বিশ্বে সর্বাধিক মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় যে সব দেশে

Spread the love

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বব্যাপী মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে।

অ্যামনেস্টির বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে ৩১ শতাংশ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর বৃদ্ধি পেয়েছে। গত বছর বিশ্বব্যাপী মোট এক হাজার ১৫৩ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের তথ্য রেকর্ড করা হয়েছে। ২০২২ সালে এই সংখ্যা ছিল ৮৮৩।

গত আট বছরের মাঝে গত বছরই সর্বোচ্চ সংখ্যক মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। এর আগে ২০১৫ সালে এই সংখ্যা সর্বোচ্চ ছিল, এক হাজার ৬৩৪ জন।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাগনেস ক্যালামার্ড বলেছেন, রেকর্ডকৃত মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি বাড়তে দেখা গেছে ইরানে।

“ইরান কর্তৃপক্ষ মানুষের জীবনের প্রতি চরম অবহেলা দেখিয়েছে এবং মাদক সংক্রান্ত অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে। দেশটির সবচেয়ে প্রান্তিক ও দরিদ্র সম্প্রদায়ের উপর মৃত্যুদণ্ডের বৈষম্যমূলক প্রভাব দেখা যাচ্ছে”, বলেছেন তিনি।

গত বছর বিশ্ব জুড়ে যত মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের ঘটনা ঘটেছে, তার মধ্যে ৭৪ শতাংশই ইরানে।

অ্যামনেস্টি বলছে, সংখ্যার হিসাবে তা অন্তত ৮৫৩। ২০২২ সালে ইরানে ৫৭৬ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল। তার আগের বছর এ সংখ্যা ছিল ৩১৪ জন। গত বছর ইরানে মাদকসংক্রান্ত অপরাধের ঘটনায় সবচেয়ে বেশি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে।

এই প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছর ইরানে অন্তত ৮৫৩ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। তবে অ্যামনেস্টির ধারণা, চীনেও প্রতি বছর অনেক মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার বিষয়ে চীনের কোনও সরকারি পরিসংখ্যান নেই।

তবে অ্যামনেস্টির অনুমান, গতবছর চীনে হাজার হাজার মানুষকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।

এছাড়া, অ্যামনেস্টির প্রতিবেদনে আরও উঠে এসেছে যে ২০২৩ সালে বিশ্বব্যাপী মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার হার ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

২০১৮ সালের পর গত বছরই সর্বোচ্চ সংখ্যক মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

কোন দেশগুলোতে মৃত্যুদণ্ড বেশি হয়?

অ্যামনেস্টি বলছে, ২০২৩ সালে বিশ্বের পাঁচটি দেশে সর্বোচ্চ সংখ্যক মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে।

সেই দেশগুলো হলো— চীন, ইরান, সৌদি আরব, সোমালিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

ওই বছর রেকর্ডকৃত কার্যকর হওয়া মৃত্যুদণ্ডের ৭৪ শতাংশই হয়েছে ইরানে। সেই সাথে ১৫ শতাংশ ঘটেছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরবে।

তবে ঠিক চীনের মতোই গত বছর উত্তর কোরিয়া, ভিয়েতনাম, সিরিয়া, ফিলিস্তিনি অঞ্চল এবং আফগানিস্তান থেকে এ বিষয়ক সরকারি কোনও পরিসংখ্যান পায়নি অ্যামনেস্টি।

কতগুলো দেশ মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ করেছে?

১৯৯১ সালে মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ করা দেশ ছিল ৪৮টি। তবে ২০২৩ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১২টিতে।

বিশ্বের নয়টি দেশ খুব গুরুতর অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয়।

তবে বিশ্বব্যাপী মোট ২৩টি দেশ আছে, যারা অন্তত গত এক দশকে মৃত্যুদণ্ড প্রয়োগ করেনি।

বিশ্বব্যাপী মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পদ্ধতি

২০২৩ সালে চারটি পরিচিত পদ্ধতিতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল।

তার মাঝে শুধুমাত্র সৌদি আরবে শিরশ্ছেদ পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়েছিল।

সাতটি দেশ ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে। ছয়টি দেশ গুলি করার মাধ্যমে এবং তিনটি দেশ প্রাণঘাতী ইঞ্জেকশন ব্যবহার করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে।

জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান ভলকার টার্ক বলেছেন, “মৃত্যুদণ্ডের বিধানকে মানুষের মর্যাদা ও বেঁচে থাকার অধিকারের সাথে, এমন কী কোনও প্রকার নির্যাতন বা নিষ্ঠুরতা, অমানবিকতা বা অবমাননাকর আচরণ বা শাস্তি থেকে মুক্ত থাকার অধিকারের সাথে মেলানো বেশ কঠিন।”

অপরাধ থেকে দায়মুক্তি

দায়মুক্তি বা অব্যাহতি হলো, যখন সাজা ও আপিল প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর একজন দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিকে দোষ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। অথবা যখন তাকে ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ থেকে খালাস করা হয়।

যদি কাউকে এই ‘এক্সোনারেশন’ বা দায়মুক্তি দেওয়া হয়, তখন তিনি আইনের চোখে নির্দোষ বলে গণ্য হন।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বিশ্বের তিনটি দেশের মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রাপ্ত নয় জন কয়েদির দোষ থেকে অব্যাহতি পাওয়ার বিষয়টি লিপিবদ্ধ করেছে।

এর মধ্যে কেনিয়ার পাঁচ জন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তিন জন ও জিম্বাবুয়ের এক জন।

মানবাধিকার কর্মীরা মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে কথা বলেন। তাদের যুক্তি হলো, মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়ে যাওয়ার পর কোনও মানুষ নির্দোষ প্রমাণিত হলে সেই দণ্ড সংশোধনের আর কোনও সুযোগ থাকে না।

যেখানে সংশয়

জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় বলছে, বিশ্বের যে সব দেশে মৃত্যুদণ্ডের বিধান আছে সে সব দেশ বিশ্বাস করে যে “এটি অপরাধকে প্রতিরোধ করে।”

সংস্থাটি অবশ্য ওই সব দেশের এই ধারণাকে ‘কাল্পনিক’ হিসেবে উল্লেখ করে।

সমাজবিজ্ঞানীরা একটি বিষয়ে একমত। তা হলো, মৃত্যুদণ্ডের আদেশ যে কাঙ্ক্ষিত প্রভাব আনতে পারে, তা কখনওই প্রমাণ করা যায়নি।

কেউ কেউ বলেন, যে বিষয়টি বরং অপরাধীদের সবচেয়ে বেশি বাধা দেয়, তা হলো ধরা পড়ার ভয় এবং শাস্তি পাওয়ার সম্ভাবনা।

মৃত্যুদণ্ড এবং হত্যার মধ্যকার সম্পর্ক কী, তা নির্ধারণের জন্য ১৯৮৮ সালে একটি জরিপ করেছিলো জাতিসংঘ। সেটি ১৯৯৬ সালে আরেক দফায় সংস্কার করা হয়।

সেই জরিপে বলা হয়, “কাউকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়ার পরিবর্তে কারও মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার প্রভাব যে বেশি, কোনও গবেষণায় বৈজ্ঞানিকভাবে তা প্রমাণিত হয়নি।”

ডেথ চেম্বার
ডেথ চেম্বার

শিশুদের ওপর প্রভাব

২০১০ সালে আলজেরিয়া, আর্জেন্টিনা, কাজাখস্তান, মেক্সিকো, তুরস্ক-সহ বিশ্বের মোট ১৪টি দেশ মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক কমিশন (ইন্টারন্যাশনাল কমিশন এগেইনস্ট দ্য ডেথ পেনাল্টি) প্রতিষ্ঠার জন্য এগিয়ে এসেছিল।

পরবর্তীতে সেই কমিশনে যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি ও টোগো-সহ বিশ্বের মোট ২৪টি দেশ সদস্য হয়েছে।

গত বছর প্রকাশিত কমিশনের সর্বশেষ প্রতিবেদনে জোর দিয়ে বলা হয়েছিল যে বিশ্বের অনেক দেশের শিশুরাও মৃত্যুদণ্ডের ঝুঁকিতে রয়েছে।

যদিও জাতিসংঘের শিশু অধিকার কনভেনশনে উল্লেখ আছে, শিশুদের ওপর এটির প্রয়োগ নিষিদ্ধ। ওই কনভেনশনটি বিশ্বে ১৯৬টি দেশে কার্যকর রয়েছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যামেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (এপিএ) নামক একটি সংস্থা দেশটির অঙ্গরাজ্যগুলোতে ২১ বছরের কম বয়সীদের ওপর মৃত্যুদণ্ড প্রয়োগ নিষিদ্ধ করার জন্য আহ্বান জানিয়েছে।

সংস্থাটি লিখেছে, “বৈজ্ঞানিক তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে এটি বলা যায় না যে ১৮ থেকে ২০ বছর বয়সীদের মস্তিষ্ক ১৭ বছর বয়সীদের মস্তিষ্ক থেকে খুব বেশি আলাদা।”

তারা আরও বলছে, “যৌবনের শুরুর সময় ও অপরিপক্কতার বৈশিষ্ট্য একই ধরনের হওয়ার কারণে এটি ১৬ ও ১৭ বছর বয়সীদের ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর না করার ন্যায্যতা দেয়। সে ক্ষেত্রে ১৮ থেকে ২০ বছর বয়সীদের মধ্যেও ওই একই বৈশিষ্ট্য রয়েছে।”

তবে শুধুমাত্র মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হলেই শিশুরা ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। কমিশন বলছে, একজন অপরাধীকে অন্য কোনও শাস্তি না দিয়ে মৃত্যুদণ্ড দিলে তা শিশুদের ওপর প্রভাব ফেলে।

“যেমন পিতা বা মাতার মৃত্যুদণ্ড একটি শিশুকে তার পিতামাতার সাথে সম্পর্ক স্থাপনের সুযোগ থেকে স্থায়ীভাবে বঞ্চিত করে,” বলছে তারা।


Spread the love

Leave a Reply