কোথা থেকে খালে ভেসে আসলো টর্পেডোটি?
পটুয়াখালীর মীরকান্দা গ্রামের একটি খালে জোয়ারের পানিতে ভেসে আসা টর্পেডোটি উদ্ধার করেছে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর বিশেষজ্ঞ দল। তবে কোথা থেকে এটি ভেসে এসেছে সে বিষয়টি এখনও স্পষ্ট নয়।
সোমবার সকালে দশ সদস্যের দলটি প্রথমে খাল থেকে টর্পেডোটি ডাঙ্গায় তোলে। এরপর বেলা সাড়ে ১১টার দিকে গাড়িতে করে সেটি পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় অবস্থিত নৌবাহিনীর শের-ই-বাংলা নৌঘাঁটিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন পটুয়াখালীর পুলিশ সুপার সাইদুল ইসলাম।
“প্রমাণস্বরূপ আমরা একটি লিখিত রেকর্ড রেখেছি। এরপর যা করার তারাই (নৌবাহিনী) করবেন,” বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. ইসলাম।
এদিকে, রোববারের মতো সোমবার সকালেও ঘটনাস্থলে ভিড় করেন আশপাশের উৎসুক জনতা।
যদিও পুলিশ, কোস্টগার্ড এবং নৌবাহিনীর সদস্যরা নিরাপত্তাবলয় তৈরি করায়, সোমবার তারা টর্পেডোর কাছে যেতে পারেননি।
“স্থানীয়দের কেউই যেন কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হন, সেজন্যই সতর্ককতামূলকভাবে আমরা নিরাপত্তাবলয় তৈরি করি,” বিবিসি বাংলাকে বলেন রাঙ্গাবালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিন।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, টর্পেডোটির মালিক কে? এটি গ্রামের খালেই বা ভেসে আসলো কীভাবে?
টর্পেডো আসলে কী?
টর্পেডো হচ্ছে এক ধরনের সেলফ প্রোপেলড বা স্ব-চালিত ক্ষেপণাস্ত্র, যেটি পানির নিচে যেকোনো লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম।
এর ভেতরে সমুদ্রযান ধ্বংসের জন্য বিস্ফোরক ওয়ারহেড যুক্ত থাকে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। লক্ষ্যবস্তুর কাছাকাছি এলে বা সংঘর্ষ হলেই এটি বিস্ফোরিত হয়।
সাধারণত বিভিন্ন দেশের নৌবাহিনীর সদস্যরা এটি ব্যবহার করে থাকেন। কারণ, টর্পেডো মূলত ব্যবহার হয়ে থাকে যুদ্ধক্ষেত্রে জাহাজ ধ্বংস করার কাজে।
আগে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের কাছে টর্পেডো আগে ‘ফিশ’ বা মাছ নামে পরিচিত ছিল।
একে অটোমোটিভ এবং অটোমোবাইল নামেও ডাকা হতো। এছাড়া ‘মাইন’ও আগে ‘টর্পেডো’ নামে পরিচিত ছিল।
গত শতাব্দীর প্রথমদিক থেকে টর্পেডো নামটি শুধুমাত্র জলের নিচের স্ব-চালিত অস্ত্রের ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়ে আসছে।
ভেসে আসা টর্পেডোটি কতটা বিপজ্জনক?
রোববার সকালে পটুয়াখালী রাঙ্গাবালী উপজেলার মীরকান্দা গ্রামের একটি খালে গ্যাস সিলেন্ডারের মতো দেখতে লম্বা টর্পেডোটি ভেসে আসে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিন।
“তাৎক্ষণিকভাবে আমরা নৌবাহিনী এবং কোস্টগার্ডের বিশেষজ্ঞ দলকে খবর দিই। তারা এসেই খালে ভেসে থাকা বস্তুতটিকে টর্পেডো বলে নিশ্চিত করেন,” বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. উদ্দিন।
এ খবর ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
পরে দশ সদস্যের নৌবাহিনীর আরও একটি বিশেষজ্ঞ দল ঘটনাস্থলে আসে, যাদের নেতৃত্বে ছিলেন শের-ই-বাংলা নৌঘাঁটির সাব-লেফটেন্যান্ট আব্দুল আলিম।
মি. আলিমের বরাত দিয়ে পুলিশ জানাচ্ছে যে, ভেসে আসা টর্পেডোটি সে অর্থে বিপজ্জনক নয়।
“প্রাথমিক পরীক্ষা শেষে তিনি আমাদের জানিয়েছেন যে, এটি নৌবাহিনীর প্রশিক্ষণের কাজে ব্যবহৃত ডামি টর্পেডো,” বিবিসি বাংলাকে বলেন রাঙ্গাবালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিন।
তিনি আরও বলেন, “এর মধ্যে বিস্ফোরক নেই। কাজেই এটি নিয়ে তেমন ভয়ের কিছু নেই বলে আমাদের জানানো হয়েছে।”
তারপরও স্থানীয় বাসিন্দাদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে ঘটনাস্থলটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সারা রাত ঘিরে রেখেছিল বলে জানান মি. উদ্দিন।
পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীতে পাওয়া টর্পেডোটি সম্পর্কে কোস্টগার্ড রাঙ্গাবালী আউটপোস্টের কন্টিনজেন্ট কমান্ডার মো. আবুল কালাম আজাদ রোববার সাংবাদিকদের জানান যে, সক্রিয় টর্পেডো ওজনে অনেক ভারী থাকে।
সে কারণে মিসাইলটি পানির নিচে ডুবে থাকে।
কিন্তু মীরকান্দা গ্রামের খালে ভেসে আসা টর্পেডোটি ভেসে ছিল।
কাজেই সেটির মধ্যে বিস্ফোরক নেই বলে নৌবাহিনীর বিশেষজ্ঞরা যে ধারণার কথা জানিয়েছেন, সেটি সঠিক বলেই মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন।
“আমার মনে হয় তারা ঠিকই বলেছেন। কারণ সক্রিয় টর্পেডো পানিতে ভেসে থাকার কথা না,” বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. হোসেন।
টর্পেডোটির মালিক কে?
পটুয়াখালীর খালে ভেসে আসা টর্পেডোটি লম্বায় প্রায় ২৭ ফুট বলে বলে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন স্থানীয় থানার ভারপ্রাপ্রত কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিন।
মাথা এবং লেজের দিকে সবুজ রং করা টর্পেডোটির গায়ে লাল সাদা রঙের ডোরাকাটা।
বিপজ্জনক নয় নিশ্চিত হওয়ার পর নৌবাহিনীর সদস্যরা সোমবার সকালে ধরাধরি করে সেটি ডাঙ্গায় তোলেন।
প্রশিক্ষণে ব্যবহৃত ‘ডামি টর্পেডোটি’ বাংলাদেশ নৌবাহিনীর নয় বলে জানানো হয়েছে।
তাহলে এটির মালিক কে?
“সেটি বের করার জন্য টর্পেডোটি নৌঘাঁটিতে নেওয়া হয়েছে,” বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. উদ্দিন।
তিনি আরও জানিয়েছেন যে, ডাঙ্গায় তোলার পর প্রাথমিক পরীক্ষায় টর্পেডোটির বিষয়ে বিস্তারিত তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
“ওটা কোন দেশে তৈরি বা কারা ব্যবহার করতো, সেটিও প্রাথমিকভাবে জানা যায়নি,” বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. উদ্দিন।
তবে নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, মালিকানার বিষয়ে সরাসরি কোনো তথ্য না পাওয়া গেলেও উৎপাদকের বিষয়ে তথ্য জানা সম্ভব।
“অধিকাংশ ক্ষেত্রে টর্পেডোর গায়েই এটি খোদাই করে লেখা থাকে। কাজেই না পাওয়ার কারণ নেই,” বিবিসি বাংলাকে বলেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন।
যদিও বিষয়টি তদন্তে এখনও কোনো কমিটি গঠনের কথা জানা যায়নি।
তবে পুলিশ জানিয়েছে যে, নৌবাহিনী বিষয়টি খতিয়ে দেখছে।
এ বিষয়ে নৌবাহিনীর কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা কথা বলতে রাজি হননি।
এছাড়া আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের সঙ্গে (আইএসপিআর) যোগাযোগ করা হলে তারাও বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য করেনি।
যেভাবে খালে আসলো
সাগর তীরবর্তী পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলা।
এই এলাকায় নিজকাটা খালের সঙ্গে বঙ্গোপসাগরের সরাসরি সংযোগ রয়েছে।
রোববার সকালে সেখানকার মৌডুবি ইউনিয়ন সংলগ্ন সাগর থেকে ২৭ ফুট লম্বা টর্পেডোটি ভেসে যেতে দেখেন স্থানীয় কিছু শিশু কিশোর ও কয়েকজন জেলে।
যদিও তারা প্রথমে টর্পেডোটিকে চিনতে পারেননি।
মৌডুবি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাহমুদুল হাসান বিবিসি বাংলাকে বলেন, “স্থানীয় ঐ শিশু-কিশোর ও বাসিন্দারা তখন এটিকে জোয়ারের পানিতে ভাসিয়ে সাগর থেকে খালের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়।”
“পরে সেটি মৌডুবি এলাকার ভেতরে খালের মধ্যে চলে আসে,” বলেন মি. হাসান।
কিছুক্ষণের মধ্যেই খবর ছড়িয়ে পড়ে। এরপর অনেকেই ঘটনাস্থলে ভিড় করেন এবং ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করেন।
কেউ কেউ লাইভও করেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা, খালের মধ্যে ঢোকার পর দুজন ব্যক্তি সেটিকে একটি দড়ি দিয়ে গাছের সাথে বেঁধে রাখার চেষ্টা করেন। পরে খালে ভাসমান অবস্থায় সেটিকে গাছের সাথে বেঁধে রাখা হয়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে খালপাড়ে মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে।
তারা এসময় গণমাধ্যমকে বলেন, বিষয়টি অদ্ভুত, কিন্তু তাদের জন্য আতঙ্কিত হওয়ারও কারণ রয়েছে বলে তারা মনে করেন। তাই তারা দ্রুত এটিকে সরিয়ে নিতে প্রশাসনের কাছে অনুরোধ জানান।
মৌডুবি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মি. হাসান বিবিসি বাংলাকে বলেন, “খালে ঢুকিয়ে দেওয়ার পর আমরা সাড়ে এগারোটার দিকে নিউজ পাই। এরপর প্রশাসনকে জানাই।”
এই খবর পেয়ে প্রথমে সেখানে আসে ইউনিয়নের গ্রাম পুলিশ। পরে রাঙ্গাবালী থানা থেকে রোববার দুপুর বারোটার দিকে পুলিশের একদল সদস্য আসেন।
তারাও প্রথমে ঠিক ধারণা করতে পারেননি আসলে বস্তুটি কী। তবে স্থানীয়ভাবে খবর ছড়িয়ে পড়ে সাগর থেকে মিসাইল জাতীয় কিছু একটা ঢুকে পড়েছে খালে।
স্থানীয় বাসিন্দা এনামুল হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেন, “এটি কোথা থেকে কী কারণে এসেছে আমরা সঠিক জানি না। তবে বস্তুটি দেখতে ভারী অস্ত্রের মতো মনে হয়েছে।”
বিষয় নিয়ে এলাকায় এক ধরনের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে বলেও জানান তিনি।
পরে বরিশালের শের-ই বাংলা নৌঘাঁটি থেকে বিস্ফোরক বিষয়ে বিশেষজ্ঞ একটি দল ঘটনাস্থলে যান।
ওই দলের একজন সদস্য বিবিসি বাংলাকে জানান, রোববার তারা যখন ঘটনাস্থলে পৌঁছান, ততক্ষণে খালে ভাটা পড়ে গিয়েছিল।
সে কারণে নৌবাহিনী উদ্ধার তৎপরতা চালাতে পারেনি বলেও জানান তিনি। এরপর রাত নেমে যাওয়ায় সিদ্ধান্ত হয়, সারারাত পাহারায় রেখে সোমবার সকালে টর্পেডোটি উদ্ধার করা হবে।
সেই প্রেক্ষিতেই নৌবাহিনীর সদস্যরা সোমবার ‘ডামি টর্পেডোটি’টি উদ্ধার করে পাশ্ববর্তী ঘাঁটিতে নিয়ে যান।