পাওয়ার অব এটর্নি বিষয়ে বৃটেন প্রবাসীরা বিড়ম্বনার স্বীকার, সিলেটে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চাইলেন ব্যারিস্টার নাজির
ডেস্ক রিপোর্টঃ পাওয়ার অব অ্যাটর্নি ইস্যু করতে গিয়ে বাংলাদেশি আইনের জটিলতায় ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা কয়েক লাখ প্রবাসী। এ সমস্যার সমাধান না হলে দেশে ব্যবসা- বিনিয়োগসহ নানা ক্ষেত্রে স্থবিরতা দেখা দিতে পারে। মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন প্রবাসীরা। মঙ্গলবার দুপুরে সিলেট প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন, যুক্তরাজ্য প্রবাসী আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার নাজির আহমদ।
প্রতিথযশা আইনজীবী ব্যারিস্টার নাজির আহমদ বলেন, পাওয়ার অব এটর্নি বিষয়ে লক্ষ লক্ষ্য বৃটেন প্রবাসীরা মারাত্মক বিড়ম্বনার স্বীকার। এ বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ আশু প্রয়োজন। তিনি তার লিখিত বক্তব্যে বলেন, পাওয়ার অব এটর্নী জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি বৈধ আইনি ডকুমেন্ট। এটির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ বা প্রতিষ্টানের পক্ষ থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত এটর্নী বা এটর্নীরা তাদের উপর অর্পিত কার্য সম্পাদন করতে পারেন। এটা নিযুক্ত এটর্নীরা এমনভাবে সম্পাদন করেন যেন মূল মালিকরাই করছেন। সম্পত্তি ক্রয়-বিক্রয়, হস্তান্তর, বন্টন, মামলা দায়ের ও মামলা ডিফেন্ডসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পাওয়ার অব এটর্নী দেয়ার প্রয়োজন পড়ে। এটা শত শত বছর ধরে চলে আসা স্বীকৃত আইনি পন্থা।
তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, ভেলিড বাংলাদেশী পাসপোর্ট ছাড়া এখন পাওয়ার অব এটর্নী সম্পাদন করা যাচ্ছে না বাংলাদেশ হাই কমিশনে। তাও যদি আবেদন করার পর ২/১ সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশী পাসপোর্ট পাওয়া যেত তাহলে এই নিয়ম করার একটি যৌক্তিকতা হয়তো থাকতো। বাংলাদেশী পাসপোর্ট বানাতে অনেক বিড়ম্বনার স্বীকার হতে হয়ে। পাসপোর্টের জন্য আবেদন করলে ৬/৮ মাস বা এর চেয়েও বেশী সময় অপেক্ষা করেও তা পাওয়া যাচ্ছে না। তাই পাওয়ার অব এটর্নী সম্পাদনে নতুন নিয়মের ফলে চরম ভূগান্তিতে পড়েছেন লক্ষ লক্ষ প্রবাসীরা। আধুনিক প্রযুক্তির যুগে নিয়ম যেখানে সহজ হবার কথা সেখানে সহজ না হয়ে বরং বাংলাদেশে প্রবাসীদের সম্পত্তি রক্ষা ও অধিকার আস্তে আস্তে কঠিন ও সংকোচিত হয়ে আসছে।
ব্যারিস্টার নাজির আহমদ বলেন, পাওয়ার এটর্নী সম্পাদনে ভেলিড বাংলাদেশী পাসপোর্ট থাকার বাধ্যতামূলক নিয়ম কেন যে করা হলো তার যুক্তিসংগত কারণ ও ব্যাখ্যা এখনও পাওয়া যাচ্ছে না। পাওয়ার অব এটর্নীর সাথে ভেলিড বাংলাদেশী পাসপোর্ট বা বাংলাদেশী নাগরিকত্বের কি সম্পর্ক? পাওয়ার অব এটর্নী সম্পাদন করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তথা হাইকমিশন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের সনাক্ত করতে বিভিন্ন ধরণের স্বীকৃত আইডি দেখতে পারে। সেই আইডির অংশ হিসেবে যে কোন ধরণের পাসপোর্ট যথেষ্ট ছিল এবং হওয়া উচিৎ। ভেলিড বাংলাদেশী পাসপোর্ট থাকার বাধ্যতামূলক এই নিয়মটি চালু করা হয়েছে মাত্র দু’বছর আগে। অথচ স্বাধীনতার পর থেকে পঞ্চাশ বছর এই নিয়ম ছিল না। তখন তো প্রবাসীরা পাওয়ার অব এটর্নী দিয়েছেন এবং তাতে তো কোন সমস্যা হয়নি। এখন অযথা এই অযৌক্তিক নিয়ম বা শর্তারোপ করার হেতু কি?
পূর্বের নিয়ম ব্যাখ্যা করে ব্যারিস্টার নাজির বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে ৭/৮ বছর আগ পর্যন্ত বৃটেন থেকে পাওয়ার অব এটর্নী দেয়ার নিয়ম ছিল – পাওয়ার অব এটর্নী ড্রাফট করে আইডিসহ যে কোন ব্যারিস্টার বা সলিসিটরের সামনে গিয়ে দস্তখত করতে হতো। উল্লেখ্য বৃটেনে qualified সব ব্যারিস্টার বা সলিসিটর হলেন “Commissioner for Oath. অর্থাৎ তারা Oath তথা শপথ এডমিনিস্টার করতে ক্ষমতাপ্রাপ্ত। ব্যারিস্টার বা সলিসিটর sign ও seal দেয়ার পর সম্পাদিত পাওয়ার অব এটর্নীকে Foreign and Commonwealth Office -এ পাঠানো লাগতো Legalisation করার জন্য। Legalisation হয়ে আসার পর হাইকমিশনে পাঠানো লাগতো তা Attestation করার জন্য। উল্লেখ্য পাওয়ার অব এটর্নী সম্পাদনের জন্য তখন সশরীরে কেবলমাত্র ব্যারিস্টার বা সলিসিটরের সামনে উপস্থিত হতে হতো। Foreign and Commonwealth Office বা হাইকমিশনে সশরীরে যেতে হতে না। ডাকে বা প্রতিনিধির মাধ্যমে পাঠালে হতো।
প্রাসঙ্গিকভাবে অন্যান্য দেশের সাথে তুলনা করে ব্যারিস্টার নাজির বলেন, অনেক বৃটিশ নাগরিক তুরস্কের ইস্তাম্বুলে বা সংযুক্ত আবর আমিরাতের দুবাইতে ইনভেস্ট করেছেন, কিনেছেন বাড়ি ও এপার্টমেন্ট। তারা সহজেই বৃটিশ পাসপোর্ট দিয়ে লেনদেন করছেন, বিক্রি বা হস্তান্তর করছেন তাদের সম্পত্তি পাওয়ার অব এটর্নী দিয়ে। সেখানে তো তুরস্ক বা সংযুক্ত আবর আমিরাত শর্ত দেয়নি যে তাদের দেশের ভেলিড পাসপোর্ট লাগবে পাওয়ার অব এটর্নী দিতে। অনুরূপভাবে চীন, জাপান ও রাশিয়ার নাগরিকদের প্রচুর ইনভেস্টমেন্ট আছে লন্ডনের রিয়েল এস্টেট সেক্টরে। বৃটিশ সরকার যদি পাওয়ার অব এটর্নী সম্পাদনে ভেলিড বৃটিশ পাসপোর্ট থাকার শর্ত জুড়ে দিতো তাহলে ঐ দেশগুলোর বিনিয়োগ বন্ধ হয়ে যেত। ফলে লন্ডন অনেকটা ভূতুড়ে নগরীতে পরিনত হয়। আচ্ছা, বৃটেন, সংযুক্ত আবর আমিরাত ও তুরস্কের কথা না হয় বাদই দিলাম, বাংলাদেশের অনেক নাগরিকদের রিয়েল এস্টেটে ইনভেস্টমেন্ট আছে মালয়েশিয়াসহ পৃথিবীর অনেক দেশে। তারা যদি বাংলাদেশের মতো নিয়ম করে যে পাওয়ার অব এটর্নী দিতে তাদের স্ব স্ব দেশের ভেলিড পাসপোর্ট লাগবে, তখন কেমন হতো বা দেখতে কেমন লাগতো?
ব্যারিস্টার নাজির আহমদ আরও বলেন, লন্ডনে অবস্থানরত বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের সাবেক সিনিয়র বিচারপতির সাথে কথা হলো পাওয়ার অব এটর্নী সম্পাদনে ভেলিড বাংলাদেশী পাসপোর্ট থাকার বাধ্যতামূলক অভিনব নিয়ম নিয়ে। তিনিও বললেন পাওয়ার অব এটর্নীর সাথে পাসপোর্ট বা নাগরিকত্বের কোনো সম্পর্ক নেই। বড়জোর যথাযথ আইডি দেখা যেতে পারে। বাংলাদেশে সুপ্রীম কোর্টে প্র্যাকটিস করছেন এমন একজন আইনজীবীর সাথে কথা বললাম। তিনি জানালেন চট্রগ্রাম পোর্টে অহরহ বিদেশী পাসপোর্ট দিয়ে পাওয়ার অব এটর্নী সম্পাদন করা হচ্ছে। তাহলে প্রবাসী বাংলাদেশীদের ক্ষেত্রে এই বৈষম্যমূলক ও বিমাতাশুলভ নিয়ম করার কারণ কি?
একজন বয়স্ক ব্যক্তির বুক ফাটা কান্নার ঘটনা উল্লেখ করে ব্যারিস্টার নাজির আহমদ বলেন, একজন প্রবীণ বয়স্ক ব্যক্তি ফোন করছিলেন তাঁর একটি পাওয়ার এব এটর্নীর ব্যাপারে। বললেন মাস খানেক আগে তাঁর স্ত্রী ইন্তেকাল করেছেন। তিনিও সপ্তাহে ৩ বার কিডনীর জন্য ডায়োলোসিস নেন। তিনি নিজে শারিরীক প্রতিবন্ধি এবং বাংলাদেশ সফরে অক্ষম। তাঁর সম্পত্তির ব্যাপারে পাওয়ার অব এটর্নী দিতে পারছেন না। দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে পাওয়ার অব এটর্নীসহ প্রবাসীদের বিভিন্ন অধিকারের ব্যাপারে কথা বলি বলে আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন “ব্যারিস্টার সাব, আমি আর বেশি দিন বাঁচবো না। দেশে যেতেও পারছি না, এখান থেকে পাওয়ার অব এটর্নীও দিতে পারবো না। এমন দেশ কি চেয়েছিলাম? এভাবে জানলে দেশে কোন টাকাই পাঠাতাম না। দেশে কোন সম্পদই করতাম না।” তাঁর কথায় ঠায় বসে রইলাম। কোন জবাব দিতে পারিনি প্রবীণ বয়স্ক এই মুরব্বীকে।
ব্যারিস্টার নাজির আক্ষেপ করে বলেন, প্রবাসীরা পাওয়ার অব এটর্নীসহ নানান সমস্যায় জড়জড়িত। এগুলো দেখার বা সুরাহা করার যেন কেউ নেই। প্রবাসে যারা রাজনীতি করেন তারা অনেকটা মুখে লাগাম দিয়ে বসে আছেন। এটা সব সরকারের সময়ই ঘটে। উপযুক্ত চ্যানেলে প্রবাসীদের যৌক্তিক দাবী-দাওয়া তুলে ধরার পরিবর্তে বাংলাদেশ থেকে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কেউ এলে তাদেরকে ফুলের তোড়া দিয়ে ফটো তুলাকেই তারা শ্রেয় মনে করছেন। দল ক্ষমতায় থাকায় সংশ্লিষ্টদের হয়তো অন্যদের চেয়ে সুযোগ সুবিধা ও অগ্রাধিকার পাচ্ছেন। এটা সাময়িক। সরকার পরিবর্তন হলে তারাও পড়বেন বিপদে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করে ব্যারিস্টার নাজির বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে বিলেত প্রবাসীদের অবদান অনস্বীকার্য – কি-না তারা করেছেন দেশের জন্য। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যখন ট্রেজারীতে কোনো অর্থই ছিল না তখন বিলেত প্রবাসীরা অর্ধ মিলিয়ন পাউন্ডের উপর যোগান দিয়েছেন। গত অর্ধ শতাব্দি ধরে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দেশে রেমিটেন্স পাঠিয়ে অর্থনীতির চাকা সচল রেখে ইনভেস্ট করেছেন, জায়াগা-জমি কিনেছেন, সম্পত্তি তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন। পাওয়ার অব এটর্নী সম্পাদনে অভিনব নিয়ম তাদেরকে আজ চরম ভূগান্তিতে ও বেকায়দায় ফেলেছে। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ আশু প্রয়োজন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি চাইলেই এই সমস্যার সমাধান করতে পারেন, দূর করতে পারেন প্রবাসীদের চরম ভূগান্তি। অনেক কিছুতে যুগান্তকারী ও সাহসী সিদ্ধান্ত আপনি নিচ্ছেন। সংশ্লিষ্ট আমলাদেরকে আপনার একটি ধমকই যথেষ্ট দু’বছর আগে চালু হওয়া বৈষম্যমূলক নিয়মের আগে ফিরে যাওয়া। আর এতে পাবেন আপনি কোটি প্রবাসীর অকৃত্রিম ভালবাসা।
সিলেট প্রেস ক্লাবের নব নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদকসহ সিলেটের বিভিন্ন গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিক এবং বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের সিলেটের প্রতিনিধিরা সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। বক্তব্যের পর ব্যারিস্টার নাজির আহমদ সাংবাদিকদের বিভিন্ন ধরণের প্রশ্নের উত্তর দেন।