হামাসের রকেটে তিন সেনা নিহত, এক লাখ মানুষকে রাফাহ ছাড়তে বলেছে ইসরায়েল
এক লাখ মানুষকে রাফাহ’র এক অংশ থেকে অন্যত্র চলে যেতে বলেছে ইসরায়েলি সেনারা। এর আগে, হামাসের রকেট হামলায় তিন সৈন্য নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে দেশটির প্রতিরক্ষা বাহিনী।
রাফাহ শহরে ‘সীমিত পরিসরের’ অভিযান শুরুর আগে সেখানকার কয়েকটি অংশের বাসিন্দাদের আল-মাওয়াসি বা খান ইউনিসের দিকে সরে যেতে বলেছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী।
এটি ব্যাপক মাত্রার উচ্ছেদ কার্যক্রম নয় বলে দাবি তাদের। যদিও শহরের পূর্ব অংশের এক লাখ মানুষকে সরে যেতে হচ্ছে।
সোমবার সকালে, ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্স (আইডিএফ) জানায়, তারা রাফাহ’র পূর্ব অংশের বাসিন্দাদের “এক্সপান্ডেড হিউম্যানিট্যারিয়ান জোন” (বিস্তৃত মানবিক অঞ্চল)-এর দিকে সরে যাওয়ার তাগিদ দিচ্ছেন।
“মানবিক অঞ্চলগুলোতে ফিল্ড হাসপাতাল, তাঁবু, খাবার, পানি, ঔষধ এবং অন্যান্য সরবরাহ বেশি পরিমাণে রয়েছে।”
বাহিনীর পক্ষ থেকে এক্স (সাবেক টুইটার)-এ দেয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়, “সরকারের অনুমোদন অনুযায়ী মাঠ পর্যায়ের পরিস্থিতি বিচার বিশ্লেষণ করেই পূর্ব রাফাহ’র বাসিন্দাদের পর্যায়ক্রমে মানবিক অঞ্চলে স্থানান্তর করা হবে।”
গাজা ভূখণ্ডের উত্তরাঞ্চল ও মধ্যবর্তী এলাকাগুলো থেকে যুদ্ধের জেরে বাস্তুচ্যুত হয়ে এই শহরটিতে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় ১৪ লাখ মানুষ।
হামাসের বিরুদ্ধে সাত মাস আক্রমণ চালিয়ে ইসরায়েল বলছে, রাফাহ অভিযান ছাড়া তাদের বিজয় অসম্ভব।
তবে হামাসের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা সামি আবু জুহরি এই অভিযানকে “বিপজ্জনক” উল্লেখ করে বলেছেন, “এর পরিণাম হবে ভয়াবহ”।
এর আগে গাজা সীমান্তবর্তী কেরেম শ্যালম এলাকায় হামাসের রকেট হামলায় তাদের তিন সৈন্য নিহত হয়েছে বলে জানায় ইসরায়েল।
গাজায় ত্রাণ তৎপরতার বড় অংশই কেরেম শ্যালম ‘ক্রসিং’ দিয়ে পরিচালনা করা হয়।
হামলার পর সারারাত ক্রসিংটি বন্ধ করে রাখে ইসরায়েল।
এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় রাফাহ শহরে চালানো ইসরায়েলি হামলায় ১২ জন নিহত হয়েছেন।
ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী বলছে, সোমবার সকালে রাফাহ’র বিভিন্ন অংশে আশ্রয় নেয়া গাজাবাসীকে সরে যাওয়ার তাগিদ দিয়েছে তারা।
হামলাগুলো এমন সময়ে হলো যখন গাজায় যুদ্ধবিরতি ও জিম্মিদের মুক্তি ব্যাপারে আলোচনা শুরু হয়েছে।
কেরেম শ্যালম থেকে সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরের দক্ষিণ গাজার রাফাহ ক্রসিংয়ের দিক থেকে ১০টি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়েছে বলে দাবি আইডিএফ’র।
হামাসের সামরিক শাখা এই হামলার দায় স্বীকার করেছে। তাদের দাবি, আক্রমণ করা হয়েছে ইসরায়েলের সেনাঘাঁটির একেবারে কাছে।
অন্যদিকে, একটি বেসামরিক স্থাপনার সাড়ে তিনশো মিটারের মধ্য থেকে রকেটগুলো ছোড়া হয়েছে বলে জানাচ্ছে আইডিএফ।
তাদের দাবি, “সন্ত্রাসী সংগঠনটি কীভাবে মানবিক সুযোগ-সুবিধাগুলোকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে এবং গাজার বেসামরিক নাগরিকদের মানবঢাল হিসেবে কাজে লাগাচ্ছে, এটি তার আরেকটি স্পষ্ট উদাহরণ”।
অবশ্য, বেসামরিক নাগরিকদের মানবঢাল বানানোর অভিযোগ নাকচ করেছে হামাস।
রাফাহতে পাল্টা-হামলার কথা নিশ্চিত করে ইসরায়েলি বাহিনী বলছে, তাদের হামলা যে লঞ্চার থেকে ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ছোড়া হয়েছিল ঠিক সেটিতেই আঘাত হেনেছে। হামলা করা হয়েছে পাশের একটি সামরিক স্থাপনাতেও।
গাজার স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছে, রোববার দুটি হামলা চালানো হয় আর তাতে অন্তত ১২ জন মারা যায়।
মিশরের কায়রোতে মধ্যস্থতাকারীদের সাথে আলোচনা চলছিল দু’দিন ধরে, তার মধ্যেই এ হামলার খবর এলো।
অবশ্য আলোচনায় বিশেষ অগ্রগতি হয়নি। ইসরায়েল বা হামাসের কেউই মূল দাবিগুলোর ব্যাপারে কোনো ছাড় দিতে রাজি নয়।
সোমবার আলোচনা পুনরায় শুরু হওয়ার কথা রয়েছে।
হামাস বলছে, সংগঠনের শীর্ষ নেতৃত্বের সাথে আলোচনা করতে কাতার যাবে তাদের প্রতিনিধি দলটি।
গণমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, সিআইএ চিফ উইলিয়াম বার্নস, দোহার আলোচনায় যোগ দেয়ার উদ্দেশে মিশরের রাজধানী ছেড়েছেন।
মি. বার্নস মধ্যস্থতার প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত আছেন।
যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে যেসব বিষয় অন্তভুক্ত আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে সেগুলো হলো: লড়াইয়ে ৪০ দিনের বিরতি, গাজায় জিম্মিদের মুক্তি, ইসরায়েলি কারাগারে আটক ফিলিস্তিনিদের মুক্তি।
হামাস বলছে, বর্তমান প্রস্তাবটিকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছে তারা। তবে যুদ্ধবিরতি স্থায়ী হবে নাকি সাময়িক সেটি বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যেই চুক্তিই হোক তাতে যেন যুদ্ধের ইতি টানার অঙ্গীকার থাকে, তার ওপর জোর দিয়ে আসছে গোষ্ঠীটি। কিন্তু, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন।
“ইসরায়েল রাষ্ট্র তাদের দাবি মেনে নিতে পারে না। হামাসের ব্রিগেডগুলো বাঙ্কার থেকে বেরিয়ে আসবে, আবার গাজার নিয়ন্ত্রণ নেবে, সামরিক অবকাঠামো পুনর্নির্মাণ করবে আর ইসরায়েলে জনগণের জন্য হুমকি তৈরি করবে এমন অবস্থা মেনে নেয়ার জন্য আমরা প্রস্তুত নই,” বলেন মি. নেতানিয়াহু।
“রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলের জন্য নিদারুণ পরাজয় হবে সেটা,” যোগ করেন তিনি।
গত বছরের সাতই অক্টোবর গাজা সীমান্ত পেরিয়ে হামাসের যোদ্ধারা ইসরায়েলের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে। তাদের হামলায় এক হাজার দুশো জন নিহত হয়, জিম্মি করা হয় আড়াইশো’র বেশি মানুষকে। সেখান থেকেই যুদ্ধের সূত্রপাত।
অনেক পশ্চিমা দেশই সশস্ত্র গোষ্ঠীটিকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করেছে।
পরবর্তীতে গাজায় সামরিক অভিযান চালায় ইসরায়েল। তাদের অভিযানে ৩৪ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়, আহত হয়েছে প্রায় আশি হাজার। ভূখণ্ডটিতে হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ তথ্য জানিয়েছে।
গাজার সর্বদক্ষিণের শহর রাফাহ দীর্ঘদিনের প্রতিশ্রুত অভিযান শুরু করার জন্য নেতানিয়াহু তার উগ্র-ডানপন্থী জোটের মধ্যেই চাপের মুখে আছেন।
বিপুল সংখ্যক বেসামরিক মানুষের প্রাণহানি ঘটাতে পারে, এমন কোনো সামরিক অভিযানে সমর্থন দিতে চাইছে না যুক্তরাষ্ট্র। বরং, বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের আশ্রয় নিশ্চিত করতে একটা পরিকল্পনা আগে হাতে নেয়া উচিত বলে অভিমত দেশটির।
কিন্তু, সেখানে ১৪ লাখের বেশি বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনির আশ্রয়ের কারণে, পশ্চিমা শক্তিগুলো এবং মিশরের পক্ষ থেকে শঙ্কা জানিয়ে বলা হচ্ছে, এতে ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটতে পারে। বেসামরিক মানুষদেরই এর জন্য ভুগতে হবে।