কিস্তি-২: আগামীর নেতৃত্ব শূন্য করার জন্য, না দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরী করতে বর্তমান শিক্ষা ব্যাবস্থা?
বাংলাদেশের অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হলেও দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাত তথা শিক্ষা ক্ষেত্রের উন্নয়ন ও উন্নতির পরিবর্তে অবনতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। স্বাধীনতার ৫২ বছরে ইতিমধ্যে ৬টি শিক্ষা কমিশন, অনেকগুলো জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হলেও আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে টেকসই কোন শিক্ষা পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন সম্ভব হয়ে উঠেনি। আমরা অত্যন্ত উদ্বেগ ও হতাশার সাথে লক্ষ্য করেছি রাজনৈতিক বিশ্বাস বিবেচনায় ও দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সিলেবাসের ঘন ঘন পরিবর্তন অব্যাহত। একেক সময়ে একেক সরকার ক্ষমতায় এসে নিজেদের মত শিক্ষা কার্যক্রম ও পাঠ্য পুস্তকে ব্যাপক পরিবর্তন ও রদবদল করে নিজেদের মতো করে দেশের ইতিহাস রচনা করে, দু-একটি পরিবারের গুণকীর্তনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের নিকট সঠিক ইতিহাস ও ঐতিহ্য তুলে ধরার পরিবর্তে ভুল ইতিহাসের বার্তা তুলে ধরা হচ্ছে।এতে শিক্ষার্থীদের যেমন কনফিউসড করা হচ্ছে, তেমনি শিক্ষার্থীরা দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে পরে যাচ্ছে, ফলাফল শিক্ষার্থীরা নিজের ইতিহাস সম্পর্কে বেমালুম বেখবর হয়ে পড়ছে, নিজের গর্ব করার ইতিহাসের প্রতি অনাগ্রহ দেখাচ্ছে, বা নিজের ইতিহাস, ঐতিহ্য, ও সংস্কৃতি জানা ও মানার প্রতি আগ্রহ ক্রমান্বয়ে হারিয়ে ফেলছে। এর দায় কে নেবে। যেই দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতি যত বেশী উন্নত, সেই দেশ বাস্তবে ততো বেশী উন্নত।
শিক্ষানীতি, পদ্ধতি, কৌশল ও ব্যাবস্থাপনার মধ্যে রয়েছে ব্যাপক গরমিল ও সমস্যা। যোগ্য ও অভিজ্ঞ শিক্ষকের অভাব, রাজনীতি, পরিবারনীতি, স্বজনপ্রীতি, আঞ্চলিক প্রভাব, ঘুষ ও ডোনেশনের মাধ্যমে অযোগ্য লোকদের যেমন শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। শিক্ষক রাজনীতি, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, প্রশ্নপত্র ফাঁস, নকল প্রবণতা, শিক্ষকদের নৈতিক পদস্খলন, শিক্ষকদের চৌর্যবৃতির আশ্রয়, মেধাবীরা শিক্ষকতা থেকে সরে যাওয়া, অভদ্র শিক্ষকদের প্রাধান্য, রাজনৈতিক বিবেচণায় ভিন্নমতের শিক্ষকদের কোণঠাসা করে রাখা, অযোগ্যদের দ্বারা আবার বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি তৈরী করা হয় ইত্যাদি শিক্ষার ক্ষেত্রে অন্যতম মৌলিক সমস্যা।প্রায় প্রতি বিদ্যালয়ে এখন দলীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে ম্যানেজিং কমিটি গঠন করা হয় যেখানে বিদ্যালয়ের পাঠোন্নতির চেয়ে দলীয় কর্মসূচি ও দলীয় বিভিন্ন দিবস পালনে তাদেরকে বেশি তৎপর দেখা যায়। অব্যবস্থাপনা ও রাজনীতির দুষ্টচক্র শিক্ষার মানকে তলানিতে নিয়ে ঠেকিয়েছে। আপনারা নিশ্চয়ই দেখেছেন জিপিএ ৫ পেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় প্রায় ৯০% ছাত্রছাত্রী ইংরেজিতে হরহামেশা ফেল করছে। টাইমস হায়ার এডুকেশনের ২০২৪ সালের বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিংয়ে প্রথম ৮০০টির তালিকায় নেই বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়। এ র্যাংকিং তালিকায় সেরা ৮০০ এর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের ২৪টি ও পাকিস্তানের ৮টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। তো বুঝতেই পারছেন বাংলাদেশের শিক্ষার করুণদশা।
সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতির নামে এমন এক পদ্ধতি চালু করা হয়েছে যেখানে কোনো ফেল নেই, অর্থাৎ শির্ক্ষার্থীরা যাই লিখবে তাতেই নম্বর, কোনো ভুল উত্তর নেই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, এক শিক্ষক আক্ষেপের সাথে বললেন যে আমাদেরকে একটি নির্দিষ্ট নম্বরের উপর নম্বর দিতেই হবে শিক্ষার্থী যাই লিখুক না কেন। গ্রেডিং পদ্ধতির নামে এক অসুস্থ্য শিক্ষা পদ্ধতি চালু হয়েছে যেখানে দক্ষ ও মননশীলতার পরিবর্তে অদক্ষ গ্রেডধারী ছাত্র উপহার দিচ্ছে, দক্ষ মানব সম্পদের পরিবর্তে অদক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরী করছে যারা না পারে ভালো ইংরেজি না পারে ভালো বাংলা। কিছু দিন পর পর একেক উদ্ভট বিষয় ও পাইলট প্রজেক্ট নিয়ে আমাদের শিক্ষা কার্যক্রমের সাথে জড়িত ব্যাক্তিরা আবির্ভুত হয়ে শিক্ষার্থীদের উপর সার্জারি চালায়-এক বার মূল্যায়ন পরীক্ষা থাকবে আবার বলে মূল্যায়ন পরীক্ষা থাকবে না ইত্যাদি। আরে ভাই মূল্যায়ন পরীক্ষা যদি নাই থাকে তাহলে একজন শিক্ষার্থী, একজন অভিভাবক, একজন শিক্ষক কিভাবে জানবে বা মূল্যায়ন করবে শিক্ষার্থীর অবস্থা। সে এক লেজে গোবরে অবস্থা।
জীবন পদ্ধতি সম্পর্কে নির্দেশনা বর্জিত শিক্ষা, প্রকৃত লক্ষ্য বিবর্জিত শিক্ষা ব্যবস্থা, মূল্যবোধ সৃষ্টিতে ব্যর্থতা, সৃষ্টিকর্তা বিমুখ শিক্ষা ব্যবস্থা, নেতৃত্ব ও দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে ব্যর্থ শিক্ষা ব্যাবস্থা, পাশাপাশি ডিজিটাল ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোন বা ডিভাইসের সহজলভ্যতার কারণে শিক্ষার্থীরা পড়ালেখায় অমনোযোগী হয়ে উঠছে, সময়কে অপচয় করে ইন্টারনেটের অশ্লীলতা, যৌনতা, অসভ্যতা, নোংরামি ও বেহায়াপনার সাথে জড়িয়ে নিজেরদের শুধু চরিত্রই ধ্বংস করছে না সাথে সাথে সুন্দর ভবিষ্যতটাকেও গলাটিপে হত্যা করছে। সৃজনশীলতার নামে ক্লাসরুমে এমনসব বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে, আলোচনা করা হচ্ছে বা পাঠ্য সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যা হাস্যকর, যেমনটি ধরুন পেঁয়াজ কাটা, রান্না-বান্না শেখানো, আলু ভর্তা তৈরী, খিচুড়ি রান্না, ঘুম থেকে উঠে ব্রাশ করা, আর শারীরিক শিক্ষার নামে শিক্ষক, শিক্ষিকা ও ছাত্র-ছাত্রীদের এক অদ্ভুত নৃত্য ইত্যাদি।পাশাপাশি ছেলেমেয়েদের বয়োঃসন্ধিক্ষণের লক্ষণ ও করণীয় নিয়ে এমন সিলেবাস তৈরী যা গোটা জাতিকে হতবাক করেছে। আচ্ছা বলুনতো, এই বিষয়ের জন্য নিজের পরিবার বংশ পরম্পরায় আমাদের বাপ-দাদা, মা, খালা, দাদী-নানী অত্যান্ত গুরুত্বের সাথে এই দায়িত্ব বিগত দিনগুলোতে পালন করেনি?
হ্যা, প্রশ্ন উঠতে পারে পৃথিবী বহু উন্নত বিশেষ করে ইউরোপে বাচ্চাদের বিদ্যালয়ে হাতে কলমে শেখানো হয় সাঁতারকাটা, কেক তৈরী ও বিক্রয়, বাজার করার পদ্ধতি, রাস্তা পারাপারের নির্দেশনা, কমুনিকেশন স্কিল, স্টোরি টেলিং, স্টোরি রাইটিং, ম্যাগাজিন তৈরী, স্কুল ম্যাগাজিনে রাইটিং ইত্যাদি। কিন্তু দেখেন তাদের শিক্ষা কারিকুলামের বয়স এবং এর মৌলিকত্ব ও ঘনত্ব কেমন, কত গভীর। এক দিনেই, তারা এখানে আসেনি, দীর্ঘ দিনের বা শত বছরের অভিজ্ঞতা ও সময়ের প্রয়োজনে, ইউরোপ আজকে এমন শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে।
অন্যদিকে আমাদের দেশের সৃজনশীল নামের এই ধরণের শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর আগে ব্যাপক প্রস্তুতি দরকার ছিলো, কিন্তু প্রস্তুতি না নিয়ে বা শিক্ষকদের তেমন কোনো প্রশিক্ষণ না দিয়ে, অবকাঠামোগত কোনো উন্নয়ন না করে হঠাৎ এমন শিক্ষা কার্যক্রম চালু করছে এতে শিক্ষানীতির মূল উদ্দেশ্য শিখন, পঠন ও মূল্যায়ন ব্যাহত হতে বাধ্য। আবার, লাইফ স্কিলের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদেরকে আপনি গ্লোবাল সিটিজেন তৈরী করতে চাচ্ছেন, খুবই ভালো কথা কিন্তু শিক্ষার বর্তমান পদ্ধতিতে উল্ল্যেখ্য তেমন কোনো মূল্যায়ন পরীক্ষা নেই, শিক্ষকদের নেই কোনো প্রশিক্ষণ, এমনকি তারা জানেওনা কি তাদের করতে হবে, শিক্ষার্থীদের কি শিখাতে, কি হবে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন পদ্ধতি, কোন কোণ বিষয়ে হাতে কলমে শিখাতে হবে, কখন শিখাতে হবে, মার্কিং পদ্ধতিই বা কি হবে, অর্থাৎ শিক্ষকদেরকে সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত রেখেই নতুন এক শিক্ষা কার্যক্রম হাতে নিয়েছে, যার দরুন আপনারা দেখতে পাচ্ছেন কোনো কোন বিদ্যালয়ে ব্যাঙের লাফ, হাঁসের প্যাক প্যাক, আর ডিম ভাজি শেখানো হচ্ছে।
জাতীয় শিক্ষানীতি হলো একটি দেশের শিক্ষার উন্নয়ন, উন্নতি ও আগামী দিনের নেতৃত্ব গড়ে তোলার একটি রোডম্যাপ। বর্তমান সময়ের শিক্ষানীতি প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্বের ওপর জোর দিয়ে প্রাথমিক শিক্ষাকে ন্যূনতম ৮ বছর করার গুরুত্ব দিয়ে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি,ডিজিটাল সিস্টেমকে অগ্রাধিকার দেয়ার কথা থাকলেও আমরা দেখতে পাচ্ছি শিক্ষার নামে এমনসব কার্যক্রম পরিচালনা হচ্ছে যা একটি জাতিকে ধ্বংসের দাঁড় প্রান্তে নিয়ে যাবে। গ্রেডিং ও পয়েন্ট বেজড সিস্টেমের কারণে এবং শিক্ষকদের প্রতি অলিখিত নির্দেশনার কারণে শিক্ষার্থী যাই লিখুক না কেন, তাকে পাশ দেয়ার এক গোপন মিশন লক্ষ্য করা যাচ্ছে, আপাত দৃষ্টিতে শিক্ষার সংখ্যাগত মান বৃদ্ধি পেলেও গুনগত মান বৃদ্ধি পায়নি, পাশের হার ৯০% অধিক হলেও অন্তসারশূন্য ভবিষ্যত প্রজন্ম গড়ে উঠেছে যা পরিলক্ষিত হয় বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায়।
আজকে দেখেন ভারত, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, কোরিয়া, জাপান এবং চীনের শিক্ষা নীতি, কার্যক্রম এবং পাঠ্য পুস্তক ও তাদের সিলেবাসের দিকে তাকালে সহজেই বুঝা যায় আগামীর প্রজন্মকে কিভাবে প্রস্তুত করা হচ্ছে ভবিষ্যত নেতৃত্বের জন্য, দেশের স্বার্থে, উন্নয়ন ও উন্নতির স্বার্থে। পার্শবর্তী দেশ ভারত বিশেষ করে দার্জিলিং, কালিম্পঙের বোর্ডিং স্কুলগুলো এক্ষেত্রে অনেক অ্যাডভান্স।ভারত ইতিমধ্যে এর সুফলও পেতে শুরু করেছে। আপনারা সহজেই দেখবেন, ভারত অলরেডি পৃথিবীর শ্রমবাজারে ইমার্জ করছে। পৃথিবীর সব বড় বড় কোম্পানির কল সেন্টার ভারতে। মধ্য এশিয়ার দেশ সমূহে ইতিমধ্যে সম্মান জনক বা প্রথম সারির শ্রম বাজারে যেমন ধরুন এয়ারপোর্ট, ফাইভ ষ্টার হোটেল, আইটি কোম্পানী, আইটি সেক্টর, ডাটা এনালিস্ট, প্রোগ্রামমার ইত্যাদি ক্ষেত্রে ভারতের একক আধিপত্য বিরাজ করছে, শুধুমাত্র ভালো ইংরেজি জানা এবং তাদের অ্যাডভান্স কারিকুলামের জন্য।পক্ষান্তরে, আমাদের দেশের জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় ৫ নম্বর পাচ্ছে না বা ৯০% ফেল করছে। ইউরোপ, আমেরিকা, যুক্তরাজ্যের শিক্ষা ব্যাবস্থার কথা নাই বা বললাম। এই সমস্ত দেশে প্রাইমারী থেকেই ক্লাস কাউন্সিলর, স্কুল কাউন্সিলর, স্কুল রিপ্রেসেন্টেটিভ, ইয়ং মেয়র, ইয়ং রাইটার, ইয়ং স্পিকার হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সময়পোযোগী বিভিন্ন কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে তাদেরকে নেতৃত্ব, পান্ডিত্য হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে। এই সমস্ত দেশের শিক্ষার্থীরা যখন নাসা, মহাকাশ, কম্পিউটার প্রোগ্রাম, কোডিং ও সাইবার সিস্টেম নিয়ে ব্যস্ত সেখানে আমার দেশের শিক্ষার্থীকে দিয়ে আলুর ভর্তা ও পেঁয়াজ কাটার প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। এই ভাবে যদি চলতে থাকে আগামীর বাংলাদেশ নেতৃত্বের শূন্যতায় ভুগবে এটি দিবালোকের মতোই সত্য। বরং, নতুন শিক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে বিজ্ঞান ও ধর্মীয় মূল্যবোধের সামাঞ্জস্য রেখে দেশ ও বিদেশের সময়ের প্রয়োজনে এবং আগামীর বিশ্বকে লক্ষ্য রেখেই শিক্ষা কার্যক্রম ও সিলেবাস প্রণয়ন করা দরকার।
চিন্তার খোরাক হিসেবে বলছি, কেন আমাদের শিক্ষার সিলেবাস, পাঠ্যসূচি, পাঠদান পদ্ধতিকে বার বার কাটাছেড়া করে এভাবে কুলষিত করা হচ্ছে, দিক বিবর্জিত শিক্ষা কার্যক্রম চালানো হচ্ছে? এটি কি কোনো একটি লক্ষ্যকে সামনে রেখে, বা ভিনদেশীদের প্রেক্রিপশনে যাতে বাংলাদেশ ভবিষ্যতে নেতৃত্বের শূন্যতায় পরে এবং এই উছিলায় বাংলাদেশকে গোলামীর শিকলে জিঞ্জিরাবদ্ধ রাখা যায়? ইতিহাস থেকে এটিও জানা যায় যে-একটি দেশের শিক্ষা ব্যাবস্থার ধ্বংসই, একটি জাতিকে, একটি দেশকে ধ্বংস করে দিতে পারে। পাশাপাশি শিক্ষা ক্ষেত্রে রাজনীতি, ছাত্র রাজনীতি, শিক্ষক রাজনীতি, পরিচালনা পর্ষদের রাজনীতি এবং শিক্ষকদের অতিরিক্ত আয়ের মনবাসনায় প্রাইভেট পড়ানো ( কারন চাকরিতে ঢুকতে তাকেও তো অনেকগুলো টাকা দিতে হয়েছে),একটি ভঙ্গুর জাতি গঠনে কম দায়ী নয়। শিক্ষা রাজনীতি ও প্রাইভেট সম্পর্কে আলাদা করে একটু বলে রাখি।
ছাত্র রাজনীতি বাংলাদেশের শিক্ষাকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠন ছাত্রদের মধ্যে রাজনীতির অনুপ্রবেশ করানোর জন্য ষষ্ঠ শ্রেণীর কোমলমতি শিক্ষার্থীদের নিয়েও ছাত্র রাজনীতির কমিটি গঠন করে এক ন্যাক্কারজনক অধ্যায়ের সূচনা করেছে, যা ইতিপূর্বে ছিল না। ছাত্র রাজনীতি মানেই চর দখলের মত হল দখলের স্বসস্ত্র মহড়া, রাজনৈতিক দলের শক্তি বৃদ্ধি করা, ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে একটি ভীতিকর পরিবেশ তৈরী করা, অস্রের ঝনঝনানি, ভিন্নমত পোষণকারী ছাত্রকে শারীরিক ও মানসিকভাবে লাঞ্চিত করা, আঘাত করা, হত্যা করা, ভিন্ন মতকে অবদমিত করা, জুলুম-নির্যাতন করা, ছাত্রীতে-ছাত্রীতে চুলাচুলি, দিগম্বর করে, অপমান করা, হোস্টেলে ফ্রি খাওয়া, অছাত্রদেরকে হলে থাকার সুযোগ দেয়া, ন্যায্য প্রতিবাদের ভাষা রোধ করে দেয়া আর যা ইচ্ছে তাই করা, দলীয় লেজুড়বৃত্তি করা, লাঠিসোঠা নিয়ে দলীয় কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা, কথায় কথায় গাড়ী ভাঙ্গা, গাড়িতে আগুন দেয়া, যাকে তাকে আক্রমন চালানো, লুটপাট, চাদাবাজী, মাদকের ছড়াছড়ি ইত্যাদি ইত্যাদি।এই ছাত্র রাজনীতির কারণে যেমন অকালে ঝরে পরে অনেক মেধাবী ও সম্ভাবনাময়ী ছাত্র, আবার দেশ বঞ্চিত হয় আগামীর যোগ্য নাগরিক ও নেতৃত্ব থেকে। তাই ছাত্র রাজনীতির লাগাম টেনে ধরা ও এর সংশোধন জরুরি।
অন্যদিকে, আগের দিনে প্রাইভেট পড়ানো বা লজিং মাস্টারের প্ৰথা ছিলো ছাত্রছাত্রীদের কিছুটা সহায়তা করো জন্য এবং লজিং শিক্ষকের নিজের পড়াশুনার জন্য। কিন্তু বর্তমানে প্রাইভেট পড়ার বাণিজ্য ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র। শিক্ষার্থীদেরকে বাংলা, সমাজ বিজ্ঞান ও ধর্মীয় শিক্ষারমতো বিষয়গুলোকে প্রাইভেট পড়তে বাধ্য করা হচ্ছে।এমনটিও দেখা যায় যে ছাত্র কোনো শিক্ষকের নিকট প্রাইভেট না পড়লে ওই ছাত্রকে ওই বিষয়ে ফেল করানো হয়। তাছাড়া কোচিং বাণিজ্য এবং শিক্ষাকে কখনো পণ্য হিসেবে প্রতিযোগিতায় নামানো, আর শিক্ষা যখন পণ্য হয়, তখন শিক্ষার মধ্য দিয়ে উচ্চতর জ্ঞানসাধনার বিষয়টি চাপা পড়ে যায়, প্রধান হয়ে ওঠে বাজারের চাহিদা। শিক্ষকদের প্রাইভেট পড়ানোর এমন হীন বাণিজ্য জাতির মেরুদন্ডকে একেবারে ভেঙে দিচ্ছে। এক সময় শিক্ষকতা মহৎ পেশা হলেও, বর্তমানে শিক্ষকতার প্রতি সাধারণ মানুষের নেতিবাচক মনোভাব তৈরী হয়েছে, এতে মেধাবীরা এখন আর শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করছে না। তাছাড়া মেধাবীরা কিভাবে দেশ ছাড়া যায়, সেই চেষ্টায় সচেষ্ট। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের চরম ব্যর্থতা রয়েছে, রাষ্ট্র যেমন পারেনি মেধাবীকে মূল্যায়ন করতে, ঠিক তেমনি পারেনি তাকে ধরে রাখতে।
সমাধানের জন্য বিবেচনা করা যায় সবার আগে ধর্মীয় ও নৈতিকতা সম্বলিত এবং বর্তমান সময়ের উপযোগী বাস্তবভিত্তিক একটি শিক্ষানীতি ও সিলেবাস প্রণয়ন করা। সৃজনশীলতার নামে যে নতুন শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা হচ্ছে তার সংশোধন, পরিমার্জন ও পরিবর্তন দরকার। এর সাথে সাথে শিক্ষায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি, গ্রামাঞ্চলে আরও বেশি স্কুল নির্মাণ, সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের বৃত্তি ও আর্থিক সহায়তা প্রদান এবং উন্নত অবকাঠামো ও সম্পদের মাধ্যমে শিক্ষার মানোন্নয়ন করা, শিক্ষকের গুণগত মান ও প্রশিক্ষণ প্রদান, শিক্ষকদের নৈতিক চরিত্রের উন্নয়ন ঘটানো, শিক্ষাগত দক্ষতা বৃদ্ধি, পেশাগত উন্নয়নকে উৎসাহিত করা এবং শিক্ষকদের মধ্যে অনুপ্রেরণা বোধ বাড়ানো, শিক্ষকদের আকর্ষণীয় বেতন, প্রণোদনা এবং পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে ক্যারিয়ারের অগ্রগতির সুযোগ প্রদান, শিক্ষার দক্ষতা উন্নয়ন এবং ব্যবহারিক শিক্ষার উপর জোর দেয়া, কারিগরি শিক্ষার প্রচার ও প্রসার, নারী শিক্ষা সহজীকরণ, উৎপাদন ও কর্মমুখী কারিকুলাম প্রণয়ন, পরিকল্পিত শিক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করা, দেশের স্বার্থে টেকসই শিক্ষা কার্যক্রম হাতে নেয়া, দলীয় পরিচয় না দেখে যোগ্যতার ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগ ও বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদ গঠন করা, এবং সবকিছুর আগে শিক্ষালয়কে রাজনীতি মুক্ত করা, পাশাপাশি প্রাইভেট শিক্ষা ও কোচিং বাণিজ্যকে বন্ধ করা বা নিরুৎসাহিত করা।
তাহলেই আমরা আগামী প্রজন্মের বাংলাদেশীদের মধ্য থেকে উন্নত নেতৃত্ব, আন্তর্জাতিক মানের উদ্ভাবক, উদ্যোক্তা, বিশ্লেষক, গবেষক, রাজীনীতিবিদ, ইতিহাসবিদ, বিজ্ঞানী, এবং ইতিবাচক পরিবর্তনকারী সৃষ্টি করতে পারবো, আর তা নাহলে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্য নাগরিকের অভাবে এই দেশটি একটি গোষ্ঠীদ্বারা অবদমিত হবে, স্বাধীনতার সুফল বঞ্চিত হবে এবং গোলামীর জিঞ্জিরাবদ্ধ হবে। ভৌগোলিক স্বাধীনতা থাকলেও নেতৃত্ব শুন্যতায় পরাধীনতার ভাগ্যবরণ করতে হবে। শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য মানুষকে বিকশিত করা, দক্ষ মানবসম্পদে রুপান্তরিত করা, আগামীর নেতৃত্ব গড়ে তোলা, দেশকে বিশ্বমঞ্চে উপস্থাপন করা অধরাই থেকে যাবে।
লেখকঃ ব্যারিষ্টার ওয়াহিদ মুহাম্মদ মাহবুব
০৬/১২/২০২৩, লন্ডন।