মেসির উপস্থিতি যেভাবে বদলে দিচ্ছে মায়ামির ক্রীড়া অর্থনীতি
ডেস্ক রিপোর্টঃ “লিওনেল মেসির আগে ও পরে – যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবলের ইতিহাস এখন থেকে এভাবেই বর্ণিত হবে,” জুলাই মাসে বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় ইন্টার মায়ামির স্টেডিয়ামে ১৮ হাজার দর্শকের সামনে ক্লাবের মালিক হোর্হে মাসে এভাবেই মেসির আগমনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছিলেন। মি. মার্সের এই ঘোষণার সাথে কারও দ্বিমত থাকতেই পারে।
কারণ মেসির আগে যুক্তরাষ্ট্রের লিগে ব্রাজিলের কিংবদন্তী পেলেও খেলে গেছেন। সত্তরের দশকে তিনবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন পেলের নিউ ইয়র্ক কসমসে যোগ দেয়ার ঘটনাকেও সে সময় বলা হয়েছিল যে আমেরিকার ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
তাই দু’জনের মধ্যে তুলনা করতে চাইলে, যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবলের ইতিহাসে কার আগমন বেশি তাৎপর্যপূর্ণ সে বিতর্ক চালিয়ে যাওয়াই যায়।
তবে লিওনেল মেসি ৩৬ বছর বয়সে অখ্যাত মেজর লিগ সকারে যোগ দিয়ে রাতারাতি তার দল এবং পুরো লিগকে বিশ্বের ফুটবল প্রেমীদের কাছে অতি পরিচিত করে তুলেছেন।
ইন্টার মায়ামিতে মেসির যোগ দেয়া এবং তার প্রভাবে যুক্তরাষ্ট্রের খেলাধুলার জগত বদলে যাওয়াকে ‘মেসি ইফেক্ট’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে।
টাকার অংক, সোশ্যাল মিডিয়ায় বাড়তে থাকা ফ্যান-ফলোয়ার বা মেসিকে ঘিরে ব্যবসায়িক কার্যক্রমের প্রসার দিয়ে ‘মেসি ইফেক্টের’ পরিমাপ সম্ভব নয়।
‘মেসি ইফেক্ট’
লিওনেল মেসির ইন্টার মায়ামিতে যোগ দেয়ার খবর প্রকাশ পায় ৭ই জুন। তখন থেকে দুই মাসের মধ্যে গুগল সার্চের হিসেবে ইন্টার মায়ামির জনপ্রিয়তা বেড়েছে শতকরা ১,২০০ ভাগেরও বেশি। ইন্টার মায়ামি দলটি কী খেলে, এটাই যারা জানতো না, তাদের অনেকেই এই দুই মাসের মধ্যে হয়ে গেছে দলের সবচেয়ে বড় ফ্যান।
ইন্টার মায়ামি মেসির জার্সি বিক্রি শুরু করার প্রথম ২৪ ঘন্টায় যে পরিমাণ জার্সি বিক্রি হয়, তা পৃথিবীর সব ধরণের খেলার যে কোনো খেলোয়াড়ের জার্সি বিক্রির রেকর্ড ভেঙে দেয়।
খেলাধূলার রেটিং নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান ফেনাটিকসের তথ্য অনুযায়ী তার আগে এই রেকর্ড হয় ২০২১ সালে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে যোগ দেয়ার সময়। আর আগের দুটি রেকর্ড ছিল রাগবি খেলোয়ার টম ব্রেডির এবং বাস্কেটবল খেলোয়াড় লেব্রন জেমসের জার্সি বিক্রির।
দলের ব্র্যান্ডের পরিচিতি বৃদ্ধি, মেসির জার্সি বিক্রি বা মেসিকে ঘিরে তৈরি করা পণ্যের বিক্রি তো বহুগুণ বেড়েছেই, সেই সাথে অবিশ্বাস্য হারে বেড়েছে ম্যাচের টিকিটের দাম।
মেসির ইন্টার মায়ামিতে আসার গুঞ্জন শুরু হয় ৪ঠা জুন আর শেষ পর্যন্ত দলে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত হয় ৭ই জুন। আর ইন্টার মায়ামির হয়ে ক্রুজ আজুলের বিপক্ষে মেসি প্রথম ম্যাচ খেলেন ২০শে জুলাই।
২০শে জুলাইয়ের ঐ ম্যাচের টিকিটের দাম ৪ঠা জুন ছিল ১২২ ডলার, যা ৭ই জুন বেড়ে দাঁড়ায় ৩৭৩ ডলারে। টিকেট বিক্রির ওয়েবসাইট টিকেটস্মার্টারের তথ্য অনুযায়ী ২০শে জুলাই ক্রুজ আজুলের বিপক্ষে ম্যাচের টিকিটের গড় দাম ছিল ৭১২ ডলার, যা স্বাভাবিকের চেয় শতকরা ২০০ ভাগেরও বেশি।
আর মেসিকে নিয়ে এই উন্মাদনা মাত্র ছড়িয়ে পড়া শুরু হয়েছে আমেরিকার ফুটবল ভক্তদের মধ্যে।
রবিবার ইন্টার মায়ামি প্রথমবারের মত লিগস কাপ ফাইনাল খেলবে ন্যাশভিল এফসি’র বিপক্ষে, তাদের মাঠ জেওডিস পার্কে। ফাইনালের টিকেটের সর্বনিম্ন মূল্য ধরা হয়েছে প্রায় পাঁচশো ডলার। আর সবচেয়ে দামী টিকেটের মূল্য ২,৩৬০ ডলার ডলার। যেখানে গত মৌসুমেও মেসি পারি সাঁ জার্মেইয়ে খেলার সময় প্রতিম্যাচে টিকেটের গড় দাম ছিল ১০৩ ইউরো।
যেভাবে বদলে যাচ্ছে ক্রীড়া সংস্কৃতি
ক্রীড়া বিষয়ক অনলাইন ম্যাগাজিন স্পোর্টসকিডার ভাষ্যে, মেসিকে ঘিরে চলমান বাণিজ্যিক কার্যক্রমের প্রসার ও আর্থিক লেনদেনের চেয়ে অনেক বড়, গভীর প্রভাব মেসি ফেলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ক্রীড়া সংস্কৃতিতে।
মেসি যুক্তরাষ্ট্রের লিগে খেলা শুরু করেছেন মাত্র এক মাস আগে। এরই মধ্যে স্কুল পড়ুয়া শিশু-কিশোর ও তরুণদের মধ্যে ফুটবল খেলার এবং ফুটবল প্রশিক্ষণের হার অনেকাংশে বেড়ে গেছে বলে বলছে পত্রিকাটি।
তারা মনে করছে তরুণদের এই বিপুল অংশগ্রহণের ফলে আমেরিকার ফুটবলে বিপুল সম্ভাবনার সৃষ্টি হবে সামনের বছরগুলোয়।
এর পাশাপাশি ইন্টার মায়ামির প্রতিটি খেলা ঘিরে যে পরিমাণ জনসমাগম হয়, তা একটি শহরের চিত্রই রাতারাতি পাল্টে দেয় বলে লিখেছে স্পোর্টসকিডা।
তারা বলছে, “মেসি যখন শহরে আসে, তখন এটি শুধু খেলা থাকে না। সব মানুষকে একত্রিত করার এক উৎসবে পরিণত হয় এটি।”
ইন্টার মায়ামির খেলা ঘিরে শহরে আসা মানুষের কারণে স্থানীয় ব্যবসার পাশাপাশি শহরের অর্থনীতিও সমৃদ্ধ হওয়ার সুযোগ পায়।
আর মানুষের ব্যাপক আগ্রহ থাকায় মেসির দলের খেলা দেখানোর স্বত্ত্ব কিনতে যেমন বিপুল অর্থ খরচ করছে বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো, তেমনি মেসি, ইন্টার মায়ামি ও মেজর লিগের খবরাখবর জানানোর জন্য ডিজিটাল স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম ও সংবাদ মাধ্যমগুলোও বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে, যার ফলে তৈরি হচ্ছে নতুন কর্মসংস্থান।
মেসির খেলা দেখার জন্য সারাবিশ্ব থেকে যে পরিমাণ পর্যটক সমাগম হবে বলে হিসেব করা হয়েছে, সেটিও স্থানীয় অর্থনীতিতে বেশ ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
স্পোর্টসকিডা বলছে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবল লিগই নয়, অন্যান্য খেলাতেও মেসির উপস্থিতি ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বাস্কেটবল লিগ এনবিএ, আইস হকি লিগ এনএফএল আর বেসবল লিগ এমএলবি’ও মেজর লিগ সকারের পথ অনুসরণ করে সম্প্রসারণের চিন্তা করছে। মেসির উপস্থিতি বিশ্বের বহু দেশে আমেরিকার ফুটবলের পরিচিতি বাড়িয়েছে। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে সেসব দেশে অন্যান্য লিগগুলোকেও জনপ্রিয় করার জন্য কৌশল খুঁজছে তারা।
স্পোর্টসকিডা বলছে, লিওনেল মেসি আমেরিকার ফুটবল লিগে যোগ দিয়েছেন মাত্র এক মাস আগে, কিন্তু এরই মধ্যে দেশটির সামগ্রিক ক্রীড়াঙ্গনে রীতিমত আমূল পরিবর্তনের সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলেছেন ফুটবলের এই কিংবদন্তী।