ইহুদি বিদ্বেষ এবং ইহুদিবাদ বিরোধিতা- এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য কী?
ডেস্ক রিপোর্টঃ গাজায় ইসরায়েল হামাস যুদ্ধ তীব্র হওয়ার সাথে সাথে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই অ্যান্টি সেমিটিজম বা ইহুদি-বিদ্বেষ এবং অ্যান্টি জায়োনিজম বা জায়নবাদ বিরোধিতা, এই দুটি বিষয়ের মধ্যে পার্থক্য কী সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন।
অ্যান্টি সেমিটিজম বা ইহুদি-বিদ্বেষ বলতে ইহুদিদের বিরুদ্ধে কুসংস্কার, বৈষম্য এবং ধর্মীয় গোঁড়ামি থাকাকে বোঝায় যা শত শত বছর ধরে অনেকের মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে।
অন্যদিকে ইসরায়েল রাষ্ট্রের অস্তিত্বের বিরোধিতা করাকে অ্যান্টি জায়োনিজম বা জায়নবাদ বিরোধিতা বলে বর্ণনা করা যেতে পারে।
ব্রিটেনের আদালত বলছে, ইহুদি বলতে যেমন একটি ধর্মীয় বিশ্বাসকে বোঝায় পাশাপাশি ইহুদি বলতে একটি জাতিগোষ্ঠীকেও বোঝায়। কিন্তু দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়।
অ্যান্টি-সেমিটিজম বা ইহুদি বিদ্বেষ কী?
ইহুদিরা বহু শতাব্দী ধরে ধর্মীয় গোঁড়ামি, বৈরিতা ও নিপীড়নের সম্মুখীন হয়েছে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, নাৎসি এবং তাদের মিত্ররা প্রায় ষাট লাখ ইহুদিকে হত্যা করেছিল। ওই গণহত্যা ‘হলোকাস্ট’ নামে পরিচিত।
সমসাময়িক অ্যান্টি-সেমিটিজম বা ইহুদি বিদ্বেষকে অনেকভাবে দেখা যেতে পারে। এর মধ্যে একটি হল ইহুদিদের নিয়ে প্রচলিত ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বিশ্বাস করে ঘৃণা ছড়ানো।
এসব ষড়যন্ত্র তত্ত্ব অনুযায়ী, ইহুদিরা বিশ্বের আর্থিক ব্যবস্থা এবং সংবাদ মাধ্যমের প্রচার প্রচারণা নিয়ন্ত্রণ করে।
এই ধারণা থেকে ইহুদিদের প্রার্থনালয় সিনাগগে আক্রমণ, আজেবাজে গালিগালাজ করা বা ঘৃণা ছড়ানো বক্তব্য দেয়া হয়ে থাকে।
সেই সাথে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা আপত্তিকর মিমস এবং কন্টেন্ট তৈরি করা বা শেয়ার করাকে অ্যান্টি-সেমিটিজম অর্থাৎ ইহুদি বিদ্বেষের উদাহরণ বলা যেতে পারে।
তবে কিছু মন্তব্য বা মতামত ইহুদি বিরোধী কিনা তা নিয়ে আবার অনেকে দ্বিমত পোষণ করেন।
বিশেষ করে যারা ইসরায়েল সম্পর্কে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি রাখেন তারা কখনও কখনও কিছু মন্তব্য বা মত প্রকাশকে ইহুদি বিদ্বেষী বলতে রাজি নন।
যেমন ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের আচরণ ও সরকারি নীতির সমালোচনা করা মানে অ্যান্টি-সেমিটিজম বা ইহুদি বিদ্বেষ নয়।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই আলোচনা বা সমালোচনাগুলো ইসরায়েল এবং জায়োনিজম বা জায়নবাদের সঙ্গে সম্পর্কিত।
জায়োনিজম বা জায়নবাদ কি?
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ইউরোপে ইহুদীবাদ একটি রাজনৈতিক আন্দোলন হিসেবে গড়ে ওঠে।
এই আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল ইহুদি বিরোধিতা প্রতিরোধ করা এবং “ফিলিস্তিন” ভূখণ্ডে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা।
যাকে ইহুদিরা “ইসরায়েলের প্রাচীন ভূমি” বা “ইসরায়েলের ঐতিহাসিক ভূখণ্ড” বলে মনে করে।
জায়োনিজম বা ইহুদিবাদ বলতে মধ্যপ্রাচ্যে এই ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের আন্দোলনকে বোঝায়।
১৯১৭ সালের বেলফোর ঘোষণায় ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি রাষ্ট্র ঘোষণার প্রস্তাবে ব্রিটেন সমর্থন দেয়।
১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনের উপর ব্রিটিশ আধিপত্যের অবসানের সাথে সাথে জাতিসংঘ সুপারিশ করেছিল যে ফিলিস্তিনি এলাকাকে – ইহুদি ও আরব রাষ্ট্র এই দুটি ভাগে ভাগ করা হবে।
ওই প্রথম ইসরাইল রাষ্ট্র গঠনের বিষয়টি সামনে আসে।
জায়োনিস্ট বা ইহুদিবাদীরা মূলত এভাবেই আধুনিক ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতি তাদের সমর্থন জানায়।
কিন্তু ফিলিস্তিন ও এর আশেপাশের আরব প্রতিবেশীদের বেশিরভাগই ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের বিপক্ষে অবস্থান নেয়।
ফিলিস্তিন এবং আশেপাশের অঞ্চলে বসবাসকারী আরবরা ইহুদিবাদীদের ওই দাবিকে অন্যায় বলে মনে করেন।
তারা মনে করতেন, ইসরায়েলের স্বীকৃতি দেয়া মানে আরব জনগণের অধিকারকে খর্ব করা।
ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি
হিব্রু বাইবেলে “জিওন” শব্দটি দিয়ে জেরুজালেমকে বোঝানো। যে অঞ্চলকে ঘিরেই মূলত ইসরায়েল ফিলিস্তিনের সংঘাত চলছে।
বর্তমানে, যারা ইহুদি রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলের সুরক্ষা ও সম্প্রসারণে বিশ্বাসী তারা সাধারণত জায়োনিজম বা ইহুদিবাদী আন্দোলনের অংশ বলে মনে করা হয়।
কিন্তু অ্যান্টি জায়োনিস্ট বা জায়নবাদ বিরোধীরা ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবির বিরোধিতা করে।
জায়নবাদ বা জায়োনিজমকে ঘিরে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। যেমন, কিছু ইহুদিবাদী ইসরায়েলের বর্তমান সীমানার বাইরে অন্যান্য ভূমিতে ইসরায়েলের দখলদারিত্বের অধিকারে বিশ্বাস করে, আবার অন্য একটি অংশ এই দখলদারি বিশ্বাসের বিরুদ্ধে।
আবার আরেকটি অংশ ধর্মীয় বা রাজনৈতিক কারণে ইহুদীবাদের বিরোধিতা করে।
অনেক ইহুদি, ইহুদীবাদের মৌলিক নীতিগুলোকে সমর্থন করে বা সহানুভূতি প্রকাশ করে।
যেমন ইহুদিদের মৌলিক নীতি অনুযায়ী বর্তমানে যেখানে ইসরায়েল ভূখণ্ড রয়েছে সেখানে একটি ইহুদি রাষ্ট্র থাকা উচিত।
সাধারণত যারা জায়োনিস্ট বা ইহুদিবাদী আন্দোলনের সাথে যুক্ত তারা ইহুদি জাতি হিসেবে ইসরায়েলের সুরক্ষা ও উন্নয়নে বিশ্বাস করে।
তবে ইহুদি সম্প্রদায়ের অনেকেই মনে করে যে জায়োনিস্ট বা “জায়নবাদী” শব্দটি নানাভাবে অপব্যবহার করা হচ্ছে। বিশেষ করে এই শব্দের মাধ্যমে ইহুদিদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং বর্ণবাদ প্রকাশ করা হচ্ছে।
তবে সব ইহুদি জনগণ জায়নবাদে বা ইহুদীবাদের সমর্থন করে না আবার যারা ইহুদি না, তারাও জায়নবাদী বা জায়োনিস্ট হতে পারেন।
অর্থাৎ জায়োনিস্ট বা ইহুদিবাদী হওয়া এবং ইহুদি হওয়া এক জিনিস নয়।
উদাহরণস্বরূপ অনেক ইহুদিবাদী আছেন যারা ইসরায়েলি সরকারের দখলদারিত্বের নীতির সমালোচনা করেন। আবার অনেক ইহুদি আছেন যারা ইহুদীবাদের বিরোধিতা করেন।
আবার অনেকের মতে জায়নবাদ এক ধরনেররাজনৈতিক প্রকল্প যা পশ্চিমা সরকার, অ-ইহুদি এবং মার্কিন খ্রিস্টান সম্প্রদায় দ্বারা সমর্থিত।
অ্যান্টি জায়োনিজম বা জায়নবাদ বিরোধী
সাধারণত যারা ইসরায়েল রাষ্ট্রের অস্তিত্বের বিরোধিতা করে তাদেরকে অ্যান্টি জায়োনিজম বা জায়নবাদ বিরোধী হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে।
অনেক ইহুদিবাদী আছেন যারা ইসরায়েলি সরকারের নীতির সমালোচনা করে বিশেষ করে পশ্চিম তীরের দখলদারিত্ব, বসতি নির্মাণ, সেইসাথে পশ্চিম তীরে এবং তার চারপাশে ইসরায়েল যে দেয়াল নির্মাণ করছে তার বিরোধিতা করে।
সেই সাথে এই দেয়াল নির্মাণের পেছনে ফিলিস্তিনি অনুপ্রবেশকারীদের আক্রমণ প্রতিরোধের দাবিরও সমালোচনা করে থাকে অনেক ইহুদিবাদী।
কিন্তু অ্যান্টি জায়োনিজম বা জায়নবাদ বিরোধীরা ইসরায়েলের এসব তৎপরতাকে, ফিলিস্তিনিদের আরও ভূমি হাতিয়ে নেওয়ার হাতিয়ার হিসেবে দেখে।
কিছু ক্ষেত্রে, যখন ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করা হয়, তখন সেই সমালোচনার ইহুদি-বিরোধী উদ্দেশ্য আছে কিনা তা নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে পড়ে।
এই ইস্যুটিকে ঘিরে অভিযোগ উঠেছে যে, অ্যান্টি জায়োনিস্ট বা জায়নবাদ বিরোধী হওয়া অর্থাৎ ইহুদি রাষ্ট্রের বিরোধিতা করা – আসলে ইহুদি বিরোধিতার একটি আধুনিক রূপ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদি গণহত্যা স্মরণে আন্তর্জাতিক জোট- ইন্টারন্যাশনাল হলোকাস্ট রিমেমব্রেন্স কোয়ালিশন বলছে যে ইসরায়েল সম্পর্কে কিছু দাবি এবং এর বিরুদ্ধে অভিযোগ ইহুদি বিরোধী বা অ্যান্টি সেমেটিক।
যারা এই দাবির বিরোধিতা করে তাদের মতে, এই যুক্তির মাধ্যমে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুক্তিসঙ্গত সমালোচনাকে দমন করা হয় এবং ইসরায়েলের সমর্থকরা এই যুক্তিকে তাদের বিরুদ্ধে বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। একে বর্ণবাদী আচরণ বলে মনে করে তারা।
অন্যদের মতে, ইসরায়েলি সরকার এবং তার সমর্থকরা সমালোচনা এড়াতে ইচ্ছাকৃতভাবে অ্যান্টি সেমিটিজম বা ইহুদি-বিদ্বেষের পরিবর্তে অ্যান্টি জায়োনিজম বা জায়নবাদ-বিরোধী শব্দটি ব্যবহার করে, যাদের তাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে কেউ কথা বলতে না পারে।