বাইডেনের সেলফি নিয়ে এত আলোচনা, পর্যালোচনা কিংবা ‘প্রচার যুদ্ধ’ কেন
ডেস্ক রিপোর্টঃ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের সাথে সেলফি তুলছেন- সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এমন কয়েকটি আলোকচিত্র নিয়ে আলোচনা ও পর্যালোচনার ঝড় উঠেছে বাংলাদেশে।
মি. বাইডেন ভারতের রাজধানী দিল্লিতে জি২০ সম্মেলন চলাকালে এ সেলফি তোলেন।
বাংলাদেশে সরকার সমর্থক রাজনৈতিক কর্মী-সমর্থক এবং গণমাধ্যম কর্মীদের অনেকেই এসব ছবি সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে শেয়ার করছেন।
কেউ কেউ নির্বাচনকে সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে শেখ হাসিনা সরকারের সম্পর্ক ভালো হয়ে যাবার প্রমাণ হিসেবে এ সেলফিকে বর্ণনা করছেন। আবার কেউ কেউ এটিকে ‘নয়াদিল্লির সাফল্য’ হিসেবেও প্রচার করছেন।
তবে এ নিয়ে সরকার সমর্থক ও বিরোধীদের মধ্যে রীতিমত প্রচার যুদ্ধ চলছে সামাজিক মাধ্যমে।
বিরোধীরা দাবি করছেন যে ‘সেলফি দিয়ে বিভ্রান্তির চেষ্টা হচ্ছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের কোন নড়চড় হবে না’।
চলতি বছরের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্র নতুন ভিসা-নীতি ঘোষণা করে। সেসময় দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেছিলেন, বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ক্ষেত্রে যারা বাধা সৃষ্টি করবে তাদের আমেরিকার ভিসা দেয়া হবে না।
মূলত ওই ঘোষণার পরই বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সঙ্গে বাইডেন প্রশাসনের সম্পর্কের টানাপড়েনের বিষয়টি সামনে চলে আসে।
সেলফি যেভাবে তোলা হয়েছিল
জি-২০ সামিটে অংশ নিতে ভারতের দিল্লি এসেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। আর এই জোটের সদস্য না হলেও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে অতিথি রাষ্ট্র হিসেবে ওই সম্মেলনে অংশ নেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
শনিবার সম্মেলনের এক পর্যায়ে মি. বাইডেনের সাথে সাক্ষাত হয় শেখ হাসিনার। এ সময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলও উপস্থিত ছিলেন।
গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত ছবিগুলোতে দেখা যায় মি. বাইডেন শেখ হাসিনা এবং তার কন্যার সঙ্গে হাস্যোজ্জ্বল ভঙ্গিতে সেলফি তুলছেন।
আরেকটি ছবিতে দেখা যায় তাদের কাছেই দাঁড়িয়ে আছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন। একই ছবিতে দেখা যায়, কিছুটা দূরত্বে থেকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সেলফি তোলার দৃশ্য দেখছেন।
আরেকটি ছবিতে দেখা যায়, মি. বাইডেন শেখ হাসিনা এবং সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের সঙ্গে আলাপ করছেন।
অন্য আরেকটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে মি.বাইডেন শেখ হাসিনার হাত ধরে আছেন আর কথা বলছেন শেখ রেহানার সঙ্গে। পাশে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
এই সেলফি পরে সায়মা ওয়াজেদ নিজের সামাজিক মাধ্যম এক্স-এ (সাবেক টুইটারে) প্রকাশ করেন।
তাকে উদ্ধৃত করে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস মি. বাইডেনের সাথে প্রধানমন্ত্রী এবং তার কন্যার আলাপ হওয়ার বিষয়টি জানিয়েছে।
এ সময় বাংলাদেশের অ্যাম্বাসেডর-এট-লার্জ জিয়াউদ্দিন তার ফোন ব্যবহার করে ছবি তুলতে গেলে মি. বাইডেন নিজেই ফোনটি হাতে নিয়ে সেলফি তোলেন।
পরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন দিল্লিতে বাংলাদেশী সাংবাদিকদের জানান যে, মি. বাইডেনের সাথে প্রধানমন্ত্রী ও তার কন্যার কথা বলার সময় শেখ রেহানাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে, ওই ছবিগুলো সায়মা ওয়াজেদ পুতুল সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করার পর ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইং থেকেও ফোনে বার্তা দিয়ে গণমাধ্যকর্মীদের এসব ছবি দ্রুত প্রকাশের নির্দেশনা দেয়ার একটি স্ক্রীনশটও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।
সরকার ও বিরোধীদের ‘প্রচার যুদ্ধ’
গত কয়েক মাস যাবত দুই দেশের সম্পর্কের টানাপোড়েনের পটভূমিতে মি. বাইডেনের হাসিমুখে শেখ হাসিনা এবং তার কন্যার সাথে সেলফি তোলার ঘটনাকে কার্যত ‘আগের দূরত্ব ঘুচে গেছে’ বলে প্রচারের চেষ্টা করছে আওয়ামী লীগের সমর্থকরা।
দলটির নেতা, কর্মী ও সমর্থকরা মি. বাইডেনের সাথে শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা ও সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের সেলফিসহ আলোচনার ছবিগুলোকে সরকারের সাফল্য হিসেবে প্রচার করছেন।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের শনিবার বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে এক সমাবেশে বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের এক সেলফিতে বিএনপির নেতাদের রাতের ঘুম হারাম।”
বিএনপিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, “আজ নতুন একটা খবর আছে। দিল্লিতে কী হচ্ছে? জি-২০ (সম্মেলন)। এত দিন বিএনপি আটলান্টিকের ওপারে হোয়াইট হাউসের দিকে তাকিয়ে ছিল- বাইডেন সাহেব নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আওয়ামী লীগকে হটিয়ে তাদের ক্ষমতায় বসাবে। এই না? কী দেখলেন আজকে?
বাইডেন সাহেব নিজেই সেলফি তুললেন শেখ হাসিনার সঙ্গে। তুলেছেন না? সঙ্গে আবার পুতুলও (সায়মা ওয়াজেদ) ছিল।”
রোববার তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছেন, “ছবি অনেক কথা বলে। এই ছবির ভাষা নিশ্চয়ই সাংবাদিক এবং বোদ্ধা ব্যক্তিরাও বুঝতে পারছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এবং আগামী দিনে আরও ঘনিষ্ঠ হবে।”
মি. বাইডেনের সাথে সেলফি তোলাকে ক্ষমতাসীন দল নিজেদের সাফল্য হিসেবে প্রচারের যে চেষ্টা চালাচ্ছে, তার সমালোচনা করছে বিরোধীরা।
ঢাকায় রোববার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, “সেলফির জন্য কিন্তু র্যাবের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা কিংবা ভিসা-নীতি উঠে যায়নি। দেউলিয়া হয়ে গেছে বলেই বাইডেনের সঙ্গে সেলফি তুলে ঢোল পেটাচ্ছেন। ভোটটা ঠিকমতো না করলে কোনো সেলফিই রক্ষা করতে পারবে না।”
কেবল রাজনৈতিক দলের নেতারাই নন, সরকার এবং বিরোধী উভয় দলের কর্ম-সমর্থকেরাও যেন বিষয়টি নিয়ে নেমে পড়েছেন ‘প্রচার যুদ্ধে’। পক্ষে বিপক্ষে নানা বক্তব্য, আক্রমণ এবং পাল্টা আক্রমণ চলছে সামাজিক মাধ্যমে, বিশেষত ফেসবুকে।
সরকারি দলের সমর্থনে শংকর মৈত্র ফেসবুকে লিখেছেন, “ম্যাসেজ ইজ ক্লিয়ার। ফ্রম আমেরিকা। ফ্রম ভারত। জয় বাংলা”।
অন্যদিকে, সরকার বিরোধী হিসেবে পরিচিত অনেকে সামাজিক মাধ্যমে মি. বাইডেন আগে বিভিন্ন সময়ে অনেক দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের সাথে যেসব সেলফি তুলেছেন তা পোস্ট করে লিখছেন যে ‘এটা নিতান্তই ভদ্রতা’।
কেউ আবার সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সাথে লিবিয়ার প্রয়াত নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফীর ছবি প্রকাশ করে মন্তব্য করেছেন, ‘এসব ছবি তোলায় যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে কোনো পরিবর্তন আসে না’।
তারা বোঝাতে চাইছেন, সাম্প্রতিক সময়ে নির্বাচন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে প্রকাশ্যেই সরকারের ওপর চাপ তৈরি করেছে তাতে কোন পরিবর্তনের ইঙ্গিত এই সেলফি তোলার মধ্যে নেই বলেই মনে করেন তারা।
কামরুল হাসান বাবু নামে একজন শেখ হাসিনার সাথে বাইডেন সহ বিশ্ব নেতাদের কয়েকটি ছবি পোস্ট করে লিখেছেন, “এগুলো সেলফি নয়, জি-২০ সম্মেলনের সৌজন্যতা !!!”
এদিকে, মি. বাইডেনের সাথে শেখ হাসিনার সেলফি প্রকাশ নিয়ে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের মত ভারতের কয়েকটি গণমাধ্যমেও সংবাদ প্রকাশিত হয়।
ভারতীয় সংবাদ সংস্থা এএনআই এক্সে (সাবেক টুইটারে) নয়াদিল্লির বাংলাদেশ হাইকমিশনের সৌজন্যে পাওয়া এমন কয়েকটি ছবি পোস্ট করে জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দারুণ একটি মূহুর্ত, যেখানে তারা সেলফি তুলছিলেন।
এএনআই-এর ছবি ও তথ্যের ভিত্তিতে সংবাদ প্রকাশ করে এনডিটিভি ওয়ার্ল্ড, যার শিরোনাম ছিলো ‘যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জি-২০ সামিটে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সাথে সেলফি তুলছেন’।
প্রসঙ্গত, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ‘গুরুতর মানবাধিকার লংঘনমূলক কাজে জড়িত থাকার’ অভিযোগে বাংলাদেশের বিশেষ পুলিশ র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এবং এর ছয়জন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র।
এরপর ২০২৩ সালের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্র নতুন ভিসা-নীতি ঘোষণা করে। সেসময় দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেন, বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ক্ষেত্রে যারা বাধা সৃষ্টি করবে তাদের আমেরিকার ভিসা দেয়া হবে না।
মূলত ওই ঘোষণার পর বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সঙ্গে বাইডেন প্রশাসনের সম্পর্কের টানাপড়েনের বিষয়টি সামনে চলে আসে।
সেসময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর সমালোচনা করে একাধিক বক্তব্য দেন। তখন তিনি বিবিসিকে দেয়া এক ইন্টারভিউতে মন্তব্য করেছিলেন যে ‘যুক্তরাষ্ট্র হয়তো তার সরকারকে ক্ষমতায় দেখতে চাইছে না’।
এরপর গত কয়েক মাস যাবত বাংলাদেশের আগামী সংসদ নির্বাচন যেন অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হয় – সেটি নিশ্চিতের তাগিদ দিয়ে কয়েক দফা বক্তব্য দেয় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর এবং ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত।
এর ফলে দৃশ্যমানভাবেই দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কে অবনতি ঘটে।
কিন্তু উল্টোদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের এসব পদক্ষেপ বাংলাদেশের বিরোধী দলসমূহ এবং তাদের কর্মী সমর্থকদের দারুণভাবে উজ্জীবিত করে এবং ভিসা নীতি ঘোষণার পর থেকেই বিরোধী দলগুলো বাধাহীন ভাবে সভা সমাবেশের সুযোগ পেতে থাকে।
এর পরের কয়েক মাসে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক ঠিক কোন দিকে যাচ্ছে, কিংবা আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে পরিচিত ভারত বাংলাদেশের পক্ষ নিয়ে কী করবে- এসব নিয়ে রাজনীতিতে নানা আলোচনা চলছিল।
এ পটভূমিতে মি. বাইডেনের হাসিমুখে শেখ হাসিনার সেলফি ঠিক কী অর্থ বহন করে আর আওয়ামী লীগ কোন রাজনৈতিক অর্জন এ থেকে পেলো কী না – সে আলাপে মুখর অনেকেই।