টাওয়ার হ্যামলেটসে আত্মহত্যা প্রতিরোধে মিডিয়া কর্মীদের ভূমিকা শীর্ষক কর্মশালা অনুষ্ঠিত
সাজু আহমদ:
“আত্মহত্যা প্রতিরোধে মিডিয়া কর্মীদের ভূমিকা ও মানসিক সাস্থ সুরক্ষা” শীর্ষক এক ট্রেনিং সেশনের আযোজন করে টাওয়ার হ্যামলেটস্ কাউন্সিল গত মঙ্গলবার তাঁদের কাউন্সিল চেম্বারে. টাওয়ার হ্যামলেটস্ কাউন্সিল, চ্যারিটি সংস্থা সামারিটানস, লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাব ও এনএইচএস টাওয়ার হ্যামলেটস্ যৌথ ভাবে আয়োজন করে অনুষ্ঠানটি।
যুক্তরাজ্যে গড়ে ৬,০০০ মানুষ বছরে আত্মহত্যা করে যদি ও যুক্তরাজ্য পৃথিবীর অন্যতম ধনী দেশ. সাধারণত বিভিন্ন কিছু থেকে বঞ্চিত (চাকরি, পরিবারের অবহেলা, দারিদ্রতা) মানুষ হতাশ হয়ে নিজের জীবন নিজে বিলিয়ে দেয়. আশ্চর্যের বিষয় টাওয়ার হ্যামলেটস্ বিলেতের মধ্যে অন্যতম দরিদ্র এলাকা হলে ও এখানে আত্মহত্যার হার পুরো দেশের মধ্যে এমনকি পুরো লন্ডনের মধ্যে কম. এ নিয়ে প্রেস ক্লাবের সেক্রেটারি তাইসির মাহমুদ প্রশ্ন করলে আলোচক বিষয়টি গবেষণার দাবি রাখে বলে উল্লেখ করেন!
আত্মহত্যার মুখরোচক রিপোর্ট কিভাবে অন্য হতাশাগ্রস্তদের কিভাবে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করতে পারে, এ ব্যাপারে বিস্তারিত তুলে ধরেন আলোচক. তাই এ রকম ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরতে নিরুৎসারিত করা হয় এবং এসব রিপোর্টের ক্ষেত্রে হতাশাগ্রস্তদের সাহায্য করতে সঠিক জায়গায় যোগাযোগের ঠিকানা ও নম্বর উল্লেখের ব্যাপারে গুরুত্ব আরোপ করা হয়. এমনকি আত্মহত্যার পরিচিত জায়গা বিস্তারিত তুলে ধরতে নিরুৎসাহিত করা হয়. কারণ কেস স্টাডি তে দেখা গেছে এক জায়গায় আত্মহত্যার খবর প্রচারের পর একই জায়গায় পর পর আরও অনেকগুলো আত্মহননের ঘটনা ঘটেছে. কারণ এসব খবর হতাশাগ্রস্তদের আত্মহননের সঠিক জায়গা খুঁজে বের করতে সহাযতা করেছে।
প্রায় ৮০ জন সাংবাদিক কর্মশালায় অংশগ্রহণ করেন. অনুষ্টান শেষে সকলের মধ্যে সনদ বিতরণ করা হয়।
সনদ বিতরনী পর্বে বক্তব্য রাখেন এবং সনদপত্র তুলে দেন টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের ডেপুটি মেয়র মাইয়ুম মিয়া তালুকদার ও জনস্বাস্থ্য বিষয়ক কেবিনেট মেম্বার কাউন্সিলার গোলাম কিবরিয়া চৌধুরী। পুরো আয়োজনটির সমন্বয় করেন টাওয়ার হ্যামলেটস মেয়রের স্ট্রাটিজিক এডভাইজার মোহাম্মদ জুবায়ের।
কর্মশালার শুরুতে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের সভাপতি মোহাম্মদ এমদাদুল হক চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক তাইসির মাহমুদ ও প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক এমরান আহমদ।
প্রশিক্ষণ কর্মশালায় মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের নানা সেবা ও উদ্যোগের পাশাপাশি টাওয়ার হ্যামলেটসের জনগোষ্ঠীর মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক নানা উপাত্ত তুলে ধরেন টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের জনস্বাস্থ্য বিষয়ক কর্মকর্তা এঞ্জেলা বার্ণস। মানসিক কষ্টে ভোগা লোকদের জন্য টাওয়ার হ্যামলেটস টকিং থেরাপির বিভিন্ন সেবা ও কার্যক্রম নিয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন থেরাপিষ্ট ম্যারিয়েলা ক্যানটোনি ও ফোটিনি ব্রিনিয়া। আর মানসিক স্বাস্থ্য ও আত্মহত্যা প্রতিরোধে গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন ‘সামারিটান্স মিডিয়া এডভাইজরি সার্ভিস’র প্রধান মোনিকা হোলি।
টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের জনস্বাস্থ্য বিষয়ক কর্মকর্তা এঞ্জেলা বার্ণস বলেন, টাওয়ার হ্যামলেটসের বাসিন্দাদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা একটি সাধারণ ঘটনা। তবে জাতীয় গড়ের তুলনায় এখানকার বাসিন্দাদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা তুলনামূলক কম। তিনি বলেন, টাওয়ার হ্যামলেটসে মানসিক কষ্টে থাকা মানুষদের বেশির ভাগই ডিপ্রেশন (হতাশা) ও এংজাইটিতে (চরম বিষন্নতা) ভূগছেন। অনেকের বাইপোলার ও সিজোপ্রিনিয়ার মত গুরুতর মানসিক অসুস্থতাও রয়েছে। এখানকার মোট জনগোষ্ঠীর শূণ্য দশমিক ২ শতাংশ গুরুতর মানসিক রোগে আক্রান্ত। যাদের বেশির ভাগই বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত।
কাউন্সিলের গণস্বাস্থ্য-বিষয়ক এই কর্মকর্তা জানান, টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলে গত ১০ বছরে প্রায় ২০০টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে সর্বশেষ ২০২১ সালে ঘটে ২৫টি ঘটনা। যা এর আগের বছর অর্থ্যাৎ ২০২০ সালে ছিলো ১৬টি। তিনি বলেন, বাসিন্দাদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার হিসেবে দেখে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল। এ নিয়ে এনএইচএস, জিপি, টকিং থেরাপি ও দাতব্য সংস্থাসহ বিভিন্ন অংশীজনদের নিয়ে কাজ করছে কাউন্সিল। মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা তৈরি, এ সংক্রান্ত সেবাগুলোর প্রচার এবং আত্মহত্যা প্রতিরোধে ভূমিকা রাখার জন্য কাউন্সিল বাংলা গণমাধ্যমগুলোকে অংশীদার হিসেবে চায়।
টাওয়ার হ্যামলেটস টকিং থেরাপির বিভিন্ন সেবা ও কার্যক্রম নিয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন থেরাপিষ্ট ম্যারিয়েলা ক্যানটোনি ও ফোটিনি ব্রিনিয়া। তাঁরা বলেন, কেউ যদি মনে করেন কোনো কারণে মানসিক কষ্টে আছেন কিংবা হতাশাগ্রস্থ, তারা চাইলে নিজেরাই টাওয়ার হ্যামলেটস টকিং থেরাপির সাহায্য নিতে পারেন। অনলাইনে কিংবা টেলিফোনে নিজেরা যোগাযোগ করতে পারেন। অথবা জিপি কিংবা অন্য কোনো মাধ্যমেও টকিং থেরাপিতে রেফারেল (সুপারিশ) পাঠানো যাবে। টাওয়ার হ্যামলেটস টকিং থেরাপি কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে মানসিক সমস্যা সমাধানে সহায়তা করে । পাশাপাশি যাদের মানসিক চিকিৎসা অথবা বাড়তি সহায়তার প্রয়োজন- তাদেরকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর কাছে রেফার করে টাওয়ার হ্যামলেটস টকিং থেরাপি।
‘সামারিটান্স মিডিয়া এডভাইজরি সার্ভিস’র প্রধান মোনিকা হোলি বিভিন্ন দেশে গণমাধ্যমের ভূমিকা এবং আত্মহত্যার সঙ্গে যোগসূত্রের উপাত্ত তুলে ধরেন । তিনি বলেন, বিভিন্ন আত্মহত্যার ঘটনায় দেখা গেছে-গণমাধ্যমের খবরের ধরণের কারণে আত্মহত্যা উৎসাহিত হয়েছে। আত্মহত্যার কৌশল ও বিস্তারিত বর্ণনা তুলে ধরার কারণে অন্যরাও একই কৌশল বেছে নিয়েছে। তিনি বলেন, বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপ্রাপ্ত বয়ষ্করাও নানাভাব আত্মহত্যায় প্ররোচিত হয়। তাই আত্মহত্যাকে রোমাঞ্চকর হিসেবে উপস্থাপন করে এমন সব শব্দ ও বাক্য এড়িয়ে চলতে হবে । তিনি বলেন, যুক্তরাজ্যে আত্মহত্যা বিষয়ক খবর প্রচারের ক্ষেত্রে সার্বজনিন গ্রহণযোগ্য সম্পাদকীয় নীতি এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থা অফকম-এর সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। এসব নীতি মেনে আত্মহত্যার খবর প্রচারে বিশেষ সতর্কতার গুরুত্ব তুলে ধরেন তিনি।
ধন্যবাদ জ্ঞাপনমুলক বক্তব্যে ডেপুটি মেয়র মাইয়ুম মিয়া তালুকদার প্রশিক্ষণ কর্মশালার সকল অংশীজন ও অংশগ্রহণকারীদের ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাসিন্দাদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করছে। বাসিন্দাদের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন করতে তিনি বাংলা গণমাধ্যমগুলোকে জোরালো ভূমিকা রাখার আহবান জানান।
একই আহবান জানিয়ে জনস্বাস্থ্য বিষয়ক কেবিনেট মেম্বার কাউন্সিলার গোলাম কিবরিয়া চৌধুরী বলেন, বাসিন্দাদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনা বৃদ্ধি এবং আত্মহত্যা প্রতিরোধে কাউন্সিল সুনিদির্ষ্ট নীতি নিয়ে কাজ করছে।
লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবের সভাপতি মোহাম্মদ এমদাদুল হক চৌধুরী নিজের অভিজ্ঞতার বর্ণনা করে বলেন, আত্মহত্যা সংক্রান্ত একটি খবর প্রকাশের কারণে তাদের সংবাপত্র কার্যালয়ে হামলার ঘটনা ঘটেছিলো। তিনি বলেন, আত্মহত্যার বিষয়টি অত্যন্ত সংবেদনশীল। কর্মশালার অংশীজন ও প্রশিক্ষকদের ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, এই কর্মশালা লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের সদস্যদের মানসিক স্বাস্থ্য ও আত্মহত্যার খবর প্রকাশের বিষয়ে অনেক নতুন কিছু শিখিয়েছে।
সাধারণ সম্পাদক তাইসির মাহমুদ বলেন, লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাব প্রতি বছর সদস্যদের জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন করে। তবে মানসিক স্বাস্থ্য ও আত্মহত্যার খবর প্রচার নিয়ে আয়োজিত এই প্রশিক্ষণটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এ প্রশিক্ষণ থেকে ক্লাবের সদস্যরা দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা শিক্ষার পাশাপাশি নিজেদের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়েও উপকৃত হবেন।