বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি পেলেন না খালেদা জিয়া, সিদ্ধান্তকে ‘মানবতাবিরোধী’ বলছে বিএনপি
ডেস্ক রিপোর্টঃ বাংলাদেশে বিরোধী দল বিএনপি-র চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে স্থায়ী মুক্তি দিয়ে বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি দেয়ার জন্য তার পরিবারের পক্ষ থেকে করা আবেদনে নেতিবাচক মতামত দিয়েছে আইন মন্ত্রণালয়। এর ফলে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে হলে মিসেস জিয়াকে জেলে ফেরত গিয়ে নতুন করে আবেদন করতে হবে।
তবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন ফৌজদারি কার্যধারার ৪০১ এর একটি উপধারা অনুযায়ী দুটি শর্তে তাকে বাসায় থেকে চিকিৎসা নেয়ার যে অনুমতি দেয়া হয়েছিলো সে আদেশও তারা বাতিল করবেন না।
ফলে সরকারের যে নির্বাহী আদেশে মিসেস জিয়া শর্তসাপেক্ষে বাসায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন সেই আদেশ বাতিল না করলে তার আপাতত জেলেও ফেরত যাওয়ার সুযোগ নেই।
বিএনপি আইন মন্ত্রণালয়ের এ সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে।
রবিবার এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, “আইন মন্ত্রণালয়ের এই নেতিবাচক সিদ্ধান্ত মানবতাবিরোধী ও বর্বর ইচ্ছে পূরণের চূড়ান্ত বহি:প্রকাশ। জনগণ এটা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। এটি পূর্ব পরিকল্পিত ও গভীর নীল-নকশার অংশ। এ অন্যায় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে জনগণ হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না।”
প্রসঙ্গত, টানা দু’বছর কারাভোগের পর অসুস্থতার কারণে সরকারের নির্বাহী আদেশে মুক্তি পেয়ে ২০২০ সালের মার্চে বাসায় ফিরে গিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। এরপর থেকে এ পর্যন্ত আটবার তার মুক্তির সময়সীমা বাড়িয়েছে সরকার।
তাকে বিদেশে চিকিৎসা দেয়ার সুযোগ দেয়ার জন্য অনুমতি চেয়ে তার পরিবারের পক্ষে তার ভাই শামিম ইস্কান্দার সর্বশেষ যে আবেদন করেছিলেন সেটিই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আইনি যাচাই বাছাইয়ের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিলো।
এখন আইন মন্ত্রণালয় সেই আবেদনে নেতিবাচক মতামত দেয়ায় মিসেস জিয়ার এখনি আর বিদেশে যাওয়ার সুযোগ থাকলো না। আবার সরকার নির্বাহী আদেশ বাতিল করে তাকে জেলে ফেরত না পাঠালে কারাগারেও ফেরত যাওয়ার সুযোগ তার হাতে নেই।
তবে বিএনপির আইন বিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামাল বিবিসি বাংলাকে বলেছেন আইন মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে আইনটির সঠিক ব্যাখ্যা দেয়নি।
বরং যে আইনে খালেদা জিয়াকে নির্বাহী আদেশে শর্তযুক্ত মুক্তি দেয়া হয়েছিলো সে আইনবলেই তাকে শর্তহীন মুক্তি দিয়ে বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দেয়ার সুযোগ আছে বলে মি কামাল দাবি করছেন ।
প্রসঙ্গত, মিসেস জিয়া এখন ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। গত পঁচিশে সেপ্টেম্বর তার ভাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করার পর থেকেই রাজনৈতিক অঙ্গনে ‘খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসার বিষয়টি সরকার ইতিবাচক ভাবে দেখতে’ পারে এমন গুঞ্জন ছিলো।
যদিও যুক্তরাষ্ট্রের একটি গণমাধ্যমের সাথে সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগেই পরিষ্কারভাবে বলেছেন যে বিদেশে যাওয়ার আবেদন করতে হলে খালেদা জিয়াকে কারাগারে ফেরত গিয়ে করতে হবে।
কী বলেছেন আইনমন্ত্রী
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক দুপুরে সচিবালয়ে বলেছেন বিএনপি চেয়ারপার্সনের চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে করা নতুন আবেদন বিবেচনার সুযোগ নেই এবং তারা সেই মতামত দিয়েই আবেদনকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠিয়েছেন।
“আমরা মতামত দিয়ে আবেদনটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। এর আগে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১-এর উপধারা অনুযায়ী দুটি শর্তে তাঁকে বাসায় থেকে চিকিৎসা নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। কাজেই আমরা নতুন করে আরেকটি আবেদন গ্রহণ করতে পারি না। আমাদের সেই সুযোগ নেই,” সাংবাদিকদের জানান মি. হক।
তিনি আরও বলেন খালেদা জিয়ার পক্ষে প্রথম যে দরখাস্ত ছিলো – ২০২০ সালের মার্চে যেটি নিষ্পত্তি করা হয়েছিলো – তখন দুটো শর্তসাপেক্ষে তার দণ্ডাদেশ ছয় মাসের জন্য স্থগিত করে তাকে মুক্তি দেয়া হয়েছিলো।
শর্ত দুটো ছিলো – প্রথমত তিনি বাসায় থেকে চিকিৎসা নেবেন এবং দ্বিতীয়ত তিনি বিদেশে যেতে পারবেন না।
আইনমন্ত্রী বলেন, “এসব শর্ত মেনেই তিনি কারাগার থেকে বের হয়ে বাসায় যান। প্রতি ছয় মাসে সেটা বৃদ্ধি করে এ পর্যন্ত আটবার বাড়ানো হয়েছে। আর ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী কোন দরখাস্ত একবার নিষ্পত্তি হলে সেটি আর পরিবর্তনের সুযোগ থাকে না।”
ফলে বিদেশে যাওয়ার আবেদন করতে হলে খালেদা জিয়াকে কারাগারে ফেরত গিয়ে আবেদন করতে হবে। কিন্তু ৪০১ ধারা সরকার যখন প্রয়োগ করে সেটি আদালতে চ্যালেঞ্জ করার নজির উপমহাদেশে নেই বলে উল্লেখ করেছেন আইনমন্ত্রী।
“আমরা ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারার আদেশ বাতিল করব না, এটা করা হলে তা হবে অমানবিক,” এক প্রশ্নের জবাবে বলছিলেন আইনমন্ত্রী।
অর্থাৎ খালেদা জিয়া তার শর্তযুক্ত মুক্তির বিষয়টি আদালতে চ্যালেঞ্জ করতে চাইলেও উপমহাদেশে তার নজির নেই বলে সরকারের দাবি। অন্য দিকে সরকার নিজে থেকেও এটি বাতিল করবে না।
ফলে কারাগারে ফেরত গিয়ে নতুন করে বিদেশে যাওয়ার আবেদন করার সুযোগও এখন তিনি পাবেন না।
তীব্র সমালোচনা করলো বিএনপি
সচিবালয়ে আইনমন্ত্রী গণমাধ্যমকে ব্রিফ করার কিছুক্ষণ পরেই নয়াপল্টনে বিএনপি কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন দলটির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
তিনি বলেন, “আইন মন্ত্রণালয়ে এ নেতিবাচক সিদ্ধান্ত মানবতাবিরোধী ও সরকারের বর্বর ইচ্ছে পূরণের চূড়ান্ত বহি:প্রকাশ। এই দু:শাসনের বিরুদ্ধে জনগণ পথে পথে অবরোধ করবে”।
তিনি মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন জনগণ এটা ঘৃনাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে।
মি রিজভী আরও দাবি করেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘আক্রোশ ও প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতেই’ এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে আইন মন্ত্রণালয়।
অন্যদিকে বিএনপির আইন বিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামাল বিবিসি বাংলাকে বলেছেন যে তারা মনে করেন পুরো সিদ্ধান্তটি রাজনৈতিক প্রতিহিংসাবশত নেয়া হয়েছে।
“আইনের সুস্পষ্ট বিধান থাকলেও যেহেতু দেশে আইনের শাসন নেই, তাই অনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আইন, সংবিধান ও আন্তর্জাতিক রীতিনীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।”
“আমরা মনে করি আইন নিজস্ব গতিতে চললে খালেদা জিয়া বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ পেতেন,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
খালেদা জিয়ার অবস্থা কেমন
শামিম ইস্কান্দার সরকারের কাছে যে চিঠি দিয়েছেন সেখানে বলা হয়েছে খালেদা জিয়া লিভার সিরোসিস ও হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন, যার আধুনিক চিকিৎসা বাংলাদেশে সম্ভব নয়।
চিঠিতে বলা হয়েছে, “তিনি উঠে দাঁড়াতে পারেন না, এমন কী কারও সাহায্য ছাড়া ওয়াশ-রুম কিংবা শয়নকক্ষের বাইরেও যেতে পারেন না।”
এছাড়া লিভার সিরোসিস থেকে তার কিডনি ও ফুসফুসও আক্রান্ত হয়েছে। ফলে কিছুদিন পর পর তার পেটে পানি জমছে এবং সেগুলো অপসারণ করতে হচ্ছে।
এর আগে থেকেই তিনি আথ্রাইটিস, হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। তবে এখন পরিপাকতন্ত্রের রক্তক্ষরণ ও কিডনি জটিলতা নিয়ে বেশি উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে দল ও পরিবারের মধ্যে।
বিদেশে পাঠানোর অনুমতি চেয়ে সরকারের কাছে তার ভাই সোমবার যে আবেদন করেছেন তাতে ‘লিভার সিরোসিস ও হৃদরোগ এবং ক্রনিক কিডনি ডিজিজ’ এর কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
গত তেরই জুন হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে হাসপাতালে নেয়ার পর তিনি পাঁচদিন চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফিরেছিলেন। এরপর কয়েকবার অসুস্থতা বোধ করলে বাসাতেই তার চিকিৎসা দিয়েছেন তার চিকিৎসার জন্য গঠিত মেডিকেল বোর্ড।
অসুস্থতা বেড়ে গেলে গত নয়ই অগাস্ট রাতে মিসেস জিয়াকে যখন হাসপাতালে নেয়া হয় তখন বলা হয়েছিলো তিনি ‘শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন’। এরপর থেকে তিনি হাসপাতালেই আছেন এবং এ পর্যন্ত তিন দফা তাকে সিসিইউতেও নিতে হয়েছে।
এর মধ্যে গত ১৮ই সেপ্টেম্বর দেশি-বিদেশি চিকিৎসকদের সমন্বয়ে গঠিত মেডিকেল বোর্ডের বৈঠকের পর লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত খালেদা জিয়ার পরিপাকতন্ত্রে রক্তক্ষরণ ও কিডনি জটিলতার বিষয়টি জানান বিএনপি নেতারা।
বিএনপির সূত্র গুলো বলছে ঢাকার তার মেডিকেল বোর্ডের সাথে বিদেশি কয়েকজন বিশেষজ্ঞ ছাড়াও সম্পৃক্ত হয়েছেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন তারেক রহমানের স্ত্রী ডাঃ জোবাইদা রহমান।
তার ব্যক্তিগত চিকিৎসকদের একজন ও বিএনপির স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা: রফিকুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন যে “তার মূল সমস্যাগুলোর আর কোন চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে নেই।”