প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রীরা কি বিচারের উর্ধে?
রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে বা দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিকে বিচারের বা অভিযুক্তকরণের পদ্ধতি হচ্ছে অভিশংসন (Impeachment)।অভিশংসনের কারণের মধ্যে রয়েছে কর্তব্যে চরম অবহেলা, দুর্নীতির অভিযোগ, অসদাচরণ এবং রাষ্ট্রের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা ইত্যাদি।অভিশংসনের আওতায় পড়তে পারে দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীবর্গ, সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকগণ এবং সমমর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ। তবে বাংলাদেশের সংবিধানের ৫২ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতির অভিশংসনের কথা বলা হলেও প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রীগণের অভিশংসনের ব্যাপারে তেমন কোনো কথা নেই। এর দুটি ব্যাখ্যা হতে পারে, এক প্রধামন্ত্রীকে যখন তখন অভিশংসনের আওতায় আনা যাবে, অন্য ব্যাখ্যাটি হতে পারে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে প্রধানমন্ত্রীকে পরোক্ষভাবে এতো ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে যে তিনি ধরা ছোঁয়ার বাহিরে। অর্থাৎ, সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদের ফলে দলের/ দলীয়প্রধানের বিরুদ্ধে সংসদ সদস্যরা ভোট দিতে পারেন না। তারা দলের হাই কমান্ডের কাছে জিম্মি, দলীয় প্রধানের কথার বাহিরে যাওয়ার সুযোগ নেই। নিজস্ব কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতা তাদের নেই। যদিও পৃথিবীর উন্নত দেশে সংসদ সদস্যদের স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আছে। স্বয়ং দলীয় প্রধানের বিপক্ষেও কথা বলতে পারে। ব্রিটেনের পার্লামেন্টে আমরা অনেক সময়ই দেখে থাকি নিজ দলের বিপক্ষে গিয়েও সংসদ সদস্য বক্তব্য দেয়, বিলের সমালোচনা করে। মাত্র কয়েকদিন আগে সংসদ সদস্যদের অনাস্থা ভোটের কারণে পাকিস্তানের সাবেক প্রথানমন্ত্রী ইমরান খান পদচ্যুত হলেন।তার মানে হলো তার সংসদ সদস্যরা তাকে অপসারিত করার ক্ষমতা রেখেছিলো। বাংলাদেশে সংসদ সদস্যরা কি দলীয় প্রধানের বিপক্ষে যাওয়ার সাহস ও ক্ষমতা রাখে?
ব্রিটেনের ইতিহাসে দেখা যায়, ১৬৬৬ সালে হাউস অব কমন্স তৎকালীন ‘রাজার মুখ্যমন্ত্রী’ আর্ল অব দানবে, ১৭৭৬ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস, এবং ১৮০৬ সালে সরকারি অর্থ আত্মসাতের জন্য লর্ড মেল ভাইল অভিযুক্ত হন এবং অভিশংসনের সম্মুখীন হন।যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস থেকে দেখা যায় ১৭৮৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত মাত্র সাতজন ফেডারেল জজ অভিশংসনের কারণে অপসারিত হয়েছেন। ১৮৬৮ সালে প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু জনসন, ১৯৭৪ সালে ওয়াটার গেট কেলেঙ্কারির কারণে প্রেসিডেন্ট নিক্সন, ১৯৯৮ সালে প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন যৌন কেলেঙ্কারি নিয়ে মিথ্যার আশ্রয় নেয়ার কারণে অভিশংসনের সম্মুখীন হন। এই দুটো দেশের উদাহরণ দিলাম এই কারণে যে এই দেশগুলোর বিচার ব্যবস্থার উপর নির্বাহী বিভাগ নাক গলাতে পারে না। বিচারকগণ স্বাধীনভাবে বিচার কার্য সম্পাদন করতে সক্ষম। বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের দ্বন্দ্ব কম বেশী সব দেশেই বিদ্যমান, যেখানে বিচার বিভাগ চায় নির্বাহী বিভাগের লাগামকে টেনে ধরতে, অন্যদিকে নির্বাহী বিভাগ বিচার বিভাগকে একশ ভাগ নিয়ন্ত্রণে নিতে চায়। কিন্তু আমাদের দেশে নির্বাহী বিভাগ বিচার বিভাগকে গলা টিপে হত্যা করেছে যার কারণে বিচার বিভাগ মেরুদন্ডহীন বিভাগে পরিণত হয়েছে। এই কথাগুলো আগে বলে নিলাম এ কারণে যে আসলে বাংলাদেশের বিচার বিভাগ কি প্রধানমন্ত্রী বা অন্যান্য মন্ত্রীদেরকে অভিযুক্ত করার ক্ষমতা রাখে?
কোটার সংক্রান্ত বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে প্রধামন্ত্রীর দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য, ওবায়দুল কাদেরের উস্কানিমূলক বক্তেব্যের কারণে রাষ্ট্রীয় মদদে, রাষ্ট্রীয় বাহিনী দ্বারা এবং রাষ্ট্রীয় সহযোগী বাহিনী (ছাত্রলীগ ও যুবলীগ) নিরস্র ছাত্র ও সাধারণ জনগণকে যেভাবে হত্যা, আহত-নিহত, পঙ্গু করেই ক্ষান্ত হয়নি, বরং ইন্টারনেট ও যোগাযোগ ব্যাবস্থা বন্ধ করে দিয়ে বাসাবাড়ি থেকে গণ গ্রেফতার করেছে এবং নামে বেনামে মামলা দিয়েছে তা ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়। বর্তমান আওয়ামী সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে ৫৭ জন সেনা অফিসারকে হত্যা করে সেনাবাহিনীকে একটি মেরুদন্ডহীন বাহিনীতে পরিণত করে। ২০১৩ সালে আদালতের এক রায়কে কেন্দ্র করে জামায়াত-শিবিরের ১৫০ জনেকে এক দিনে হত্যা করে। আবার ২০১৩ সালে হেফাজতের উপর শাপলা চত্বরে বিদ্যুৎ বন্ধ করে রাতের অন্ধকারে শত শত হেফাজত কর্মীকে হত্যা করে। এবার ২০২৪ সালে জুলাই মাসের হত্যাযজ্ঞ অতীতের যেকোন হত্যাযজ্ঞের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো এত শত নিরস্র ছাত্র-জনতাকে হত্যা করলেও মন্ত্রীদের মধ্যে কোনো অপরাধবোধ বা মানবিকবোধ কাজ করেনি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বছিলো দেশের আইন শৃঙ্খলার পরিবেশ রক্ষা করা, এবং দেশের প্রতিটি নাগরিকের জান-মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। অথচ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা পুলিশ, RAB, বিজিবি ও সেনাবাহিনী কর্তৃক এতগুলো হত্যাকান্ড সংঘটিত হলো অথচ তাদের মধ্যে কোনো চেতন নেই বরং এই হত্যাযজ্ঞের জন্য বিরোধী পক্ষকে দায়ী করার হীন প্রচেষ্টা উদ্বগের সাথে লক্ষ্য করেছি। পাশাপাশি, ইন্টারেনট বন্ধ করে বাংলাদেশকে দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে, আপনজনকে তার প্রিয়জন থেকে বিচ্ছিন্ন করে যে অন্যায়-অপরাধ করলো বা দায়িত্বের অবহেলা করলো তা নিয়েও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর কোনো মাথা ব্যথা নেই। নূন্যতম ক্ষমা প্রার্থনা করার মানসিকতাও আমরা দেখলাম না। বরং ভিন দেশের আস্কারায় ও প্রেসক্রিপশনে কাশ্মীর দমনের স্টাইলে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার উপর ইতিহাসের নির্মম হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা করা ও গণ গ্রেফতার অব্যাহত রাখা এবং এই হত্যাযজ্ঞ নিয়ে কটূক্তি, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি ও নাটক রয়েছে চলমান।
আমরা প্রায়ই দেখতে পাই উন্নত বিশ্বে কোনো মন্ত্রণালয়ের অধীনে মন্ত্রীর অধীনস্তদের অবহেলার কারণে জান-মালের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হলে মন্ত্রী সবার আগে দায় স্বীকার করে এবং মন্ত্রণালয় থেকে পদত্যাগ করে। এটি পাশ্চাত্যের সৌন্দর্য। কিন্তু বাংলাদেশে গত ১৫ বছরে হাজার হাজার দুর্নীতির খতিয়ান, বড় বড় ৪টি হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হলো রাষ্ট্রীয় মদদে, রাষ্ট্রীয় বাহিনী দ্বারা এবং রাষ্ট্রীয় সহযোগী বাহিনীর দ্বারা, প্রধানমন্ত্রী বা অন্যকোনো মন্ত্রী অথবা কোনো পুলিশ কর্মকর্তাও বিব্রতবোধ করেনি, পদত্যাগ করেনি, দায়িত্বে অবহেলার জন্য ক্ষমা চায়নি, বিচারের মুখোমুখি হয়নি; যার কারণে একেকটি হত্যাযজ্ঞ পরবর্তী হত্যাযজ্ঞ সংঘটনে আরো উৎসাহিত করেছে। অপরাধ করে অপরাধের দায় স্বীকার না করা যে আরো বড় অপরাধ তা তাদের দিমাগেও আসে না।
এমতাবস্থায়, প্রচলিত আইনে বাধা না থাকলেও, একদলীয় ও স্বৈরতান্ত্রিক সরকার ব্যাবস্থার কারণে প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রীদেরকে বিচারের মুখোমুখী করা যাচ্ছে না। তবে অদূর ভবিষ্যতে যে বিচারের মুখোমুখী হবে না, তা কিন্তু বলা যায় না।
লেখকঃ ব্যারিষ্টার ওয়াহিদ মুহাম্মদ মাহবুব
০১/০৮/২০২৪, লন্ডন।