হাসান নাসরাল্লাহ, যিনি লেবাননকে হাতের মুঠোয় কব্জা করে নিয়েছেন
হেজবুল্লাহকে বর্তমানে লেবাননের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দল হিসেবে গণ্য করা হয়। এর অন্যতম প্রধান কারণ হল, লেবাননের জাতীয় সেনাবাহিনীর পাশাপাশি একমাত্র তাদেরই নিজস্ব শক্তিশালী সশস্ত্র বাহিনী রয়েছে।
এদিকে, হেজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরাল্লাহ লেবাননসহ অন্যান্য আরব দেশেগুলোতেও ভীষণ জনপ্রিয়।
কারণ, লেবাননের রাজনৈতিক অঙ্গনে এবং দেশটির সরকার কাঠামোতে হেজবুল্লাহ যেভাবে প্রবেশ করেছে, এর পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন এই নেতা।
ইসলামিক রিপাবলিক অব ইরান এবং দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে নাসরাল্লাহ’র।
এখানে সবচেয়ে অবাক করা বিষয়টি হল, হেজবুল্লাহকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা সত্ত্বেও, ইরানের নেতারা বা নাসরাল্লাহ, কেউই কখনও তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা গোপন বা অস্বীকার করেন নি।
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে হাসান নাসরাল্লাহ’র যেমন অনেক অন্ধ ভক্ত আছে, তেমনি তার ঘোর শত্রুরও কোনও অভাব নেই। আর ঠিক এই কারণেই ইসরায়েলের হাতে নিহত হওয়ার ভয়ে বহু বছর ধরে তিনি জনসমক্ষে আসছেন না।
কিন্তু তার এই আত্মগোপনের কারণে ভক্ত বা অনুসারীরা বঞ্চিত হচ্ছেন না। প্রায় প্রতি সপ্তাহে তিনি টেলিভিশনে তার ভক্তদের উদ্দেশে বক্তৃতা দেন। সেখানে তিনি লেবানন ও বিশ্বের বিভিন্ন ঘটনা সম্বন্ধে মন্তব্য করেন এবং তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের ওপর চাপ দেয়ার চেষ্টা করেন।
বলা হয়ে থাকে, ক্ষমতা প্রয়োগের জন্য এইসব বক্তৃতা মূলত নাসরাল্লাহ’র প্রধান হাতিয়ার।
নাসরাল্লাহ’র শৈশব এবং কৈশোর
১৯৬০ সালের অগাস্টে পূর্ব বৈরুতের একটা দরিদ্র এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন নাসরাল্লাহ। তার বাবা একটা ছোট মুদি দোকানের মালিক ছিলেন এবং তিনি ছিলেন নয় ভাই-বোনের মাঝে সবার বড়।
লেবাননে যখন গৃহযুদ্ধ শুরু হয়, তখন নাসরাল্লাহ’র বয়স মাত্র পাঁচ বছর। ভূমধ্যসাগরের কোলঘেঁষা এই ছোট্ট দেশটিতে টানা ১৫ বছর ধরে বিধ্বংসী যুদ্ধ চলার কারণে সব লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছিলো তখন।
সেইসময় লেবাননের নাগরিকরা ধর্ম ও জাতিসত্ত্বার ভিত্তিতে একে অপরের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ে।
তবে গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর হেজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরাল্লাহ’র বাবা লেবাননের রাজধানী বৈরুত ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং তিনি দক্ষিণ লেবাননের আল-বেজুরিয়াহ গ্রামে চলে আসেন।
এই গ্রামে ছিল তার পৈতৃক বাড়ি, অর্থাৎ নাসরাল্লাহ’র দাদার বাড়ি। আল-জানুব প্রদেশের টায়ার শহরের অধিকাংশ গ্রামের মতো এই গ্রামেরও বেশিরভাগ বাসিন্দাই ছিল শিয়া মতবাদের।
তাই, নাসরাল্লাহ’র প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক শিক্ষার সময়টা কেটেছিল দক্ষিণ লেবাননের শিয়া মুসলিমদের সাথে, যারা বিশ্বাস করেন যে অটোমান বা উসমানীয় সাম্রাজ্য এবং ফরাসি সাম্রাজ্যের মতো ঔপনিবেশিক যুগে তারা অনেক প্রকার বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার হয়েছিলো।
তাদের এই মনোভাব স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ও বহাল ছিল। তখন খ্রিস্টান এবং সুন্নিরা ক্ষমতায় ছিল। এইসময় খ্রিস্টান এবং সুন্নি মিলিশিয়া গ্রুপগুলোর ব্যাপারে সামরিক সাফল্য অর্জনের জন্য বিদেশি সহায়তা গ্রহণের অভিযোগ ছিল।
সেই সময় দক্ষিণ ও পূর্ব লেবাননের বেকা উপত্যকার বাইরে থাকা সংখ্যাগরিষ্ঠ শিয়া জনগোষ্ঠী এবং ম্যারোনাইট ও অর্থোডক্স খ্রিস্টানদের ছোট ছোট গোষ্ঠীবসবাস করতো। ফিলিস্তিনে ইহুদি শাসন প্রতিষ্ঠার বছরগুলিতে এসব গোষ্ঠী ইসরায়েলের হামলার মূল লক্ষ্যে পরিণত হয়েছিল।
এই পরিবেশে হাসান নাসরাল্লাহ কেবল তার শিয়া পরিচয় এবং জাতিগত শিকড়ের দিকেই ঝুঁকে পড়েননি, সেইসাথে মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও সামরিক গোষ্ঠীর সদস্যও হয়েছিলেন।
লেবাননের সেই প্রভাবশালী এবং সক্রিয় গোষ্ঠীটির নাম ‘আমাল মুভমেন্ট’, যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মুসা-আল-সাদর নামক একজন ইরানী ধর্মপ্রচারক বা ধর্মনেতা।
লেবাননে প্রত্যাবর্তন এবং সশস্ত্র সংগ্রাম
হাসান নাসরাল্লাহ’র বয়স যখন ১৬ বছর, তখন তিনি ইরাকের নাজাফাতে গিয়েছিলেন।
ইরাক তখন এতটাই অস্থিতিশীল দেশ যে এটি টানা দুই দশক ধরে বিপ্লব, রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থান এবং রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের মাঝ দিয়ে যাচ্ছিলো। ঐসময় রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন হাসান-আল-বকর। কিন্তু তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন ইরাকের রাজনীতিতে তখন উল্লেখযোগ্য প্রভাব অর্জন করেছিলেন।
এদিকে, নাজাফে দুই বছর থাকার পর ইরাকের বা’থ পার্টির নেতারা, বিশেষ করে সাদ্দাম হোসেন এই সিদ্ধান্ত নিলেন যে শিয়াদেরকে দুর্বল করার জন্য তাদেরকে আরও জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। তাদের সেই পদক্ষেপগুলোর মাঝে অন্যতম সিদ্ধান্ত ছিল, ইরাকি মাদ্রাসা থেকে লেবাননের সব শিয়া শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করা।
যদিও নাসরাল্লাহ নাজাফে মাত্র দুই বছর পড়াশুনা করেছিলেন এবং তারপর তাকে ঐ দেশ ছেড়ে আসতে হয়েছিল। কিন্তু নাজাফে থাকার এই সময়টা এই তরুণ লেবানিজের জীবনে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল।
এখানে উল্লেখ্য, নাজাফে থাকাকালীন তিনি আব্বাস মোসাভি নামক একজন ধর্মপ্রচারকের সঙ্গে দেখা করেছিলেন।
ইরান-লেবাননভিত্তিক শিয়া মতবাদের ধর্মপ্রচারক মুসা আল-সাদরের একজন ছাত্র ছিলেন মোসাভি। নাজাফে থাকার সময় মোসাভি ইরানি রাজনীতিবিদ ও শিয়া মুসলিম ধর্মগুরু রুহুল্লাহ খোমেনির রাজনৈতিক মতাদর্শ দ্বারা দৃঢ়ভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন।
এই আব্বাস মোসাভি হাসান নাসরাল্লাহ’র চেয়ে আট বছরের বড় ছিলেন এবং তিনি খুব দ্রুত নাসরাল্লাহ’র জীবনে একজন কঠোর শিক্ষক ও প্রভাবশালী পরামর্শক হয়ে ওঠেন।
তারা দু’জনই ইরাকের নাজাফ থেকে লেবাননে ফিরে সেখানে চলমান গৃহযুদ্ধে যোগ দেন। এসময় নাসরাল্লাহ আব্বাস মোসাভির নিজ শহর বেকা উপত্যকার একটা মাদ্রাসায় পড়াশুনা করেন।
ইরানে বিপ্লব এবং হেজবুল্লাহ’র উত্থান
হাসান নাসরুল্লাহ লেবাননে ফেরার এক বছর পর ইরানে একটি বিপ্লব সংঘটিত হয়। আব্বাস মোসাভি এবং হাসান নাসরাল্লাহ’র মতো একজন ধর্মীয় নেতা রুহুল্লাহ খোমেনি ইরানের ক্ষমতা দখল করেন।
এই ঘটনা লেবাননের শিয়া মুসলিম এবং ইরানের সম্পর্ককে গভীরভাবে বদলে দেয়। দেশটির শিয়াদের রাজনৈতিক জীবন এবং সশস্ত্র সংগ্রাম ইরানের এই ঘটনা ও শিয়া মতাদর্শ দ্বারা উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত হয়েছিল।
তবে ব্যক্তিগতভাবে হাসান নাসরাল্লাহ’র তৎকালীন ইসলামি প্রজাতন্ত্রের নেতা রুহুল্লাহ খোমেনি দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার কারণ হল, ক্ষমতায় আসার পর ১৯৮১ সালে তিনি তেহরানে রুহুল্লাহ’র সাথে দেখা করেন।
তখন খোমেইনি নাসরাল্লাহকে লেবাননে তার প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত করেন। নাসরাল্লাহ’র দায়িত্ব ছিল ‘হিসবাহ’ সম্পর্কিত বিষয়াদি দেখা এবং ইসলামি তহবিল জোগাড় করা।
এই দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে নাসরাল্লাহ মাঝে মাঝেই ইরানে আসা-যাওয়া শুরু করলেন। এসময় তিনি ইরান সরকারের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের এবং ক্ষমতার সর্বোচ্চ স্তরের মানুষদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুললেন।
ইরানের শিয়া মুসলিমরা লেবাননের শিয়াদের সাথে ধর্মীয় বন্ধন এবং ঐতিহাসিক রেকর্ডকে গুরুত্ব দিয়েছিলো।
ইরানের শিয়াদের একতার মূলমন্ত্র ছিল পশ্চিমা বিরোধী মনোভাব, যেটি প্রচার করেছিলেন রুহুল্লাহ খোমেনি।
সে সময় মধ্যপ্রাচ্যে সংবাদ প্রচারের নীতি ইসরায়েলবিরোধী রূপ ধারণ করে। সেইসাথে, ইরানের বৈদেশিক নীতিতে ‘ফিলিস্তিনি আদর্শ’ অগ্রাধিকার পেতে থাকে।
এইসময় গৃহযুদ্ধ ও অস্থিরতার দ্বারা অবরুদ্ধ লেবানন ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের ঘাঁটি হয়ে উঠলো। লেবাননের বৈরুত ছাড়াও দক্ষিণ লেবাননে তাদের একটা শক্ত অবস্থান ছিলো।
ক্রমবর্ধমান অস্থিতিশীলতার মাঝে ইসরায়েল ১৯৮২ সালের জুন মাসে লেবানন আক্রমণ করে এবং ইসরায়েল খুব দ্রুত দেশটির গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো দখল করে নেয়। যদিও ইসরায়েল দাবী করেছে, ফিলিস্তিনি আগ্রাসনের জবাবে তারা এ হামলা চালিয়েছে।
লেবাননে ইসরায়েলের হামলার কিছুদিন পর ইরাকের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে ইরান। ফলে ইরানের ইসলামিক রেভোলিউশান গার্ড কর্পস (আইআরজিসি)-এর সামরিক কমান্ডাররা সিদ্ধান্ত নেন যে তারা ইরানের তত্ত্বাবধায়নে লেবাননে একটা পূর্ণাঙ্গ মিলিশিয়া বাহিনী গঠন করবেন। তারা তখন এই বাহিনীর নাম দেয় ‘হেজবুল্লাহ’, যার অর্থ সৃষ্টিকর্তার দল।
হেজবুল্লাহ ১৯৮৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। হাসান নাসরাল্লাহ, আব্বাস মোসাভি এবং আমাল মুভমেন্টের আরও কয়েকজন সদস্য একসাথে এই নবগঠিত সংগঠনটিতে যোগ দেন। তখন সংগঠনটি’র নেতৃত্ব দেন সুভি-আল-তুফায়লি নামক একজন।
এদিকে, আমেরিকান বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভিযান পরিচালনা করার কারণে এই দলটি খুব দ্রুত আঞ্চলিক রাজনীতিতে তার পদচিহ্ন তৈরি করে ফেলে।
হেজবুল্লাহ’র নেতৃত্ব প্রাপ্তির দিকে নাসরুল্লাহ
নাসরাল্লাহ যখন হেজবুল্লাহ গ্রুপে যোগ দেন, তখন তার বয়স মাত্র ২২ বছর। শিয়া ধর্মপ্রচারকদের মানদণ্ড অনুযায়ী, তিনি ছিলেন একদম নবীন।
আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে ইরানের সঙ্গে নাসরাল্লাহ’র সম্পর্ক আরও গভীর হয়। তখন তিনি ধর্ম বিষয়ক পড়াশুনার জন্য ইরানের কোম শহরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কোমের মাদ্রাসায় থাকাকালীন নাসরাল্লাহ পার্সিয়ান ভাষায় দক্ষ হয়ে ওঠেন এবং ইরানের অনেক রাজনৈতিক ও সামরিক ব্যক্তিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন।
এরপর যখন তিনি লেবাননে ফিরে আসেন, তখন তার এবং আব্বাস মোসাভির মাঝে মতবিরোধ দেখা দেয়। কারণ মোসাভি হাফেজ আসাদের নেতৃত্বে লেবাননে সিরিয়ার কার্যক্রম বাড়ানোকে সমর্থন দিয়েছিলেন। বিপরীতে, নাসরাল্লাহ চাচ্ছিলেন, হেজবুল্লাহ যাতে আমেরিকান এবং ইসরায়েলি সৈন্যদের আক্রমণের দিকে মনোনিবেশ করে।
কিন্তু নাসরাল্লাহ’র কথা কেউ শুনছিলেন না। তিনি তখন হেজবুল্লাহ’র মাঝে নিজেকে সংখ্যালঘু হিসেবে খুঁজে পেয়েছিলেন। তবে এই ঘটনাপ্রবাহের তার কিছুদিনের মাঝে তাকে ইরানে হেজবুল্লাহ’র প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। এই পদবী তাকে আবার ইরানে ফিরিয়ে নেয় এবং একইসাথে দূরেও সরিয়ে দেয়।
প্রাথমিকভাবে মনে হয়েছিল, হেজবুল্লাহ’র ওপর ইরানের প্রভাব কমে যাচ্ছে। তেহরানের ব্যাপক সমর্থন থাকা সত্ত্বেও, হেজবুল্লাহ’র সিদ্ধান্তগুলোকে প্রভাবিত করা চ্যালেঞ্জিং প্রমাণ হতে থাকলো।
উত্তেজনা এমন পর্যায়ে পৌঁছাল যে ১৯৯১ সালে সুভি আল-তুফায়ালিকে হেজবুল্লাহ’র সেক্রেটারি জেনারেলের পদ থেকে অপসারণ করা হয়েছিল। কারণ তিনি ইরানের সাথে হেজবুল্লাহর সংশ্লিষ্টতা বা সম্পর্কের বিরোধিতা করেছিলেন। তখন সুভি’র জায়গায় আব্বাস মোসাভিকে নিযুক্ত করা হয়।
তুফায়ালিকে সরিয়ে দেয়ার পর হাসান নাসরাল্লাহ দেশে ফিরে আসেন। তখন লেবাননে সিরিয়ার ভূমিকা নিয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হয়েছিলো। তিনি তখন পুরোপুরিভাবে হেজবুল্লাহ গ্রুপের ‘সেকেন্ড ইন কমান্ড’, অর্থাৎ দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি হয়ে গেলেন।
নাসরাল্লাহ’র নেতৃত্বে হেজবুল্লাহ
আব্বাস মোসাভি হেজবুল্লাহ’র সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার এক বছরেরও কম সময়ের মাঝে ইসরায়েলি এজেন্টদের হাতে নিহত হন। একই বছর, ১৯৯২ সালে, এই গ্রুপের নেতৃত্ব হাসান নাসরাল্লাহর কাঁধে এসে পড়ে।
সে সময় তার বয়স হয়েছিলো ৩২ বছর এবং অনেকে মনে করেছিলেন, তাকে গোষ্ঠীটির প্রধান হিসেবে নির্বাচিত করার কারণ হল, ইরানের সাথে তার বিশেষ সম্পর্ক। এমনকি, অনেক শিয়া আলেমদের দৃষ্টিকোণ থেকে তার পর্যাপ্ত ধর্মজ্ঞানেরও অভাব ছিলো। এইসব কারণে নাসরাল্লাহ পুনরায় তার পড়াশুনা শুরু করেছিলেন।
এদিকে, ক্ষমতা গ্রহণের পর হাসান নাসরাল্লাহর একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল লেবাননের নির্বাচনে ‘হেজবুল্লাহ’ সদস্যদের মনোনয়ন দেয়া। সৌদি আরবের মধ্যস্ততায় লেবাননের গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার একবছর পার হয়ে গেছে। তখন তিনি হেজবুল্লাহ’র সামরিক শাখার পাশাপাশি একটা রাজনৈতিক শাখা তৈরির সিদ্ধান্ত নিলেন।
ফলস্বরূপ, হেজবুল্লাহ প্রথমবারের মতো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে লেবাননের আটটি সংসদীয় আসন জিতে নেয়।
তখন বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা ও বাস্তবায়নের ব্যাপারে হেজবুল্লাহকে অভিযুক্ত করা হচ্ছিলো। আর্জেন্টিনার এএমআইএ ইহুদি কেন্দ্রে বোমা হামলা এবং আর্জেন্টিনায় ইসরায়েলি দূতাবাসে হামলা ঐ সময়ে ঘটেছিল।
এদিকে, লেবাননের গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটানো তাইফ চুক্তিতে হেজবুল্লাহকে অস্ত্র রাখার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। সে সময় ইসরায়েল দক্ষিণ লেবানন দখল করে নিয়েছিল এবং দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইকারী সংগঠন হিসেবে হেজবুল্লাহ সশস্ত্র বাহিনী ছিল। মূলত, সেই থেকেই তাদের সশস্ত্র থাকার বিষয়টি যৌক্তিকভাবে বৈধতা পেয়ে যায়।
ইরানের আর্থিক সহায়তায় নাসরাল্লাহ তখন লেবাননের শিয়া সম্প্রদায়ের জন্য অনেক স্কুল, কলেজ, দাতব্য সংস্থার মতো জনকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড করে। এই তাইফ চুক্তি আজ পর্যন্ত চলমান আছে। সময়ের সাথে সাথে এটি লেবাননের শিয়া সম্প্রদায়ের মুসলিমদের রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
ইসরায়েলের প্রত্যাহার এবং নাসরাল্লাহ’র জনপ্রিয়তা
২০০০ সালের দিকে ইসরায়েল ঘোষণা করে যে তারা লেবানন থেকে সম্পূর্ণভাবে সরে যাবে এবং দেশটির দক্ষিণাঞ্চলে দখলদারিত্বের অবসান ঘটাবে। হেজবুল্লাহ গোষ্ঠী এই ঘটনাকে একটি মহান বিজয় হিসেবে উদযাপন করেছিলো এবং তখন এই বিজয়ের সম্পূর্ণ কৃতিত্ব নাসরাল্লাহকে দেয়া হয়েছিলো।
এই প্রথম ইসরায়েল একতরফাভাবে কোনওপ্রকার শান্তি চুক্তি ছাড়াই একটা আরব দেশের ভূখণ্ড ত্যাগ করে। ঐ অঞ্চলের অনেক আরব নাগরিক এটিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হিসেবে মনে করেছিল।
যাই হোক, এই সময় থেকে হেজবুল্লাহর সশস্ত্র থাকার বিষয়টি লেবাননের নিরাপত্তা ও স্থায়িত্বের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে ওঠে। লেবানন থেকে ইসরায়েলের প্রত্যাহার হেজবুল্লার সশস্ত্র থাকার বৈধতাকে ন্যায়সঙ্গত করে তুলেছিল। প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল এবং বিদেশী শক্তি, উভয়ই গোষ্ঠীটির নিরস্ত্রীকরণের অনুরোধ করেছিল। কিন্তু এই অনুরোধে নাসরাল্লাহ কখনই সম্মত হননি।
পরবর্তীতে তিনি ইসরায়েলের সাথে একটি বন্দী বিনিময় চুক্তি করেছিলেন এবং চারশো’রও বেশি লেবানিজ, ফিলিস্তিনি ও অন্যান্য আরব দেশের নাগরিককে মুক্ত করেন।
এই সময়ে নাসরাল্লাহকে আগের চেয়েও শক্তিশালী ও প্রভাবশালী মনে হয়। তখন লেবাননের রাজনীতিতে তার প্রতিদ্বন্দ্বীরা তাকে মোকাবেলা করতে এবং তার প্রভাব ও ক্ষমতার সম্প্রসারণ রোধ করতে একটি গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিল।
হারিরি হত্যা ও সিরিয়া থেকে সেনা প্রত্যাহার
কিন্তু ২০০৫ সালে লেবাননের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রফিক হারিরিকে হত্যার পর জনমত পাল্টে যায়। রফিক হারিরিকে সৌদি আরবের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিবিদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যিনি হেজবুল্লাহর শক্তির উত্থান রোধে ব্যাপক প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন।
সিরিয়া ও লেবাননের ভেতরে জনরোষ গিয়ে পড়ে হেজবুল্লাহ গোষ্ঠী এবং এর প্রাথমিক সামরিক সমর্থক লেবাননে থাকা সিরিয়ার বাহিনীর ওপর। কারণ হারিরির হত্যার জন্য এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিলো। বৈরুতে বিরোধী দলের বিশাল বিক্ষোভের কারণে সিরিয়া ঘোষণা দেয় যে তারা দেশটি থেকে তাদের বাহিনী প্রত্যাহার করবে।
যদিও, ঐ বছর যখন সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল, তখন হেজবুল্লাহ’র ভোট কেবল বাড়ে নি, এই গোষ্ঠীটির দু’জন সদস্যকে লেবাননের সরকারের অন্তর্ভুক্ত করতে সমর্থ হয়। তাদের সংসদীয় আসন ব্যবহার করে তারা দু’টো মন্ত্রণালয়েরও দায়িত্ব গ্রহণ করে।
এখান থেকে নাসরাল্লাহ নিজেকে এবং তার বাহিনীকে লেবাননের প্রতি অনুগত জাতীয়তাবাদী সত্তা হিসেবে প্রমাণ করে, যারা দেশের জন্য প্রাণ দিতে সবসময় প্রস্তুত এবং কারো কাছে আত্মসমর্পণ করতে অনিচ্ছুক।
২০০৬ সালের গ্রীষ্মকালে হেজবুল্লাহ গোষ্ঠী ইসরায়েলে প্রবেশ করে একজন সৈন্যকে হত্যা করে এবং দুইজন সেনাকে জিম্মি করে নিয়ে আসে। এর প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েল টানা ৩৩ দিন ধরে লেবাননে ভয়ানক আক্রমণ চালায়, যাতে প্রায় ১২০০ লেবানিজ নিহত হয়।
এই যুদ্ধের ফলে নাসরাল্লাহ’র জনপ্রিয়তা আরও বেড়ে যায়। সেইসময় তাকে ইসরায়লের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো সর্বশেষ ব্যক্তি হিসেবে আরব দেশগুলোয় পরিচিত করে তোলে।
যুদ্ধ শেষে হেজবুল্লাহ তাদের অস্ত্র জমা দিতে অসম্মতি জানায়। সেইসাথে, এই দলটি যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট ধ্বংসাবশেষ পুনঃর্নির্মাণে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল। ইরানের ইসলামী প্রজাতন্ত্রের বিরোধীদের মতে, তেহরানের উদার আর্থিক সহায়তার কারণে এটি করা সম্ভব হয়েছিল।
ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং নাসরাল্লাহ’র সুদৃঢ় অবস্থান
হেজবুল্লাহর ক্ষমতাবৃদ্ধির সাথে সাথে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো, বিশেষ করে লেবাননের সুন্নি রাজনীতিবিদরা বলেছিলেন যে এই গোষ্ঠীটি একটি সরকারের মধ্যে আরেকটি সরকার গঠন করেছে। তাদের মতে, হেজবুল্লাহ’র কার্যকলাপ লেবাননের নিরাপত্তা এবং অর্থনীতিকে দুর্বল করে তুলতে পারে।
২০০৭ সালে কয়েক মাসের রাজনৈতিক সংঘাতের পর লেবানন সরকার সিদ্ধান্ত নেয় যে হেজবুল্লাহ দ্বারা নিয়ন্ত্রিৎ টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে ফেলা উচিৎ এবং টেলিকমিউনিকেশন সংক্রান্ত বিষয়াদি সম্পূর্ণভাবে সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা উচিৎ। কিন্তু নাসরাল্লাহ এই সিদ্ধান্ত শুধু প্রত্যাখ্যান-ই করেন নি, বরং খুব অল্প সময়ের মাঝে তার বাহিনী সম্পূর্ণ বৈরুতের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়।
নাসরাল্লাহ’র এই পদক্ষেপের ব্যাপারে তখন পশ্চিমা দেশগুলো ব্যাপক সমালোচনা করে। যদিও, রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনার পর তিনি লেবাননের মন্ত্রীসভায় হেজবুল্লাহর ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পেরেছিলেন। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, মন্ত্রীসভার কোনো সিদ্ধান্তে ভেটো দেয়ার বা না বলার অধিকার সুরক্ষিত করেছিলেন।
২০০৮ সালে, লেবাননের সংসদে হেজবুল্লাহর আসন কমে যাওয়া সত্ত্বেও, নাসরাল্লাহ ভেটো দেওয়ার অধিকার ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। সেই বছরই লেবাননের সংসদে হেজবুল্লাহ’র অস্ত্র রাখার বিষয়টি পাশ হয়।
সেই থেকে হাসান নাসরুল্লাহ এমন একজন ব্যক্তিত্বে পরিণত হন, যাকে লেবাননের রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের কেউই মাঠ থেকে সরাতে বা তার ক্ষমতা কেড়ে নিতে সফল হতে পারেনি।
তার বিরোধিতাকারী প্রধানমন্ত্রীদের পদত্যাগ থেকে শুরু করে সৌদি প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের নজিরবিহীন হস্তক্ষেপ, কিছুই নাসরাল্লাহকে পিছু হটাতে পায়ে নি। বরং, ইরানের সমর্থনে এত বছর ধরে আরব বসন্ত, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ এবং লেবাননে চলমান অর্থনৈতিক সংকটের মতো সমস্যাকে তিনি মোকাবিলা করছেন।
এখন তার বয়স ৬৩ বছর। তিনি এখন শুধুমাত্র লেবাননের অদ্বিতীয় রাজনৈতিক-সামরিক নেতাই নন, সেইসাথে তিনি অনেক দশকের সংগ্রামেরও সাক্ষী। তিনি এই অর্জনকে তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের দমন করতে এবং শিয়া ইসলামবাদের মতাদর্শগত ভিত্তি প্রচারের জন্য ব্যবহার করেন।