সিলেটে ঘনঘন বন্যা : এখনই যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে ভয়াবহ সংকটে পড়বে সিলেট
বন্যা সিলেট নগরীতে এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সিলেট নগরীর বন্যা মানবসৃষ্ট। কয়েক ঘণ্টা বৃষ্টি হলেই নগরীর বিশাল এলাকা পানির নিচে চলে যায়। পানি যাবার পথ রুদ্ধ হলে বন্যা তো হবেই, হতে বাধ্য। ছড়া, খাল, নালা ও ড্রেন যদি ভরে যায়, ভরাট করা হয়, দখল হয়ে যায় অথবা আংশিক দখল করে ছোট করে দেয়া হয় তাহলে বন্যা তো হবেই। এভাবে চলতে থাকলে সিলেট নগরীতে ঘনঘন ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হতে হতে এক সময় সিলেট বসবাসের অনুপোযোগী হয়ে যাবে। সিলেটের যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের মাথায় এগুলো ঢুকে? ঢুকে বলে মনে তো হয় না। তথাকথিত স্মার্ট সিলেটের সস্তা বুলি না আওড়িয়ে সিলেটকে অন্তত: স্বাভাবিক বসবাসের উপযোগী করে তুলুন।সাধারণ নাগরিকদের কোনো দায়িত্ব নেই? সম্প্রতি মাসাধিককাল বাংলাদেশ সফরে নিজ চোখে দেখেছি সুযোগ পেলেই ছড়ায়, নালায় ও ড্রেনে ময়লা, আবর্জনা ও বর্জ ফেলে দেয়া হয়। সুযোগ পেলেই নালা ও ছড়া দখল করে বিভিন্ন ধরণের স্থাপনা তৈরি করে ছোট করে দেয়া হয়। দখলদার যদি সরকারি দলের সাথে সংশ্লিষ্ট কিংবা ছত্রছায়ায় থাকে তার যেন সবকুল মাফ, অবস্থা এমন যে তাকে ধরে বা বাঁধা দেয় কে? কি এক আশ্চর্য সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে বাংলাদেশে।
নিজের বাসা ও আশেপাশের ড্রেনটি পর্যন্ত পরিস্কার রাখার প্রয়োজন অনুভব করা হয় না। এগুলো যে কত আত্মঘাতী এই ঘনঘন বন্যা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। এমতাবস্থায় সিংগাপুরের স্টাইলে strict fixed penalty’র মতো শাস্তির বিধান করা যায় কি না ভেবে দেখা দরকার। উল্লেখ্য, সিংগাপুরে চুইংগামের কাভার এমনকি মুখে থুথু রাস্তায় নিক্ষেপ করলে অন দ্য স্পট ১০০ ডলার পেনাল্টি দেয়া হয়। আর এ জন্যইতো সিংগাপুর বিশ্বের সবচেয়ে পরিস্কার দেশগুলোর (Clean Countries) অন্যতম।
নগর প্রশাসনের কোনো দায়িত্ব নেই? ছড়া, খাল, নালা ও ড্রেন ভরাট ও দখলের বিরুদ্ধে আইনের প্রয়োগ কোথায়? ছড়ায়, নালায় ও ড্রেনে ময়লা, আবর্জনা ও বর্জ ফেলার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা কেন নেয়া হচ্ছে না? নগর প্রশাসনের ছড়া, খাল, নালা ও ড্রেন ঘনঘন পরিস্কার রাখার কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না কেন? এগুলো নগর প্রশাসনের মৌলিক দায়িত্ব। নাগরিকদের নূন্যতম নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত না করে নগর প্রশাসন যেন কয়েক শত গুণ থেকে কয়েক হাজার গুন হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়াতে ব্যস্ত! আফসোস।
সিলেটের অভিজাত এলাকা বলে কথিত শাহজালাল উপশহর এলাকা আগে ছিল নীচু ডুবা এলাকা। সারা বছর পানি জমে থাকতো। এটিকে ভরাট করে আবাসিক এলাকা বানালেও পানি নিষ্কাশনের কোনো যথাযথ ব্যবস্থা রাখা হয়নি। ফলে সুরমা নদীর তীরবর্তী হওয়া সত্ত্বেও একটু বৃষ্টি হলেই শাহজালাল উপশহরে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। আর সিলেটে সাধারণ বন্যা হলে তো শাহজালাল উপশহরের এক তলা প্রায় পানির নীচে চলে যায়! এটা যে তৎকালীন কর্তৃপক্ষের খামখেয়ালি ও উপযুক্ত পরিকল্পনার অভাবের ফসল তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
বৃহত্তর সিলেট জুড়ে বন্যার আরেকটা ডাইমেনশন আছে। মেঘালয় সিলেট থেকে অনেক উচুঁতে, অনেকটা মাথার উপর খাড়া পাহাড়। সীমান্তে গেলে দেখা ও বুঝা যায় বাংলাদেশের সিলেট ও সুনামগঞ্জ কত নীচে আর মেঘালয় কত উপরে। মেঘালয় প্রচণ্ড বৃষ্টিপ্রবণ অঞ্চল। বস্তুত: মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়। ওখানে প্রচুর বৃষ্টি হলে সিলেট ও সুনামগঞ্জে পাহাড়ি ঢল নামবেই, নামতে বাধ্য। এই অসম ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ বা ভারত কেউ তা ঠেকাতে পারবে না। এই যে ঢল আকারে পানি আসে তা প্রবাহিত হয়ে যাবার পথ না থাকলে বন্যা তো হবেই, হতে বাধ্য। অনেকে না বুঝে এই ঢল নামার জন্য ভারতকে দায়ী করে থাকেন। তাছাড়া মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জি অতি নিকটে সিলেট হওয়ায় ওখানে বৃষ্টি হলে সিলেটেও হয়। ফলে তখন তা হয় মরার উপর খড়ার ঘাঁ।
এভাবে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। কিন্তু ইদানিং ঘনঘন বন্যা হয় কেন? অতীতে বহুবার সিলেটে বন্যা হয়েছে কিন্তু ইদানিংকালের মতো এত ভয়াবহ হয়নি তার কারণ তখন পানি নামার বা যাবার মোটামুটি পথ ছিল। আর এখন? এখন সব নদী হয় ভরাট হয়ে যাচ্ছে, না হয় দখল হয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ী ঢলে পলিমাটি আসায় নদীগুলো তাদের নাব্যতা হারিয়েছে। সিলেট অঞ্চলের নদী, নালা, খাল ও বিলের অবস্থা দেখলে যে কেউ আতঁকে উঠবেন। শুস্ক মৌসুমে ভারতের সীমান্ত জকিগঞ্জ থেকে সিলেট শহর পর্যন্ত সুরমা নদী দিয়ে এসে দেখে আসুন ভরাটের অবস্থা – চোখ ছানাবড়া হয়ে যাবে! ছোট ছোট নদীগুলোর অবস্থা তো আরও মারাত্মক। খাল ও নালার অবস্থা একেবারে গুরুচরণ – বেশিরভাগ দখল হয়ে গেছে। এমতাবস্থায় পানি যাবে কোথায়? যাবার পথ না পেয়ে উঠে বাসা বাড়িতে। এ অবস্থা চলতে থাকলে পরিস্থিতি আস্তে আস্তে আরও ভয়াবহ হবে, নিয়মিতভাবে একটার পর আরেকটা ভয়াবহ থেকে ভয়াবহতম বন্যার কবলে পড়তে থাকবে সিলেট।
ভারত থেকে কোম্পানীগঞ্জ ও জাফলংয়ে আসা পাথর অজ্ঞাত কারণে তুলতে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। প্রাকৃতিকভাবে প্রাপ্ত এই পাথর তুলতে পারলে এগুলো দেশের জনগণ সস্তায় পেতো। এই পাথর থেকে সিমেন্ট তৈরি করে সস্তায় জনগণের কাছে বিক্রি করা যেত। সরকার সুন্দর ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ট্যাক্স নিতে পারতো। এর সাথে সাথে বড় যে লাভ হতো তা হচ্ছে ঝর্না ও নদীগুলো গভীর হতো। ফলে ভারত থেকে আসা পানির ধারণ ক্ষমতা বেশি হতো। ফলে তা বন্যা নিয়ন্ত্রণে কিছুটা হলেও কাজে লাগতো। কেন যে পাথর তুলতে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রাখা হয়েছে তা বোধগম্য নয়।
আবহমানকাল থেকে দেখা গেছে নদীগুলো কেন্দ্র করে নগর, বন্দর ও বাজার গড়ে উঠেছে। ঠিক তেমনিভাবে বিশ্বনাথ উপজেলা গড়ে উঠেছে বাসিয়া নদীকে কেন্দ্র করে। এই নদীর উপর ভিত্তি করে বিশ্বনাথ বাজার গড়ে উঠেছে। বাসিয়া নদী কত না খরস্রোতা নদী ছিল! এই নদী দিয়ে লঞ্চ ও স্টিমার চলতো। নৌকায় বাড়ি থেকে চড়চন্ডি নদী দিয়ে (সেই নদীর অবস্থাও আরো ভয়াবহ) কত বার যে বিশ্বনাথ এসেছি শৈশবে। আর এখন এটা অনেকটা নোংরা মরা খালে পরিণত হয়েছে। দু’পাশে দখল করে নিয়েছে দখলদাররা। ময়লা-আবর্জনা ফেলাবার ডাম্পিং জায়গা যেন এককালের এই খরস্রোতা নদী। দখল, ময়লা ফেলা ও ভরাটের কারণে নাব্যতা হারিয়ে মরা খালে পরিনত হয়েছে এটি এখন। দেখার যেন কেউ নেই। এবার বাংলাদেশ সফরে এককালের খরস্রোতা নদী বাসিয়ার চেহারা দেখে স্তম্ভিত হয়েছি।
এভাবে বৃহত্তর সিলেটে ও সারা দেশে কত নদী ও খাল অবহেলা ও দখলদারদের কারণে নাব্যতা হারিয়ে মরা খালে পরিণত হয়েছে তার খবর কি কেউ রাখে? সরকার রাখেন? এভাবে যদি হয় তখন বর্ষাকালে বা ভারত থেকে ঢল নামলে বা প্রচুর বৃষ্টিপাত হলে পানি যাবে কোথায়? এই বুঝটুকু জনসাধারণের নেই! নিজের যতটুকু করার তা না করে, নিজে সচেতন হয়ে নদীগুলো বাঁচিয়ে না রেখে বন্যা হলে শুধু সরকার আর ভারতকে দায়ী করলে হবে?
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কিশোরগঞ্জের হাওরে দেয়া প্রায় ৩০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের অল ওয়েদার রোড। এই সড়কপথ মেঘালয় পর্বত থেকে নেমে আসা বৃষ্টির পানি ও পাহাড়ি ঢলের পানির স্বাভাবিক চলাচলের জন্য বড় ধরনের প্রতিবন্ধক। এই সড়কপথের কারণে পাহাড়ি ঢলের ফলে আসা বৃষ্টির পানিবাহিত পলিমাটি বা পলিমাটিযুক্ত পানি দ্রুত নিষ্কাশনের সুযোগ না পেয়ে স্থির হয়ে আছে। যার কারণে হাওর এলাকার নদ-নদীর নাব্যতা কমে গেছে। আগের পানি সেখানে জমে থাকার কারণে উজানের পানি ভাটিতে নেমে আসার হারও কমে গেছে। এ সড়কের নেতিবাচক প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি যা সাদাচোখে বুঝতে পারাটা কঠিন। রাস্তাটি তৈরির আগে পরিবেশ সমীক্ষা করা হয়েছিল কি না কিংবা হলেও সেই সমীক্ষা স্বাধীনভাবে করা হয়েছিল কি না, তা জানা নেই। এ নিয়ে গণমাধ্যমে ও সোসাল মিডিয়ায় অনেক লেখালেখি হচ্ছে। কিন্তু সরকার নীরব। এ ব্যাপারে সরকারের একটি স্পস্ট বক্তব্য বা ব্যাখ্যা আসা দরকার।
সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের প্রায় ৫৪ টি নদীর উজানে উৎসমুখে ভারত বাঁধ দিয়ে রেখেছে। বাংলাদেশ কিছুই করতে পারছে না। শত চেষ্টা করেও বাংলাদেশ তিস্তার বাঁধ ও পানি নিয়ে ভারতের সাথে চুক্তি করতে পারলো না, বাকীগুলো তো রয়েই গেল। খরার সময় পানি আটকিয়ে রাখে আবার বর্ষার সময় বাঁধের সব গেইট খোলা রাখে। এ যেন মরণফাঁদ ভাটির দেশ বাংলাদেশের জন্য। অথচ আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী উজানের দেশ হিসেবে ভারত নদীগুলোর উজানে ভারতীয় অংশে দেয়া বাঁধগুলোর সব গেট একতরফাভাবে খুলে দিতে পারে না।
এমতাবস্থায়, ছড়া, খাল ও নদীগুলোর অবৈধ দখলমুক্ত করে ব্যাপক হারে এগুলোর খনন কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। এর সাথে বিল ও হাওর খনন করতে হবে। সাথে সাথে এই আইন করতে হবে যে – ব্যক্তিগত মালিকানায় থাকা কোন ছড়া ও পুকুর বিনা প্রয়োজনে ভরাট করা যাবে না, ভরাট করতে হলে যথাযত কর্তৃপক্ষের লিখিত অনুমোদন নিতে হবে। ব্যক্তিগত মালিকানায় থাকা পুকুর খননের জন্য উৎসাহ ও প্রনোদনা ঘোষণা করা দরকার।
সত্তর দশকের শেষের দিকে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ‘খাল খনন কর্মসূচি’ ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। তার বিরোধী শিবিরে এ নিয়ে রাজনৈতিক সমালোচনাও ছিল। তবে তা ছিল খুবই ম্রিয়মান। এবারের সিলেটে শতাব্দির ভয়াবহ বন্যা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল শুধু খাল খনন নয় ব্যাপক হারে “খাল ও নদী খনন কর্মসূচি” শুরু করতে হবে, না হয় বাংলাদেশকে বাঁচানো কঠিন হবে। বন্যা এখন প্রায়ই হবে। কোন কোন সময় হবে মারাত্মক ও ভয়াবহ।
দেরী হবার আগে চিন্তা করুন, নতুবা দেশ ও জাতির অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেলে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা কোনভাবেই সম্ভব হবে না। সিলেট নগরী ও বৃহত্তর সিলেটকে নিয়ে তন্ময় চিত্তে স্বল্প মেয়াদী ও দীর্ঘ মেয়াদী চিন্তা ও ব্যাপক পরিকল্পনা করা এবং তা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা না গেলে সিলেটবাসীর কপালে আরো অনেক দু:খ আছে। যে কোন নদী ও খাল দখলদারদের বিরুদ্ধে শক্ত আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে দেশ ও জাতির স্বার্থে। পঞ্চাশ দশকের নকশা ধরে কঠোর হস্তে ব্যবস্থা নিয়ে গোটা দেশের খাল ও নদীগুলো উদ্বার করতে হবে। খাল ও নদী-নালা সরকারি সম্পত্তি (public properties)। এগুলোর দখলদার জাতির ও জনগণের শত্রু।
নাজির আহমদ: বিশিষ্ট আইনজীবী, সংবিধান বিশেষজ্ঞ, রাষ্ট্রচিন্তক এবং ইংল্যান্ডের প্র্যাকটিসিং ব্যারিস্টার।
Email: ahmedlaw2002@yahoo.co.uk