দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের প্রতিবাদ; শহীদ মিনারে হাজারো বিক্ষোভকারী

Spread the love

ডেস্ক রিপোর্টঃ কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে চলমান কর্মসূচির অংশ হিসেবে রাজধানীর সাইন্সল্যাব, উত্তরা, আফতাবনগর ও বায়তুল মোকাররম এলাকায় হাজার হাজার শিক্ষার্থী ও জনতা বিক্ষোভ মিছিল করছে। শুক্রবার সকালে উত্তরা ও আফতাব নগরে এবং জুমার নামাজ শেষে সাইন্সল্যাব ও বায়তুল মোকাররম এলাকায় এসব মিছিল শুরু হয়।
এ সময় তাদের নানা স্লোগান দিতে দেখা গেছে। সাইন্সল্যাব মোড়ে অবস্থান নেয়। অন্যদিকে রাজধানীর বায়তুল মোকাররম থেকে শুরু হওয়া মিছিলটি হাইকোর্ট হয়ে শাহবাগে যায়। প্রেস ক্লাবে জড়ো হওয়ার পর শহীদ মিনারের দিকে ‘শিক্ষার্থী- জনতা দ্রোহযাত্রা সম্বলিত ব্যানারযুক্ত মিছিল নিয়ে এগোতে থাকে আন্দোলনকারীরা। এদিকে বেলা ১১টার দিকে বৃষ্টিতে ভিজে রাজধানীর আফতাবনগরে ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়, মহাখালিতে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ও উত্তরা ৬ নম্বর সেক্টরে রাজউক উত্তরা মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা গণমিছিল করে। মিছিলে থাকা বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর গলায় পরিচয়পত্র ছিল।
এ সময় শিক্ষার্থীরা কোটা আন্দোলন ঘিরে সৃষ্ট সংঘাতে হতাহতের ঘটনায় বিচার দাবি করেন। এছাড়া তারা গ্রেপ্তার শিক্ষার্থীদের মুক্তির দাবিতে ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’সহ নানা ধরনের স্লোগান দেন। মিছিলের সামনে ও পেছনে পুলিশ ছিল।
এর আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আজ  ‘প্রার্থনা ও ছাত্র-জনতার গণমিছিল’ কর্মসূচি ঘোষণা করে। এতে বলা হয়, আজ সারা দেশের মসজিদে জুমার নামাজ শেষে দোয়া-কবর জিয়ারত, মন্দির, গির্জাসহ সব প্রার্থনালয়ে প্রার্থনা ও জুমার নামাজ শেষে ছাত্র-জনতার গণমিছিল অনুষ্ঠিত হবে। দেশের সব স্তরের নাগরিকদের এই কর্মসূচিতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেয়ার আহ্বান জানানো হয়।

সায়েন্সল্যাব থেকে সহস্রাধিক আন্দোলনকারীর মিছিল

শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর সায়েন্সল্যাব মোড় থেকে সহস্রাধিক আন্দোলনকারী মিছিল করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে অগ্রসর হয়েছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা ‘গণমিছিল কর্মসূচি’র অংশ হিসেবে শুক্রবার জুমার নামাজের পর থেকেই সায়েন্সল্যাব মোড় অবরোধ করে একদল শিক্ষার্থী। বাটা সিগন্যাল মোড় থেকে বিবিসির সংবাদদাতা জানান, ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মধ্যে মিছিলে সহস্রাধিক আন্দোলনকারীকে অংশ নিতে দেখা গেছে। এতে নারীদের উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ ছিল।এর আগে, বেলা আড়াইটার দিকে সায়েন্সল্যাব মোড় থেকে মিছিল নিয়ে আন্দোলনকারীরা আশেপাশের এলাকা প্রদক্ষিণ করে। এসময় সমস্বরে ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’সহ নানা ধরনের স্লোগান দিতে দেখা যায় তাদের। আন্দোলনকারীদের অবস্থানের কারণে এই সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

সায়েন্সল্যাব মোড় থেকে মিছিল নিয়ে বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে আন্দোলনকারীরা।
সায়েন্সল্যাব মোড় থেকে মিছিল নিয়ে বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে আন্দোলনকারীরা।

জুমার নামাজের পর চট্টগ্রামে গণমিছিল

শুক্রবার জুমার নামাজের পর চট্টগ্রাম নগরের আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ থেকে গণমিছিল বের করেন মুসল্লিরা।

প্রথমে মসজিদের সামনে পাঁচ থেকে ১০ মিনিট অবস্থান করে টেরিবাজার ও লালদীঘি হয়ে মিছিল এগিয়ে যায়।

পরে বৃষ্টির কারণে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে যায় বিক্ষোভকারীরা।

বৃষ্টি কমে এলে নিউমার্কেট এলাকায় জড়ো হয়ে অবস্থান নেয় তারা।

সেখানে ৩৫-৪০ মিনিট অবস্থান করে তারা। এতে সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

সহস্রাধিকের বেশি বিক্ষোভকারী গণমিছিলে অংশ নেয় বলে জানান স্থানীয় সংবাদকর্মীরা।

চট্টগ্রামে মিছিলে আন্দোলনকারীরা
চট্টগ্রামে মিছিলে আন্দোলনকারীরা

রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে গণমিছিল করেছে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী-জনতা

শুক্রবার সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে অবস্থান নেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা।

সেখানে আন্দোলনরত এক শিক্ষার্থী বলেন, “আমার ডেমোক্রেসি কোথায়? আমি আমার চোখের সামনে দেখেছি একটা মানুষের মুখ দিয়ে গড়গড় করে রক্ত বেরোচ্ছে। তাকে আমরা ঠিকমতো হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারি নাই।”

নিজের হাত দেখিয়ে ওই বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী বলেন, “আমি আমার হাত দিয়ে বুলেট বের করেছিলাম, বুলেট!! এটা আমার স্বাধীন দেশ? আমার স্বাধীনতা কোথায়?”

কর্মসূচিতে দাঁড়ানো আরেক বিক্ষোভকারী বলেন, “প্লিজ গুলি করা বন্ধ করুন, প্লিজ।”

এদিকে সাইন্সল্যাব মোড় ও সংলগ্ন এলাকায় ‘গণমিছিল’ করে অবস্থান নিয়েছে শিক্ষার্থীরা।

উত্তরায় শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

বৃষ্টির মধ্যেই উত্তরায় “ছাত্র-জনতার গণমিছিল” কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছে শিক্ষার্থীরা।

শুক্রবার সকাল থেকেই ঢাকার উত্তরায় রাজউক উত্তরা মডেল কলেজের সামনে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেন শিক্ষার্থীরা। তাদের সঙ্গে যোগ দেন অভিভাবকরাও।

“আমার ভাই জেলে কেন? এই মুহূর্তে মুক্তি চাই”,“আমার ভাইয়ের রক্ত বৃথা যেতে দেবো না”, “জেগেছে রে জেগেছে, ছাত্র সমাজ জেগেছে”, “we want justice”- এর মতো স্লোগান দেয় শিক্ষার্থীরা। এসময় তাদের হাতে প্ল্যাকার্ডও ছিল।

আন্দোলনে এক শিক্ষার্থী বলেন, “এই দেশটা কারো বাপের না। এই দেশটা সবার। এই দেশটা জনগণের।”

“আমি একজন সচেতন অভিভাবক। আমি প্রশ্ন করতে চাই- এটা কি কোনো গণতান্ত্রিক দেশ? প্রতিটা বাচ্চা আমার সন্তান। আমি বসে থাকতে পারি না। আমি বসে থাকতে পারিনি। সরকারের কাছে দাবি, এর সুষ্ঠু বিচার করুক,” বলেন একজন অভিভাবক।

ডিবি অফিস থেকে স্বেচ্ছায় ভিডিও বার্তা দেননি ছয় সমন্বয়ক

আন্দোলন প্রত্যাহার করে ডিবি অফিস থেকে স্বেচ্ছায় ভিডিও বার্তা দেননি বলে জানিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ক। বৃহস্পতিবার রাতে দেয়া এক বিবৃতিতে এমনটাই জানিয়েছেন তারা।

এতে বলা হয়, “আন্দোলন প্রত্যাহার করে ডিবি অফিস থেকে প্রচারিত ছয় সমন্বয়ককের ভিডিও স্টেটমেন্টটি আমরা স্বেচ্ছায় দেইনি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোনো সিদ্ধান্ত ডিবি অফিস থেকে আসতে পারে না। সারাদেশের সকল সমন্বয়ক ও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ব্যতীত কোনো সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে গৃহীত হবে না।”

বিবৃতিতে তাদের কীভাবে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, সাবেক ডিবি কর্মকর্তা হারুন অর রশীদের সঙ্গে টেবিলে খাওয়াসহ আন্দোলন এগিয়ে নেয়ার বিষয়ে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেছেন তারা।

এছাড়াও গুম, গ্রেফতার ও নির্যাতন থেকে নিরাপত্তা এবং মত প্রকাশের অধিকারের নিশ্চয়তা চাইলেও অসাংবিধানিক ও আইনবহির্ভূতভাবে তাদেরকে ডিবি হেফাজতে আটকে রাখা হয় বলে বিবৃতিতে জানানো হয়।

“ডিবি অফিসে আমাদের জোর করে খাবার টেবিলে বসিয়ে ভিডিও করা হয়। আমাদের ছেড়ে দেবার আশ্বাস দিয়ে পরিবারকে ডেকে ১৩ ঘণ্টা বসিয়ে রাখা হয় এবং মিডিয়ায় মিথ্যা স্টেটমেন্ট দেওয়ানো হয়। আমাদের শিক্ষকরা দেখা করতে আসলে, দেখা করতে দেওয়া হয়নি।”

এসময় সমন্বয়কদের আটক, সারাদেশে শিক্ষার্থীদের গ্রেফতার ও নির্যাতনের প্রতিবাদে ৩০ই জুলাই রাত থেকে সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ ও আবু বাকের ডিবি অফিসেই অনশন কর্মসূচী শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে তা জানতে পেরে সারজিস আলম, হাসনাত আব্দুলাহ ও নুসরাত তাবাসসুমও অনশন শুরু করেন।

গত সাতদিন ডিবি অফিসে তাদের ও তাদের পরিবারের সাথে ‘হয়রানি, নির্যাতন ও নাটকের’ তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানায় সমন্বয়করা।

একইসঙ্গে ‘ছাত্র-নাগরিক হত্যার বিচার ও আটককৃত নিরপরাধ ব্যক্তিদের মুক্তির দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে’ বলেও জানান তারা।

ধানমন্ডিতে শিল্পীদের প্রতিবাদ

রাজধানীর ধানমন্ডিতে আবাহনী মাঠের পাশে বেশ কিছু শিল্পী জড়ো হয়েছিলেন প্রতিবাদ জানাতে। তাদের মূল বক্তব্য ছিল বিক্ষোভের সময় নিরাপত্তা বাহিনী যেভাবে নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে এবং তাতে যে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে সেগুলোর বিচার করতে হবে।

তারা বলেন, কারফিউ জারির পর থেকে নিরাপত্তা বাহিনী নির্বিচারে গ্রেফতার করছে শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে।

“আমরা এখানে হত্যার প্রতিবাদ করতে এসেছি। রাত-বিরাতে বাসা থেকে ছাত্রদের তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এটার বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন ভিজ্যুয়াল আর্টিস্ট সৈয়দ জাকির হোসেন।

শিল্পীরা যখন সেখানে অবস্থান নিয়েছিলেন তখন তাদের সাথে সংহতি প্রকাশ করতে স্থানীয় কিছু বাসিন্দা ও পথচারী যোগ দিয়েছিলেন।

ধানমন্ডিতে শিল্পীদের প্রতিবাদ
ধানমন্ডিতে শিল্পীদের প্রতিবাদ

বনানীতে অভিভাবকদের প্রতিবাদ

শুক্রবার সকাল ১০টায় বনানীর কামাল আতাতুর্ক এভিনিউর ফুটপাতে জড়ো হয়েছিলেন কিছু অভিভাবক যাদের সন্তানরা বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালেয়ে পড়াশুনা করেন। বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে শিক্ষার্থী হত্যার বিচার ও সন্তানদের নিরাপত্তা দাবি করেন তারা।

সায়মা আহমেদ জয়া নামের একজন অভিভাবক বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, বিক্ষোভের সময় নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে নিহতের ঘটনার বিচার চান।

“আমাদের অনেক ছেলেকে গুলি করে মারা হয়েছে। এখন তাদেরকে ঘরে থাকতে দিচ্ছে না, আমরা ইয়াং ছেলেদের পড়াশুনা করতে পাঠাতে পারছি না, খেলতে পাঠাতে পারছি না। এভাবে তো চলতে পারে না,” বলছিলেন মিজ জয়া।

আরেকজন অভিভাবক মঞ্জুরুল আলম বলছিলেন, “আমাদের আরো আগেই রাস্তায় দাঁড়ানো উচিত ছিল। কিন্তু আমরা পারিনি।”

প্রতিবাদে যোগ দিয়েছিলেন নাদিরুজ্জামান ও হুসনা জাহান শিউলি দম্পতি। তারা নেদারল্যান্ডসের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। সম্প্রতি ঢাকায় এসেছেন ছুটিতে।

নাদিরুজ্জমান বিবিসি বাংলাকে বলেন, “যে মানুষগুলোকে মারা হয়েছে, তাদের মারার পর এখন ব্র্যান্ডিং করা হচ্ছে– জামাত শিবির বলে। অন্যায়ের প্রলেপ দেবার জন্য সেটার ওপরে আরো অন্যায় করা হচ্ছে।”

অভিভাবকরা কিছুক্ষণ ফুটপাতে দাঁড়ানোর পর পুলিশ এসে তাদের সেখান থেকে সরে যেতে বলে। এ নিয়ে সেখানকার দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তার সাথে অভিভাবকদের বচসাও হয়।

রাজধানীর বনানীতে অভিভাবকদের প্রতিবাদ
রাজধানীর বনানীতে অভিভাবকদের প্রতিবাদ




Spread the love

Leave a Reply