যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শ্রম নীতি বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতির জন্য কতটা শঙ্কার?
ডেস্ক রিপোর্টঃ সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের মিশন থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো একটি চিঠি আলোচনায় উঠে এসেছে । শ্রম ইস্যুতে সম্ভাব্য মার্কিন নিষেধাজ্ঞা নিয়ে সরকারকে সতর্ক করা সেই চিঠিতে বাংলাদেশ এই শ্রমনীতির অন্যতম লক্ষ্য হতে পারে বলে বলা হয়েছে।
শ্রমিক অধিকার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নীতি কতটা উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের জন্য?
নভেম্বর মাসে বেতন বৃদ্ধির দাবিতে বাংলাদেশে যখন সপ্তাহখানেক ধরে শ্রমিক আন্দোলন চলছিলো সেরকম সময়েই যুক্তরাষ্ট্র তাদের নতুন শ্রমিক অধিকার নীতি ঘোষণা করে।
বিশ্বজুড়ে যারা শ্রমিক অধিকার হরণ করবে, শ্রমিকদের ভয়ভীতি দেখাবে এবং আক্রমণ করবে তাদের উপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞাসহ নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়।
বিশ্লেষকদের অনেকে আশঙ্কা করছেন, এমন ঘোষণায় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির বিবেচনায় বাংলাদেশের জন্য বাড়তি উদ্বেগের জায়গা রয়েছে।
সেটা আরো পরিষ্কার হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের মিশন থেকে দূতাবাসের মিনিস্টার মো. সেলিম রেজার সই করা একটা চিঠির মধ্য দিয়ে।
বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলিতে ব্যাপকভাবে আলোচিত ওই চিঠিটির একটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল রাজনৈতিক প্রসঙ্গ। সেখানে বলা হয়েছে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের বিবেচনায় মার্কিন এই নীতিতে বাংলাদেশের জন্য শঙ্কিত হওয়ার কারণ রয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্র একে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের চেষ্টা করতে পারে।
কী বলা হচ্ছে শ্রমিক অধিকার নীতিতে?
১৬ই নভেম্বর একটি স্মারকে সই করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। হোয়াইট হাউজ বিষয়টিকে ঐতিহাসিক পদক্ষেপ হিসেবে উল্লেখ করে।
সেই নীতি সব দেশের জন্য প্রযোজ্য হলেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন যখন এর বিস্তারিত তুলে ধরেন সেখানে উঠে এসেছিল বাংলাদেশ প্রসঙ্গ।
তিনি বলেছিলেন, “যারা হুমকি দেয়, ভয় দেখায়, যারা ইউনিয়ন নেতা, শ্রমিক অধিকার রক্ষাকারী বা শ্রমিক সংগঠনকে আক্রমণ করে তাদেরকে আমরা জবাবদিহি করবো। নিষেধাজ্ঞা, বাণিজ্যে শাস্তি, ভিসা নিষেধাজ্ঞার মতো যতো বিষয় রয়েছে তার সবই ব্যবহার করা হবে। আমরা কল্পনা আক্তারের মতো মানুষদের সাথে থাকতে চাই। কল্পনা আক্তার একজন বাংলাদেশি গার্মেন্টস কর্মী এবং গার্মেন্টস শ্রমিক অধিকার কর্মী। তিনি বলেছেন যে, তিনি জীবিত রয়েছেন কারণ মার্কিন দূতাবাস তার পক্ষে কাজ করেছে।”
হোয়াইট হাউজের বিবৃতিতে মূলত পাঁচটি কর্মপরিকল্পনার কথা উঠে আসে।
- আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শ্রম অধিকার রক্ষা, শ্রমিকদের ক্ষমতায়ন ও সংগঠনের অধিকার নিশ্চিত করতে কূটনীতি, অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ এবং বিদেশি সহায়তা ব্যবহার করা।
- ট্রেড ইউনিয়নের নেতা, শ্রম অধিকারের পক্ষে কাজ করা ব্যক্তি এবং শ্রমিক সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে হুমকি, ভয় দেখানো এবং সহিংসতার বিষয়ে দ্রুত ও কার্যকরভাবে এগিয়ে আসা এবং তা প্রতিরোধ করা।
- বৈশ্বিক শ্রম এজেন্ডা পরিচালনার জন্য ফেডারেল বিভাগ ও সংস্থাগুলোর সক্ষমতা আরো বাড়ানো।
- বৈশ্বিক শ্রম মান উন্নয়ন, শ্রম সংগঠন এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শ্রম অধিকারের পক্ষে কাজ করতে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে কাজ করা এবং তাদের সাথে জোট গঠন করা।
- আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শ্রম অধিকার উন্নয়নে বাণিজ্য সংক্রান্ত ও অন্যান্য উপায় বাড়ানো
রাজনৈতিক কারণে শঙ্কা?
মার্কিন এই নতুন শ্রমনীতি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে। কেউ কেউ মনে করেন, পোশাক খাতে আন্তর্জাতিক বেশিরভাগ আইনকানুন বাংলাদেশের কারখানাগুলোয় বাস্তবায়ন হওয়ায় ওই নীতি নিয়ে খুব বেশি উদ্বেগের কিছু নেই। আবার অনেক ব্যবসায়ীদের মতে, এখনো শ্রমখাতে অনেক অনিয়ম বা অসন্তোষ রয়েছে, যা চিন্তার কারণ হয়ে উঠতে পারে।
নির্বাচন, রাজনীতি এমন নানা প্রসঙ্গে ইতোমধ্যেই আমেরিকার সাথে বাংলাদেশ সরকারের অনেকটা টানাপড়েনের পরিস্থিতি চলছে। এর সাথে শ্রমিক অধিকারের বিষয় যুক্ত হয়ে ঝুঁকির জায়গা সৃষ্টি করছে বলে করছেন অনেকে। তাদের আশঙ্কা, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেও এই শ্রম নীতি ব্যবহার করা হতে পারে।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমের মতে শ্রম সংক্রান্ত এই বিষয়টির সাথে রাজনৈতিক পরিস্থিতির একটা সংশ্লেষ থাকায় “রাজনৈতিক বিষয়গুলোকেও সরকারের গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করার প্রয়োজন পড়বে।”
পোশাক মালিক ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর একজন পরিচালক ও সাবেক সভাপতি আরশাদ জামাল দীপুও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ আছে বলে মনে করছেন।
বিশেষত উদাহরণ হিসেবে সেক্রেটারি ব্লিংকেন যেহেতু বাংলাদেশের গার্মেন্টস শ্রমিক নেত্রী কল্পনা আখতারের নাম উল্লেখ করেছেন, ফলে একে যথেষ্ট উদ্বেগজনক হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন “আমরা এটাকে হালকাভাবে নিচ্ছি না।”
প্রেসিডেন্সিয়াল স্মারকে বাংলাদেশের এভাবে উদাহরণ টানার নজির নেই বলে “এখানে রাজনৈতিক সংমিশ্রণ আছে” বলে মনে করছেন মিঃ জামাল।
এই বিষয়টিকে বাংলাদেশ সরকারের গুরুত্ব সহকারে দেখার প্রয়োজন রয়েছে বলে বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করছেন।
যেমন মিঃ মোয়াজ্জেম বলছিলেন “রাজনৈতিক জায়গাগুলোকে, বিশেষ করে নির্বাচনকেন্দ্রিক যে সমস্ত অনিশ্চয়তা অস্থিরতা রয়েছে সেই জায়গাগুলোকে সরকার কীভাবে অ্যাড্রেস করবে তার উপরও কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে নির্ভর করতে পারে আমাদের ওপর শ্রম নীতির প্রয়োগ কোন পর্যায়ে হতে পারে।”
বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার মতো কোন পরিস্থিতির সৃষ্টি যাতে না হয় সেজন্য সরকারকেই পদক্ষেপ নিতে হবে বলে তারা দুজনেই মনে করেন।
রপ্তানি শিল্প
বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের বৃহত্তম বাজার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি পণ্যের ২০ শতাংশের গন্তব্য ছিল আমেরিকা।
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়েছে ২৮৬৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি যেটা ছিল মোট রপ্তানির ১৬.৪২ শতাংশ। যদিও গত অর্থবছরের একই সময়ে ৩০৭৩.৯ মিলিয়ন ডলারের তুলনায় এবার ছিল ৬.৭৯ শতাংশ কম।
শীর্ষ রপ্তানির বাজারের দেশ থেকে এমন নীতির ঘোষণায় বাংলাদেশের উপরে এর প্রভাব পড়ার শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। যেমন বিজিএমইএর একজন পরিচালক ও সাবেক সভাপতি আরশাদ জামাল দীপু বলছিলেন “নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে, এটা যথেষ্ট উদ্বেগের, কারণ যুক্তরাষ্ট্র আমাদের এক নম্বর বাজার।”
গার্মেন্টস শিল্পে আগের তুলনায় যথেষ্ট উন্নতি হলেও নানাবিধ চ্যালেঞ্জ যে রয়েছে বলে মনে করেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমও।
শ্রম অধিকার, শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করা, শ্রমিকদের দাবি দাওয়া নিয়ে রাস্তায় যাওয়ার কারণে বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হওয়া, গার্মেন্টস শিল্পকে ঘিরে এমন নানা চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন “এর বাইরে অন্যান্য খাতে তো শ্রম অধিকার আরো চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে, দুর্বলতা রয়েছে।”
সেক্ষেত্রে মজুরি, কারখানার কর্মপরিবেশ, শ্রম-নিরাপত্তা, শ্রমিকদের সংগঠন করার অধিকার এমন সব দুর্বলতার কথা তুলে ধরে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন “সামগ্রিকভাবে আমাদের রপ্তানিমুখী খাতগুলো যদি বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়ে তাহলে এই মুহূর্তে অর্থনীতির যে পরিস্থিতি তাতে এটি বহন করবার মতো শক্তি আমাদের কম।”
মার্কিন এই নীতির কারণে উদ্বেগ রয়েছে গার্মেন্টস ছাড়াও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য খাতের ব্যবসায়ীদের মধ্যেও।
যেমন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমইএ) ভাইস প্রেসিডেন্ট মোঃ ফজলুল হক বলছিলেন “আমরা শঙ্কিত যে কোনোভাবে যদি আমাদের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয় তাহলে আমাদের এ ব্যবসাটা চালানো কঠিন থেকে কঠিনতম পর্যায়ে চলে যাবে।”
রপ্তানির প্রেক্ষাপটে আমেরিকাকে ‘অন্নদাতা’ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন “আমরা যদি তাদের কথা না শুনি, মতের বাইরে চলে যাই, তাহলে তারা এরকম বিধিনিষেধ আরোপ করতেই পারে।”
যদিও এমন আশঙ্কার তেমন কারণ দেখছে না বিজিএমইএর সহ-সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম। বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও ও শ্রম আইনের সব নিয়ম নীতি পালন করা হয় দাবি করে তিনি মনে করেন, নিষেধাজ্ঞা দেয়ার মতো কোনো কারণ নেই।
একই রকম মত দেন চট্টগ্রামের একজন গার্মেন্টস মালিক ও বিজিএমইএর সাবেক সহ-সভাপতি এস এম আবু তৈয়ব। আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের চাহিদা ও নিয়মকানুন মেনেই ফ্যাক্টরি চালানো হয় দাবি করে তিনিও নিষেধাজ্ঞার কোন শঙ্কা আছে বলে মনে করেন না।
সম্প্রতি পোশাক শ্রমিকদের বেতন বাড়ানো হলেও সেখানে শ্রমিকরা যতটা চান তার প্রতিফলন দেখা যায়নি। এক্ষেত্রে শ্রমিকদের মধ্যে জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ে অভিযোগ রয়েছে, আর মালিকদের চেষ্টা কম খরচে রপ্তানির প্রতিযোগিতামূলক বাজার ধরে রাখা।
এমন অবস্থায় যদি আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার মতো তেমন কোনো পদক্ষেপ চলে আসে, তার ফলে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তখন বাংলাদেশের শ্রমিক শ্রেণি সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করেন মিঃ আজিম।
“আমার মনে হয় তারাও (আমেরিকা) অন্তত শ্রমিকদের দিকে তাকিয়ে স্যাংশন না দেয়ার চিন্তা-ভাবনা করবে” বলছিলেন তিনি।
রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা বা জিএসপি সুবিধা বাতিল করে দেয়া হয়েছিল। এরপরে শ্রম পরিবেশ উন্নয়নের যেসব শর্ত ছিল তার বেশির ভাগ পূরণ করা হলেও বাংলাদেশের জন্য খোলেনি জিএসপি সুবিধা।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মনে করেন, নির্বাচন ঘিরে বর্তমান পরিস্থিতিতে যখন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা খাত মার্কিন নীতির কষাঘাতে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা আছে, এমন অবস্থায় নতুন এই শ্রম নীতির বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখার দরকার আছে।
সরকারকে এনিয়ে দেশে ও দেশের বাইরে আলাপ আলোচনা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার জন্যও তিনি পরামর্শ দিচ্ছেন।
বিশেষত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও রিজার্ভ সংকটের মধ্যে পুরো বিষয়টি হালকা করে দেখার সুযোগ নেই বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।