বাংলাদেশি জাহাজটির অবস্থান বারবার বদল করছে জলদস্যুরা
তেইশ নাবিকসহ ভারত মহাসাগরে ছিনতাইয়ের শিকার হওয়া বাংলাদেশি জাহাজটির অবস্থান বারবার বদল করছে জলদস্যুরা।
গত মঙ্গলবার জলদস্যুরা জাহাজটির দখল নেয়ার পর নোঙ্গর করার পরও অন্তত তিনবার স্থান বদলেছে এমভি আব্দুল্লাহ। জলদস্যুরা বর্তমানে জাহাজটিকে সরিয়ে সোমালিয়ার গদবজিরান উপকূলে নোঙ্গর করেছে।
জাহাজটির মালিকপক্ষ ধারণা করছে,জলদস্যুদের যে গ্রুপটি জাহাজটি ছিনতাই করেছে তারা হয়তো ছোট একটি গ্রুপ। তারা কিছু টাকা পয়সার বিনিময়ে এটি বড় গ্রুপের কাছে হস্তান্তর করবে। সেই গ্রুপই মুক্তিপণ নিয়ে দেন দরবার করবে।
হয়তো এ কারণেই জলদস্যুদের পক্ষ থেকে যোগাযোগে দেরি হচ্ছে বলে তারা ধারণা করছেন।
মালিকপক্ষ কেএসআরএম গ্রুপের মিডিয়া অ্যাডভাইজার মিজানুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেন, “এই জলদস্যুরা মূল প্লেয়ার না। মূল প্লেয়ার শুটেট বুটেড। ওরা অফিস নিয়ে বসে আছে কোন না কোন জায়গায়। তারাই হয়তো আমাদের সাথে যোগাযোগ করবে”।
জাহাজটি জলদস্যুদের কবলে পড়ার পর থেকে স্যাটেলাইট ইমেজ ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে এটির সর্বশেষ অবস্থান সম্পর্কে খোজ খবর রাখছে বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএমওএ)।
সংগঠনটির সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী শনিবার বিবিসি বাংলাকে বলেন, “বৃহস্পতিবার জাহাজটি যেখানে নোঙর করা ছিল, সেখান থেকে আজ ৪৫-৫০ নটিক্যাল মাইল উত্তর দিকে সরিয়ে নেয়া হয় শুক্রবার। বর্তমানে জাহাজটির অবস্থান সোমালিয়ার গদবজিরান শহর থেকে ৪ নটিক্যাল মাইল দূরে।”
এদিকে, ঐ জাহাজটিতে থাকা সশস্ত্র জলদস্যুদের একটি ছবি প্রকাশ করেছে ভারতীয় নৌবাহিনী। ভারতীয় নৌবাহিনীর এক্স অ্যাকাউন্টে (সাবেক টুইটার) চার জলদস্যুর সশস্ত্র অবস্থানের ঐ ছবি প্রকাশ করা হয়।
শুক্রবার সন্ধার পর জিম্মি নাবিকদের সাথে পরিবারের আর কোন যোগাযোগ হয় নি বলে তাদের পরিবারে সদস্যরা জানিয়েছেন।
জাহাজটিতে জিম্মি চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ খানের ছোট ভাই মোহাম্মদ আসিফ খান শনিবার বিবিসি বাংলাকে বলেন, “শুক্রবার সন্ধ্যায় জাহাজে থাকা স্যাটেলাইট ফোন দিয়ে কল করেছিলো ভাইয়া। তখন দেড় মিনিটের মতো কথা হয়েছে। এরপর আর আমরা তার সাথে যোগাযোগ করতে পারি নি”।
বার বার অবস্থান বদলাচ্ছে আব্দুল্লাহ
আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিক থেকে ৫৫ হাজার টন কয়লা নিয়ে আরব আমিরাত যাওয়ার পথে গত ১২ই মার্চ ভারত মহাসাগরের সোমালি জলদস্যুদের কবলে পড়ে এমভি আবদুল্লাহ। জলদস্যুরা জাহাজটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ২৩ নাবিকের সবাইকে জিম্মি করে।
দু’দিন পর জাহাজটিকে নিয়ে যাওয়া হয় সোমালিয়া উপকূলে। সেখানে একদিন অবস্থান করেছিলো জাহাজটি। পরে বৃহস্পতিবার দুপুরে আবার জাহাজটিকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
এমভি আবদুল্লাহ’কে বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে গ্যারাকাড উপকূলে নোঙর করা হয়েছিল। পরে সেখানে আরেকটা সশস্ত্র গ্রুপের হাতে তাদেরকে সোপর্দ করা হয়। এখন সেখান থেকে নাবিকসহ জাহাজটিকে অন্যদিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
শুক্রবার আরেক দফা স্থান পরিবর্তনের পর বর্তমানে জাহাজটি সোমালিয়ার গদবজিরান শহর থেকে ৪ নটিক্যাল মাইল দূরে অবস্থান করছে জাহাজটি।
বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএমওএ) স্যাটেলাইট ইমেজ ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে জাহাজটির সর্বশেন অবস্থান পর্যবক্ষেণ করছে গত মঙ্গলবার থেকে।
জাহাজটির এই গতিপথ ও অবস্থান দেখে বিএমএমওএ বলছে, জাহাজটি জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার পর প্রথমেই তারা বাংলাদেশি পতাবাহী জাহাজটিকে দেড় দিনের মাথায় সোমালিয়া উপকূলের কাছাকাছি নিয়ে।
জলদস্যুদের কবলে পড়ার পরদিন বুধবার এটি ছিলো সোমালিয়ার রাজধানী মোগাদিসু উপকূলের কাছাকাছি অবস্থানে। পরবর্তীতে সেটিকে আরো উত্তর দিকে সরিয়ে প্রথমে নেয়া হয় গারদাকে। এরপরই ভারতীয় নৌবাহিনী জাহাজটি ঘিরে নজরদারি বাড়ালে সেটি আবারো সরিয়ে নেয়া হয় গদজিরান উপকূলে।
বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএমওএ) সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলেন, “চারদিকে নেভাল সার্ভিলেন্স বাড়িয়ে দেয়ার কথা তারা শুনেছে। এ কারণে তারাও তাদের ক্ষমতা প্রদর্শন করছে এবং একেবার জাহাজের স্থান পরিবর্তন করে ফেলছে”।
জলদস্যুদের ছবি প্রকাশ করেছে ভারতীয় নৌবাহিনী
এমভি আব্দুল্লাহ জলদস্যুদের কবলে পড়ার পর থেকে এবং এরপর সোমালিয়া উপকূলে প্রবেশের আগ পর্যন্ত কাছাকাছি দূরত্বে থেকে অনুসরণ করছিলো ভারতীয় নৌবাহিনীর একটি যুদ্ধ জাহাজ।
এই তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স (সাবেক টুইটারে) প্রকাশ করে ভারতীয় নৌবাহিনী।
শুক্রবার বিকেল সাড়ে চারটায় ভারতীয় নৌবাহিনীর মুখপাত্র এক্স একাউন্ট থেকে যে ছবিটি প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে এমভি আব্দুল্লাহ জাহাজে চারজন অস্ত্রসহ টহল দিচ্ছে। তাদের সবার অবস্থাই ছিলো জাহাজের মাস্টার কেবিনের ছাদে।
টুইটারের এই পোস্টে ভারতীয় নৌবাহিনী জানায়, গত ১২ মার্চ এমভি আব্দুল্লাহ থেকে সাহায্যের সিগন্যাল পেয়ে তারা একটি মেরিটাইম পেট্রোল এয়ারক্র্যাফ্ট-এলআরএমপি পাঠিয়েছিলো। কিন্তু ভারতীয় বিমানটি পরে আর এমভি আব্দুল্লাহর সাথে কোন ধরনের যোগাযোগ করতে পারেনি।
তারা জানায় পরবর্তীতে ভারতীয় নৌবাহিনী একটি যুদ্ধ জাহাজ মোতায়েন করে। যেটি ভারত মহাসাগরের সামুদ্রিক নিরাপত্তায় কাজ করছে। গত বৃহস্পতিবার থেকে এই জাহাজটি এমভি আব্দুল্লাহকে নজরদারি শুরু করেছে।
ভারতীয় নৌবাহিনীর ওই পোস্টে আরো বলা হয়েছে সশস্ত্র জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাণিজ্যিক জাহাজের ক্রুদের নিরাপত্তায় খেয়াল রাখছে তারা। জাহাজটি সোমালিয়া জলসীমায় পৌঁছানো পর্যন্ত ভারতীয় নৌবাহিনী নিরাপত্তা নিশ্চিতের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে বলেও জানানো হয় ওই পোস্টের মাধ্যমে।
বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ওরা লং রেঞ্জ সার্ভিলেন্সের জন্য হেলিকপ্টার পাঠিয়ে ছবিটি নিয়েছে। কোন দেশের জলসীমায় এ ধরনের ঘটনা ঘটলে সে দেশের নৌবাহিনী এসেসমেন্টের জন্য ফ্লাইট পাঠিয়ে এমন ছবি নিয়ে থাকে”।
ভারতীয় নৌবাহিনীর এই ছবি দেখে নিজেদের জাহাজ বলে নিশ্চিত করেছেন মালিক প্রতিষ্ঠান কেএসআরএম গ্রুপ।
শনিবার কেএসআরএম গ্রুপের মিডিয়া অ্যাডভাইজর মিজানুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ভারতীয় নৌবাহিনী তাদের টুইটার একাউন্টে যে ছবি প্রকাশ করেছে সেটি আমাদের এমভি আব্দুল্লাহ জাহাজের ছবি”।
অপারেশন আটলান্টার তথ্য
শুধু ভারতীয় নৌবাহিনী নয়, জলদস্যুদের হাতে জিম্মি জাহাজটিতে নজর রাখছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন নেভাল ফোর্স- ইইউএনএভিএফওআর। জাহাজটি দস্যুদের কবলে পড়ার দুই দিন পর গত বৃহস্পতিবার এ নিয়ে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে সংস্থাটি।
এই বিজ্ঞপ্তিতে তারা হেলিকপ্টার দিয়ে জাহাজটি পর্যবেক্ষণের একটি ছবিও প্রকাশ করেছে। যেখানে বলা হয়, এমভি আব্দুল্লাহকে পর্যবেক্ষণে রেখেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন নেভাল ফোর্স।
সমুদ্রে জলদস্যুতা এবং সশস্ত্র ডাকাতি দমনে প্রয়োজনীয় পদ্ধতি’ ব্যবহার করে ইউএস-নেতৃত্বাধীন টাস্ক ফোর্স ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের যে যৌথ কার্যক্রম রয়েছে, তার নাম অপারেশন আটলান্টা।
অপারেশন আটলান্টা থেকে বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবব্দুলাহর ওপর নজর রাখা হচ্ছে বলে সংস্থাটি এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে।
এতে বলা হয়, সামুদ্রিক নিরাপত্তায় সবচেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে বাংলাদেশ ও সোমালিয়া এই অঞ্চলের অংশীদারদের সাথে যোগাযোগ করছে।
এতে জানানো হয়েছে, ছিনতাই হওয়া জাহাজের নাবিকেরা এখন পর্যন্ত সুস্থ আছে।
প্রাথমিকভাবে জাহাজটি ছিনতাই হওয়ার সময় ২০ জন জলদস্যু থাকলেও এখন ১২ জন জলদস্যু থাকার বিষয়টি তারা বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নিশ্চিত করেছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সোমালি উপকূলের উত্তর, দক্ষিণ ও মধ্য অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় জলদস্যুরা সাধারণত তিনটি ক্যাম্প ব্যবহার করে। এই ক্যাম্পগুলো ঘিরেই চলে তাদের ছিনতাই কার্যক্রম। ঠিক এই অঞ্চলে ‘এমভি রুয়েন’ নামের আরেকটি জাহাজও ছিনতাই করে জলদস্যুরা। ওই দলের সদস্যরাই ‘এমভি আবদুল্লাহ’র ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে বলে ওই বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
এই বিজ্ঞপ্তিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন নেভাল ফোর্স জানিয়েছে এমভি আব্দুল্লাহর ওপর নজর রাখতে ইইউ’র একটি জাহাজ মোতায়েন করা হয়েছে।
জলদস্যুদের ফোনের অপেক্ষায় মালিকপক্ষ
গত মঙ্গলবার ভারত মহাসাগরে সোমালি জলদস্যুরে হাতে ছিনতাইয়ের শিকার হওয়ার পর কয়েক দফায় স্থান পরিবর্তন করে এমভি আব্দুল্লাহ জাহাজটি। প্রায় ২৪ ঘণ্টা ধরে সোমালিয়ার গদবজিরান উপকূলে নোঙ্গর করে আছে জাহাজটি।
এর আগে দফায় দফায় স্থান পরিবর্তন করলেও জলদস্যুদের পক্ষ থেকে কোন ধরনের মুক্তিপণ দাবি করা হয় নি।
সর্বশেষ গত শুক্রবার সন্ধ্যায় জাহাজের নাবিকদের তাদের পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলতে দেয়া হয় খুব অল্প সময়ের জন্য। এসময় তারা শারীরিকভাবে সুস্থ থাকার কথা জানিয়েছে।
জাহাজে থাকা চীফ অফিসার আতিকুল্লাহ খানের ছোট ভাই মোহাম্মদ আসিফ খানের সাথে সর্বশেষ শুক্রবার তার ভাইয়ের কথা হয়।
শনিবার সন্ধ্যায় আসিফ খান বিবিসি বাংলাকে বলেন, “গতকাল সন্ধ্যায় আর হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করতে দেয়া হয়নি। সন্ধ্যায় আমার সাথে কথা হয়েছে স্যাটেলাইট ফোনে। সর্বোচ্চ দেড় মিনিট কথা বলেছি। খুব বিস্তারিত জানতে পারিনি”।
জাহাজটির মালিক প্রতিষ্ঠান কেএসআরএম গ্রুপ আশা করছে, খুব তাড়াতাড়ি জলদস্যুরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করবে।
কেএসআরএম গ্রুপের মিডিয়া অ্যাডভাইজর মিজানুল ইসলাম জানান, এই ধরনের পরিস্থিতিতে জলদস্যুরা একটা নিরাপদ স্থান খুঁজে তারপর যোগাযোগ শুরু করে মালিকপক্ষের সাথে। একই সাথে পরিবারের সদস্যদের সাথেও তারা কথা বলার সুযোগ দেয়।
মি. ইসলাম বলেন, “যতক্ষণ পর্যন্ত জলদস্যুদের কাছ থেকে কোন ধরনের অফার না পাওয়া যাচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা যোগাযোগ রক্ষা করে যাচ্ছি। কিন্তু দস্যুদের পক্ষ থেকে এখনো কোন ধরনের অফার পাওয়া যায় নি”।