ইসরায়েল সফর করবেন বাইডেন, মিশর সীমান্ত খোলার আলোচনাসহ যা ঘটছে গাজায়
ডেস্ক রিপোর্টঃ ইসরায়েলে থাকা অবস্থায় মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেছেন,যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বুধবার ইসরায়েল সফর করবেন।
হামাসের হাতে আটক জিম্মিদের উদ্ধারে মি. বাইডেন ইসরায়েলিদের সাথে আলোচনা করবেন। একই সাথে বেসামরিক হতাহত সর্বনিম্ন রেখে ইসরায়েল কীভাবে স্থল অভিযান পরিচালনা করবে এবং হামাসকে সুবিধা না দিয়ে গাজায় কিভাবে ত্রাণ পৌঁছানো যাবে, সেসব বিষয়ও গুরুত্ব পাবে তার এই সফরে।
হামাস বলেছে, জেরুসালেম এবং তেল আবিব লক্ষ্য করে তারা রকেট হামলা চালিয়েছে। এ হামলার কারণে ইসরায়েল জুড়ে সাইরেন বাজার পর আইনপ্রণেতারা বোমা হামলা থেকে রক্ষা পাওয়ার বোম্ব শেল্টার সেন্টার বা বোমা হামলা থেকে সুরক্ষাস্থানে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন।
জাতিসংঘের ত্রাণ সহায়তা বিষয়ক প্রধান মার্টিন গ্রিফিথস বলেন, হামাস পরিচালিত গাজা উপত্যকায় হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ছে।
মিশর ও গাজা সীমান্তের রাফাহ সীমান্ত পারাপার খুলে দেয়ার বিষয়ে কূটনৈতিক আলোচনা চলছে। গাজায় ত্রাণ সহায়তা প্রবেশ এবং বিদেশি নাগরিকদের সরিয়ে নেয়ার বিষয়ে এই সীমান্ত ব্যবহারের কথা রয়েছে।
রাফাহ সীমান্ত এলাকায় বিমান হামলা করেছে ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান। হামলার একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, সেখানে বড় ধরণের বিস্ফোরণ হয়েছে। বিবিসি এই ভিডিওটি যাচাই করেছে। তবে ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে এখনো বিস্তারিত জানা যায়নি।
ইসরায়েলে হামলার পর সেখান থেকে আটক জিম্মিদের একজনের একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে হামাস।
এতে দেখা যাচ্ছে একজন তরুণী নারী হিব্রু ভাষায় কথা বলছে এবং সে নিজেকে ২১ বছর বয়সী মায়া শেম বলে পরিচয় দিচ্ছে।
ইসরায়েল জানিয়েছে কমপক্ষে ১৯৯ জন ইসরায়েলি নাগরিককে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। হামাসের সামরিক অংশের একজন মুখপাত্র বলেছেন, গাজায় কমপক্ষে ২০০ থেকে ২৫০ জন জিম্মি রয়েছে।
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক বলেছেন, হামাসের হামলায় প্রাথমিকভাবে ছয় জন ব্রিটিশ নাগরিক নিহত হয়েছে। নিখোঁজ রয়েছে আরো ১০ জন।
জাতিসংঘ বলেছে, প্রায় ১০ লাখ ফিলিস্তিনি যারা তাদের বাড়িঘর ছেড়ে এসেছে তাদের জরুরী ভিত্তিতে খাবার, পানি এবং জ্বালানি দরকার।
নেতানিয়াহুকে পুতিনের ফোন
ইসরায়েল ও গাজা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে ফোন করেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। মস্কোতে থাকা প্রেসিডেন্টের দপ্তর ক্রেমলিন থেকে একথা জানানো হয়েছে।
এক বিবৃতিতে ক্রেমলিন জানায়, হামাসের হামলায় নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন পুতিন। একই সাথে তিনি “বেসামরিক নারী ও শিশুরা ভুক্তভোগী হয় এমন যেকোনো হামলার বিরোধিতা এবং নিন্দা জানিয়েছেন।”
ইউক্রেনে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারি পরোয়ানার মধ্যে থাকা ভ্লাদিমির পুতিন এই ইস্যুতে রাশিয়ার পদক্ষেপ সম্পর্কে মি.নেতানিয়াহুকে অবহিত করেছেন। এই সংঘাত বন্ধ করে মানবিক সহায়তা কার্যক্রমের জন্য জাতিসংঘে একটি প্রস্তাব এনেছিল রাশিয়া। যা নিরাপত্তা পরিষদের ভোটাভুটিতে বাতিল হয়ে যায়।
সেই সম্পর্কে বলেছেন, “এর লক্ষ্য হচ্ছে পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করা, আরো বেশি উত্তেজনা বাড়তে না দেয়া এবং গাজা উপত্যকায় একটি মানবিক বিপর্যয় রোধ করা।”
ইসরায়েল সফর করবেন বাইডেন
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বুধবার ইসরায়েল সফর করার কথা রয়েছে বলে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন জানিয়েছেন।
সোমবার ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের মধ্যে টানা সাত ঘণ্টা ধরে বৈঠকের পর জেরুসালেমে থাকা মার্কিন দূতাবাস থেকে এই ঘোষণা দেন তিনি।
মি. ব্লিঙ্কেন সাংবাদিকদের বলেন, “মি. বাইডেনকে ইসরায়েল সফর করার সময় দেশটির যুদ্ধের লক্ষ্য এবং কৌশল সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া হবে।”
তিনি “ইসরায়েল কিভাবে বেসামরিক মানুষ হতাহত হওয়ার বিষয়টি সর্বনিম্ন পর্যায়ে রেখে অভিযান পরিচালনা করবে” এবং গাজায় ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের কাছে ত্রাণ পৌঁছানোর- বিষয়েও শুনবেন।
মি. নেতানিয়াহুর আমন্ত্রণে ইসরায়েল সফর করবেন মি. বাইডেন।
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মুখপাত্র জন কিরবি এক সংবাদ সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ইসরায়েল সফরের বিষয়ে বলেন, ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে উত্তেজনার “গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে” তিনি বুধবারে তেল আবিবে পৌঁছাবেন।
মি. বাইডেনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ইসরায়েলের সাথে “একাত্মতা পুনর্ব্যক্ত করা” এবং গাজায় বেসামরিক নাগরিকদের জন্য ত্রাণ সরবরাহ নিশ্চিত করা।
মি. কিরবি বলেন, হামাসকে সুবিধা দেবে না এমন ধরণের “মানবিক সহায়তার বিষয় নিয়ে আলোচনা করবেন তিনি।”
এছাড়া গাজার বাসিন্দারা চাইলে তারা যাতে গাজা ছেড়ে যেতে পারে তার জন্য “নিরাপদে সরে যাওয়ার পথ” তৈরি করার বিষয়ে কাজ করবেন মি. বাইডেন।
ইসরায়েল সফর শেষে তিনি জর্ডানের আম্মান সফর করবেন। সেখানে তিনি জর্ডানের বাদশা আব্দুল্লাহ, মিশরের প্রেসিডেন্ট আল-সিসি এবং ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সাথে দেখা করবেন।
জাতিসংঘে প্রস্তাব পাস ব্যর্থ
ইসরায়েল ও গাজার পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে রাশিয়ার তোলা প্রস্তাবকে “মানবিক প্রস্তাবনা” বলা হচ্ছে। প্রস্তাবটির একটি খসড়া নিরাপত্তা পরিষদে পাস হতে পারেনি।
রয়টার্স জানাচ্ছে, এই প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, উভয়পক্ষের মধ্যে একটি মানবিক যুদ্ধ বিরতি কার্যকর করা যাতে জিম্মিদের মুক্তি, মানবিক সহায়তা প্রদান এবং বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপদে সরিয়ে আনা হবে। ওই প্রস্তাবনায় সন্ত্রাসবাদের নিন্দা জানানো হলেও হামাসের নাম উল্লেখ করা হয়নি।
নিরাপত্তা পরিষদে কোন প্রস্তাব পাস হতে হলে অন্তত নয়টি সদস্য দেশের ভোটের দরকার হয়। সেই সাথে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের যে কেউ ভেটো দিলে তা পাস হতে পারে না।
নিরাপত্তা পরিষদের পশ্চিমা দুই দেশ যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, খসড়া প্রস্তাবটিতে বিশেষ করে হামাসের নিন্দা না জানানোর কারণে তারা এই প্রস্তাবে সমর্থন জানাবেন না।
রাশিয়া জোর দিয়ে বলেছে যে, প্রস্তাবের লেখাগুলো পুরোপুরি মানবিক- রাজনৈতিক নয়।
রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত ভ্যাসিলি নেবেনজিয়া বলেন, ভোটের ফল যাই আসুক, এর ফলে নিরাপত্তা পরিষদে একটি আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
প্রস্তাবনায় রাশিয়া, চীন এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ পাঁচটি দেশ পক্ষে ভোট দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স এবং যুক্তরাজ্য বিপক্ষে ভোট দিয়েছে এবং ছয়টি দেশ ভোট দেয়া থেকে বিরত থেকেছে। ব্রাজিলের আনা এর একটি বিরোধী প্রস্তাবনায় মঙ্গলবার ভোটাভুটির কথা রয়েছে।
গাজায় বেঁচে থাকার সংগ্রামে লাখ লাখ মানুষ
গাজার দক্ষিণাঞ্চলে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে আশ্রয়হীন আর ক্ষুধার্ত লাখ লাখ মানুষ বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে।
উত্তরাঞ্চল থেকে পালিয়ে আসা এক ব্যক্তি বলেন, “বেঁচে থাকার জন্য যা দরকার তার কিছুই আমাদের কাছে নেই।”
“আমরা আস্তাঁকুড়ে বসবাস করছি। এখান থেকে সরে গেলে আমরা মারা যাবো।”
কর্মীরা বিপুল পরিমাণ ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে নিতে কাজ করছে। বাথরুমের ব্যবস্থা খুবই কম। সেখানে রোগবালাই ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
খাবার থাকলেও সেটি পর্যাপ্ত নয়। খান ইউনিস শহরে রাস্তার পাশে বড় একটি পাত্রে স্যুপ আর ভাত রান্না করছেন আমির। যে শহরটিতে এক সময় চার লাখ বাসিন্দা ছিলো, সেখানে এখন প্রায় ১০ লাখ মানুষের ব্যবস্থা করতে হচ্ছে।
আমির বলেন, তিনি যা রান্না করছেন তা খুব বেশি হলে দুই হাজার মানুষের খাবার হবে। এই সংখ্যা সহায়তা প্রয়োজন এমন মানুষের একটি সামান্য অংশ মাত্র।
লেবাননে হেজবুল্লাহকে লক্ষ্য করে হামলা
ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী আইডিএফ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক পোস্টে বলেছে, “লেবাননে হেজবুল্লাহ অস্ত্রধারীদের লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে তারা।”
বেশ কয়েক দিন ধরে হেজবুল্লাহ এবং ইসরায়েলি বাহিনীর মধ্যে সীমান্তে গুলি বিনিময় হচ্ছে।
হামাসের মতো হেজবুল্লাহকেও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ অন্যান্য দেশ সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করেছে।
হামাসের তুলনায় তাদের কাছে আরো উন্নত অস্ত্র রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। বলা হয়, এসব অস্ত্র যা দিয়ে তারা হামাসের তুলনায় ইসরায়েলের আরো ভেতরে আঘাত করতে সক্ষম।
সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক এন্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিসের তথ্য অনুযায়ী, ইরান সমর্থিত ভারী অস্ত্রে সজ্জিত এই গোষ্ঠীটির কাছে প্রায় এক লাখ ৩০ হাজার রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে।
হেজবুল্লাহর সাথে সংঘাত শুরু হলে ইসরায়েলি বাহিনীর জন্য দ্বিতীয় আরেকটি যুদ্ধক্ষেত্র তৈরি হবে।
এর কয়েক ঘণ্টা আগে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু দেশটির পার্লামেন্ট নেসেটে দেয়া এক ভাষণে, ইরান ও হেজুবল্লাহকে এই উত্তেজনায় না জড়ানোর হুশিয়ারি দিয়েছেন।
তিনি বলেন, “আমাদের ঘাটিয়ো না, তোমাদের মারাত্মক ক্ষতি হবে।”
কূটনীতি কতদূর?
বিবিসির কূটনীতিক প্রতিনিধি জেমস ল্যানডেল বলেন, ইসরায়েলে হামাসের হামলার পর থেকে এখনো পর্যন্ত কূটনীতি খুব একটা কাজে লাগেনি।
গাজায় বেসামরিক নাগরিদের সুরক্ষার কোন ব্যবস্থা নেই, কোন জিম্মিকে মুক্ত করা হয়নি, মিশরের সাথে সীমান্ত পারাপার এখনো বন্ধ।
গালফ পরিভ্রমণ শেষে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবারো ইসরায়েলে ফেরত এসেছেন শুধু বাঙ্কারে লুকিয়ে থাকার জন্য কারণ তেল আবিব জুড়ে বিমান হামলার সাইরেন বেজে উঠে।
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরায়েলকে হুশিয়ার করে বলেছে, গাজায় যেকোন স্থল অভিযান চালানো হলে তা “আগ-বাড়িয়ে পদক্ষেপ” নেয়ার সুযোগ তৈরি করবে, তিনি মূলত লেবাননে হেজবুল্লাহর হামলাকে বোঝাতে এই উপমা ব্যবহার করেছেন।
কিন্তু এসব কিছুর পরও কূটনীতি চলছে। মি. ব্লিঙ্কেন এলাকাতেই রয়েছেন। তার নেতা প্রেসিডেন্ট বাইডেনও বুধবার সেখানে সফর করবেন।
রাশিয়া এই ঘটনায় যুক্ত হচ্ছে এবং তুর্কিরা হামাসের সাথে আলোচনা করছে।
মঙ্গলবার ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতারা একটি টেলিকনফারেন্সের মাধ্যমে উত্তেজনার বিষয়ে আলোচনা করবেন।