পবিত্র হজ আজ : লাব্বাইক ধ্বনিতে মুখর আরাফাত

Spread the love

ডেস্ক রিপোর্টঃ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ২০ থেকে ২৫ লাখের বেশি ধর্মপ্রাণ মুসলমান পাপমুক্তি ও আত্মশুদ্ধির জন্য আজ মঙ্গলবার পবিত্র হজ পালন করেছেন। ইসলামের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ হজ।

আজ সূর্যোদয়ের পর লাখ লাখ হাজি মিনা থেকে রওনা হন আরাফাতের ময়দানের দিকে। ট্রেনে, বাসে আর হেঁটে হাজিরা আরাফাতের ময়দানে হাজির হন। লাখো কণ্ঠে ছিল একটাই রব, ‘আমি হাজির, হে আল্লাহ আমি হাজির, তোমার কোনো শরিক নেই, সব প্রশংসা ও নিয়ামত শুধু তোমারই, সব সাম্রাজ্যও তোমার। (‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান নি’মাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা শারিকা লাক।’

হজের তিন ফরজের মধ্যে ৯ জিলহজ আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। হজ ভিসা নিয়ে যাঁরা সৌদি আরবে পৌঁছেছেন, তাঁরা তো যাবেনই। তাঁদের মধ্যে যাঁরা অসুস্থতার জন্য হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, তাঁদেরও অ্যাম্বুলেন্সে করে আরাফাতের ময়দানে স্বল্প সময়ের জন্য আনা হয়। কারণ, আরাফাতের ময়দানে উপস্থিত হওয়া হজের অন্যতম ফরজ।

তালবিয়া পাঠ করে মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে নিজের উপস্থিতি জানান দিয়ে পাপমুক্তির আকুল বাসনায় লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ হজযাত্রী মিনা থেকে আরাফাতের ময়দানে সমবেত হন। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত তাঁরা আরাফাতের ময়দানে থাকবেন। প্রচণ্ড গরম (৪৪ ডিগ্রি) উপেক্ষা করে কেউ পাহাড়ের কাছে, কেউ সুবিধাজনক জায়গায় বসে ইবাদত করেন। কেউ কেউ যান জাবালে রহমতের কাছে (জনশ্রুতি আছে যে হজরত আদম (আ.) ও বিবি হাওয়া (আ.) দীর্ঘদিন কান্নাকাটির পর এখানেই এসে মিলিত হয়েছিলেন। হজরত মুহাম্মদ (সা.) বিদায় হজের দিন এই পাহাড়ের কাছে দাঁড়িয়ে বিদায় হজের ভাষণ দিয়েছিলেন।) কেউ কেউ যান মসজিদে নামিরায় হজের খুতবা শুনতে।

গতকাল সোমবার এশার নামাজের পর মিনার তাঁবুতে আমাদের দলনেতা বললেন, আরাফাতে যাওয়ার গাড়িগুলো আসতে শুরু করেছে। পরে ভিড় বাড়তে শুরু করলে সমস্যা হবে। আমাদের এখনই আরাফাতে রওনা দেওয়া উচিত। কোরআন শরিফ, হাজি ম্যাট এবং কিছু টুকিটাকি ব্যবহার্য জিনিস নিয়ে বাসে উঠে পড়লাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাস আরাফাতের ময়দানে পৌঁছে গেল। ছোট ছোট গাছের ফাঁকে হাজার হাজার তাঁবু টানানো আছে। মিনার মতো আরাফাতে তাঁবুর সারি। তবে এগুলো অস্থায়ী। কিছু দূর পরপর টয়লেট ও অজুর ব্যবস্থা রয়েছে।

মৃত্যুর পর কেয়ামতের সময় এই আরাফাতের ময়দান থেকে বিচার শুরু হবে। সেই আরাফাতের ময়দানে আল্লাহপাকের রহমতে হাজির হলাম। সব প্রার্থনা কবুল করার জন্য যেন আরাফা প্রান্তর প্রস্তুত। ফজরের নামাজ তাঁবুর ভেতরেই জামাতের সঙ্গে পড়লাম। তাঁবুর মধ্যেই আমরা নামাজ, বন্দেগি, দোয়াদরুদ ও পবিত্র কোরআন শরিফ পড়তে থাকলাম। প্রতিটি তাঁবুর সামনেই খাবার পানির কনটেইনার রয়েছে। কিছু দূর পরপর একসঙ্গে বেশ কয়েকটি টয়লেট। পুরুষ ও নারীদের টয়লেট আলাদা। টয়লেটগুলোর দুই প্রান্তে অজু করার জন্য কয়েকটি করে ট্যাপ আছে। অনেকেই ট্যাপগুলো থেকে পানি নিয়ে গোসল সেরে নিলেন। আমাদের তাঁবু থেকে একটু দূরেই দেখি রান্নাবান্নার বিরাট আয়োজন। মোয়াল্লেমের লোকজন আমাদের জন্য বিরিয়ানি রান্নার ব্যবস্থা করছেন। আরাফাতের ময়দানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গাড়িতে করে ফাস্ট ফুডের প্যাকেট বিতরণ করা হচ্ছে।  গাড়ি থেকে খাবার প্যাকেট ছুড়ে দেওয়া হচ্ছে আর উপস্থিত সবাই তা ক্যাচ ধরতে বা কুড়িয়ে নিতে ব্যস্ত। উল্টো ছাতাপদ্ধতি প্রয়োগ করলাম অর্থাৎ ছাতাটা উল্টো করে ধরলাম, যাতে ছুড়ে দেওয়া প্যাকেট ছাতার মধ্যে পড়ে। এভাবে কয়েকটি প্যাকেট সংগ্রহ করে তাঁবুতে ফিরে এলাম।

লাব্বাইক ধ্বনিতে মুখর আরাফাতের ময়দান

আরাফাত ময়দানটি মিনা থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ৯ জিলহজ দ্বিপ্রহরের পর থেকে ১০ জিলহজ সুবহে সাদিক পর্যন্ত এক মুহূর্তের জন্য হলেও আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা হজের ফরজ। এই ময়দানে অবস্থিত মসজিদটির নাম মসজিদে নামিরাহ। এই মসজিদের জামাতে অংশগ্রহণকারী হজযাত্রীরা জোহরের ওয়াক্তে এক আজান ও দুই ইকামতের সঙ্গে একই সময়ে পরপর জোহর ও আসরের নামাজ আদায় করে থাকেন। নামাজের আগে ইমাম সাহেব খুতবা প্রদান করে থাকেন। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আরাফাত ময়দানে অবস্থানের যে দৃশ্য সরাসরি সম্প্রচার করা হয়, তাতে এই খুতবা এবং নামাজ দেখানো হয়। আমাদের তাঁবু যেহেতু মসজিদে নামিরাহ থেকে অনেক দূরে ছিল, তাই মসজিদের জামাতে আমরা শামিল হতে পারিনি। নিয়ম হচ্ছে কেউ মসজিদের জামাতে শামিল হতে না পারলে নিজ নিজ তাঁবুতেই জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় করবে। তবে সে ক্ষেত্রে জোহর এবং আসরের নামাজ একত্রে না পড়ে জোহর এবং আসরের ওয়াক্তে আলাদা আলাদাভাবে পড়তে হবে। লাখ লাখ হাজির মধ্যে আমিও একজন হাজি। প্রতি মুহূর্তে অনুভব করছি মহান স্রষ্টার রহমত।

আমাদের পরবর্তী কাজ সূর্যাস্তের পর মুজদালিফার উদ্দেশে রওনা দেওয়া। এখানে একদল পায়ে হেঁটে গেলেন। মুজদালিফা থেকে হেঁটে গেলে অনেক আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা অর্জন করা যায়। এজদালিফা শব্দ থেকে মুজদালিফা শব্দের উৎপত্তি। এজদালিফা মানে হলো নিকটবর্তী হওয়া বা জমা হওয়া, মিলিত হওয়া। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হাজিরা একে অপরের কাছাকাছি হন। তাই হয়তো এই নামকরণ। নামকরণের আরেকটি ঘটনা শুনলাম, তা হলো হজরত আদম (আ.) ও হজরত হাওয়া (আ.) পৃথিবীতে বহুদিন অবস্থান করে বহু বছর পর আরাফাতে মিলিত হন। আরাফা থেকে এসে মুজদালিফায় একত্রে রাত যাপন করেন। সে ময়দান মুজদালিফা। মুজদালিফা অর্থ নৈকট্য লাভ করা।

সন্ধ্যার আগে আরাফাতের সীমানার গেট খোলা হয় না। সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে আমরা আরাফাতের ময়দান ত্যাগ করে মুজদালিফার উদ্দেশে রওনা দেন অনেকে। মুজদালিফার দিকের প্রান্তে পৌঁছাতে যতই অগ্রসর হবেন, ততই দেখবেন চলার পথ ফাস্ট ফুডের খালি প্যাকেট এবং সফট ড্রিংকসের ক্যান দিয়ে কার্পেটের মতো ঢাকা পড়ে গেছে।

সূর্যাস্তের আগে যাতে কেউ ভুলক্রমে আরাফাতের ময়দান ত্যাগ না করতে পারে, সে জন্য সীমানাপ্রাচীরের ফটক বন্ধ করা আছে। সূর্যাস্তের পর যখন গেট খুলে দেওয়া হলো, তখন রাস্তায় হাজার হাজার মানুষের ঢল নামল। যেন খরস্রোতা নদীর স্রোত বাঁধ দিয়ে আটকানোর পর হঠাৎ ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। সেই প্রচণ্ড ভিড় এবং মানুষের চাপ সহ্য করে সামনে অগ্রসর হওয়া যেন যুদ্ধ করার শামিল। যুবক, বৃদ্ধ, পুরুষ, মহিলা, কালো, সাদা হরেক রকমের মানুষ। কিন্তু সবার উদ্দেশ্য এক, গন্তব্য এক। রাস্তার দুই ধারে উঁচু উঁচু পাহাড় যেন প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তার পাশে কিছুদূর পরপর খাওয়ার পানির ট্যাপ আছে।

বাসে করে রওনা দিলাম। ঘণ্টা দুয়েক পরে পৌঁছালাম। হাজার হাজার লোক রাস্তাজুড়ে শুয়ে পড়েছেন। রাস্তার দুই পাশের মাঠ এবং পাহাড়ের গায়েও হাজার হাজার লোক অবস্থান গ্রহণ করেছেন। সামনে অগ্রসর হওয়া প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। মূল সড়ক থেকে কিছুটা নিচে একটা পিচঢালাই সড়কের ওপর কাছাকাছি টয়লেটের অবস্থান দেখে মক্কা থেকে কেনা প্লাস্টিকের পাটি বিছালাম। পাটির ওপর চাদর বিছিয়ে, পাটির সঙ্গে থাকা বালিশ ফুঁ দিয়ে ফোলালাম। তখন রাত প্রায় নয়টা। টয়লেট অজু সেরে মাগরিব ও এশার নামাজ আমরা একসঙ্গে আদায় করলাম।

মুজদালিফায় পৌঁছার পর মাগরিব ও এশার নামাজ একসঙ্গে পড়তে হয়। এরপর মুজদালিফার খোলা প্রান্তরে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাতে হয়। এই মাঠে ও কিছু দূর পরপর বাথরুম রয়েছে। প্রতিটি বাথরুমের একটা নম্বর আছে। মানুষের ভিড়ের মধ্যে এই নম্বরটি মনে রাখলে হারানোর ভয় থাকে না। তবে তা আরাফাতের তুলনায় অনেক কম। ফলে সারা রাতই বাথরুমগুলোর সামনে লম্বা লাইন লেগে থাকে।

নামাজ শেষে আমরা আশপাশ থেকে ছোট ছোট ৭০টি পাথর সংগ্রহ করলাম। জামারায় শয়তানের উদ্দেশে পরপর তিন দিন ছোড়ার জন্য প্রয়োজনীয় পাথরের টুকরা এখান থেকেই সংগ্রহ করতে হয়। প্রয়োজনীয় পাথর সংগ্রহ করতে মোটেই বেগ পেতে হয় না। পাথর সংগ্রহ করার পর আমরা শুয়ে একটু বিশ্রাম নেওয়ার চেষ্টা করলাম। ইহরাম অবস্থায় আবার মুখ ও মাথা ঢাকা নিষেধ। এভাবে কখনো শুয়ে, কখনো বসে সময় কাটাচ্ছি। চাদর গায়ে দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছি। আমাদের আশপাশে যাঁরা অবস্থান করছিলেন, তাঁরা কেউ বাংলায়, কেউ আরবিতে, কেউ ইংরেজিতে নানান ভাষা কথা বলছেন। বসে বসে ভাবছি কত মানুষ দুনিয়ায়, তার মধ্যে কিছু লোক এখানে আসার সুযোগ পেয়েছেন। ধনী, গরিব সবাই খোলা আকাশের নিচে শুয়ে আছেন, কেউবা ঘুমাচ্ছেন, কেউ নামাজ পড়ছেন। ঘুম কি আসে। অচেনা অনেক পাশাপাশি ঘুমিয়ে আছে, কেউবা নামাজে। কোনো পাপকাজের কথাই মনে হয় না এখানে। মুজদালিফায় সুবহে সাদিক হতে সূর্যোদয়ের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে (ক্ষণিকের জন্য হলেও) অবস্থান করা ওয়াজিব। আমরা ফজরের নামাজ পড়ে দোয়াদরুদ পড়তে থাকলাম। সকালের নাশতা সেরে সূর্যোদয়ের কিছু পরে মিনার উদ্দেশে রওনা দিলাম। তাঁবুতে পৌঁছে বিশ্রাম নিলাম।

আজ মিনার তাঁবুতে ফিরে যাবেন বড় শয়তানকে সাতটি পাথর মারবেন। আমাদের কোরবানি আইডিবি কুপনের মাধ্যম হয়েছে। কোরবানি শেষে হাজিরা মাথার চুল ছেঁটে বা মাথা মুড়িয়ে স্বাভাবিক পোশাক পরে মক্কায় ফিরে কাবা শরিফ সাতবার তাওয়াফ করবেন। জমজমের পানি পান করবেন। সাফা-মারওয়া পাহাড় সাতবার প্রদক্ষিণ করে হজের অত্যাবশ্যকীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করবেন।

আবার মিনায় ফিরে পরবর্তী দুই দিন সেখানে তাঁরা তিনটি শয়তানের প্রতীকী প্রতিকৃতিতে পাথর মারবেন। এভাবে হজের কার্যক্রম শেষ হবে।


Spread the love

Leave a Reply