপন বাসস্থানে দুজনের সাক্ষাত হয়।
রানি জানান তিনি আর্থিকভাবে আলেমায়েহুর দায়িত্ব নেবেন। ইথিওপিয়া থেকে ক্যাপ্টেন ট্রিসট্রাম চার্লস সইয়ার স্পিডি নামে যার সাথে ওই অনাথ বালক ইংল্যান্ডে এসে পৌঁছেছিল, রানি তাকে আলেমায়েহুর অভিভাবক নিযুক্ত করেন।
বেড়ে ওঠার কঠিন দিনগুলো
প্রথমদিকে তারা দুজনে থাকতেন আইল অফ ওয়াইটে। পরে ক্যাপ্টেন স্পিডি বালক আলেমায়েহুকে নিয়ে বিশ্বের নানা জায়গায় বাস করেন। তারা দুজনে ভারতেও কিছুদিন ছিলেন।
কিন্তু একসময় সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে যুবরাজের আনুষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজন।
তাকে ফিরিয়ে আনা হয় ব্রিটেনে, ভর্তি করে দেয়া হয় উত্তর ইংল্যান্ডের রাগবি শহরে ব্রিটেনের একটি বেসরকারি স্কুলে। কিন্তু সেখানে যুবরাজের মন বসেনি। পরে তাকে পাঠানো হয় স্যান্ডহার্স্টের সামরিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়াল মিলিটারি কলেজে। সেখানে তার ওপর ‘বুলিং’ বা মানসিক নির্যাতন চালানো হতো।
লেখক অ্যান্ড্রু হেভেন্স লিখেছেন, চিঠিপত্র থেকে জানা যায় যুবরাজ নিজের দেশে ফিরে যেতে “উৎসুক” হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু তার সেই ইচ্ছাকে কোনভাবেই আমল দেয়া হয়নি।
“তার কষ্টটা আমি অনুভব করতে পারি। তার মনের কথা, মনে হয় যেন আমি বুঝতে পারি। ইথিওপিয়া থেকে, আফ্রিকা থেকে, কৃষ্ণাঙ্গ জনজাতির আবাসভূমি থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছিল, যেন তার নিজের ঘরবাড়ি বলতে কিছুই ছিল না,” বিবিসিকে বলেন তার আরেক বংশধর আবেবেক কাসা।
করুণ পরিণতি
অবশেষে যুবরাজ আলেমায়েহুকে লিডস এলাকায় এক সাধারণ বাসায় গৃহশিক্ষক রেখে লেখাপড়ার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু যুবরাজ অসুস্থ হয়ে পড়েন- তার সম্ভবত নিউমোনিয়া হয়েছিল।
এক পর্যায়ে তিনি চিকিৎসা নিতে অস্বীকৃতি জানান। তার ধারণা হয়েছিল তাকে বিষপ্রয়োগ করা হয়েছে।
এক দশক নির্বাসনে জীবন কাটানোর পর রাজপুত্র আলেমায়েহুর অকালমৃত্যু হয় মাত্র ১৮ বছর বয়সে ১৮৭৯ সালে।
তার অসুস্থতার সংবাদ সেসময় ব্রিটেনের জাতীয় পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়। তার অকালমৃত্যুতে মর্মাহত হয়েছিলেন রানি ভিক্টোরিয়া।
আলেমায়েহুর মৃত্যুসংবাদ শুনে রানি ভিক্টোরিয়া তার ডায়েরিতে এক শোক বার্তায় লিখেছিলেন:
“টেলিগ্রামে জানতে পারলাম আজ সকালে সুশীল যুবক আলেমায়েহু মারা গেছেন। আমি খুবই শোকাহত ও মর্মাহত। খবরটা নিদারুণ দুঃখজনক! একটা অপরিচিত দেশে একেবারে একাকী, নিজের কোন আত্মীয় বন্ধুবিহীন পরিবেশে এই মৃত্যু,” লেখেন রানি ভিক্টোরিয়া।
“জীবনে তিনি কোনদিন সুখ পাননি, তার জীবন ছিল সব দিক দিয়ে সমস্যায় জর্জরিত। তিনি ছিলেন খুবই স্পর্শকাতর। সবসময়ই তার মনে হতো তার গাত্রবর্ণের জন্য সবাই তার দিকে কটাক্ষ করছে…তার জন্য সবাই আন্তরিকভাবে দুঃখিত।”
এরপর রানি উইন্ডসর রাজপ্রাসাদের চ্যাপেলে তাকে সমাহিত করার ব্যবস্থা করেন।
দেহাবশেষ ফেরত পাঠানোর দাবি
যুবরাজের দেহাবশেষ তার স্বদেশে ফেরত পাঠানোর দাবি নতুন নয়।
২০০৭ সালে ইথিওপিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গিরমা ওল্ড-জিওর্গিস রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ জানিয়েছিলেন যুবরাজ আলেমায়েহুর মরদেহাবশেষ ইথিওপিয়ায় ফেরত পাঠানোর জন্য। কিন্তু তার সে চেষ্টা সফল হয়নি।
“আমরা তাকে ফেরত চাই। আমরা চাই না তার দেহাবশেষ বিদেশে পড়ে থাকুক,” বিবিসিকে বলেন মিজ আবেবেক।
“তার জীবন ছিল যন্ত্রণার। তার কথা যখনই ভাবি আমি কাঁদি। ব্রিটিশ রাজপরিবার যদি তার দেহাবশেষ ফিরিয়ে দিতে সম্মত হয়, আমি মনে করব যেন তিনি আবার সশরীরে নিজ ভূমিতে ফেরত এসেছেন,” বলেন বংশধর মিজ আবেবেক।
তার আশা সম্প্রতি ব্রিটেনের রাজা হিসাবে অভিষিক্ত তৃতীয় চার্লস তাদের আবেদনে ইতিবাচক সাড়া দেবেন।
ইথিওপিয়ার সাম্প্রতিক আবেদনের জবাবে বাকিংহাম রাজপ্রাসাদের জবাব হল উইন্ডসর প্রাসাদে সেন্ট জর্জেস চ্যাপেল থেকে তার মৃতদেহ খুঁড়ে তুললে সেই প্রক্রিয়া একই জায়গায় কবরস্থ অন্য মৃতদেহগুলোর ওপর প্রভাব ফেলবে।
“যুবরাজের দেহাবশেষ খুঁড়ে তোলা অসম্ভব বলেই আমরা মনে করি কারণ সেখানে আশেপাশে আরও অনেকের মৃতদেহ শায়িত আছে, যেগুলোর গায়ে আঁচড় লাগুক- আমরা চাই না,” বিবিসিকে বলেছেন প্রাসাদের মুখপাত্র।
ওই বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে চ্যাপেল কর্তৃপক্ষ প্রিন্স আলেমায়েহুর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং মনে করে তাকে সম্মান জানানো তাদের কর্তব্য। কিন্তু একই সঙ্গে “প্রয়াত অন্যান্য যারা সেখানে সমাহিত তাদের সম্মান রক্ষা করাটাও তাদের দায়িত্ব”।
প্রাসাদ কর্তৃপক্ষ আরও জানিয়েছে অতীতে ইথিওপিয়ার প্রতিনিধিদের ওই সমাধিস্থল পরিদর্শনের অনুরোধ রাজপরিবার রক্ষা করেছে।
কিন্তু ইথিওপিয়ায় যুবরাজের বংশধর এবং সামগ্রিকভাবে সেদেশের মানুষের অনুরোধকে সম্মান জানানোর বিষয়টাও গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন ব্রিটিশ ইথিওপিয়া সম্পর্ক বিষয়ে বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আলুলা প্যাংকহার্স্ট।
“পুরনো কিছু ফিরিয়ে দেয়া আপোষের একটা পথ। অতীতের ভুলকে স্বীকার করে নেবার একটা উপায়,” তিনি বলেন।
তিনি মনে করেন যুবরাজের দেহাবশেষ ফিরিয়ে দেয়া হবে “ব্রিটেনের জন্য তার অতীত কার্যকলাপ পুনর্মূল্যায়ন করার একটা পথ। ঔপনিবেশিক শাসনামলে ব্রিটেন যা করেছে তা ফিরে দেখা এবং তার যথার্থতা বিবেচনা করে দেখার একটা সুযোগ।”