‘রক্ত লাল’ দেশ – বিদেশে ছাত্র হত্যার প্রতিবাদ

Spread the love

ডেস্ক রিপোর্টঃ ‘রক্ত লাল’ প্রতিবাদে গতকাল সরব হয়েছিল পুরো দেশ। এই প্রতিবাদ চলেছে অনলাইন ও অফলাইনে। লালে লাল হয়ে উঠেছিল অনেকের ফেসবুক প্রোফাইল। মুখে মাথায় লাল কাপড় বেঁধে মিছিল-র‌্যালি হয়েছে স্থানে স্থানে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যুক্ত হয়েছিলেন এসব কর্মসূচিতে। শিল্পী-সংস্কৃতিসেবীরাও যোগ দেন এতে। মুখে ও চোখে লাল কাপড় বেঁধে প্রতিবাদ করতে দেশবাসীকে আহ্বান জানিয়েছিলেন কোটা বিরোধী আন্দোলনকারীরা। যে আহ্বানে সাড়া দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকসহ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই কর্মসূচিতে যুক্ত হন বহু মানুষ। প্রবাসী বাংলাদেশিরাও লাল রঙের এ প্রতিবাদে যুক্ত হন। মূলত আন্দোলন ঘিরে দেশব্যাপী শিক্ষার্থীদের ওপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্বিচারে গুলিতে বহু হতাহতের ঘটনায় প্রতিবাদ জানাতে লাল রঙ বেছে নিয়েছে আন্দোলনকারীরা।

সরকার যখন হতাহতের ঘটনায় দেশব্যাপী শোক পালনের সিদ্ধান্ত নেয় ঠিক তখন লাল রঙে প্রতিবাদে শামিল হতে ভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কয়েকজন সমন্বয়ক। লাল রঙের কাপড়ে মুখ ও চোখ বেঁধে ছবি তুলে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক প্রোফাইলে দেয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়। শিক্ষার্থীদের এ আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন শিক্ষক, শিক্ষার্থী, রাজনীতিক, শিল্পী, সংস্কৃতিকর্মী, সাংবাদিক, লেখক, আইনজীবী, মানবাধিকারকর্মী থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ডিপি চেঞ্জ করা ছাড়াও অনেকে রাস্তায় নেমেও লাল কাপড় বেঁধে প্রতিবাদ করেছেন।

ওদিকে আজ সারাদেশের আদালত প্রাঙ্গণে ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছেন কোটা সংস্কারের আন্দোলনকারীরা। গতকাল সকাল থেকেই ফেসবুকে লাল রঙের ডিপিতে সয়লাব হয়ে পড়ে। অনেকে নিজেদের প্রোফাইল লাল রঙের ছবিতে পরিবর্তন করেছেন। একইসঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন নানা মতও। লাল কাপড়ে মুখ বেঁধে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদে অংশ নিয়েছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। গানের মিছিল বের করেছে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন। অভিভাবকরাও নেমেছেন লাল প্ল্যাকার্ড হাতে।
No photo description available.
প্রোফাইল পিক পরিবর্তন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সাইফুল আলম চৌধুরী লিখেছেন, এত মানুষের মৃত্যুর পরও কেন মানুষ কালোকে বেছে না নিয়ে লালকে বেছে নিলো? আপনাদের ধ্বংসযজ্ঞ, ষড়যন্ত্র, তৃতীয় শক্তি, পানি ছিটানো, গুজব রোধ, নিরাপত্তা হেফাজত এসব তত্ত্ব আর ন্যারেটিভের বিরুদ্ধে এটা যে কতো বড় শক্ত প্রতিবাদ, সেটা আপনাদের মতো বড় বড় ন্যারেটিভের জন্মদাতা ও প্রচারকের বোঝার ক্ষমতা নেই। কালো যেখানে শোকের প্রতীক, লাল সেখানে বিপ্লব আর ভালোবাসার রং। লাল শৌর্যবীর্য আর সাহসিকতার প্রতীক। শিক্ষার্থীদের এ ক্যাম্পেইনে সমর্থন দিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও ফেসবুক প্রোফাইলে লাল ফ্রেম জুড়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। নরওয়ের অসলো ইউনিভার্সিটিতে কর্মরত বাংলাদেশি গবেষক মুবাশ্বার হাসান নিজের প্রোফাইল পিকচার লাল রঙে পরিবর্তন করেছেন যার মধ্যে একটি প্রতীকী ছবি। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, গণতন্ত্র লেখা আকৃতির একটি মানবদেহকে হামলা করা হচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধা আশরাফ আলী টিপুর লাল প্রোফাইল পিকচারে লেখা, আহারে মৃত্যু!! হায়রে স্বাধীনতা!! বিবিসি’র সাংবাদিক আকবর হোসেন লাল রঙে রাঙিয়ে লিখেছেন, পাঁচ বছর পর কাভার ফটো পরিবর্তন করলাম। লাকী ইসলাম লিখেছেন, তোমাদের শোক আর অভিনয় দুটোই ভাগাড়ে মিলাক। যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর আলী রীয়াজও তার প্রোফাইল পিকচার লাল রঙে পরিবর্তন করেছেন। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমানও তার কাভার ফটো লাল রঙে রাঙিয়েছেন। হ্যাশট্যাগ দিয়েছেন, রেড জুলাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর কামরুল হাসান মামুন লেখেছেন, ফুলগুলো সব লাল হলো ক্যান? লাল রঙের প্রোফাইল পরিবর্তনের এ স্রোতে যুক্ত হয়েছেন আইমান সাদিক, মুনজেরিন শহীদের মতো সোশ্যাল ইনফুলেয়েন্সাররাও। এদিকে শিক্ষার্থীদের সমর্থন দিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা রাজপথে নেমেছেন। এ সময় তারা লাল রঙের কাপড়ে চোখ ও মুখ বেঁধে দেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনের মহাসড়কে ‘নিপীড়নবিরোধী শিক্ষক সমাজ’-এর ব্যানারে কর্মসূচি পালন করা হয়। এতে প্রায় ২০০ শিক্ষক অংশ নেন। সমাবেশে শিক্ষকদের মধ্যে বক্তব্য দেন পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সালেহ হাসান নকীব, অধ্যাপক রায়হানা শামস ইসলাম, প্রাণরসায়ন বিভাগের অধ্যাপক রেজাউল করিম, প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম ফারুকী, ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক ইসমত আরা, অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খান, আরবি বিভাগের অধ্যাপক ইফতিখারুল আলম মাসউদ, মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক ফরিদুল ইসলাম প্রমুখ। এ ছাড়াও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও লাল কাপড়ে মুখ বেঁধে মৌন মিছিল করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ থেকে একটি মৌন মিছিল বের করেন। মিছিলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ঘুরে পুরাতন ফজিলাতুন্নেছা হল সংলগ্ন কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় নিহতদের স্মরণে নবনির্মিত ছাত্র-জনতা শহীদ স্মৃতিস্তম্ভের সামনে যায়। পরে সেখানে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। সেখান থেকে পুনরায় মিছিল নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা একই পথে শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে এসে শেষে হয়। সমাবেশে শিক্ষকরা দেশব্যাপী কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষদের হত্যা, তাদের ওপর হামলা, নির্যাতন ও আটকের ঘটনার প্রতিবাদ জানান। এ ছাড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জাবি শাখার অন্যতম সমন্বয়ক আরিফ সোহেলকে ‘মিথ্যা মামলায়’ রিমান্ড মঞ্জুর করার ঘটনার নিন্দা জানান। দর্শন বিভাগের প্রফেসর আনোয়ারুল্লাহ ভূঁইয়া বলেন, দুঃশাসন ও স্বৈরাচারী মন-মানসিকতার দুঃশাসক যখন রাষ্ট্রের শাসন ক্ষমতায় থাকে, তার পরিপূর্ণ নকশা ও বাস্তবায়ন আমরা দেখতে পাচ্ছি। শিক্ষার্থীরা যখন তাদের যৌক্তিক দাবি নিয়ে রাস্তায় নামে, তখন তাদের প্রতিরোধ করতে রাষ্ট্রের বাহিনী, নানান যন্ত্র ও তাদের মদতপুষ্ট সংগঠনগুলো সাধারণ শিক্ষার্থীদের আহত করেছে। এখন আবার সরকার শিক্ষার্থীদের নির্বিচারে আটক করছে, জেলে নিয়ে নির্যাতন করছে। ৭১’র কাল রাতের যে ভয়াবহ অবস্থা ছিল, তা আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে সংহতি প্রকাশ করেছেন। শিক্ষার্থীদের হত্যার বিচার এবং শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার-হয়রানি বন্ধ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ধশতাধিক শিক্ষক এতে অংশ নেন। সকাল সাড়ে ১১টায় ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বাইরে মানববন্ধন করেন তারা। সেখানে অনেকের হাতে লাল প্ল্যাকার্ড দেখা যায়। গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিজ উদ্যোগে চলমান আন্দোলনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে এই কর্মসূচি আয়োজন করেছেন। কর্মসূচিতে নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চারটি অনুষদের সব বিভাগের প্রায় ৫০ জন শিক্ষক অংশ নেন। তাদের হাতে ‘নিরস্ত্র ছাত্র হত্যার বিচার চাই’, ‘দমন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা’, ‘নিরস্ত্র ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার ও হয়রানি বন্ধ করতে হবে’, ‘শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা, মানসিক স্বাস্থ্য ও শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে’ ও ‘শিক্ষার্থীদের পাশে শিক্ষক’ লেখা প্ল্যাকার্ড ছিল।

প্রতিবাদী গানে হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ-মিছিলে পুলিশের বাধা: এদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে ছাত্র-জনতা হত্যা, নির্যাতন, গণগ্রেপ্তার, হামলা-মামলার প্রতিবাদে সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিবাদী গানের মিছিলে বাধা দিয়েছে পুলিশ। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী গতকাল বিকাল ৩টার দিকে গুলিস্তানের জিপিও মোড়ে অবস্থান নেন বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এ সময় তারা অনেকে লাল কাপড়ে মুখ বেঁধে নেন। এ ছাড়াও লাল প্ল্যাকার্ড গ্রহণ করেন। পরে বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে বাহাদুর শাহ পার্কের দিকে গানের মিছিল নিতে চাইলে জিপিও মোড়েই বাধা দেয় পুলিশ। এ সময় পুলিশের সঙ্গে বাকবিতণ্ডা ও ধস্তাধস্তির ঘটনা ঘটে সংগঠনের নেতাকর্মীদের। তারা পুলিশকে উদ্দেশ্য করে দুয়োধ্বনি দিতে থাকেন। পুলিশি বাধায় বাহাদুর শাহ পার্ক অভিমুখে যেতে না পারলেও জিপিও মোড়ের খদ্দর বাজার শপিং কমপ্লেক্সের সামনের সড়কে অবস্থান নিয়ে প্রতিবাদী গান করেন শিল্পীরা। এতে জিপিও থেকে গোলাপশাহ মাজার অভিমুখী সড়কটি বন্ধ হয়ে যায়। তবে বিপরীত সড়ক দিয়ে যান চলাচল স্বাভাবিক ছিল। প্রতিবাদী এই কর্মসূচিতে বিভিন্ন স্লোগান, প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করেন তারা। এসব প্ল্যাকার্ডে কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিহত শিক্ষার্থীদের ছবিসহ স্মরণ করা হয়। এ সময় তাদের সরকারবিরোধী এবং কোটা আন্দোলনের পক্ষে বিভিন্ন স্লোগান দিতে দেখা যায়। প্রতিবাদী গান ও স্লোগানের ফাঁকে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেন উদীচীর সহ-সভাপতি জামশেদ আহমেদ তপন। আগামী শুক্রবার বিকাল ৩টায় প্রেস ক্লাব থেকে শহীদ মিনার অভিমুখে শোক মিছিল করার ঘোষণা দেন তিনি। জামশেদ আহমেদ তপন বলেন, আমরা শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ মিছিল নিয়ে বাহাদুর শাহ পার্কের দিকে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পুলিশের বাধার কারণে সেটি সম্ভব হয়নি। সেজন্য আমরা সড়কেই অবস্থান নিয়ে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছি। আমরা থেমে থাকবো না। যেখানেই বাধা আসবে সেখানেই প্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে। জোরজবরদস্তি করে ক্ষমতায় টিকে থাকা যাবে না। তিনি আরও বলেন, স্বৈরাচার সরকার এতগুলো প্রাণ কেড়ে নিলো, এই সরকারকে আমরা পতন ঘটাবোই। আমাদের লাঠি, গুলি, টিয়ারগ্যাসের মধ্যদিয়ে দমানো যাবে না। আমরা বাংলাদেশের শিল্পী সমাজ চেতনার তাগিদে, প্রাণের তাগিদে আজ এখানে কাঁদতে এসেছি। আমাদের কি কান্না করারও সুযোগ নাই? হাহাকার করার সুযোগ নেই? আজকে ঘরে ঘরে কান্না হচ্ছে। ঘরে ঘরে মানুষ ট্রমাক্রান্ত। ঘুমাতে পারছে না। সেই মানুষকে আমরা সাহস দিতে চাই। তোমাদের সন্তানরা গেছে। কিন্তু আমরা বেঁচে আছি। আমাদের সবার সম্মিলিত আন্দোলনের প্রেক্ষিতে এই স্বৈরতন্ত্রকে আমরা উৎখাত করবো।


Spread the love

Leave a Reply