বাংলাদেশের ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামানের ‘হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ’ ব্রিটেনে
ডেস্ক রিপোর্টঃ বাংলাদেশের ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ব্রিটেনে ‘হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ’ আছে বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। বাংলাদেশ থেকে বিদেশে টাকা নেয়া জটিল প্রক্রিয়া হলেও ভূমিমন্ত্রী কিভাবে বিদেশে এতো সম্পদ গড়ে তুলেছেন সেটি নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে।
তবে ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী সম্প্রতি তার নির্বাচনী এলাকায় এক জনসভায় দাবি করেছেন, তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি প্রমাণ করতে পারলে রাজনীতি ছেড়ে দেবেন তিনি।
মন্ত্রী বৈধ নাকি অবৈধ উপায়ে এ অর্থ আয় করেছেন সেটি নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলছে না। প্রশ্ন হচ্ছে, বিদেশে তিনি এতো টাকা নিয়ে গেলেন কিভাবে?
গত ২৬শে ডিসেম্বর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবি এক সংবাদ সম্মেলনে জানায়, এক মন্ত্রীর বিদেশে ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকার ব্যবসা রয়েছে। তবে তিনি নির্বাচনী হলফনামায় এ তথ্য দেননি। ওই সংবাদ সম্মেলনে টিআইবি ওই মন্ত্রীর নাম প্রকাশ করেনি।
এর একদিন পরে দেশের বিভিন্ন পত্রিকায় রিপোর্ট হয় যে নাম প্রকাশ না করা সেই মন্ত্রী হচ্ছেন ভূমিমন্ত্রী সাইফুফুজ্জামান চৌধুরী।
বেশ কয়েকটি পত্রিকায় মন্ত্রীর পরিচয় প্রকাশ হবার পরে বিষয়টি জানতে চাওয়াও হয় টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান-এর কাছে। তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, তারা যে মন্ত্রীর সম্পদের বিষয়ে তথ্য তুলে ধরেছিলেন তিনি ভূমি মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীই ছিলেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশেষভাবে সুনির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে অর্থ নেয়ার সুযোগ থাকলেও তা অত্যন্ত জটিল প্রক্রিয়া। এছাড়া মন্ত্রী যে খাতে যে পরিমাণ অর্থ নিয়েছেন তা এই প্রক্রিয়ার আওতাভুক্ত নয়।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান “রিয়েল এস্টেট খাত, যে ক্ষেত্রে এই ইনভেস্টমেন্টগুলো, এটার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক এখনো কোন অনুমোদন দেয়নি।”
ভূমিমন্ত্রী কী বলছেন?
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য ভূমি মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর সাথে বিবিসি বাংলার তরফ থেকে যোগাযোগ করা হলেও তার কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
বিভিন্ন সংবাদপত্রে নাম প্রকাশিত হবার পর চট্টগ্রামের আনোয়ারায় এক নির্বাচনী জনসভায় ভূমি মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী বলেন, তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি প্রমাণ করতে পারলে রাজনীতি ছেড়ে দেবেন তিনি।
তিনি বলেন, “আমি এক টাকাও দুর্নীতি করেছি কেউ বলতে পারলে রাজনীতি ছেড়ে দেব। এমপি, মন্ত্রী হলেও আমি ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তান।”
“ব্যবসা করেছি, ব্যবসা না করে আমি উপোস করে থাকবো? চুরি করবো নাকি আমি? মানুষের হক খেয়ে তো আমি চলতে পারবো না। হারাম পয়সার আমার দরকার নেই। আমার পদ বেচে আমি ব্যবসা করি না, আমার এই পদের অনেক আগে, আমার বাবাও ব্যবসায়ী ছিলেন, আমিও ব্যবসায়ী ছিলাম।”
মি. চৌধুরী বলেন, “আমি মনে করি রাজনীতি এবং এই এমপি-মন্ত্রী এগুলো আল্লাহর রহমত। মানুষকে দেয়ার মন-মানসিকতা থাকতে হবে, দেশের মানুষের জন্য করতে হবে, সেবা করতে হবে।”
সংবাদ মাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, এসব সম্পদের বর্তমান বাজারমূল্য দুই হাজার তিনশ কোটি টাকার বেশি।
ভূমিমন্ত্রী নিজে এবং তার স্ত্রী মিলে বিদেশি অন্তত ছয়টি কোম্পানি পরিচালনা করছেন বলে তথ্য দেয়া হয়। যেগুলোর মূল্য ১৬.৬৪ কোটি পাউন্ড বা দুই হাজার ৩১২ কোটি টাকা বলে জানানো হয়।
বিভিন্ন সংবাদপত্রের রিপোর্টে বলা হয়েছে, যুক্তরাজ্য সরকারের ওয়েবসাইটে গিয়ে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর নামে অন্তত ছয়টি কোম্পানি পাওয়া যায় যার সবগুলোই আবাসন ব্যবসার সাথে যুক্ত।
এগুলো হচ্ছে, জেডটিজেড প্রোপার্টি ভেনচার্স লিমিটেড, আরামিট প্রোপার্টিজ লিমিটেড, রুখমিলা প্রোপার্টিজ লিমিটেড, সাদাকাত প্রোপার্টিজ লিমিটেড, জেবা প্রোপার্টিজ লিমিটেড এবং জারিয়া প্রোপার্টিজ লিমিটেড। এই সবগুলো কোম্পানিরই পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন তিনি।
এর মধ্যে শুধু রুখমিলা প্রোপার্টিজ লিমিটেড এর পরিচালক পদ থেকে তিনি সরে দাঁড়িয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই কোম্পানিটির ঠিকানা লন্ডনের ওয়ারউইক লেন। বাকি সবগুলো কোম্পানির ঠিকানা লন্ডনের ডেভনশায়ার স্কয়ার উল্লেখ করা হয়েছে।
মন্ত্রী টাকা কীভাবে নিয়েছেন?
বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী, বিদেশে বিনিয়োগ করার নিয়ম নেই। এমনটি একজন ব্যক্তি বৈধভাবে বছরে ১২ হাজার ডলারের বেশি নিয়ে যেতেও পারেন না। এমন অবস্থায় সরকারি একজন মন্ত্রীর বিদেশে এতো সম্পদের মালিক হওয়া নিয়ে আলোচনা চলছে।
ভূমি মন্ত্রীর বিদেশে সম্পদ থাকার বিষয়টি সামনে আনে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ।
এই প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, যে উৎসগুলো থেকে তারা মন্ত্রীর এসব সম্পদের বিষয়ে জানতে পেরেছেন তা উন্মুক্ত ওয়েবসাইট। সেখানে শুধু সম্পদের হিসাব রয়েছে।
কিন্তু এসব সম্পদ গড়তে মন্ত্রী কোন উপায়ে অর্থ নিয়েছেন তা বলা হয়নি। যার কারণে মন্ত্রী কীভাবে অর্থ নিয়ে গেছেন সেটি তাদের পক্ষে জানা সম্ভব হয়নি।
তবে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো চাইলে সেটা তদন্ত করে বের করা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি। এক্ষেত্রে দরকার হলে বিদেশি সহায়তাও নেয়া যেতে পারে।
মি. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্য-দুদেশই জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক দুর্নীতি বিরোধী কনভেনশনের সদস্য। ফলে এই দুই দেশ চাইলে যৌথভাবে কাজ করতে পারবে। সেই সুযোগ ছাড়াও আইনি কাঠামো আছে।
“সরকার চাইলে বিএফআইইউ(বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট) এর নেতৃত্বে, দুর্নীতি দমন কমিশন, সিআইডি, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড- এ ধরণের সংস্থাগুলো যদি সঠিকভাবে চেষ্টা করে তাহলে অবশ্যই সবকিছুই বের করা সম্ভব।”
টিআইবির এই নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, নিয়ম অনুযায়ী, কোন ব্যক্তি ১২ হাজার ডলারের বেশি দেশ থেকে বিদেশে নিতে পারেন না। সেই বিবেচনায় ভূমি মন্ত্রী যে পরিমাণ অর্থ নিয়েছেন তা এই সীমার চেয়ে অনেক বেশি। তাই এই বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ বলে উল্লেখ করেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংক নির্দিষ্ট কিছু খাতে অর্থ নেয়ার অনুমোদন দিলেও সেই শ্রেণিতেও ভূমি মন্ত্রীর অর্থ নেয়ার সুযোগ নেই বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, “রিয়েল এস্টেট খাত, যে ক্ষেত্রে এই ইনভেস্টমেন্টগুলো, এটার জন্য আমাদের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক এখনো কোন অনুমোদন দেয়নি।”
এবিষয়ে সাবেক ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, “যে পরিমাণ অর্থ নেয়া হয়েছে তা আসলে অবৈধ উপায়ে পাচার করা হয়েছে। এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।”
এ বিষয়ে ভূমি মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর সাথে যোগাযোগ করা হলেও তাৎক্ষণিকভাবে তার কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
আইন কী বলে?
বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা নীতি অনুযায়ী, ব্যক্তিগত ভ্রমণের জন্য বাংলাদেশের বাসিন্দারা প্রতি বছর মাথাপিছু সর্বোচ্চ ১২ হাজার মার্কিন ডলার নিতে পারবেন।
বিদেশে চিকিৎসার জন্য যেতে হলে বিশেষ অনুমতি সাপেক্ষে আরো ১০ হাজার ডলার নেয়ার বিধান রয়েছে। এর বেশি পরিমাণ অর্থ দরকার হলে আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নিতে হয়।
এছাড়া বাংলাদেশের বাসিন্দারা দেশের স্থাবর সম্পত্তি বিক্রয় করে সেই টাকা বৈদেশিক মুদ্রায় বিদেশে পাঠানোর নিয়ম নেই।
এছাড়া বিদেশে প্রত্যক্ষ বা পোর্টফোলিও বিনিয়োগ বাংলাদেশিদের জন্য উন্মুক্ত নয়। কারণ বাংলাদেশী টাকা মূলধনী খাতে রূপান্তরযোগ্য ঘোষিত নয়। যার কারণে বাংলাদেশি মুদ্রা বৈদেশিক মুদ্রায় রূপান্তর করে পাঠানোর সুযোগ নেই।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান জানান, সাম্প্রতিক সময়ে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিনিয়োগের অনুমতি দেয়। তবে সেটা সুনির্দিষ্ট খাত ভিত্তিক।
“বিদেশে ইন্ড্রাস্টি গড়তে চায় এমন ব্যক্তিদেরকে(অনুমতি দেয়)। তবে সেটার সুনির্দিষ্ট খাত আছে এবং সুনির্দিষ্ট অনুমোদন লাগে,” বলেন তিনি।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, কোন শিল্প প্রতিষ্ঠার জন্য বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে বাইরে বিনিয়োগের অনুমতি দেয়া হয়। তবে কোন সম্পত্তি কেনার জন্য অনুমতি দেয়া হয় না।
এই অনুমোদন মিলিতভাবে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি-বিডা।
“এই দুই প্রতিষ্ঠান এক সাথে বসে, সেটা অ্যাপ্রুভ করে। তখন সেই টাকা বাইরে নিয়ে সেই ইন্ড্রাস্টি তারা করতে পারে। সেটা সিলেকটিভলি এবং একেবারে কেস বাই কেস দেয়া হয়। সেটা এক্ষেত্রে পড়বেই না,” বলেন মি. মনসুর।
উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, গার্মেন্টস শিল্প হয়তো ইথিওপিয়াতে কোন শিল্প কারখানা গড়ে তুলতে চায়, তাহলে সেক্ষেত্রে তাদের অনুমোদন দেয়া হতে পারে।
আবার কোন কোম্পানি যদি অন্য কোন দেশে আউটলেট বা দোকান করতে চায় তাহলে সেটা হতে পারে। একইভাবে হতে পারে দেশের কোন ফার্নিচার কোম্পানি যদি মালয়েশিয়াতে কোন প্রতিষ্ঠান গড়তে চায় সেক্ষেত্রে দেয়া যেতে পারে।
এই ধরণের বিশেষ ও বাছাইকৃত কিছু ক্ষেত্রে দেশের বাইরে বিনিয়োগ করতে পারে। তবে এক্ষেত্রেও কঠোর নিয়ম-নীতি অনুসরণ করতে হয় যেগুলো মোটেই সহজ নয় বলে জানান তিনি।
“সেখানে তাদের নিয়মিত রিপোর্টিং করতে হয়, তাদের ডিভিডেন্ড আনতে হয় ইত্যাদি ইত্যাদি,” বলেন মি. মনসুর।