হামাসের সাথে অস্ত্র বিরতির সম্ভাবনা নাকচ, নেতানিয়াহু বলছেন, ‘এখন যুদ্ধের সময়’
ডেস্ক রিপোর্টঃ ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গাজায় অস্ত্র বিরতির আহ্বান নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, “এটা হবে হামাসের কাছে ‘আত্মসমর্পণের সমান’।”
তেল আবিবে ভাষণ দেয়ার সময় মি. নেতানিয়াহু বাইবেলের কিছু উক্তির উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, “এখন যুদ্ধের সময়।”
এদিকে, নিরাপত্তা কাউন্সিলে জরুরী বৈঠকে জাতিসংঘের ত্রাণ বিষয়ক সংস্থাগুলো আবারো মানবিক অস্ত্র বিরতির জন্য আহ্বান জানিয়েছে।
ইউনিসেফ বলেছে, প্রতি ঘণ্টায় গাজার অবস্থা আরো খারাপ হচ্ছে। আর “সাম্প্রতিক উত্তেজনা বৃদ্ধির মূল্য শিশুদের জীবনের বিনিময়ে পরিশোধ করতে হবে।”
এর আগে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী বলেছে, তারা গাজা থেকে প্রাইভেট ওরি মেগিডিস নামে এক সেনাকে উদ্ধার করেছে, যাকে গত সাতই অক্টোবর জিম্মি করেছিল হামাস।
হামাস গাজায় থাকা তিনজন জিম্মির ভিডিও প্রকাশ করেছে। বিবিসি এই ভিডিও প্রচার বা প্রকাশ করছে না, কারণ জোর করে ধারণ করা ভিডিও প্রচার করে না বিবিসি।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী একে “নিষ্ঠুর মানসিক প্রচারণা” বলে উল্লেখ করেছেন। ভিডিওতে থাকা এক নারীর বাবা বলেছেন, তার মেয়েকে ভিডিওতে দেখার পর তার হৃৎস্পন্দন প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল।
গত সাতই অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের আক্রমণে ১৪০০ ইসরায়েলি নিহত ও প্রায় ২৩৯ জনকে জিম্মি করার পর থেকে গাজায় বিমান হামলা চালিয়ে আসছে তেল আবিব।
গাজায় থাকা হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইসরায়েলের বোমা হামলায় এখনো পর্যন্ত আট হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে।
ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধে ৩১ সাংবাদিক নিহত-সিপিজে
কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্ট-সিপিজে এর সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে সংঘাতের বিষয়ে প্রতিবেদন করতে গিয়ে এ পর্যন্ত ৩১ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছে।
নিহতদের মধ্যে ২৬ জন ফিলিস্তিনি, চার জন ইসরায়েলি এবং এক জন লেবাননের সাংবাদিক। সিপিজে বলছে, এছাড়া আরো আট জন সাংবাদিক আহত হয়েছে এবং নয় জন নিঁখোজ বা আটক রয়েছে।
সোমবার দেয়া এক বিবৃতিতে সংস্থাটি বলে, “গাজায় ইসরায়েলি স্থল অভিযান, ধ্বংসাত্মক বিমান হামলা, ভগ্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং জ্বালানি সংকটের মধ্যে গাজায় এই সংঘাতের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে উচ্চ মাত্রার ঝুঁকির মুখে পড়ছে সাংবাদিকরা।”
সিপিজে’র তথ্য অনুযায়ী, নিহতদের মধ্যে রয়েছেন স্বনামধন্য ফিলিস্তিনি চলচ্চিত্র নির্মাতা রশদি সারাজ, বৈরুত ভিত্তিক রয়টার্সের ভিডিওগ্রাফার ইসাম আবদাল্লাহ যিনি লেবানন সীমান্তের কাছে ইসরায়েলের দিক থেকে আসা গোলার আঘাতে নিহত হন। ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী আইডিএফ বলেছে, তারা এই অভিযোগ খতিয়ে দেখছে।
তবে বার্তা সংস্থা রয়টার্স এবং এজেন্স ফ্রান্স প্রেস-এএফপি সংবাদ সংস্থাকে আইডিএফ আরো বলেছে, গাজা উপত্যকায় থাকা সংস্থাগুলোর সাংবাদিকদের নিরাপত্তার গ্যারান্টি দিতে পারবে না তারা।
রয়টার্স বলছে, সংস্থা দুটো তাদের সাংবাদিকদের নিরাপত্তা চেয়ে আবেদন করার পর এমনটা জানায় আইডিএফ।
লেবাননে ‘হেজবুল্লাহর অবকাঠামোয়’ হামলা
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী-আইডিএফ একটি ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করেছে যেখানে, লেবাননে হেজবুল্লাহর অবকাঠামো লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে।
মঙ্গলবার এক্স (সাবেক টুইটার) এ দেয়া এক পোষ্টে আইডিএফ বলছে, “লেবাননে হেজবুল্লাহ সন্ত্রাসীদের অবকাঠামো, অস্ত্র, পোস্ট এবং এলাকা লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে আইএএফ যুদ্ধ বিমান।”
হেজবুল্লাহ ইরান সমর্থিত শক্তিশালী একটি সশস্ত্র বাহিনী যারা হামাসের মিত্র। গত সাতই অক্টোবর থেকে আইডিএফ এর সাথে আন্তঃসীমান্ত গোলাগুলি চালিয়ে আসছে গোষ্ঠীটি।
আল-কুদস হাসপাতালে ‘আতঙ্ক’
ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি জানিয়েছে, আল-কুদস হাসপাতালের আশেপাশের এলাকায় ভারী বোমা হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী।
সাবেক টুইটার বা বর্তমান এক্স এর এক পোষ্টে গোষ্ঠীটি জানিয়েছে, “গাজার তাল-আলহওয়া এলাকায় যেখানে আল-কুদস হাসপাতালটি অবস্থিত সেখানে ইসরায়েলের বিমান হামলা ও গোলাবারুদ নিক্ষেপ চলমান রয়েছে।”
“হাসপাতাল ভবনটি কাঁপছে এবং এখানে থাকা বেসামরিক নাগরিক ও চিকিৎসাকর্মীরা আতঙ্কে রয়েছেন।”
এই তথ্য এমন এক সময়ে জানানো হলো যখন ইসরায়েল ওই হাসপাতালটি এর আগে খালি করার নির্দেশ দিয়েছিল।
আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা অ্যাকশন এইড বলছে, আল-কুদস হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সগুলোতে কোন জ্বালানি নেই। আর আশপাশের রাস্তাগুলো বোমা হামলায় এমন অবস্থা হয়েছে যে, সেখানে চিকিৎসক ও রোগীদের কাছে ত্রাণ সহায়তা গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
অ্যাকশনএইড ফিলিস্তিন এর কমিউনিকেশন্স এন্ড অ্যাডভোকেসি কো-অর্ডিনেটর রিহাম জাফারি বলেছেন, “গাজায় ত্রাণ বাড়ানোকে আমরা স্বাগত জানাই। কিন্তু সম্প্রতি হামলার পরিমাণ যেভাবে বাড়ছে এবং হাসপাতালগুলোকে যেভাবে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হচ্ছে তাতে, যে পরিমাণ ত্রাণ সহায়তা আসছে তা চাহিদার সাথে তাল মেলাতে পারছে না।”
“টানা বোমা হামলার কারণে সরবরাহগুলো হাসপাতালগুলোতে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না রাস্তাঘাট ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কারণে। আমরা আবারো অস্ত্র বিরতির আহ্বান জানাচ্ছি যাতে হাসপাতালগুলোতে লাইফ সাপোর্টের মেশিনগুলো চলমান থাকতে পারে।”
গাজায় রাতভর যুদ্ধ
গাজার ভোর বেলার সরাসরি সম্প্রচারিত একটি ভিডিও ফুটেজে দূর থেকে গাজার কিছু অংশ দেখা যায়, যেখানে অন্ধকারেও যুদ্ধ চলছে।
বিবিসির প্যাট্রিক জ্যাকসন বলেন, আমরা বোমা বিস্ফোরণ এবং বিমান উড়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। মাঝে মাঝে স্বয়ংক্রিয় গুলির শব্দও কানে আসছিল।
এপর্যন্ত যা জানা গেছে তা হলে গত কয়েক দিনে ইসরায়েলে শত শত বিমান হামলা চালিয়েছে। আর গাজার রাস্তায় ইসরায়েলের ট্যাংক দেখা গেছে।
এর মধ্যেই লাখ লাখ ফিলিস্তিনি গাজায় আরো একটি উদ্বিগ্ন রাত কাটাচ্ছে। এদের অনেকে ইসরায়েলের সতর্কতায় সাড়া দিয়ে গাজার উত্তরাঞ্চল থেকে দক্ষিণে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে।
সৌদি আরবের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সাথে হোয়াইট হাউসে সাক্ষাৎ
গাজার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে সৌদি আরবের প্রতিরক্ষামন্ত্রী যুবরাজ খালিদ বিন সালমান আল সৌদ এর সাথে হোয়াইট হাউসে সাক্ষাৎ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান।
হোয়াইট হাউস থেকে প্রকাশিত এক বার্তায় জানানো হয়, তারা “গাজার মানুষদের জন্য জরুরী মানবিক সহায়তা বাড়ানোর বিষয়ে ঐক্যমত হয়েছেন।”
এই বার্তায় “সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এরইমধ্যে শুরু হওয়া পদক্ষেপের উপর ভিত্তি করে ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করার গুরুত্ব” সম্পর্কে তুলে ধরা হয়।
ওই বার্তায় “যেকোন রাষ্ট্র বা অরাষ্ট্রীয় পক্ষকে সংঘাত আরো বাড়ানোর চেষ্টা থেকে বিরত থাকার” গুরুত্বও তুলে ধরা হয়।
আইডিএফ এর পরবর্তী পদক্ষেপের বিস্তারিত জানাবে না ইসরায়েল
সোমবার বিবিসির আন্তর্জাতিক বিষয়ক করেসপনডেন্ট লাইস ডুসেট ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা মার্ক রেগেভের সাথে কথা বলেন।
তাকে গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনী এগিয়ে যাবে কিনা প্রশ্ন করা হলে মি. রেগেভ বলেন: “আইডিএফ এর পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানাতে চাই না আমি।”
“হতে পারে যে হামাস হয়তো দেখছে এবং আমরা তাদের নির্দেশ দিতে চাই না যে তাদের পরবর্তী সবচেয়ে ভাল প্রতিরক্ষা কেমন হতে পারে। আমাদের উদ্দেশ্য পরিষ্কার: আমরা হামাসের সামরিক মেশিন ধ্বংস করবো, এবং গাজায় তাদের রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থা ভেঙ্গে ফেলবো। আটক জিম্মিদের উদ্ধারের সাথে সাথে এগুলোই আমাদের লক্ষ্য।”
গাজার উত্তরাঞ্চল থেকে মানুষের সরিয়ে নেয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন: “আমরা মানুষদের যুদ্ধাঞ্চল ছেড়ে চলে যেতে উৎসাহিত করছি। মানুষ সেগুলো শুনেছে এবং তারা দক্ষিণে চলে গেছে। কিন্তু সবাই যায়নি। নির্দোষ বেসামরিক নাগরিক এবং হামাস সন্ত্রাসীদের মধ্যে পার্থক্য করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো আমরা।”
প্রতি ১০ মিনিটে মারা যাচ্ছে একটি শিশু: সেভ দ্য চিলড্রেন
দাতব্য সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনের ফিলিস্তিনি শাখার কর্মকর্তা জেসন লি গাজার পরিস্থিতি সম্পর্কে বলেন, প্রতি ১০ মিনিটে একটি করে শিশু মারা যায়।
জেরুসালেম থেকে বিবিসির সাথে কথা বলার সময় তিনি বলেন, এ পর্যন্ত যে ২০ হাজারের মতো মানুষ আহত হয়েছে তাদের প্রতি তিন জনের মধ্যে একজন শিশু।
লি বলেন, জনাকীর্ণ পরিবেশ এবং যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি না থাকার কারণে সংক্রামক রোগ বাড়ছে। তিনি বলেন, ইনফ্লুয়েঞ্জা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, গাজায় ট্রাকের মাধ্যমে যে ত্রাণ সহায়তা দেয়া হচ্ছে তা “সাগরে এক ফোটা পানির মতো।”
“সার্জনরা অ্যানেসথেটিক ছাড়াই অস্ত্রোপচার করছেন, হাসপাতালগুলোতে আলোর উৎস হিসেবে মোবাইল ফোন ব্যবহার করছে মানুষ।”
তিনি বলেন, “তাদের চিকিৎসা সরবরাহ যেমন ব্যান্ডেজ শেষ হয়ে গেছে। আর ১৩০টি শিশু রয়েছে ইনকিউবেটরে যেগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।”
জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলের জরুরী বৈঠকে ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক ক্যাথেরিন রাসেল বলেছেন, সংঘাত চলতে থাকায় গাজায় প্রতিদিন ৪২০টির বেশি শিশু মারা যাচ্ছে বা আহত হচ্ছে।
রাসেল বলেন, গাজা উপত্যকার বাইরেও শিশুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা পরিচালিত হচ্ছে। পশ্চিম তীর এবং পূর্ব জেরুসালেমে কমপক্ষে ৩৭টি শিশু নিহত হয়েছে। ইসরায়েলের ৩০টির বেশি শিশু নিহত হয়েছে এবং আরো ২০ জন গাজায় জিম্মি হিসেবে আটক রয়েছে যাদের ভাগ্য এখনো অনিশ্চিত।