ছেলের জন্য পাত্রী দেখতে গিয়েছিলেন, এসে শুনলেন ছেলে নেই

Spread the love

তারেকুজ্জামান শিমুল,বিবিসি নিউজ বাংলা, ঢাকা

“ছেলের জন্য পাত্রী দেখতে গেছিলাম, ফিরে এসে শুনি ছেলেটা আমার বেঁচে নেই,” কথাগুলো বলতে গিয়ে গলা ধরে আসছিল আব্দুর রাজ্জাকের।

মি. রাজ্জাকের একমাত্র ছেলে হাসিব ইকবাল কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে শুরু হওয়া সাম্প্রতিক সহিংসতায় নিহত হয়েছেন।

পরিবারের ভাষ্যমতে, সাতাশ বছর বয়সী মি. ইকবাল বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। গত শুক্রবার দুপুরে ঢাকার মিরপুর এলাকার নিজ বাসা থেকে তিনি জুমার নামাজ পড়তে বের হয়েছিলেন।

“আমাদের এক সঙ্গেই নামাজে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আমার একটু দেরি হওয়ায় ও একাই মসজিদের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিল,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন নিহত ইকবালের বৃদ্ধ বাবা মি. রাজ্জাক।

প্রায় ৬৮ বছর বয়সী মি. রাজ্জাক নামাজ শেষে বাড়ি ফিরে আসেন।

“ওইদিন নামাজের পর আমার একটা দাওয়াত ছিল। মূলত ছেলের জন্য পাত্রী দেখার একটা অনুষ্ঠান ছিল। সে কারণে দ্রুত বাসায় ফিরে আমি দাওয়াতের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ি,” বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. রাজ্জাক।

নামাজের পর প্রায় তিন ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও বাড়িতে ফেরেননি হাসিব ইকবাল। ফলে দুশ্চিন্তায় উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন স্বজনরা।

“বিকেলে বাসায় ফিরে শুনি ছেলে ফেরেনি। বাইরে তখন গেঞ্জাম চলছিল। ফলে স্বাভাবিকভাবেই আমরা টেনশনে পড়ে যাই এবং সম্ভাব্য সবখানে খোঁজ নিতে শুরু করি,” বিবিসি বাংলাকে বলেন ইকবালের বাবা মি. রাজ্জাক।

প্রায় দেড় ঘণ্টা খোঁজাখুঁজির পরও মি. ইকবালের কোনও সন্ধান পায়নি পরিবার। পরে সন্ধ্যায় তার মৃত্যুর খবর আসে।

“সন্ধ্যার দিকে হঠাৎ একটা ছেলে ফোন দিয়ে বললো: আঙ্কেল, হাসিবের গোসল শেষ। ওর লাশ নিয়ে যান,” বিবিসি বাংলাকে বলতে গিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন মি. রাজ্জাক।

পরিবার যখন মরদেহ বুঝে পায়, তখন মি. ইকবালের শরীরে কাফনের কাপড় পরানো ছিল।

“আমরা শুনেছি যে, দুপুরেই ওর মৃত্যু হয়েছিল,” বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. রাজ্জাক।

তিনি আরও বলেন, “এরপর পুলিশ ওর লাশ আঞ্জুমানে মফিদুলের কাছে পাঠিয়ে দেয়। তারাই গোসল, কাফন- এগুলো করেছে।”

‘আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম’ হচ্ছে বাংলাদেশের একটি দাতব্য সংগঠন, যারা বেওয়ারিশ বা পরিচয়হীন মানুষের মরদেহ সমাধিস্থ করে থাকেন।

মৃত্যুর পর তাৎক্ষণিকভাবে পরিচয় শনাক্ত করতে না পেরে মি. ইকবালের মরদেহকে ‘বেওয়ারিশ’ ঘোষণা করে পুলিশ। এরপর পরিচয় মিললো কীভাবে?

“আঞ্জুমানে মফিদুলে নেওয়ার পর আমাদের এলাকার কিছু ছেলে হাসিবকে দেখে চিনতে পারে। তারাই আমাকে ফোন করে খবরটা দেয়,” বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. রাজ্জাক।

স্বজনরা বলছেন, মি. ইকবাল স্বভাবে বেশ শান্ত প্রকৃতির ছিলেন এবং বেকার না হওয়ায় কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গেও তার কোনও যোগ ছিলো না। তাহলে সহিংসতায় প্রাণ হারালেন কীভাবে?

“ডাক্তার ওর ডেথ সার্টিফিকেটে লিখেছে যে, শ্বাসকষ্টজনিত কারণে মৃত্যু হয়েছে,” বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. রাজ্জাক।

তিনি আরও বলেন, “তাদের ধারণা (চিকিৎসকদের), সংঘর্ষ চলাকালে আমার ছেলে হয়তো পুলিশের টিয়ার শেলের মধ্যে পড়েছিল।”

তবে সমাধিস্থ করার আগে মি. ইকবালের বুকের কাছে ‘কালচে’ ধরনের দাগ দেখতে পেয়েছেন স্বজনরা।

“কাফনে মোড়ানো থাকায় আমরা পুরো বডি সেভাবে দেখতে পারিনি। তবে ওর বুকের উপরের অংশে কালচে মতো একটা দাগ দেখা যাচ্ছিল,” বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. রাজ্জাক।

যদিও বিষয়টি নিয়ে তিনি পুলিশের কাছে কোনও অভিযোগ করেননি।

“এগুলো করে আর কী হবে? আমার ছেলে তো আর ফিরে আসবে না,” বিবিসি বাংলাকে বলেন ইকবালের বাবা।

“আমার একটামাত্র ছেলে, আমার বংশের প্রদীপ। ওকে এভাবে হারাবো, স্বপ্নেও ভাবিনি,” দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন মি. রাজ্জাক।

আন্দোলনকারীদের ধাওয়া করছে পুলিশ

ঢাকায় চাকরি খুঁজতে এসে মৃত্যু

২১ বছর বয়সী মারুফ হোসেন। কুষ্টিয়া পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে পড়াশোনা শেষ করে সপ্তাহ তিনেক আগে ঢাকায় এসেছিলেন চাকরি খুঁজতে।

গত শুক্রবার দুপুরে বাড্ডা এলাকায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষ চলাকালে মি. হোসেনের পিঠে গুলি লাগে।

পরে তিনি হাসপাতালে মারা যান।

“ওরা আমার একমাত্র ছেলেরে গুলি করে মেরে ফেললো! আমার মারুফ আর ফিরে আসবে না,” আহাজারির সুরে বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মি. হোসেনের মা ময়না খাতুন।

ছেলের সঙ্গে তার শেষবারের মতো কথা হয়েছিল শুক্রবার সকাল এগারোটার দিকে।

“আমরা ওরে বার বার করে বলে দিলাম যেন গণ্ডগোলের মধ্যে বাইরে বের না হয়,” বিবিসি বাংলাকে বলেন মিজ খাতুন।

“ও বললো: মা, তুমি চিন্তা করো না, আমি রুমেই আছি,” যোগ করেন তিনি।

এ ঘটনার প্রায় চার ঘণ্টা পর স্বজনরা জানতে পারেন যে, মি. হোসেনকে আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।

“ঢাকা থেকে মারুফের এক বন্ধু ফোন করে আমাকে বলে যে, আপনারা দ্রুত ঢাকা চলে আসেন। মারুফ আহত হয়েছে,” বিবিসি বাংলাকে বলেন নিহত মি. হোসেনের বাবা মোহাম্মদ শরিফ।

মি. শরিফ অবশ্য তখনও জানতেন না যে, তার ছেলে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।

“ছেলে আহত হয়েছে শুনে তাৎক্ষণিকভাবে আমরা ঢাকায় এক আত্মীয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করি। খোঁজখবর নিয়ে সে পরবর্তীতে আমাদের জানায় যে, গুলি লেগে মারুফ মারা গেছে,” বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. শরিফ।

কিন্তু সদ্য ঢাকায় আসা মি. হোসেন গুলিবিদ্ধ হলেন কীভাবে?

একজন বিক্ষোভকারীকে চ্যাংদোলা করে ধরে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ
একজন বিক্ষোভকারীকে চ্যাংদোলা করে ধরে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ

“ঢাকায় যাদের সঙ্গে আমার ছেলে থাকতো, তারা বলেছে যে, দুপুরে সংঘর্ষ শুরু হলে উৎসুক সবাই গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়,” বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. শরিফ।

তিনি আরও বলেন, “কিছুক্ষণের মধ্যে গোলাগুলি শুরু হলে বাকিদের মতো মারুফও বাসার দিকে দৌড় দেয়। তখনই ওর পিঠে গুলি লাগে।”

প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে মি. শরিফ বলছেন যে, গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর তার ছেলে দীর্ঘক্ষণ রাস্তায় পড়ে ছিলো। পরে যে সময় তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়, ততক্ষণে সে মারা গেছেন।

“হাসপাতালে নেয়ার পর ডাক্তার নাকি ওদের বলেছে যে, মারুফ আগেই মারা গেছে,” বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. শরিফ।

দুই ভাই-বোনের মধ্যে মারুফ হোসেন ছিলেন বড়। তার বাবা মি. শরিফ পেশায় একজন ফল বিক্রেতা।

ছেলেকে লেখাপড়া করাতে গিয়ে তিনি তার আয়ের সবটুকু খরচ করেছেন বলে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন।

“আয়ের সবটুকু দিয়ে কত কষ্টে ছেলেটারে পড়াশোনা করালাম। কত স্বপ্ন ছিল, ছেলেটা চাকরি করবে, সংসারের হাল ধরবে, আর অভাব থাকবে না,” বলছিলেন মি. শরিফ।

“সেই ছেলে আমার চাকরি খুঁজতে যেয়ে গুলিতে মারা গেলো,” বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন মি. শরিফ।

‘ও ভাই, আমি আগুনে আটকা পড়ছি’

পাবনা সদর উপজেলার চর ভাবানিপুর গ্রামের বাসিন্দা সেলিম মন্ডল।

পেশায় নির্মাণ শ্রমিক মি. মন্ডল মাসখানেক আগে ঢাকায় এসেছিলেন। কাজ করছিলেন নারায়ণগঞ্জে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পার্শ্ববর্তী একটি নির্মাণাধীন ভবনে।

ওই ভবনের দোতলার একটি কক্ষে অস্থায়ীভাবে বসবাস করছিলেন নির্মাণ শ্রমিকরা।

গত শনিবার দুপুরে ওই এলাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকার সমর্থকদের সংঘর্ষ শুরু হলে ভবনের নির্মাণকাজ বন্ধ হয়ে যায়।

এরপর মি. মন্ডলসহ অন্য শ্রমিকরা ভবনের দোতলায় নিজেদের কক্ষে চলে যান।

এর ঘণ্টা দেড়েক পর ভবনের নিচতলায় আগুন লাগে।

“বিকেল সাড়ে চারটার দিকে যখন আগুন লাগে, তখন শ্রমিকদের অনেকেই ঘুমাচ্ছিলো,” বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. মন্ডলের বড় ভাই ওয়াজ মন্ডল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই দোতলা পেরিয়ে আগুন ছড়িয়ে পড়ে ভবনের তিন তলা পর্যন্ত। আগুনে আটকে পড়লে বাড়িতে ফোন করেন সেলিম মন্ডল।

“কান্না-কাটি করতে করতে সেলিম শুধু বলতেছিলো, ও ভাই আমি আগুনে আটকা পড়ছি। মনে হয় বাঁচবো না,” বিবিসি বাংলাকে বলেন বড় ভাই ওয়াজ মন্ডল।

আগুনের ঘটনার সময় মি. মন্ডলের সঙ্গে অনিক নামে তার এক ভাতিজাও ছিল। প্রাণে বাঁচতে তিনি দোতলা থেকে লাফ দেন।

মি. অনিক এখন গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি আছেন।

“এর সঙ্গে কথা বলেই পরে আমরা জানতে পারি যে, সেলিম বের হতে পারেনি,” বিবিসি বাংলাকে বলেন ওয়াজ মন্ডল।

পরে ঘটনাস্থল থেকে মি. মন্ডলসহ তিনজনের অগ্নিদগ্ধ মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

নাশকতার উদ্দেশ্যে ভবনের নিচতলার শুকনো কাঠে আগুন দেওয়া হয়েছিল বলে ধারণা করছে পুলিশ। তবে কে বা কারা আগুন দিয়েছে, সেটি নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

এদিকে, ২৭ বছর বয়সী মি. মন্ডলের মৃত্যুর খবর জানার পর তার স্ত্রী বারবার মুর্ছা যাচ্ছেন।

“কান্না-কাটি করতে করতে সে বার বার অজ্ঞান হয়ে পড়তেছে। পরে ডাক্তার এসে ঘুমের ওষুধ আর স্যালাইন দিয়ে গেছে,” বিবিসি বাংলাকে বলেন বড়ভাই ওয়াজ মন্ডল।

মি. মন্ডলের ঘরে চার বছর বয়সী একটি মেয়ে রয়েছে।

“ছোট্ট এই মেয়েটা এখন কাকে আব্বা বলে ডাকবে?” আহাজারির সুরে বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন ওয়াজ মন্ডল।

তিনি আরও বলেন, “জমি-জায়গা, ধন-সম্পত্তিও কিছু নেই। সংসার চলবে কীভাবে?”

কোটা সংস্কারের দাবিতে গত জুনে আন্দোলন শুরু করার পর শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকার সমর্থকদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়।

এসব সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত অন্তত ১৩৩ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, যাদের অনেকে শিক্ষার্থী ও শ্রমিক বলে জানা যাচ্ছে।


Spread the love

Leave a Reply