আরো জিম্মি ও ফিলিস্তিনির মুক্তি, যুদ্ধবিরতি বাড়ার ঘোষণা
ডেস্ক রিপোর্টঃ গাজায় টানা চারদিনের অস্থায়ী যুদ্ধবিরতির শেষ দিনে, হামাস এবং ইসরায়েলের মধ্যে সমঝোতা অনুযায়ী ইসরায়েলি জিম্মিদের আরো একটি দলকে ছেড়ে দেয়ার বিনিময়ে একদল ফিলিস্তিনি বন্দীকে মুক্ত করা হয়েছে।
স্থানীয় সময় সোমবার মধ্যরাতে ইসরায়েলি কারাগার থেকে ৩৩ জন ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দেওয়া হয়। এর আগে হামাস ১১ ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি দেয়। যারা ছিলেন ফ্রান্স, জার্মানি বা আর্জেন্টিনার দ্বৈত নাগরিকত্ব পাওয়া ব্যক্তি।
চারদিনের যুদ্ধবিরতির মেয়াদ শেষ হওয়ার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে সোমবার কাতারের মধ্যস্থতাকারীরা মঙ্গলবার এবং বুধবার দুই দিন যুদ্ধবিরতি বাড়ানোর ঘোষণা দেয়।
কাতার বলেছে, ইসরায়েল ও হামাস যুদ্ধবিরতির মেয়াদ দুই দিন বাড়ানোর বিষয়ে সম্মত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউস যুদ্ধবিরতি বাড়ানোর বিষয়টি নিশ্চিত করেছে তবে ইসরায়েলের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে এখনও নিশ্চিত করা হয়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা মুখপাত্র জন কারবি বলেছেন, আগামী দুই দিনের মধ্যে হামাস আরও ২০ জন নারী ও শিশুকে মুক্তি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
এর আগে সোমবার সন্ধ্যায় এক প্রেস ব্রিফিংয়ে ইসরায়েলের সামরিক মুখপাত্র ড্যানিয়েল হাগারি বলেছেন: “বাস্তবে না হওয়া পর্যন্ত কোনো কিছুই চূড়ান্ত নয়। আজ রাতেও পরিস্থিতি এগিয়েছে, তবে এজন্য ধৈর্যের প্রয়োজন।”
তিনি আরও বলেন: “এই মুহূর্তে আমাদের মূল লক্ষ্য যে পরিবারগুলো প্রিয়জনের অপেক্ষায় প্রচণ্ড চাপের মধ্যে আছেন, অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছেন তাদের কথা ভেবে অপহৃতদের বাড়িতে ফিরিয়ে আনা। এটা চলতি কাঠামোর ধারাবাহিকতার মাধ্যমে বা যুদ্ধের পরবর্তী পর্যায়ের ধারাবাহিকতার মাধ্যমে হতে পারে।”
এক কথায়, যুদ্ধবিরতি বাড়তে পারে আবার যুদ্ধ পুনরায় চালু হতে পারে এই দুটি সম্ভাবনার কথাই বলেছেন তিনি।
এদিকে যুদ্ধবিরতির মধ্যে মানবিক ত্রাণ সহায়তার ভর্তি আরও কিছু ট্রাক সোমবার গাজা উপত্যকায় প্রবেশ করেছে। সহায়তা সংস্থাগুলি মূলত যুদ্ধপীড়িতদের মধ্যে খাবার, জ্বালানি এবং ওষুধ বিতরণ করছে।
গাজাবাসীর জন্য জরুরি ত্রাণ বিতরণ আগের চেয়ে বাড়ানো হয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। কিন্তু তারা এটাও সতর্ক করে বলেছে, যে পরিমাণ ত্রাণ সহায়তা আসছে তা চাহিদার তুলনায় নগণ্য। সমুদ্রে এক ফোটা পানির মতো।
এরপরও গাজাবাসী জরুরি ত্রাণ সহায়তা পেতে এবং নিরাপদে গাজায় চলাফেরা করতে, যুদ্ধে বিরতির এই সময়টি ব্যবহার করছে – অনেকেই তাদের বাড়িতে ফিরে যাচ্ছেন।
আবার যাদের বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে গিয়েছে তারা কী পরিমাণে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সেটা খতিয়ে দেখতে যাচ্ছেন।
অনেকে শীতের কাপড়ের সন্ধান করছেন। কেননা গাজায় বৃষ্টিপাত এবং ঝড়ো বাতাস দেখা দিতে শুরু করেছে।
যুদ্ধবিরতি বাড়ার সম্ভাবনা কতোটা?
অনেকেই ভাবছেন যে গাজায় যুদ্ধবিরতির মেয়াদ দুই দিন বাড়ানো হলে সামনে আরও দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধবিরতির পথ প্রশস্ত করতে পারে।
এটা নির্ভর করছে হামাস কী দিতে পারে তার উপর। যুদ্ধবিরতি অব্যাহত রাখতে তাদের প্রতিদিন ১০ জন করে জিম্মিকে মুক্তি দিতে হবে।
জিম্মিরাও গাজা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তারা শুধু হামাসের হাতেই নয়, অন্যান্য অনেক দল ও গোষ্ঠীর হাতেও জিম্মি অবস্থায় আছে।
তাদের কাছে পৌঁছানো সবসময় সহজ নয়। সব মিলিয়ে বর্তমান পরিস্থিতি বেশ জটিল রূপ নিয়েছে।
যদি এই সুষ্ঠুভাবে দুই দিন যুদ্ধবিরতি বাড়ে এবং হামাস যদি আরও জিম্মিদের মুক্তি দেয় – তাহলে এই যুদ্ধ বিরতি বাড়ানোর কথা বিবেচনা করা হতে পারে।
এ ব্যাপারে উভয় পক্ষ থেকে নেতিবাচক কিছু শোনেননি বিবিসির সংবাদদাতা লুসি উইলিয়ামসন।
তবে ইসরায়েল বলেছে যে, তারা যুদ্ধবিরতি বাড়ানোর প্রস্তুতি নিতে কতোটা এগোবে তার একটি সীমা আছে। এবং এটাও খুব স্পষ্ট যে একবার সেই প্রক্রিয়া শেষ হয়ে গেলে ইসরায়েল পুনরায় পূর্ণ শক্তিতে যুদ্ধে ফিরে যাবে।
তারা এটাও বলেছে যে, ইসরায়েলের মূল লক্ষ্য, হামাসকে নির্মূল করা।
কাতারের আশা যুদ্ধবিরতি দীর্ঘায়িত হবে
কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাজেদ আল আনসারি মানবিক যুদ্ধবিরতি আরও দুই দিন বাড়ানোর চুক্তির বিষয়ে বিবিসি নিউজের সাথে কথা বলেছেন।
ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে জিম্মিদের মুক্তির আলোচনায় মধ্যস্থতা করছে কাতার।
তিনি নিশ্চিত করেছেন যে, হামাস বর্ধিত অস্থায়ী যুদ্ধবিরতির অংশ হিসাবে আরও ২০ জিম্মিকে মুক্তি দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে।
চুক্তিটি ওই দুই দিনের পরে আরও বাড়ানো যেতে পারে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন: “আমরা বেশ আশাবাদী”।
তার মতে, চার দিনের বিরতির জন্য চুক্তিতে পৌঁছানো সহজ কাজ ছিল না।
“আমরা এই মানবিক যুদ্ধ বিরতি চুক্তির জন্য আলোচনা করতে গিয়ে অনেক কঠিন সময় পার করেছি।”
“এখন যেহেতু দুই দিনের যুদ্ধবিরতি রয়েছে আমরা আশাবাদী যে উভয় পক্ষের জন্য আমরা আরও টেকসই যুদ্ধ বিরতির বিষয়ে কাজ করতে পারবো।”
আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে
চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই এই সপ্তাহের শেষের দিকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে একটি বৈঠক আয়োজন করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে যাবেন।
কারণ ইসরায়েল-গাজা সংঘাতের মধ্যস্থতার জন্য আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা এখনও অব্যাহত রয়েছে।
বৈঠকের আগে, জর্ডান অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি স্থায়ী করার জন্য পুনরায় আহ্বান জানিয়েছে।
অন্যদিকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন গাজায় বেসামরিক নাগরিকদের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে ইসরায়েলের যে “দৃঢ় পদক্ষেপ” নেয়া উচিত, সেই গুরুত্বের বিষয়টি পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতিত্ব প্রতি মাসে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন দেশের ওপর বর্তায়। এবারে চীন সেই দায়িত্ব পেয়েছে।
ইসরায়েল এবং পশ্চিম তীর সফর করবেন ব্লিঙ্কেন
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন চলতি সপ্তাহের শেষের দিকে আবারও মধ্যপ্রাচ্য সফর করবেন। তিনি ইসরায়েল এবং পশ্চিম তীর পরিদর্শন করবেন বলে জানা গিয়েছে।
সেইসাথে তিনি গাজায় ত্রাণ সহায়তা অব্যাহত রাখার বিষয়েও আলোচনা করবেন।
হামাসের হাতে জিম্মি সবার মুক্তি নিশ্চিত করবেন এবং গাজার বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা উন্নত করার বিষয়ে কাজ করবেন।
ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ শুরুর পর এই অঞ্চলে এটি হবে তার তৃতীয় সফর।
যুক্তরাষ্ট্রে ফিলিস্তিনি ছাত্রদের গুলি করার তথ্য জানাতে পুরস্কার ঘোষণা
যুক্তরাষ্ট্রের ভারমন্টে শনিবার তিন ফিলিস্তিনি ছাত্রকে লক্ষ্য করে গুলি করার ঘটনায় মুসলিম নাগরিক অধিকার এবং অ্যাডভোকেসি গ্রুপ অপরাধীর বিষয়ে যেকোনো তথ্য জানানোর বিপরীতে ১০ হাজার ডলার পুরস্কার ঘোষণা করেছে।
গুলিবিদ্ধ ওই তিন ফিলিস্তিনি তরুণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন।
বার্লিংটন পুলিশ জানিয়েছে, ঘটনার দিন হিশাম আওয়ারতানি, তাহসিন আহমেদ এবং কিন্নান আবদালহামিদ এক পারিবারিক নৈশভোজের উদ্দেশে হেঁটে যাচ্ছিলেন।
এ সময় ইউনিভার্সিটি অফ ভারমন্ট ক্যাম্পাসের কাছে তাদেরকে লক্ষ্য করে এক ব্যক্তি গুলি ছুড়ে পালিয়ে যায়।
কাউন্সিল অন আমেরিকান-ইসলামিক রিলেশনসের (সিএআইআর) দাবি, সাম্প্রতিক সময়ে “মুসলিম-বিদ্বেষ এবং ফিলিস্তিন-বিরোধী ঘৃণা ও সহিংসতা বেড়ে গিয়েছে।”
এমন “পক্ষপাতমূলক উদ্দেশ্য” নিয়েই তাদের ওপর গুলি চালানো হয়েছে বলে তারা ধারণা করছেন।
এমন সব সম্ভাব্য কারণ তদন্ত করার জন্য কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানিয়েছে সংস্থাটি।
এর আগে ভিকটিমদের পরিবারও গুলি চালানোর ঘটনাকে ‘ ঘৃণা-বিদ্বেষমূলক হামলা’ আখ্যা দিয়ে পুলিশকে তদন্ত করার আহ্বান জানায়।
তবে পুলিশ এখন পর্যন্ত এই হামলার পেছনে সম্ভাব্য কোনো কারণ জানাতে পারেনি।
তবে তারা বলেছে, হামলার সময় ওই তিন ছাত্র, কেফিয়েহ পরা অবস্থায় ছিলেন -যা সাদাকালো ডিজাইনের আরবদের ঐতিহ্যবাহী স্কার্ফ।
আক্রমণের সময় হামলাকারী আরবি ভাষায় কথা বলছিলেন বলেও জানায় পুলিশ।
সন্দেহভাজন ওই ব্যক্তিকে এখনও ধরতে পারেনি পুলিশ। তার খোঁজ চলছে।
গুলিবিদ্ধ তিনজনের মধ্যে, দুইজনের শারীরিক অবস্থা অবস্থা স্থিতিশীল হলেও তৃতীয় জন গুরুতর আহত হয়েছেন।
ঠাণ্ডা ও আর্দ্র আবহাওয়ায় গাজার পরিস্থিতি আরও বিরূপ
গাজায় সাম্প্রতিক দিনগুলিতে ভারী বৃষ্টিপাত দেখা দিয়েছে এবং এর প্রভাবে তাপমাত্রাও অনেকখানি নেমে গিয়েছে।
বিবিসির সংবাদদাতা, আদনান এল-বুর্শ বলেছেন, পরিস্থিতি খুবই খারাপ – বিশেষ করে তাঁবুতে বসবাসকারী বাস্তুচ্যুত পরিবারগুলো এখনও পর্যাপ্ত গরম কাপড় পায়নি। তাদের মানবেতর দিন কাটাতে হচ্ছে।
“আমি তাদের অনেককে ধ্বংসস্তূপের নিচে পুরানো কাপড় এবং কম্বল খুঁজতে দেখেছি, তাদের ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়িতে ফিরে যেতে দেখেছি”।
গত ৭ই অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলায় ১২০০ জন নিহত হয়েছিলেন। সেইসময় তারা প্রায় ২৪০ জনকে জিম্মি করেছিল।
এরপর থেকে, গাজায় টানা ছয় সপ্তাহ ধরে হামলা চালিয়ে আসছে ইসরায়েলি বাহিনী। গাজার হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, ইসরায়েলের ওই পাল্টা অভিযানে নিহতের সংখ্যা সাড়ে চৌদ্দ হাজারে ছাড়িয়েছে।