হামাসের হামলায় হতভম্ব ইসরায়েল, এর পরে কী হতে পারে?
ডেস্ক রিপোর্টঃ আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে ইসরায়েলের উপর আকস্মিক আক্রমণ চালিয়েছিল মিশর ও সিরিয়া। যা ইওম কিপুর যুদ্ধ নামে পরিচিতি পায়। এবারে একই উপায়ে ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস ইসরায়েলের ওপর বড় ধরনের আক্রমণ শুরু করেছে।
এবারও ইহুদিদের ছুটির সময়ে এই অপ্রত্যাশিত হামলার ঘটনা ঘটে।
সাম্প্রতিক সময়ে গাজা উপত্যকায় উত্তেজনা ঘনীভূত হচ্ছিল। তবে সেখানকার ইসলামপন্থী শাসক দল হামাস অথবা ইসরায়েল কেউই সেই উত্তেজনা আর বাড়াতে চায়নি।
তবে, হামাস একটি গোছানো আর সমন্বিত অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করেছিল।
রবিবার সকালে তারা জেরুজালেম এবং তেল আবিব পর্যন্ত একের পর এক রকেট নিক্ষেপ শুরু করে। সেই সাথে ফিলিস্তিনি ওই যোদ্ধারা সমুদ্র, স্থল এবং আকাশপথে দক্ষিণ ইসরায়েলে প্রবেশ করে।
তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ইসরায়েলি শহর ও সেনা ঘাঁটিগুলো ঘেরাও করে আক্রমণ করে এবং বহু মানুষকে হত্যা করে।
সেইসাথে তারা অজ্ঞাত সংখ্যক ইসরায়েলি বেসামরিক নাগরিক ও সৈন্যদের গাজায় জিম্মি করে রাখার জন্য আটক করে নিয়ে যায়।
এই ভয়াবহ ঘটনাপ্রবাহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং মূলধারার গণমাধ্যমে সরাসরি প্রচারিত হয়েছে।
গাজার আশেপাশের এলাকাগুলোয় যারা বাড়ির বাইরে খোলা মাঠে রাতভর উৎসব করছিল তারা হঠাৎ করে গোলাগুলির মুখে পড়ে যায়।
ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, পার্টিতে আসা লোকজন তাদের জীবন বাঁচানোর জন্য ছোটাছুটি করছে।
সেই রাতের বর্ণনা দিতে গিয়ে এদের একজন গিলি ইয়োসকোভিচ বিবিসিকে জানান যে কীভাবে তিনি ভারী ভারী অস্ত্রধারী যোদ্ধাদের থেকে নিজেকে গাছের আড়ালে লুকিয়ে রেখেছিলেন।
“তারা প্রতিটি গাছের কাছে যাচ্ছিল এবং সব জায়গায় গুলি করছিল। দুই দিক থেকে দেখলাম চারিদিকে মানুষ মরছে।”
“আমি ধরে নিলাম, ‘ঠিক আছে, আমি মরতে যাচ্ছি, ঠিক আছে, নিজেকে বলছিলাম শ্বাস নাও, চোখ বন্ধ করো’, কারণ [সেখানে] সর্বত্র গোলাগুলি চলছে। তারা আমার খুব কাছাকাছি ছিল।”
পরবর্তীতে ইয়োসকোভিচের সঙ্গী গাড়ি চালিয়ে তাকে খুঁজে বের করেন এবং সেখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যান।
ইসরায়েলের হাইয়োম পত্রিকায় কিবুতজ বেইরি শহরের এক বাসিন্দাকে উদ্ধৃত করা হয়। যিনি তার বাবাকে নিয়ে খুব চিন্তায় ছিলেন। রকেট হামলার সতর্কীকরণ সাইরেন বেজে ওঠার পর তার বাবা একটি নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গিয়েছিলেন।
“তিনি আমাকে লিখেছিলেন যে অস্ত্রধারীরা আশ্রয়ের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। আমি গাজার ভিতর থেকে টেলিগ্রামে তার ছবি দেখছিলাম। আমি এখনও গুলির শব্দ শুনতে পাচ্ছি,” তিনি বলেন।
এমন পরিস্থিতিতে ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর সাধারণ মানুষের সাহায্যে যতো দ্রুত এগিয়ে আসার কথা ছিল তারা সেভাবে আসেনি। এতে অনেক ইসরায়েলি তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
এদিকে, হামাস চ্যানেলে শেয়ার করা ফুটেজে দেখা গেছে যে, সশস্ত্র যোদ্ধারা ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর ঘাঁটি এবং একটি সাঁজোয়া যানে থাকা সৈন্যদের বন্দী করছে এবং হত্যা করছে।
শুরুতে গাজায় উৎসব উদযাপনের বেশ কিছু ছবি দেখা যায়। সেখানে ছিনিয়ে নেয়া কয়েকটি ইসরায়েলি সামরিক যান রাস্তা দিয়ে চালিয়ে নিতে দেখা যায়।
“আল-আকসায় ইসরায়েলি অভিযানের প্রতিশোধ নিতে হামাস এখন পর্যন্ত যা যা করেছে তাতে আমি খুশি,” গাজা শহরের এক যুবক বিবিসিকে এ কথা জানায়।
ইসরায়েল-অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেমের আল আকসায় ইহুদিদের সাম্প্রতিক উৎসবের সময়ে ইহুদি দর্শনার্থীদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি এসব কথা বলেন।
আল-আকসা মসজিদ ইসলামের তৃতীয় পবিত্র স্থান এবং এটি ইহুদিদের জন্য সবচেয়ে পবিত্রতম স্থান, যা টেম্পল মাউন্ট নামেও পরিচিত।
তবুও, এই যুবক ওই হামলার ঘটনায় তার উদ্বিগ্ন হওয়ার কথাও জানিয়েছেন।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী, গাজার কাছাকাছি কোথাও হামলা চালাতে পারে এ নিয়ে সতর্ক বার্তা পাওয়ার পরে তিনি তার বাড়ি ছেড়ে যান।
হামাসের হামলার প্রতিক্রিয়ায় পরবর্তীতে কী ঘটবে তার জন্য আতঙ্কে থাকার কথা জানান তিনি।
তিনি বলেন, “আমরা উদ্বিগ্ন, ২০২১ সালের যুদ্ধে ইসরায়েলের হামলার কারণে শোরুক টাওয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এতে আমার পরিবার একটি দোকান হারায়, এবার হামাস অনেক বড় আকারে হামলা চালিয়েছে, তাই ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া আরও বড় হবে।”
ইসরায়েলি বিমান হামলায় আহতদের ভিড়ে ফিলিস্তিনি হাসপাতালগুলো ইতিমধ্যে সয়লাব হয়ে গিয়েছে।
গাজা উপত্যকা – উপকূলীয় এই ক্ষুদ্র ভূখণ্ডে প্রায় ২৩ লাখ ফিলিস্তিনি বসবাস করেন। হামাস, পার্লামেন্ট নির্বাচনে জয়ী হওয়ার এক বছর পরে ২০০৭ সালে এই গাজা উপত্যকা দখল করে।
ইসরায়েল এবং মিশর তখন তাদের ভূখণ্ডের অবরোধ আরও কঠোর করে তোলে।
এই অঞ্চলের প্রায় ৫০% মানুষ বেকারত্ব আর দরিদ্রতার সাথে লড়াই করছে।
সবশেষ ২০২১ সালে ইসরায়েল এবং হামাসের মধ্যে বড় ধরনের সংঘাত হয়। এরপর মিশর, কাতার এবং জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় পরোক্ষ আলোচনার মাধ্যমে গাজার বাসিন্দাদের ইসরায়েলে কাজ করার জন্য হাজার হাজার কাজের অনুমোদনের ব্যবস্থা করা হয়।
সেইসাথে পরিস্থিতি শান্ত রাখার বিনিময়ে অন্যান্য বিধিনিষেধ শিথিল করা হয়েছিল।
গত মাসে, যখন শত শত ফিলিস্তিনি পাঁচ বছর আগে শুরু হওয়া গণ-বিক্ষোভের স্মরণে কাঁটাতারের বেষ্টনীর পাশে বিক্ষোভে যোগ দিতে শুরু করে, তখন ধারণা করা হয়েছিল যে এটি হামাসের প্ররোচনায় হয়েছে।
এর উদ্দেশ্য ছিল ইসরায়েলের কাছ থেকে আরও সুবিধা আদায় করা এবং কাতারের থেকে অর্থ সাহায্য পাওয়া।
ছোট ছোট সমাবেশগুলোকেও এখন ভিন্নভাবে দেখা হচ্ছে। অনেকে সন্দেহ করছেন আক্রমণ শুরুর আগে ইসরায়েলের সুরক্ষা বেষ্টনী সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্যই ওই সমাবেশ হয়েছে।
এই সর্বশেষ অভিযানের মাধ্যমে, হামাস আবারও একটি সশস্ত্র সংগঠন হিসেবে নিজেদেরকে নতুনভাবে জাহির করতে চাইছে বলে মনে করা হচ্ছে। যারা ইসরায়েলের ধ্বংসের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
আক্রমণের শুরুতে হামাসের কমান্ডার, মোহাম্মদ দেইফ ফিলিস্তিনি এবং অন্যান্য আরবদের “ইসরায়েলি দখলদারিত্ব দূর করার” অভিযানে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান।
এখন একটি বড় প্রশ্ন হল, অধিকৃত পশ্চিম তীর এবং পূর্ব জেরুজালেম বা এই অঞ্চলের অন্য জায়গায় বসবাসকারী ফিলিস্তিনিরা তার আহ্বানে সাড়া দেবে কিনা।
ইসরায়েল নিঃসন্দেহে একাধিক ফ্রন্ট থেকে যুদ্ধের আশঙ্কা করছে।
সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি যা হতে পারে তা হল, এটি শক্তিশালী লেবানিজ সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে।
এদিকে, ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী ব্যাপকভাবে সেনা মোতায়েনের নির্দেশ দিয়েছে। গাজায় তীব্র বিমান হামলার পাশাপাশি তারা সেখানে স্থল অভিযানের পরিকল্পনা করছে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
তবে এই ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী যেসব ইসরায়েলি সৈন্য এবং বেসামরিক নাগরিকদের আটক করেছে তাদেরকে তারা, মানব ঢাল বা দর কষাকষির অনুষঙ্গ হিসাবে ব্যবহার করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলবে।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী- আইডিএফ এর মুখপাত্র রিয়ার এডিএম ড্যানিয়েল হাগারি বলেন, “আমরা বর্তমানে এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করতে ব্যস্ত। আমরা ব্যাপকভাবে হামলা চালাচ্ছি, বিশেষ করে গাজা উপত্যকার আশেপাশের এলাকার নজরে রাখছি। আমরা খুব তীক্ষ্ণ এবং পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা করব।”
এ সংক্রান্ত পর্যালোচনা সম্পন্ন না হলেও, এতে কোন সন্দেহ নেই যে ইসরায়েলের গোয়েন্দা এবং নিরাপত্তা সংস্থাগুলো নিজেরাই যাচাই করতে শুরু করেছে যে কীভাবে তারা এই হামলার বিষয়ে আগে থেকে জানতে পারেনি এবং কেন তারা এই বিশাল হামলা প্রতিরোধ করতে পারেনি।