ড. ইউনূসের সমর্থনে ঢাকায় আসতে চান আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা
ডেস্ক রিপোর্টঃ বাংলাদেশে নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসকে অযথা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে কি না আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা তা চাইলে এসে দেখে যেতে পারেন, মাসকয়েক আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া এই ‘আমন্ত্রণ’ গ্রহণ করে বাংলাদেশে প্রতিনিধিদল পাঠানোর কথা জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক স্তরে সুপরিচিত বেশ কয়েকজন ব্যক্তিত্ব ও নোবেল পুরস্কার বিজেতা।
গত ২৮ জানুয়ারি (রোববার) প্রধানমন্ত্রী হাসিনাকে একটি খোলা চিঠি লিখে এই সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়েছে। চিঠিটিতে সই করেছেন ১২৫জন নোবেলজয়ী-সহ মোট ২৪২জন বিখ্যাত আন্তর্জাতিক ব্যক্তি।
এর আগেও বাংলাদেশে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলার রায়ের মাধ্যমে ও দুর্নীতি দমন কমিশনের করা মামলায় ‘বিচারিক হয়রানি’ হচ্ছে বলে দাবি করে একাধিকবার সরকারকে চিঠি দিয়েছেন নোবেল বিজয়ী-সহ বিশ্ব নেতারা।
এই পটভূমিতেই গত বছরের অগাস্ট মাসের শেষ দিকে দেশটির প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই সব মামলা অন্যায়ভাবে করা হয়েছে কি না বা অধ্যাপক ইউনূসের প্রতি কোনও অবিচার হয়েছে কি না, তা দেখার জন্য বিশেষজ্ঞ বা আইনজীবী পাঠাতে তাদের ‘আমন্ত্রণ’ জানান। আমন্ত্রণের আকারে পেশ করা হলেও সেটি ছিল কার্যত সরকারের ছুড়ে দেওয়া একটি চ্যালেঞ্জ।
এরপর ২৮শে জানুয়ারির ওই চিঠিতে সেই ‘আমন্ত্রণ’ গ্রহণ করার কথা বলা হয় এবং পরদিন protectyunus.wordpress.com নামে একটি ওয়েবসাইটে সেই চিঠিটি প্রকাশ করা হয়।
এই চিঠিতে আরো বলা হয়েছে, “এই পর্যবেক্ষণ শুধুমাত্র গত পহেলা জানুয়ারি শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলায় দেওয়া রায়েই নয় বরং দুর্নীতি দমন কমিশন পরিচালিত চলমান তদন্তেও করা হবে।”
এই খোলা চিঠির বক্তব্য অনুযায়ী, “পর্যবেক্ষণ পরিচালনার জন্য আমরা একজন সিনিয়র আন্তর্জাতিক আইনজীবীর পরিচালনায় স্বাধীন আইনজীবী বিশেষজ্ঞদের একটা ছোট্ট দলের প্রস্তাব করছি।”
যা বলছেন বাংলাদেশের আইনজীবীরা
অধ্যাপক ড. ইউনূসের আইনজীবী ড. আব্দুল্লাহ আল মামুন বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আন্তর্জাতিক আইনজীবীদের এই রিভিউয়ের সিদ্ধান্ত সরকার আমন্ত্রণ জানানোর পরই এসেছে। এখন সরকারের অনুমতির উপর এটা নির্ভর করছে।”
মি. আল মামুন বলেন, “কোনও বিদেশি আইনজীবী আদালতে মুভ করতে পারবেন কি না এটা বার কাউন্সিলের এখতিয়ার। পারমিশন দেবে তারা, কোর্ট না।”
“সরকারের সর্বময় ক্ষমতা রয়েছে, তারা যদি সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে বিদেশি আইনজীবীরা আদালতেও শুনানি করতে পারবে। সরকার এলাউ না করলে হবে না”, জানান তিনি।
তবে এ বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেছেন বাংলাদেশের প্রধান আইন কর্মকর্তা এ এম আমিন উদ্দিন।
তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আদালতের যে কোনও নথি বা রায় পাবলিক ডকুমেন্ট। মামলায় কেউ পক্ষ থাকলে নিয়মানুযায়ী সে রায়ের সার্টিফায়েড কপি পায়। এছাড়া অন্য যে কেউ পক্ষ না থাকলে আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে সার্টিফায়েড কপি তুলতে পারবে।”
“এছাড়া যে কোনও আইনজীবী বা এক্সপার্টের সাথে সে মামলার বিভিন্ন বিষয় বা পরিচালনা নিয়ে কথা বলতে পারবেন সেই অধিকার তাদের আছে।”
তবে বাংলাদেশের বার কাউন্সিলের নিয়ম অনুযায়ী, যারা সংগঠনটির সদস্য তারাই শুধু আদালতে মামলার শুনানি করতে পারে।
এই বিষয়টি উল্লেখ করলে অ্যাটর্নি জেনারেলও বলেন, “বার কাউন্সিলের সদস্যরাই শুধু কোর্টে শুনানি করতে পারবেন”।
তবে, পর্যালোচনা বা আলোচনার জন্য মামলা স্থগিত করা যাবে না বলে মন্তব্য করেছেন মি. উদ্দিন। তিনি জানান, “বাংলাদেশের ফৌজদারি কার্যবিধিতে মামলা স্থগিতের এ ধরনের কোনও বিধান নেই”।
বাংলাদেশের ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিকও ‘কোনও বিদেশি লইয়ার বাংলাদেশের আদালতে শুনানি করতে পারবেন না’ – এই বক্তব্যটুকুর সাথে একমত।
তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং তাদের মামলা দেখার আহবান জানিয়েছেন। তাই আমি আশা করবো তারা যেহেতু আহবানে সাড়া দিয়েছে, তাদের যেন দেশে আসার সুযোগ দেওয়া হয়।”
“তাদের যেন ভিসা দেওয়া হয় ও তারা যেন নথিপত্র দেখতে পারেন সেই সুযোগ করে দেওয়া হয়, এটাই এখন স্বাভাবিক প্রত্যাশা”, বলেন মি. মালিক।
একই সাথে পাবলিক ডকুমেন্ট হিসেবে আদালতের নথিপত্র পর্যালোচনা বা ড. ইউনূসের আইনজীবী প্যানেলকে সহায়তার অধিকার তাদের রয়েছে বলে জানান এই আইনজীবী।
যা রয়েছে সর্বশেষ চিঠিতে
বিশ্বের ১২৫ জন নোবেল বিজয়ীসহ ২৪২ জন বিশ্বনেতা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এই খোলা চিঠি লিখেছেন।
এতে নোবেলজয়ীদের মধ্যে রয়েছেন বারাক ওবামা, জোসে রামোস হোর্তে, ম্যারিড করিগান মেগুয়ার, অস্কার অ্যারিয়াস স্যাঞ্চেজ, কার্লোস ফিলিপ জিমেনিস বিলো, জোডি উইলিয়ামস, শিরিন এবাদী, মোহাম্মদ আল বারাদী, ওয়াল্টার গিলবার্ট-সহ আরও অনেকেই।
চিঠিটিতে বলা হয়েছে, “নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে করা মামলায় ধারাবাহিক হয়রানি এবং সম্ভাব্য জেলে যাওয়ার বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে (আমরা) লিখছি।”
“জাতিসংঘের স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ার আইরিন খানের সাথে আমরা একমত। যিনি এ বছরের পহেলা জানুয়ারি রায়ের দিন আদালত থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে এই রায়কে ‘বিচারের নামে প্রহসন’ বলে মন্তব্য করেছিলেন।”
চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, “আমরা এই দ্রুত আইনি প্রক্রিয়া এবং বাংলাদেশে আইন কীভাবে প্রয়োগ করা হয় সে বিষয়ে ধারাবাহিকতার অভাবের বিষয়টিকে ঘিরে উদ্বিগ্ন।”
“ফৌজদারি মামলার রায়ে অলাভজনক সংস্থা গ্রামীণ টেলিকমের ৮৩ বছর বয়সী অবৈতনিক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ইউনূস-সহ প্রতিষ্ঠানটির বোর্ডের চারজন সদস্যের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এটা স্পষ্ট যে প্রাসঙ্গিক আইনে গ্রামীণ টেলিকমকে কেবল অল্প দেওয়ানি বা প্রশাসনিক জরিমানা করা যেত।”
চিঠিতে এ বছর ৭ই জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, “বিরোধী দলীয় নেতাদের দমন ও কারাগারে প্রেরণ এবং মিডিয়া ও স্বাধীন কণ্ঠস্বরকে দমন করা হয়েছে। বাংলাদেশ এবং দেশের বাইরে অনেক মানবাধিকার কর্মী এবং গনতন্ত্রপন্থী গ্রুপ এই বিষয়গুলো নথিবদ্ধ করেছে।”
এই বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, “এর আগে ড. ইউনূসের প্রতি চলমান হয়রানি বন্ধে ১৯০ জন বিশ্বনেতার আরেকটি চিঠির প্রত্যুত্তরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছরের আগস্ট মাসের শেষের দিকে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “বিশেষজ্ঞ পাঠান, আইনজীবীরা এসে দেখে যাক এখানে কোনও অবিচার হয়েছে কি না অথবা মামলাটি অন্যায়ভাবে করা হয়েছিলো কি না।”
প্রধানমন্ত্রীর সেই ‘আমন্ত্রণ’ই গ্রহণ করা হল বলে ওই খোলা চিঠিতে জানানো হয়েছে।
এতে আরো বলা হয়েছে, “এই পর্যবেক্ষণ শুধুমাত্র গত পহেলা জানুয়ারি শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলায় দেওয়া রায়েই নয়, বরং দুর্নীতি দমন কমিশন পরিচালিত চলমান তদন্তেও করা হবে।”
“পর্যবেক্ষণ পরিচালনার জন্য আমরা একজন সিনিয়র আন্তর্জাতিক আইনজীবীর পরিচালনায় স্বাধীন আইনজীবী বিশেষজ্ঞদের একটা ছোট্ট দলের প্রস্তাব করছি।”
“আমরা খুব শিগগিরই (এই প্রক্রিয়া) শুরু করব” বলে জানিয়ে ড. ইউনূস ও তার সহকর্মীদের বিরুদ্ধে দেওয়া যে কোনও কারাদণ্ড এই পর্যবেক্ষণ পর্যন্ত স্থগিত রাখারও অনুরোধ করেছেন বিশ্বনেতারা।
তবে, এরই মধ্যে ড. ইউনূসের কারাদণ্ড স্থগিত করে তাকে স্থায়ী জামিন দিয়েছে বাংলাদেশের ঢাকার শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল।
অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিভিন্ন অর্জনের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে ওই চিঠিটিতে।
বলা হয়েছে, “এ সমস্ত কারণে তার নিজের সরকার তার সাথে কীভাবে আচরণ করছে তার ওপর সব জায়গার নেতা ও নাগরিকরা গভীরভাবে নজর রাখছেন। অধ্যাপক ইউনূস ও তার সহকর্মীদের কারাদণ্ডের মুখোমুখি হওয়া উচিত নয়।”
চিঠিতে বাংলাদেশকে অবিলম্বে ‘ন্যায় বিচারের নামে এই প্রহসনে’র অবসান ঘটিয়ে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের আন্তর্জাতিক চুক্তিসহ মানবাধিকারের বাধ্যবাধকতা সমুন্নত রাখারও আহবান জানানো হয়।
এর আগে গত ২২শে জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের বারোজন সেনেটর অধ্যাপক ইউনূসের হয়রানি বন্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর খোলা চিঠি লেখেন।
গত বছরের মার্চে ও অগাস্টেও অধ্যাপক ড. ইউনূসের ‘হয়রানি’ বন্ধ করতে প্রধানমন্ত্রী হাসিনাকে উদ্দেশ্য করে চিঠি লেখা হয়েছিলো।
শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলায় সাজা
শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে বাংলাদেশের কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তরের করা একটি মামলায় গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস-সহ চারজনকে গত পহেলা জানুয়ারি ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়।
ঢাকার একটি শ্রম আদালত এ সাজা ঘোষণা করে। এছাড়া এ মামলায় প্রত্যেককে পাঁচ হাজার টাকা করে জরিমানাও করা হয়েছে।
মামলার আরেকটি ধারায় তাদের ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। ওই দিন আদালত কক্ষে দেশি-বিদেশি বহু মানবাধিকার কর্মী রায় পর্যবেক্ষণ করতে উপস্থিত ছিলেন।
তবে, সাজা ঘোষণার সাথে সাথেই তার আইনজীবী জামিনের আবেদন করলে তা মঞ্জুর করে আদালত। ফলে কারাগারে যেতে হয়নি মুহাম্মদ ইউনূসকে।
এরই মধ্যে গত ২৮শে জানুয়ারি ঢাকার শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে স্থায়ী জামিন চান অধ্যাপক ইউনূস। শুনানি নিয়ে ট্রাইব্যুনাল তাকে স্থায়ী জামিন দেয়।
এছাড়া, গতকাল সোমবার দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদক গ্রামীণ টেলিকমের কর্মীদের লভ্যাংশের ২৫ কোটি ২২ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ড. ইউনূসসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র অনুমোদন দিয়েছে।
এই অভিযোগপত্রে প্রতিষ্ঠানটির অন্য কর্মকর্তারাও রয়েছেন। গত বছরের ৩০শে মে দুদক এই মামলাটি করেছিল।
এছাড়া ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে ঢাকার শ্রম আদালতে শ্রমিকদের করা আরো ১৮টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। গত বছর এসব মামলা যেদিন হয় সেদিনও মামলা স্থগিত চেয়ে বিশ্বের ১৬০ জন্য বিশিষ্ট ব্যক্তি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে খোলা চিঠি লেখেন।