কোটা সংস্কার আন্দোলনের আরো দুইজন সমন্বয়ককে ‘তুলে নেয়ার’ অভিযোগ
কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুম এবং আরিফ সোহেলকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে তাদের পরিবার।
নুসরাত তাবাসসুম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং কোটা বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক। তাকে আজ ভোরে মিরপুরের রূপনগরের বাসা থেকে ডিবি পুলিশের পরিচয়ে তুলে নিয়ে গেছে বলে অভিযোগ করেছে তার পরিবার।
আর আরিফ সোহেল কোটা সংস্কার আন্দোলনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সমন্বয়ক ছিলেন।
তার পরিবার জানিয়েছে, শনিবার দিবাগত রাত সোয়া তিনটার দিকে সাদা পোশাকধারী আট-নয়জনের একটি দল আরিফ সোহেলকে তুলে নিয়ে যায়। এসময় তারা ডিবি পুলিশের পরিচয় দেয়।
রোববার দুপুরে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) প্রধান হারুন-অর রশীদ নিশ্চিত করেছেন, ‘নিরাপত্তার স্বার্থে’ নুসরাতকে ডিবির হেফাজতে আনা হয়েছে।
তবে,আরিফ আরিফ সোহেলের বিষয়টি সাভারের আশুলিয়া থানা কিংবা ডিবি পুলিশের পক্ষ থেকে এখনো নিশ্চিত করা যায়নি।
এর আগে শনিবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুইজন সমন্বয়ক সারজিস আলম এবং হাসনাত আব্দুল্লাহকে গোয়েন্দা পুলিশ তাদের ‘হেফাজতে’ নিয়েছে।
তার আগে শুক্রবার বিকেলে ঢাকার গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল থেকে চিকিৎসারত অবস্থায় আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ ও আবু বাকের মজুমদারকে ‘তুলে নিয়ে যাওয়ার’ অভিযোগ উঠে।
নুসরাতের পরিবারের অভিযোগ
নুসরাত তাবাসসুমের ফুফাতো বোন মেহের নিগার মিষ্টি বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, ভোরে মিরপুরের রূপনগরের যেই বাসা থেকে নুসরাতকে তুলে নেয়া হয়েছে সেখানে পাশাপাশি দুই ফ্ল্যাটে বসবাস করেন তারা।
“ভোরে মূল গেইট ভেঙ্গে সাদা পোশাকে একদল ব্যক্তি বিল্ডিংয়ে ঢুকে চার তলার দুইটি ফ্ল্যাটে দরজা ভেঙ্গে ফেলে। তারা নুসরাত ঠিকমতো পোশাক পরিবর্তনের সুযোগ পর্যন্ত দেয়নি।
এক নারীও ছিলো তাদের সাথে। ডিবি পরিচয় দিয়ে তারা নুসরাতকে নিয়ে গেছে,” মিজ নিগার বলছিলেন।
তিনি বলেন, নুসরাতকে বাসা থেকে নেয়ার সময় কোথায় নেয়া হচ্ছে জানতে চাইলে, তারা শুধু মিন্টো রোডে ডিবি অফিসে খোঁজ নেয়ার জন্য বলেছে।
প্রসঙ্গত, নুসরাত তাবাসসুম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের মাষ্টার্সের শিক্ষার্থী এবং তার ফেসবুক প্রোফাইলে তিনি নিজেকে গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির যু্গ্ম সদস্য সচিব এবং ছাত্র অধিকার পরিষদের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন।
এবারের কোটা বিরোধী আন্দোলনের শুরু থেকেই তিনি এর সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন।
আরিফের পরিবারের অভিযোগ
আরিফ সোহেলের বাবা মো. আবুল খায়ের বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, রাতে দুটি কালো গ্লাসের মাইক্রোবাসে করে এসে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তার বাড়িতে অভিযান চালানো হয়।
তিনি বলেছেন, “তাদের সবার হাতে অস্ত্র ছিলো। বাড়ির গেটে এসে গেট খুলতে বললো। পরিচয় জানতে চাইলে ডিবি পুলিশের কথা বলে।”
“তারা বললো, আংকেল গেট খুলেন। একটু চা খাবো। আমরা সরকারের লোক। তারপর গেট খুলে দিলে বাড়িতে এসে সার্চ শুরু করে। সবার মোবাইল ফোন জব্দ করে নেয়।”
মি. খায়ের জানান, তল্লাশি শেষে তার ছেলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়ক আরিফ সোহেলকে জিজ্ঞাসাবাদের কথা বলে সাথে করে নিয়ে যায়।
সঙ্গে বড় ছেলেকেও নিয়ে যায়। তবে পরে বড় ছেলেকে কিছুদূর এগিয়ে রাস্তায় নামিয়ে দেয়।
আরিফ সোহেলের পরিবার বিবিসিকে বলেছে, আরিফ সোহেলকে আটকের সময় আশুলিয়া থানায় যোগাযোগ করতে বলা হয়। তবে ভোরেই তারা আশুলিয়া থানায় গেলে সেখান থেকে কাউকে আটকের কথা স্বীকার করা হয়নি।
“আমরা উদ্বিগ্ন। তাকে কোথায় নেয়া হয়েছে সেটা জানতে পারছি না।” বলেন আরিফ সোহেলের পিতা আবুল খায়ের।
পুলিশ কী বলছে?
রোববার দুপুরে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) প্রধান হারুন-অর রশীদ সাংবাদিকদের নিশ্চিত করেছেন, ‘নিরাপত্তার স্বার্থে’ নুসরাতকে ডিবির হেফাজতে আনা হয়েছে।
তবে, আরিফ সোহেলের বিষয়ে জানতে বিবিসি বাংলার পক্ষ থেকে আশুলিয়া থানায় যোগাযোগ করা হলে থানার অপারেশনের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা জানান, তাদের পক্ষ থেকে আরিফ সোহেল নামে কাউকে আটক বা গ্রেফতার করা হয়নি।
অন্যদিকে, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ কার্যালয়ের পক্ষ থেকেও এ বিষয়ে এখনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
এর আগে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মোট পাঁচজনকে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ বা ডিবির ‘হেফাজতে’ নেয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছে গোয়েন্দা পুলিশ।
শনিবার মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত উপ-কমিশনার জুনায়েদ আলম সরকার বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, “গত কয়েকদিনে ঘটে যাওয়া ঘটনার বিষয়ে জানতে ও তাদের নিরাপত্তার স্বার্থে ডিবি হেফাজতে নেয়া হয়েছে।”
শিক্ষার্থীদের আল্টিমেটাম
এদিকে, সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার করে আদালতের রায় পর সরকারের জারি করা প্রজ্ঞাপনকে প্রত্যাখ্যান করেছে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
শনিবার রাতে অনলাইনে সংবাদ সম্মেলন করে নতুন তিন দাবিতে সরকারকে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেয় কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা।
এসব দাবি মানা না হলে পরবর্তীতে আরো ‘কঠোর কর্মসূচি’ ঘোষণার কথা জানান তারা।
শনিবার রাতে এক অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কয়েকজন সমন্বয়ক জানান, পুলিশের ধরপাকড়সহ নানা কারণে সব সমন্বয়কদের সাথে তারা যোগাযোগ করতে পারছেন না।
যে কারণে সমন্বিতভাবে তারা কোন কর্মসূচি ঘোষণা করতে পারছেন না।
আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক মাহিন সরকার সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “আন্দোলনের মূল দাবি মেনে নেয়া হয়েছে বলে প্রচার করছে সরকার। কিন্তু আমাদের দাবি ছিল কমিশন গঠন করে এই সংকটের সমাধান করা। কিন্তু সেটি করা হয়নি বলেই আমরা এই পরিপত্র প্রত্যাখ্যান করছি।
অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ ও আবু বাকের মজুমদারসহ সমন্বয়কদের গ্রেফতার ও মামলা হামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন আন্দোলনকারীরা।
সংবাদ সম্মেলনে সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসুদ বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সমন্বয়কদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এখন পর্যন্ত তিন হাজারের বেশি শিক্ষার্থীকে আটক করা হয়েছে বলে তারা অভিযোগ করেছে।
বাংলাদেশে ২০১৮ সালের কোটা বিরোধী আন্দোলনের পর সরকার কোটা বাতিল করে যে পরিপত্র দিয়েছিলো সেটি গত পাঁচই জুন বাতিল করে দেয় হাইকোর্ট।
মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের পক্ষ থেকে রিট করার প্রেক্ষিতে ওই রায় দিয়েছিলো হাইকোর্ট। পরে ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে সরকার পক্ষ। কিন্তু এর মধ্যেই শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ বিক্ষোভ শুরু করে।
দোসরা জুলাই থেকে এ নিয়ে আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে। পরে বিভিন্ন ঘটনার ধারাবাহিকতায় ১৬ই জুলাই সহিংসতায় আবু সাঈদ সহ ছয় জন মারা যায়।
এরপর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংঘাতে জড়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
কোটা আন্দোলন ঘিরে ব্যাপক সংঘর্ষের পর বৃহস্পতিবার ১৮ই জুলাই থেকে বন্ধ হয়ে যায় ইন্টারনেট সেবা, আর তার আগেই বন্ধ করে দেয়া হয় মোবাইল ইন্টারনেট।
এমন প্রেক্ষাপটে শুক্রবার সকাল থেকে ঢাকা শহরে সব ধরনের সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ। পরে ওইদিন দিবাগত রাত ১২টা থেকে সারাদেশে জারি করা হয় কারফিউ।
এটি ছিল প্রায় ১৭ বছর পর বাংলাদেশে কারফিউ জারির ঘটনা। এর আগে সর্বশেষ ২০০৭ সালে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় কারফিউ জারি করা হয়েছিল।
বাংলাদেশে ১৬ই জুলাই থেকে ২১শে জুলাই পর্যন্ত টানা নজিরবিহীন বিক্ষোভ আর সহিংস আন্দোলনে ১৫০ জনের বেশি মানুষ নিহত হবার ঘটনা ঘটেছে।