বিমান দুর্ঘটনায় রক্ষা পাওয়া চার শিশু গভীর জঙ্গলে কীভাবে ৪০দিন বেঁচে ছিল

Spread the love

ডেস্ক রিপোর্টঃ কলম্বিয়ার পহেলা মে এক মা ও তার চার সন্তানের পারিবারিক ভ্রমণ পরিণত হয় এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনায়। মাঝপথে তাদের বহনকারী বিমানটি বিধ্বস্ত হয়ে অ্যামাজনের দুর্গম জঙ্গলে পড়ে।

স্থানীয় আদিবাসীদের সাথে সেনাবাহিনী মিলে উদ্ধার অভিযান চালাতে থাকে। দুর্ঘটনার প্রায় দুই সপ্তাহ পর জঙ্গলে দুই পাইলট ও মায়ের মরদেহ মেলে।

কিন্তু চার ভাই-বোন যাদের একজনের বয়স মাত্র ১১ মাস, তাদের কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি তখন।

অবশেষে গত শুক্রবার কলম্বিয়ার অ্যামাজন জঙ্গলে তাদের জীবিত খুঁজে পাওয়ার কথা জানান কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেত্রো। তিনি বলেন “সারা দেশের জন্যই এটা একটা আনন্দের সংবাদ।”

সেনাবাহিনী তাদের জঙ্গল থেকে উদ্ধার করে হেলিকপ্টারে তোলে। এরপর তাদের নিয়ে আসা হয় রাজধানী বোগোটার সেন্ট্রাল মিলিটারি হাসপাতালে। আর সেখানেই পরিবারের সাথে মিলিত হয় বাচ্চাগুলো।

তারা এখন ‘খুবই দুর্বল অবস্থায়’ আছে কিন্তু ‘পরিবারকে দেখতে পেয়ে তারা আনন্দিত’ বলে জানিয়েছেন বাচ্চাদের নানা ফিদেন্সিও ভ্যালেন্সিয়া।

দুর্ঘটনার ২ সপ্তাহ পর বিমানটি উদ্ধার হয়

যেভাবে দুর্ঘটনাটি ঘটে

পরিবারটি হুইতোতো আদিবাসী গোষ্ঠীর সদস্য। গত পহেলা মে মা ম্যাগডালিনা মুকুতুই ভ্যালেন্সিয়া তার তিন মেয়ে ও এক ছেলে, যাদের বয়স যথাক্রমে ১৩, ৯ ও ৪ বছর এবং সবচেয়ে ছোটটির বয়স ১১ মাস মাত্র, তাদের নিয়ে বিমানে ওঠেন।

সেসনা ২০৬ একটি ছোট হালকা ধরণের বিমান। এই পাঁচ জনের সাথে দুজন পাইলটসহ মোট সাতজন নিয়ে বিমানটি ক্যাকুয়েটা প্রভিন্সের জঙ্গলাকীর্ণ আরারাকুয়ারা বিমানবন্দর থেকে ওড়ে। তাদের গন্তব্য ছিল কলম্বিয়ার জঙ্গলের উপর দিয়ে ৩৫০ কিমি দূরের শহর সান হোসে দেল গুয়াভিয়ারে।

কিন্ত বিমানটি আকাশে উঠার কিছুক্ষণের মধ্যেই এর পাইলট ইঞ্জিনের ত্রুটির কথা জানিয়ে সংকেত পাঠান এবং এরপর রাডার থেকে বিমানটি হারিয়ে যায়।

উদ্ধার অভিযান

অ্যামাজন জঙ্গলের এই অংশে জাগুয়ার, সাপ ও অন্যান্য ভয়ংকর প্রাণী ছাড়াও বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীরও তৎপরতা রয়েছে । স্থানীয় আদিবাসী সম্প্রদায় ও কলম্বিয়ান আর্মি মিলে বিমানটির খোঁজে গভীর জঙ্গলে অভিযান শুরু করে।

অবশেষে মে মাসের ১৫ তারিখে দুর্ঘটনার দুই সপ্তাহ পর জঙ্গলে বিমানটির দেখা মেলে।

এটিকে খাড়াভাবে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখা যায়। দুই পাইলট ও শিশুগুলোর মা ম্যাগডেলিনার মরদেহ মেলে।

কিন্তু বাচ্চাদের কোন সন্ধান পাওয়া যায় না। তবে সঙ্গে থাকা শিকারী কুকুর প্রথমে বাচ্চাদের পানি খাওয়ার একটি বোতল শনাক্ত করে।

এরপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আধ খাওয়া ফল, জামা কাপড়সহ নানা প্রাণের অস্তিত্ব ধরা পড়ে উদ্ধারকারীদের চোখে। খোঁজ শুরু হয়।

নানা ক্লু ও প্রেসিডেন্টের ভুল টুইট

বাচ্চাদের জীবিত ফেরত পাওয়ার আশায় জোরালো করা হয় উদ্ধার অভিযান।

সেনাবাহিনী ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সাথে যোগ হয় বিমানবাহিনীও। নিচে এই জঙ্গলেই বসবাস করা গ্রামবাসী ও সেনাবাহিনীর একশোর উপর সদস্য অভিযান চালায়। আর আকাশ থেকে বিমান ও হেলিকপ্টারে করে শিশুদের খোঁজে উদ্ধার অভিযান চলতে থাকে।

দুর্ঘটনাস্থলের পাশে বাচ্চাদের বিভিন্ন জিনিস খুঁজে পাওয়া যায়
দুর্ঘটনাস্থলের পাশে বাচ্চাদের বিভিন্ন জিনিস খুঁজে পাওয়া যায়

এর মাঝে দুর্ঘটনাস্থলের আশেপাশে পাওয়া যেতে থাকে একের পর ক্লু। জঙ্গলেই বানানো একটা থাকার জায়গা চোখে পড়ে উদ্ধারকারী দলের। এছাড়া কাঁচি, চুলের ফিতা, টাওয়েল ও জুতারও খোঁজ মেলে।

তবে তৃতীয় সপ্তাহে এসে দুটি ব্যবহৃত ডায়াপার ও পায়ের ছাপ দেখে আর্মি নিশ্চিত হয় দুর্ঘটনায় বাচ্চারা মারা যায়নি। কিন্তু তারা সতর্ক করে দিয়ে বলেন এই বাচ্চারা খুব সম্প্রতি দুর্ঘটনাস্থল থেকে সরে যায়নি, বরং বিভিন্ন ক্লু দেখে মনে হচ্ছে তারা ‘৩ থেকে ৮ মে’র মধ্যে’ জায়গাটা ত্যাগ করেছে।

তবে ভারী বৃষ্টি শুরু হলে এই ঘন জঙ্গলে উদ্ধার অভিযান কঠিণ হয়ে পড়ে।

এর আগে ব্যাপক সমালোচনার মধ্যে পড়েন কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেত্রো। তিনি একটা টুইট করে জানান শিশুদের খোঁজ মিলেছে। তবে ২৪ ঘন্টার মধ্যে সেটি মুছে দিয়ে বলেন তাকে ভুল তথ্য দেয়া হয়েছে।

উদ্ধারকারী দল বিমান থেকে জঙ্গলের ভেতর স্প্যানিশ ও হুইতুতো ভাষায় লেখা বার্তা ফেলতে থাকে যেন বাচ্চারা একসাথে থাকে এবং বিভিন্ন দিকে ঘোরাফেরা না করে। একইসাথে তার নানির কন্ঠেও এই কথাগুলি রেকর্ড করে বাজানো হয় জঙ্গলজুড়ে।

মিরাকল! মিরাকল! মিরাকল!

কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্টই প্রথমে এ চারজনকে খুঁজে পাওয়ার কথা জানান। তার ভাষায় গত ৯ই মে ছিল ‘ম্যাজিকাল ডে’।

“তারা একা একাই ছিল, তারা টিকে থাকার এক দুর্দান্ত উদাহরণ তৈরি করেছে যা ইতিহাসে লেখা থাকবে”-বলেন মি. গুস্তাভো।

জেনারেল পেদ্রো সানচেজ যিনি এই উদ্ধার অভিযানের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তিনি এই সফলতার জন্য কৃতিত্ব দিয়েছেন অভিযানে এগিয়ে আসা আদিবাসী সম্প্রদায়কে।

“আমরা বাচ্চাদের খুঁজে পেয়েছি: মিরাকল, মিরাকল, মিরাকল!”-সাংবাদিকদের এভাবেই নিজের প্রতিক্রিয়া জানান মি. পেদ্রো।

উদ্ধারের পর বাচ্চাদের সেবা শুশ্রূষা করছে সেনাবাহিনী
উদ্ধারের পর বাচ্চাদের সেবা শুশ্রূষা করছে সেনাবাহিনী

কলম্বিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের শেয়ার করা এক ভিডিওতে দেখা যায় উদ্ধারকৃত শিশুদের অন্ধকার জঙ্গল থেকে একটা হেলিকপ্টারে তোলা হচ্ছে।

এরপর তাদের রাজধানী বোগোটায় উড়িয়ে আনা হয়। সেখান থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নেয়া হয় বাচ্চাদের।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইভান ভেলাসকুয়েজ বলেন, “সবমিলে বাচ্চারা ভালো অবস্থায় আছে, মেডিকেল রিপোর্ট অনুযায়ী তারা বিপদমুক্ত।”

আর্মি ডাক্তার কার্লোস রিনকন জানিয়েছেন তাদের একটা ‘পুষ্টিগত সমস্যা’ আছে। আর ‘সামান্য টিস্যু ইনজুরি, চামড়ায় কিছু আচড় কামড়ের দাগ’ ছাড়া তেমন কোন সমস্যা নেই।

কীভাবে গভীর জঙ্গলে টিকে থাকলো তারা?

হুইতুতু সম্প্রদায়ের পরিচিতি আছে জঙ্গলে মানিয়ে চলার দক্ষতার জন্য। উদ্ধার অভিযানে থাকা এই সম্প্রদায়ের সদস্যরা বলছিলেন বিভিন্ন ফলমূল চেনা ও জঙ্গলে টিকে থাকার কৌশল এই বাচ্চাদের বাঁচিয়ে রেখেছে।

বাচ্চাদের নানি, ফাতিমা ভ্যালেন্সিয়া, তার নাতি-নাতনিদের উদ্ধারের খবর পেয়েই বলেন, “আমি খুবই কৃতজ্ঞ এবং ধরিত্রী মাতাকেই ধন্যবাদ তাদের নিরাপদে মুক্ত করে দেয়ার জন্য।”

তিনি জানান এই চার ভাই-বোনের মধ্যে সবচেয়ে বড় লেসলি মুকুতির বয়স ১৩ বছর। আর সে আগে থেকেই তার মা কাজে গেলে বাকি তিন ভাইবোনের দেখাশোনা করতো।

আর এটাই তাদের জঙ্গলে টিকে থাকতে সাহায্য করেছে। এছাড়া বিমানের ধ্বংসাবশেষ থেকে দরকারি জিনিসও সংগ্রহ করেছে তারা।

“সে তাদের আটা এবং ক্যাসাভা রুটি খাইয়েছে, ঝোপঝাড় থেকে ফল সংগ্রহ করেছে, তারা জানে যে কোনটি খাওয়া যাবে” – মিজ ভ্যালেন্সিয়াকে এমনটি বলতে দেখা যায় ইভিএনে প্রচারিত এক ভিডিওতে।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইভান ভেলাসকুয়েজও লেসলির প্রশংসা করে বলেন, “তাকে ধন্যবাদ, তার নেতৃত্বগুণ, জঙ্গল সম্পর্কে জ্ঞান ও তার যত্ন বাকি তিনজনকে টিকে থাকতে সাহায্য করেছে।”

কলম্বিয়ার ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক অ্যাসট্রিড ক্যাসেরেস জানিয়েছেন বাচ্চারা এখনো সেভাবে কথা বলছে না এবং তাদের পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে।


Spread the love

Leave a Reply