নির্বাচন ইস্যুতে ভারতের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বিএনপিতে, কী বলছেন নেতারা
ডেস্ক রিপোর্টঃ বাংলাদেশের বিরোধী দল বিএনপির নেতারা মনে করছেন ‘ভারতের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থনের কারণেই’ পশ্চিমা বিশ্বের চাপ উপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত আরেকটি ‘বিরোধী দলহীন নির্বাচনের’ দিকে এগিয়ে যেতে পারছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার।
দলটির দাবি ভারত বাংলাদেশের জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে এবং পশ্চিমা বিশ্বের চাপ ও বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলোর দাবিকে উপেক্ষা করে দেশটি যে অবস্থান নিয়েছে সেটি তাদের মতে ‘আরেকটি ভুল’।
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড: আব্দুল মঈন খান বলছেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পুনরুজ্জীবন স্পষ্টতই বাধাগ্রস্ত করছে ‘বন্ধু রাষ্ট্র ভারতের সরকার’।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেছেন, “তারা কি আজ পুনরায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ের অজুহাতে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে বাধা সৃষ্টি করে ২০১৪ সালের মতো আরেকটি ভুল করতে যাচ্ছে না?”
দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলছেন, ভারতের একতরফা সমর্থনের কারণে আরেকটি ভোটারবিহীন নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যেতে পারছে সরকার, যা তাদের কাছে অপ্রত্যাশিত ছিলো।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ অবশ্য বলেছেন, ভারতের বিষয়ে অনেক দিন নরম সুর দেখালেও বিএনপি হয়তো এখন মনে করছে যে তাদের প্রত্যাশিত ‘নিরপেক্ষ’ অবস্থান ভারত নেবে না।
“ভারত তার সুবিধা ও নিরাপত্তার বিষয়টি চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেয়। এখানে জনগণের ব্যাপার নেই। সে কারণেই হয়তো বিএনপির প্রত্যাশার সঙ্গে মিলছে না,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
প্রসঙ্গত, আগামী সাতই জানুয়ারি বাংলাদেশের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বিএনপিসহ কয়েকটি বিরোধী দলের অংশগ্রহণ ছাড়াই।
যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব অনেক দিন ধরে নানাভাবে নির্বাচন নিয়ে সরকারের ওপর চাপ তৈরি করলেও, বিএনপি মনে করছে ভারতের সমর্থনের কারণেই শেষ পর্যন্ত তাদের ছাড়াই নির্বাচনটি সম্পন্ন হবার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশের নির্বাচন এবং ভারত
বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে গত প্রায় দুই বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন সহ পশ্চিমারা বাংলাদেশ সরকারের ওপর নানা ভাবে চাপ প্রয়োগ করে আসছে।
এমনকি বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসা নীতিরও প্রয়োগ ইতোমধ্যে শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র, যে নীতি আপাতদৃষ্টিতে সরকারকে বেশ চাপে ফেলেছিলো।
এরপর ইউরোপীয় কমিশন বাংলাদেশকে নিয়ে বেশ শক্ত ভাষায় একটি প্রস্তাবও গ্রহণ করেছিলো। একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিবেশ না থাকায় নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠানো থেকে বিরত থাকার কথাও তারা ঘোষণা করেছে।
আবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল এসে সবার সঙ্গে আলোচনা করে যে সুপারিশ করেছে, তার শুরুতেই ছিলো একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সংলাপ করা। কিন্তু সরকার তা গ্রহণ করেনি।
বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে পশ্চিমাদের এমন সব তৎপরতার মধ্যে পুরোপুরি চুপ ছিলো ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী দেশ ভারত। ফলে নির্বাচন নিয়ে শেষ পর্যন্ত ভারত কী অবস্থান নেয় তা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে ছিলো ব্যাপক কৌতূহল।
শেষ পর্যন্ত গত ১০ই নভেম্বর দিল্লিতে ভারত আর যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে পররাষ্ট্র এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রীদের ‘টু-প্লাস-টু’ বৈঠকের পর ভারতের বিদেশ সচিব ভিনয় কোয়াত্রা জানান যে ওই বৈঠকে তারা বাংলাদেশ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
তিনি বলেছেন যে, একটি স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ ও প্রগতিশীল রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশকে সেদেশের মানুষ যেভাবে দেখতে চায়, সেই ‘ভিশন’কে ভারত কঠোরভাবে সমর্থন করে।
“বাংলাদেশের নির্বাচন সেদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং সেদেশের মানুষই তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন,” বলেছেন তিনি।
বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন ভারত যা করছে সেটা তারা করছে সম্পূর্ণ তাদের নিজেদের স্বার্থে।
“ভারত যদি মনে করে তাদের নিরাপত্তা জন্য শেখ হাসিনাকে দরকার তাহলে তাকেই তারা সমর্থন দিবে। এটি স্বাভাবিক। বাংলাদেশের জনগণের জন্য মাথাব্যথা ভারতের শাসকের আছে, সেটা আশা করবো কেন?” বলছিলেন তিনি।
মূলত ভারতের দিক থেকে এই আনুষ্ঠানিক বক্তব্য আসার পরেও বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর আশা ছিলো যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব আরও কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের বিষয়ে আওয়ামী লীগ সরকারকে চাপ দেয়ার বিষয়ে সফল হবে।
কিন্তু এখন দলের নেতারা মনে করছেন, তেমনটি হয়নি বলেই শেখ হাসিনার সরকার পশ্চিমাদের চাপ সত্ত্বেও ‘নিজেদের মতো করে আরেকটি নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যেতে পারছে’।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলছেন, ভারত যা করছে সেটি গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে তাদের কাছ থেকে বাংলাদেশের মানুষ আশা করেনি।
“আরও একটি ভোটারবিহীন নির্বাচনের জন্য সরকারকে তারা যে একতরফা সমর্থন দিচ্ছে সেটি তো দৃশ্যমান। ২০১৪ সালে তাদের পররাষ্ট্র সচিব এসেছিলো ঢাকায়। এবার তা না হলেও স্থানীয়ভাবে এমন অনেক কিছু আমাদের চোখে পড়েছে, যাতে মনে হচ্ছে তারা এই অনির্বাচিত সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে,” বিবিসি বাংলাকে বলেছেন তিনি।
ভারত এবং বিএনপি
বাংলাদেশে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ভারত সরকারের সাথে আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পায় এবং গত প্রায় দেড় দশক ধরে ভারত সরকার নানা ইস্যুতে শেখ হাসিনা সরকারকে সহায়তা করে আসছে।
তবে ভারত সরকারের সাথে বিএনপির দূরত্ব তৈরির জন্য ২০১৩ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশে সফররত তখনকার ভারতীয় রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে খালেদা জিয়ার সাক্ষাত বাতিলের ঘটনাকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন।
এরপর ২০১৪ সালের বিরোধী দলহীন নির্বাচনের ক্ষেত্রে ভারতের তৎপরতা ছিলো দৃশ্যমান। সেবার তখনকার ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব নিজেই ঢাকায় এসে রাজনৈতিক নেতাদের সাথে বৈঠক করেছিলেন।
বিএনপি থেকে বিভিন্ন সময়ে এ নিয়ে তখন ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে। দলটির প্রয়াত মহাসচিব খন্দকার দেলোয়ার হোসেন প্রকাশ্যেই এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন।
এরপর থেকে ভারত এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে সম্পর্ক আরও জোরালো হয়েছে বলে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলে আসছেন এবং এর ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময়েও আওয়ামী লীগ সরকারকেই সমর্থন করে গেছে ভারত।
কিন্তু এবার নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গত প্রায় দু’বছর ধরে সবাই কথা বললেও ভারতও যেমন চুপ ছিলো, তেমনি বিএনপিও এই সময়ে ভারতের অবস্থানকে কেন্দ্র করে কোন মন্তব্য করেনি।
তবে এ বছরই বিএনপি নেতাদের একটি দল ভারতের গিয়ে সেখানকার কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠকও করেছিলেন।
চীন রাশিয়া নিয়ে সরব বিএনপি ভারত নিয়ে চুপ ছিলো
আওয়ামী লীগ সরকারকে সমর্থন দেয়ায় কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতার সমালোচনা করায় চীন এবং রাশিয়ার সমালোচনা করে বিএনপি সরাসরি বিবৃতি দিলেও ভারত নিয়ে কোন প্রকাশ্যে কিছু বলা থেকে বিরতই ছিলে দলটির নেতারা।
শেষ পর্যন্ত, গত ২৬শে নভেম্বর প্রথম বারের মতো ভারত নিয়ে মুখ খোলেন রুহুল কবির রিজভী।
ঢাকার বনানীতে অবরোধের সমর্থনে এক সমাবেশে তিনি বলেন “ভারতের উচিত বাংলাদেশের জনগণ যা চায়, সেটিকে সমর্থন দেওয়া।”
“ভারত সরকার ও তাদের দেশের রাজনীতিবিদদের বোঝা উচিত, বাংলাদেশের জনগণ কেন তাদের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছে। একটি কর্তৃত্ববাদী সরকারকে সমর্থন দিয়ে তারা বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে,” সমাবেশে বলেন তিনি।
এরপর শুক্রবার পহেলা ডিসেম্বর দলের পক্ষে ভার্চুয়াল ব্রিফিংয়ে ভারত প্রসঙ্গে আবারো কথা বলেন বিএনপির এই নেতা। তিনি বলেন শেখ হাসিনার পক্ষে বক্তব্য-বিবৃতি দিচ্ছে রাশিয়া, চীন এবং ভারত। রাশিয়া-চীনে তো গণতন্ত্র নেই।
“আমাদের কাছের প্রতিবেশী ভারত, যে রাষ্ট্রটি গণতান্ত্রিক। যেখানে গণতন্ত্রের ঐতিহ্য আছে। সেই ভারত সরকার সরাসরি কীভাবে একটি অগণতান্ত্রিক ‘মনস্টার স্বৈরাচারে’র পক্ষে অবস্থান নেয়? তারা মুখে বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে আছে বললেও তারা ১৮ কোটি জনগণের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। যা অতীব দুঃখজনক,” সংবাদ সম্মেলনে বলেন তিনি।
কিন্তু এটি কি তার নিজের বক্তব্য নাকি দলের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য – এমন প্রশ্নের জবাবে মি. রিজভী বলেন, “এটিই এখন বাংলাদেশে বিএনপিসহ সবার বক্তব্য।”
“বিশ্বের গণতন্ত্রকামী দেশগুলো বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতি সম্মান জানিয়েছে। আমরা মনে করি ভারত সেটি করতে পারেনি,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
কিন্তু ভারত তো বলেছে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে সেদেশের জনগণই সিদ্ধান্ত নেবে। এরপরেও বিএনপি কেন ভারতকে দায়ী করছে – এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “পলিসি লেভেল থেকে যাই বলা হোক, স্থানীয়ভাবে তাদের কর্মকাণ্ড আমরা দেখছি এবং জনগণ মনে করে ভারতের কারণেই সরকার ভোটারবিহীন নির্বাচনের দিকে এগুচ্ছে”।
ভারত নিয়ে বিএনপির অবস্থান তাহলে কী?
বিএনপি নেতারা মনে করেন, ভারত সরকার যে অবস্থান নিয়েছে বলে তারা দাবি করছেন, তাতে দুই দেশের জনগণের প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটেনি।
দলটির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ডঃ আব্দুল মঈন খান বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “আমাকে যে বিষয়টি উদ্বিগ্ন করে তা হলো এই যে, মুক্তিযুদ্ধে সর্বাত্মক সহায়তার জন্য ভারতের প্রতি যে বাংলাদেশের জনগণের চিরদিন কৃতজ্ঞ থাকার কথা সেই ভারত কি করে বাংলাদেশের জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো! এটা কি গত কয়েক দশকে ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা সাউথ ব্লকের বিশাল ব্যর্থতা নয়”?
তিনি বলেন, “তারা কি আজ পুনরায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ের অজুহাতে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে বাধা সৃষ্টি করে ২০১৪ সালের মতো আরেকটি ভুল করতে যাচ্ছে না?”
“বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলোর পাশাপাশি পশ্চিমা গণতান্ত্রিক বিশ্বেরও চাওয়া হচ্ছে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের পুনরুজ্জীবন এবং আমাদের বন্ধু রাষ্ট্রের সরকার স্পষ্টতই তা বাধাগ্রস্ত করছে,” বলেন তিনি।
তার মতে দুই দেশের সম্পর্ক স্থায়ী ও অর্থবহ করতে পারে দুই দেশের জনগণের মধ্যকার সম্পর্ক, রাজনৈতিক দলের সাথে দলের বা সরকারের সাথে সরকারের সম্পর্ক নয়।
যদিও বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন, ভারত বরাবরই তাদের জাতীয় নিরাপত্তার ইস্যুতে শেখ হাসিনা সরকারকে বেশি গ্রহণযোগ্য মনে করে এবং সে কারণেই তারা বোঝাতে চাইছে যে শেখ হাসিনার সরকারই তাদের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য।
“এখানে বিষয়টি হলো জাতীয় স্বার্থ ও নিরাপত্তা। বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময় কী করেছিলো সেটি ভারত হয়তো ভোলেনি। এখনও নিরাপত্তা ইস্যু তাদের জন্য বেশী গুরুত্বপূর্ণ। সে কারণে তারা তাদের স্বার্থই দেখছে। এখানে অন্য কিছু প্রত্যাশা করার সুযোগ কোথায়,” বলছিলেন মি.আহমেদ।