নির্বাচন নিয়ে পশ্চিমাদের প্রতিক্রিয়া কি শুধু বিবৃতিতেই সীমিত থাকবে?
ডেস্ক রিপোর্টঃ বাংলাদেশে সাতই জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভক্তি এখন অনেকটাই প্রকাশ্য। তবে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হয় তা নিয়ে কৌতূহল আছে জনমনে, এমন কী দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনেও।
যদিও বিশ্লেষকরা বলছেন যুক্তরাষ্ট্র-সহ পশ্চিমা দেশগুলোর পরবর্তী পদক্ষেপ বুঝতে আরো সময় লাগতে পারে। কারণ তারা তাদের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজির আলোকে এবং এইঅঞ্চলের সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন বলে মনে করছেন তারা।
বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন অবশ্য বলছেন নির্বাচনের আগের চেয়ে নির্বাচনের পরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া তার কাছে কিছুটা নমনীয় মনে হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলছেন বাংলাদেশ কোনও অনিশ্চয়তায় পড়তে পারে, এমন কোনও সিদ্ধান্ত আসার ইঙ্গিত যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে আছে বলে তার কাছে মনে হয় না।
প্রসঙ্গত, সাতই জানুয়ারির নির্বাচনের পরপর চীন, ভারত, রাশিয়া ও জাপান-সহ অনেকগুলো দেশ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য বলেছে বাংলাদেশের নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী হয়নি।
ফলে রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন বড় প্রশ্ন হল, ‘আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে’ না হওয়া নির্বাচনের ফল নিয়ে পশ্চিমারা নতুন কোনও পদক্ষেপ নেয় কি-না।
কিংবা নির্বাচন নিয়ে আনুষ্ঠানিক যে বিবৃতি এসেছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের দিক থেকে, তাতে অন্য কোনও ইঙ্গিত আছে কি না।
কারণ এর আগে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধাপ্রদানকারীদের বিরুদ্ধে ভিসা নীতি প্রয়োগের ঘোষণা দিয়ছিলো যুক্তরাষ্ট্র।
নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২২২টি আসন পেয়েছে। বিরোধী দল বিএনপি ও সমমনা দলগুলো এ নির্বাচন বর্জন করেছে। নির্বাচনে জয়ী এমপিরা বুধবার সংসদ ভবনে শপথ গ্রহণ করেছেন।
একই সঙ্গে শেখ হাসিনা আবারো শাসক দল আওয়ামী লীগের সংসদীয় নেতা নির্বাচিত হয়েছেন।
কী বলেছে পশ্চিমারা
সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলারের কার্যালয় থেকে ইস্যু করা বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জনগণ এবং তাদের গণতন্ত্র, শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি তাদের আকাঙ্ক্ষাকে সমর্থন করে।
সেই সাথে, বাংলাদেশের এই নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হয়নি বলে অন্য পর্যবেক্ষকদের প্রতিক্রিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্র একমত বলে জানানো হয় বিবৃতিতে। এছাড়া নির্বাচনে সব দল অংশগ্রহণ না করায় হতাশা প্রকাশ করা হয়।
এই হতাশা উঠে এসেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিক্রিয়াতেও। “স্বচ্ছ্বতা ও জবাবদিহিতার চেতনার ওপর ভিত্তি করে” নির্বাচনে যেসব অনিয়ম হয়েছে তার সময়োপযোগী ও পূর্ণাঙ্গ তদন্তের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি।
আর যুক্তরাজ্য বলেছে নির্বাচনে সব দল অংশ না নেওয়ায় বাংলাদেশের মানুষের হাতে ভোট দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিকল্প ছিল না।
নির্বাচনের আগে বিরোধী রাজনৈতিক দলের বহু সংখ্যক কর্মীর গ্রেফতার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মতো যুক্তরাজ্যও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
অন্য দিকে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান ভলকার টার্ক এক বিবৃতিতে বাংলাদেশে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতা, বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের গ্রেফতার এবং আটকাবস্থায় মৃত্যুর ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছেন।
তিনি প্রকৃত ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতন্ত্রে’র জন্য সরকারকে ‘গতিপথ পরিবর্তন করার’ও আহবান জানিয়েছেন।
দ্রুত প্রতিক্রিয়া চীন, রাশিয়া ও ভারতের
নির্বাচনের পর শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়ে দ্রুততার সাথে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলো চীন, রাশিয়া ও ভারত।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ফোনে শেখ হাসিনার সাথে কথাও বলেছেন।
এছাড়া জাপান, সৌদি আরব-সহ আরও অনেক দেশের রাষ্ট্রদূত ঢাকায় সশরীরে গিয়ে শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাৎ করে অভিনন্দন জানিয়েছেন।
শুভেচ্ছা জানিয়ে বার্তা এসেছে কমনওয়েলথ মহাসচিবের দিক থেকেও।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিভক্তির ধারাবাহিকতা
বাংলাদেশের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের পরিবর্তনের প্রকাশ শুরু হয়েছিলো ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে।
তবে নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র-সহ পশ্চিমারা মূলত শক্ত অবস্থান নিতে শুরু করে গত বছরের মে মাস থেকে, যার বহি:প্রকাশ ঘটে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ জাতীয় নির্বাচনের স্বার্থে এক নতুন ভিসা নীতির কথা ঘোষণা করেন।
তবে এর আগেই বাংলাদেশকে নিয়ে বিবৃতি ও পাল্টা বিবৃতি শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে। শেখ হাসিনার সরকারকে প্রকাশ্যে সমর্থন জানায় চীন।
শেষ দিকে এসে দিল্লিতে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যকার টু প্লাস টু বৈঠকের পর ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে জানায় নির্বাচনটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। ভারতের এমন অবস্থান তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বিরোধী দল বিএনপি।
অন্যদিকে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো সরকারের সমালোচনায় মূখর হয়ে ওঠে এবং একটি ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের’ জন্য পশ্চিমারা সরকারের ওপর চাপ বাড়াতে থাকে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলছেন “আগের বিভক্তিটাই নির্বাচনের পরেও দেখা যাচ্ছে। এখন বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নিয়ে তাদের অবস্থান প্রকাশ করছে। হয়তো সরকার গঠন কার্যক্রম সম্পন্ন হলে তাদের অবস্থান আরও পরিষ্কার হবে।”
তৌহিদ হোসেনও মনে করেন, ‘জাপান ছাড়া’ বাকি দেশগুলো যে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে সেটাই স্বাভাবিক। তার কথায়, “ভারত, চীন বা রাশিয়া আগের মতোই বলছে এবং এটাই স্বাভাবিক। আর মধ্যপ্রাচ্য কখনো নির্বাচন নিয়ে মাথা ঘামায় না। অর্থাৎ আগের পরিস্থিতিই আছে।”
বিশ্লেষকরা বলছেন এখন পর্যন্ত যেসব দেশ নির্বাচন নিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে তারা নিজেদের স্বার্থেই যার যার অবস্থান প্রকাশ করেছেন।
যদিও যুক্তরাষ্ট্র-সহ পশ্চিমাদের দিক থেকে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ার ধারাবাহিকতায় নতুন কোন সিদ্ধান্ত আসবে কি না, তা নিয়ে কৌতূহল আছে।
অনেকে মনে করেন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রভাবশালী সিভিল সোসাইটি গোষ্ঠী – যেমন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল কিংবা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো সংগঠনগুলো ছাড়াও বৈশ্বিক গণমাধ্যমগুলো বাংলাদেশের নতুন সরকারকে ঘিরে কী ধরনের অবস্থান নেয় সেটিও মার্কিন প্রশাসনকে প্রভাবিত করতে পারে।
“বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক চরিত্র প্রশ্নের মুখে পড়ছে-এমন আলোচনা গ্লোবাল মিডিয়া করছে। এ নির্বাচনকে তারা কীভাবে ব্যাখ্যা করবে তার উপরও আন্তর্জাতিক জনমত কোনদিকে যাবে তা নির্ভর করবে। এগুলো থেকে বোঝা যাবে সামনের দিনগুলো কেমন যাবে”, বলছিলেন মি. কবির।
পশ্চিমাদের বার্তায় অন্য কোনও ইঙ্গিত?
বাংলাদেশের সঙ্গে একটি “অবাধ ও মুক্ত ভারত -প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল গঠন, মানবাধিকার ও বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখতে” যুক্তরাষ্ট্র আগ্রহী বলে নির্বাচন নিয়ে দেওয়া তাদের বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র কিছুটা হলেও ইঙ্গিত দিয়েছে যে ইন্দো প্যাসিফিক অংশীদারিত্বের ক্ষেত্রে তারা বাংলাদেশকে নিয়ে কাজ করতে চায়।
হুমায়ুন কবির বলছেন ওই বিবৃতিতে আর কোনও ব্যবস্থা নেয়ার ইঙ্গিত না থাকলেও তারা হয়তো এখন পরিস্থিতি পর্যালোচনা করছে।
“তাদের বিবেচনায় যদি মনে হয় কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নির্বাচন প্রক্রিয়ার বিপক্ষে কাজ করেছে তাহলে সে দিকে তারা যেতে পারে,” বলছিলেন তিনি।
আর তৌহিদ হোসেন বলছেন নির্বাচনের পর যুক্তরাষ্ট্র যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে সেটি তাদের আগের অবস্থানের তুলনায় নমনীয় মনে হয়েছে তার কাছে।
পাশাপাশি তিনি এ কথাও বলছেন, “কিন্তু আমাদের আরও প্রায় ছয় মাস দেখতে হবে যে যুক্তরাষ্ট্র কোন দিকে আগায়।”
“বাংলাদেশের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আরও কোন ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে আসলে কোনও পরিবর্তন ঘটে থাকলে সেটা টু প্লাস টুর সময়েই ঘটেছে। কিন্তু তখনি বোঝা গেছে দুই পক্ষর (ভারত ও আমেরিকার) স্বার্থ এক হচ্ছে না।”
“আমেরিকার প্রতিক্রিয়া আগের তুলনায় নমনীয় মনে হচ্ছে। কিন্তু আমাদের আরও প্রায় ৬ মাস দেখতে হবে যে যুক্তরাষ্ট্র কোন দিকে আগায়”, বলেছিলেন তৌহিদ হোসেন।
আঞ্চলিক পরিস্থিতি ও ভারত
দক্ষিণ এশিয়ার তিনটি দেশ এখন রাজনৈতিক ভাবে অস্থির অবস্থা পার করছে। এগুলো হলো পাকিস্তান, শ্রীলংকা ও মালদ্বীপ। আবার ভারতেও সামনে নির্বাচন।
অনেকে মনে করেন আঞ্চলিক কারণেই নতুন করে বাংলাদেশে কোনও অস্থির পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে এমন কোন পদক্ষেপ পশ্চিমাদের দিক থেকে নাও আসতে পারে।
যদিও বাংলাদেশের নির্বাচন ইস্যুতে ভারতের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের পার্থক্য যুক্তরাষ্ট্র নিজেও তুলে ধরেছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন এ কারণেই গত দু বছর বাংলাদেশ নিয়ে আলাদা তৎপরতা দেখিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কও বহুমাত্রিকতা পেয়েছে নানাভাবে।
“বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক এমন পর্যায়ে আছে সেখানে ভারতের ভূমিকা খুব একটা কাজে আসবে না। তবে যুক্তরাষ্ট্র এমন কোনও সিদ্ধান্ত হয়তো নেবে না যাতে নতুন অনিশ্চয়তা তৈরি হতে পারে।”
“আর মনে রাখতে হবে যুক্তরাষ্ট্র যখন সিদ্ধান্ত নেয় তখন শুধু বাংলাদেশ না, পুরো ইন্দো প্যাসিফিক কৌশলসহ এ অঞ্চলের অবস্থা পর্যালোচনা করেই সিদ্ধান্ত নেয়”, বিবিসিকে বলছিলেন মি. কবির।
তৌহিদ হোসেন বলেন দিল্লিতে টু প্লাস টু বৈঠকের সময়েই পরিষ্কার হয়ে গেছে যে বাংলাদেশের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের স্বার্থ এক হচ্ছে না।
“এখন শুধু ভিসা নিষেধাজ্ঞা আসলে তাতে সরকারের কোনও সমস্যা হবে না। এই চ্যালেঞ্জ সরকার মোকাবেলা করতে পারবে”, বলছিলেন তিনি।
তবে তার মতে পশ্চিমাদের সঙ্গে বৈরি সম্পর্ক তৈরির সুযোগ নেই। “বাংলাদেশ তা এফোর্ড করতে পারি না, কারণ সেটিই আমাদের বাজার!”
“যদিও তেমন কোনও ইঙ্গিত নাই যে সেখানে হাত আসবে। তারপরেও সরকারকে সতর্ক থেকে সেই বাজার ঠিক রাখতে হবে”, বলছিলেন মি. হোসেন।